#গল্প নীলকন্ঠ
‘ভাবী, আপনি মাশাল্লাহ দেখতে কত সুন্দর! ভাইয়াও তো কত ফর্সা! আপনাদের বংশে কি কালো কেউ আছে?’
অন্তরা ভাবীর এই কথায় হঠাৎ ধাক্কা খেলো অহনা। জিজ্ঞেস করলো,
‘ না তো, কেনো ভাবী?’
শুকনো মুখে অন্তরা ভাবী বললেন,
-‘না, হঠাৎ মনে হলো ভাবী। আপনাদের মেয়ে হয়েও অপরাজিতা এত কালো হলো কেনো! বংশে নাই তাহলে তো এত কালো হওয়ার কথা না! তাহলে ওকে পেটে নিয়ে বোধহয় কোনো কালো মানুষের চেহারা দেখেছিলেন আপনি!’
অহনা অন্তরা ভাবীকে থামিয়ে দিলো। বললো,
-‘ভাবী, আমি তো এভাবে কখনও ভাবিনি। তাই কিছু বলতে পারছি না’।
বলে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো। সাথে সাথে অন্তরা ভাবীও বলে উঠলেন,
-‘ভাবী আপনি কি রাগ করলেন?’
বলেই অন্য আরেকজন ভাবীকে চোখ ইশারা করলেন। সেটা অহনার চোখ এড়ালো না।
এসময় অপরাজিতার স্কুল ছুটি হয়ে যাওয়াতে দূর থেকে ওকে আসতে দেখলো অহনা। সাদা ধবধবে স্কুল ড্রেস পরা অপরাজিতা পিঠে ব্যাগ নিয়ে, মুক্তার মত সাদা দাঁতে হাসতে হাসতে ছুটে আসছে। অহনার আজকে নিজের মেয়েকে দেখে চোখ ভরে জল এলো যেনো।
অপরাজিতার যখন জন্ম হলো, তখন অহনা খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলো। কত কষ্ট করে তিলতিল করে এই ছোট্ট মেয়েটাকে মানুষ করেছে অহনা। সন্তান, সে তো সন্তানই। সে ছেলে না মেয়ে, কালো না ফর্সা সেসব বিষয় নিয়ে ভাববার কোনো অবকাশই নেই।
অপরাজিতা জন্মাবার পর প্রথম অহনার কাকী শাশুড়ি এসে বললেন,
– ‘এ হে! মেয়ে কার রঙ পেয়েছে অহনা! এত কালো হয়েছে কেনো?’
অহনার শাশুড়িমা জবাব দিয়েছিলেন,
-‘ অহনার মেয়ে সুস্থ হয়েছে, স্বাভাবিক হয়েছে। দোয়া করো যেনো সুস্থ থাকে। অত কালো, ফর্সা দিয়ে কী করবা শুনি?’
অহনার কাকী শাশুড়ি এই কথা শুনে চুপ করে থাকেন।
গত ডিসেম্বরে অহনার এক খালাতো ননদের বিয়ের গায়ে হলুদে সব মেয়েরা এক রঙের শাড়ি পরেছিলো। আর বাচ্চাদের জন্য গাঢ় নীল আর মেজেন্টা রঙের লেহেঙ্গা বানিয়ে দেয়া হয়েছিলো। কিন্তু অপরাজিতার জন্য দেয়া হয়েছিলো একটা হাল্কা গোলাপী ফ্রক। সেই ফ্রক নিয়ে খালা অহনাদের বাসায় এসে বললেন,
-‘ অহনা, তোমার মেয়েকে অত গাঢ় রঙ পরলে ফুটবে না, বুঝলে। ছবি ভাল আসবে না। গায়ের রঙটা ময়লা তো! তাই অপরাজিতার জন্য হাল্কা রঙের ফ্রক আনলাম। দেখেতো পছন্দ হয় কি না!’
রাগে-দুঃখে সেই গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানেই যায়নি অহনা। শাশুড়িমা, স্বামী রাকেশের অনুরোধেও সে অনুষ্ঠানে যায়নি। পরে অনেক কথা হবে ভেবে, শাশুড়ির অত অনুরোধ ফেলতে না পেরে বিয়েতে গিয়ে অল্প কিছুক্ষণ থেকে চলে এসেছিলো।
অপরাজিতা ছোট বেলায় এসব কিছু বুঝতো না। কিন্তু বড় হওয়ার সাথে সাথে ও কিছুটা বুঝতে শিখলো, এই সমাজে কালো মেয়ে আর ফর্সা মেয়েকে আলাদা করে দেখা হয়। সব রঙের পোশাক সবার জন্য আনা হয় না। আর অনেকেই নানাভাবে ছোট করার চেষ্টা করতে থাকে।
মাঝে মাঝে ছবি আঁকার ফাঁকে মুখ তুলে ও অহনাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,
-‘ মা, বলো না, তোমার প্রিয় রঙ কী?’
অহনা বলে,
-‘সব রঙই আমার প্রিয়। কেনো মা?’
অপরাজিতা বলে,
-‘ তাহলে অন্য সবাই যে আমি কালো বলে মন খারাপ করে! কালো কি মা খুব খারাপ রঙ?’
অপরাজিতার এমন কথায় চমকে উঠে অহনা বলে,
-‘না মা, কালো সবচেয়ে সুন্দর রঙ। দেখো না, রাত কালো। রাতে কত সুন্দর চাঁদ উঠে, ঝিকমিক করে তারা উঠে আকাশে, লক্ষ লক্ষ তারা, জোনাকি জ্বলে, রাতে সবাই শান্তিতে ঘুমিয়ে থাকে। রাত কালো না হলে কি আমরা এত তারা, চাঁদ, জোনাকি কিছু দেখতে পেতাম? তুমিই বলো!’
তখন অহনার মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠে। আর সে মনের আনন্দে ছবি আঁকতে থাকে। অহনা জানে, কালো-সাদার জটিল সমীকরণ গুলো অপরাজিতা কিছু কিছু বুঝতে শিখছে। স্কুলে কিছু কিছু অভিভাবক, কিছু শিক্ষকও অহনাকে নিয়ে ফিসফিস করে।
সবার এক প্রশ্ন, বাবা-মা ফর্সা, মেয়ে এত কালো কেনো! যেনো জগত-সংসারের সকল লেনাদেনা এই কালো আর ফর্সাতে আটকে আছে!
একদিন স্কুলে থেকে ফিরে অপরাজিতা খাবার টেবিলে বসে অহনাকে বললো,
-‘মা, তুমি কি আমাকে ড্রেনের পাশে কুড়িয়ে পেয়েছো?’
ছোট্ট অপরাজিতার মুখে এই কথা শুনে অহনা আর রাকেশ দু’জনই আঁতকে উঠে। ঘাবড়ে গিয়ে রাকেশ বলে,
-‘কে বলেছে তোমাকে এসব মা?’
অপরাজিতা ভীরু ভীরু মুখে জানায়,
-‘ আমাদের ক্লাসের তাসফিয়া আমাকে বলছিলো আজকে। তোর মা এত ফর্সা তাহলে তুই এত কালো কেনো। আমার আম্মু বলেছে, নিশ্চয়ই তোকে কুড়িয়ে এনেছে ড্রেনের পাশ থেকে!’
অহনা আর রাকেশ দু’জনেই বিস্মিত হয়ে একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে থাকে। কত জটিল মারপ্যাচ আর হিসেব-কিতাব মানুষের মনে। ওরা দু’জনই অবাক হয় অভিভাবকদের এমন মানসিকতা দেখে আর ওদের ছোট্ট বাচ্চাগুলোর মনে এমন নেতিবাচকতার চর্চা ঢুকিয়ে দেওয়ার জন্য।
একবার ওরা দু’জন ভাবে, এই স্কুল থেকে ছাড়িয়ে অন্য স্কুলে ভর্তি করবে অপরাজিতাকে। কিন্তু পরে অনেক ভেবে মত পাল্টায় অহনা। সব জায়গায় কেউ না কেউ এরকম নানা কিছু বলে মানুষের মনে আঘাত দেওয়ার জন্য তৈরি হয়েই থাকে। তাই এইসব সংশয়, জটিলতা নিয়েই মেয়েকে বড় করতে হবে এটা বুঝতে পেরেছে অহনা। সেজন্য নিজেকে আর মেয়েকে এসব প্রতিকূলতা জয় করার জন্য মানসিকভাবে তৈরি হতে থাকে।
এই তো সেদিন, পহেলা বৈশাখে স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অপরাজিতা নাচ করবে বলে নাম লিখিয়ে এলো । রিহার্সেলও চলছিলো প্রতিদিন। একদিন অহনা রিহার্সেলে যেতেই একজন অভিভাবক জানালেন, অপরাজিতাকে দলীয় নৃত্যে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হবে না। অবাক হয়ে ও জিজ্ঞেস করাতে জানতে পারলো, দলীয় নৃত্যে ‘আমাদের দেশটা স্বপ্নপুরী, সাথী মোদের ফুলপরী’ গানের সাথে বাচ্চারা অংশ নেবে। অনেক অভিভাবক অভিযোগ করেছেন,এই গানে অপরাজিতাকে মানাবে না। পারফরম্যান্সটাই নষ্ট হবে।
অপরাজিতার ক্লাসমেট প্রীতির মা শরমিন ভাবী অহনাকে বললেন,
-‘ভাবী, একটু ফর্সা সুন্দর মেয়েদের পরী সাজলে মানায়। অপরাজিতার যা গায়ের রঙ ওকে পরী সাজলে মানাবে, আপনিই বলুন? মানাবে না। আমার মেয়ে প্রীতিকে পরী সাজাবো।’
সেদিন অহনা বলেছিলো,
-‘ গায়ের রঙ টাই কি সব ভাবী? আমার মেয়ের মেধার কোনো দাম নেই?’
শরমিন ভাবী উত্তর দিলেন,
-‘নিজেকে প্রেজেন্ট করার জন্য গায়ের রঙ সুন্দর না হলে চলে না ভাবী। সবাই যখন কাউকে দেখবে কালো হলে কেউ দেখতে চাইবে? আগে দর্শনধারী পরে তো গুণবিচারী। মেধা দিয়ে কী করবেন ভাবী?’
সেদিন প্রচন্ড মন খারাপ নিয়ে বাড়ি ফিরে এসেছিলো অহনা। বাড়ি ফিরে অপরাজিতা বারবার জিজ্ঞেস করেছিলো,
-‘ মা, আমাকে নাচ থেকে বাদ দিয়ে দিলো কেন? আমি তো নাচ করতে পারি। আমি দেখাবো তোমাকে?’
অহনা সেদিন অপরাজিতাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছিলো। আর খুব জেদ চেপেছিলো ওর মনে।
এই ঘটনার অনেক অনেক বছর পরের কথা। এখন একটি ইউরোপীয় নিউজ চ্যানেলের ডাকসাইটে রিপোর্টার অপরাজিতা। দেশে পড়াশোনার পাট চুকিয়ে মিডিয়া স্টাডিজে ইউরোপের ডিগ্রি এখন অপরাজিতার ঝুলিতে। ইউরোপীয় সংবাদ মাধ্যমে দেদারসে সাংবাদিকতা করছে অপরাজিতা।
মাঝে মাঝে সেই চ্যানেলে অপরাজিতাকে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ইভেন্ট কাভার করতে দেখা যায়। কখনো রাশিয়া, কখনো চীন, কখনো আমেরিকা, কখনও অস্ট্রেলিয়ায় সংবাদ কাভার করতে ঘুরছে অপরাজিতা। অহনা আর রাকেশ টিভি চালিয়ে সেই ইউরোপীয় চ্যানেলে নিজের মেয়েকে দেখে। সাথে সাথে আত্মতৃপ্তি আর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। অহনার সেই জেদ আজ অপরাজিতাকে এত উঁচুতে তুলে দিতে পেরেছে। অপরাজিতার মেধা আর অহনার পরিশ্রমে অপরাজিতা আজ এতটা সম্মানিত একটি অবস্থানে পৌঁছাতে পেরেছে।
আজই একটি সুপারশপে বাজার করতে গিয়ে অপরাজিতার স্কুলের ক্লাসমেট প্রীতির মা শরমিন ভাবীর সাথে অনেকদিন পর দেখা অহনার। অহনাকে দেখে ছুটে এলেন তিনি। নানা কথায় ঘুরেফিরে প্রীতির কথা বলছিলেন ভাবী,
-‘ জানেন তো ভাবী, প্রীতির অনেক বড়লোকের সাথে বিয়ে হয়েছে। কলেজে পড়তে পড়তেই বিয়ে হয়ে গেলো। বিশাল গার্মেন্টস আছে জামাইয়ের। পাত্রপক্ষ এক দেখায় পছন্দ করে ফেলেছে আমার মেয়েকে। পছন্দ করবেই বা না কেনো! ফর্সা গায়ের রঙ আমার মেয়ের। আমরাও আপত্তি করলাম না। পড়াশোনা করে কী হবে বলেন! তো, অপরাজিতার কী খবর?মেয়েকে বিয়েশাদী দিতে পেরেছিলেন?’
অহনা বললো,
-‘না ভাবী। বিয়ে দিতে পারিনি। অপরাজিতা এখনই বিয়ে করতে চায়নি।’
শরমিন ভাবী বলে উঠলেন,
-‘ ঠিক, যা ভেবেছিলাম তাই! এই মেয়ে বিয়ে দেওয়া এত সোজা না ভাবী। একটু বেশি যৌতুক দিলে হয়তো কাউকে না কাউকে পেয়ে যাবেন। অপরাজিতা কী করছে এখন? চাকরি-বাকরি খুঁজতে বলেন। কতদিন বাবার সংসাতে পড়ে থাকবে?’
অহনা এবার স্পষ্ট গলায় জবাব দিলো,
-‘অপরাজিতাকে ইউরোপে পড়তে পাঠিয়েছিলাম ভাবী। সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একাধিক ডিগ্রি নিয়েছে। এখন ইউরোপীয় একটি চ্যানেলের রিপোর্টার ও। সব সময়ই বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়ায় চ্যানেলের নিউজ কাভার করতে। আমরা টিভিতেই ওকে দেখি বেশিরভাগ সময়। সেদিনই দেখলাম ও আমেরিকার নির্বাচন কাভার করছে। মাঝে মাঝে নিউজ প্রেজেন্টিং ও করে।’
শরমিন ভাবী চোখ বড় আর মুখ হা করে তাকিয়ে রইলো অহনার দিকে।
সোমা দেব