লাঞ্চ ব্রেকের পর অফিসে বসে কাজ করছিলাম। হঠাৎ বউ কল দিয়ে সেকি কান্না! তাকে নাকি এক্ষুনি তার বাবার বাড়ি দিয়ে আসতে হবে। কারন, আমার আম্মু আজকেও তাকে সকালে ঘুম থেকে ওঠা নিয়ে কথা শুনিয়েছে। তার কথা হচ্ছে, সে যদি দেরি করেই ওঠে তাহলে সকালে সকলের খাবার গুলো কে রেডি করে দেয়! আমার অফিসে আসার জন্য রেডি হবার সব কিছু কে গুছিয়ে রাখে? এত করেও শ্বাশুড়ির কাছে যদি শুনতে হয়,”এত সকাল পর্যন্ত স্বামীর গলা ধরে ঘুমিয়ে থাকলে ঘরের কাজগুলো করবে কে!” তাহলে আর থেকে কি লাভ! এর থেকে তাকে যেন আমি তার বাবার বাড়ি দিয়ে আসি।
যাইহোক একনাগাড়ে সব অভিযোগগুলো শুনলাম তার। সব শুনে বললাম, আমি এসে আম্মুর সাথে কথা বলতেছি। এই বলে তখনকার মত রেখে দিলাম ফোনটা।
বাসার ঠিক দরজার সামনে এসে, একবার মোবাইলের স্ক্রীনে নিজের চেহারাটা দেখে নিলাম। একদম চোখ মুখ কুচকে ভীষণ রাগী রাগী একটা ভাব ফুটিয়ে রেখেছি মুখে। দরজায় নক করার পর, বউ দরজাটা খুলতেই, রুমে ঢুকে অফিসের ব্যাগটা খাটের উপর ছুড়ে ফেলে, ঝাঁঝালো গলায় বউকে বললাম, “আজকে আবার আমার চার্জার দাও নি তুমি! জানো না অফিসে মোবাইল কত ইম্পর্ট্যান্ট! একদিন ঘড়ি দাও না একদিন চার্জার দাও না! সকালবেলা মাথা কোথায় থাকে তোমার?”
আমার চিল্লাপাল্লা শুনে আম্মু বেশ উৎসুক নয়নে হাস্যোজ্জ্বল মুখে এগিয়ে আমার পিছে এসে বলল, “বাবা এসেছিস বাসায়, কথা আছে তোর সাথে শুনে যা”। সাথে সাথে ঘুরে আম্মুর দিকে তাকিয়ে বললাম, “কি কথা বলবা তুমি তা তো জানি আমি! হয় আমার বদনাম, নয়তো অন্য কারো ছেলে মেয়ের এভারেস্ট বিজয়ের কাহিনী শোনাবা, এই তো! ওসব শোনার কোন ইচ্ছা আমার নেই। তার আগে আমাকে তুমি বল যে, আমি কবে অফিসে জয়েন করেছি, আমার বেতন কত, আমার শেষ ইনক্রিমেন্ট কবে হয়েছে, আমার বেতন কার কার ছেলের থেকে কত কম, এসব খবর নিচের দোকানের জহির আঙ্কেল কে কেন বলেছ? বয়স তো কম হল না, এখনো বাইরের লোকের কাছে নিজের বাচ্চাদের বদনাম করতে একবার বুকে আটকায় না তোমার! এখন আবার কার কার নামে কি কি বলতে আসছো আমার কাছে! তোমার অবজেকসন তো সবাইকে নিয়ে।” একনাগাড়ে কথাগুলো বলে, ঘোৎ ঘোৎ শব্দ করতে করতে বাথরুমে গিয়ে ঢুকলাম।
বাথরুমে ঢুকে দরজাটা লাগিয়ে চুপ করে বাইরের অবস্থা বোঝার চেষ্টা করছিলাম। প্রায় স্পষ্টই শুনলাম, আম্মু কাঁদো কাঁদো গলায় আমার বউকে বলছে, “দেখলে তো ছেলেটা কেমন করল আমার সাথে! মায়ের সাথে এমন কেউ করে! আমি কি মানুষের কাছে আমার ছেলের বদনাম করতে পারি! কথায় কথায় নাহয় দু কথা বলেই ফেলেছি প্রতিবেশীর কাছে। তাই বলে আমাকে এতো গুলো কথা শোনাতে পারলো ও!” ঠিক তারপরেই শুনলাম, আমার বউ আবার আম্মুকে বোঝাচ্ছে, “থাক মা কষ্ট পাইয়েন না। আপনার ছেলের কথা কি আর বলব, দেখলেনই তো আমার সাথেও কেমন করলো! এতো করি মানুষটার জন্য, আর দিন শেষে এই জোটে আমার কপালে!” তারপর আবার আমার আম্মু বলল,”থাক মা মন খারাপ করো না, আসলে তোমার আর আমার নসিব টাই মনে হয় একরকম। আসো, আমার সাথে আসো। বদরাগীটা বের হবার আগে টেবিলে খাবার গুলো রেডি করি দুজন।” মায়ের কথা শেষ হতে না হতেই আমার স্ত্রী বলে উঠলো, “মা কি যে বলেন, আমি থাকতে আপনি কেন খাবার জোগাড় করবেন! আপনি বসুন আমি খাবার টেবিলে দিয়ে আপনাদের ডাকছি।”
দুজনের সব কথা শুনে মুচকি একটা হাসি দিলাম বাথরুমের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে। দুই প্রতিপক্ষের মধ্যকার সম্পর্কটা বাড়ানোর জন্য মাঝে মাঝে একটা কমন শত্রুর দরকার হয়। আর বউ শাশুড়ি সম্পর্ক তখনই সবথেকে ভালো থাকে যখন সেই কমন শত্রুর জায়গায় স্বামী নিজেই গিয়ে দাঁড়ায়।
টেবিলে এসে খেতে বসে প্লেটে ভাত নিতে নিতে বউকে উদ্দেশ্য করে বললাম, “প্রতিদিন যে এরকম জিনিস দিতে মিস করো সকাল বেলা ওঠো কয়টায় তুমি হ্যা? সাথে সাথে পাশ থেকে এবার আম্মু কঠিন গলায় বলে উঠলো,”যে কয়টায় ঘুম থেকে উঠলে ঘরের সবার সব কাজ রেডি করে, সবার জন্য খাবার রেডি করে, তোমার অফিসে জিনিসপত্র গুছিয়ে দেওয়া যায়, ঠিক সেই কয়টায় উঠে আমার এই মেয়েটা। সারাদিন কাজ করে বাসায় এসেছো তাই এতক্ষন কিছু বলিনি। আমাকে যা বলার বলেছিস কিন্তু আমার এই লক্ষী মেয়েটাকে যদি আর একটা কথাও বলতে শুনি, আমার থেকে খারাপ তোর জন্য কেউ হবে না। চুপচাপ ভাত খেয়ে রুমে যাও সোজা।” আম্মুর কথাগুলো শোনার পর হালকা মাথাটা জাগিয়ে আম্মুর পেছনে দাঁড়ানো আমার স্ত্রীর চোখের দিকে তাকালাম। অশ্রুর একটা বিশাল ফোটা চকচক করছিল তার চোখের কোনায়। তবে এই অশ্রু কষ্টের নয়, এই অশ্রুর ছিল সুখের অশ্রু। নতুন করে এক মা কে পাওয়ার আনন্দের অশ্রু। আমি রুমে এসে অফিসের ব্যাগের ডান পকেট থেকে চার্জারটা বের করে মোবাইলটা চার্জে লাগিয়ে দিলাম। তারপর বালিশে মাথাটা রেখে পরম তৃপ্তিতে বন্ধ করলাম চোখ দুটো।
একটু পর বউ রুমে ঢুকতেই জিজ্ঞেস করলাম, “তা কবে যাবা বাবার বাড়ি ঠিক করেছো? ব্যাগ কি গোছানো হয়েছে?” আমার কথা শুনে বউ বলল, “কিসের ব্যাগ! তোমার কোথাও যেতে ইচ্ছে হলে যাও, আমি আমার মাকে রেখে কোত্থাও যাচ্ছি না।”
কমন শত্রু
: Arif Islam
kobitor কবিতর