৩১.
হাসপাতালের করিডোরে দাঁড়িয়ে আছে মলি ফাহাদ রুমকি ও তার হাজবেন্ড পলাশ। মলি নিশ্চুপ কিন্তু চোখে মুখে আতংকের ছাপ। চোখ বেয়ে অনড় গল নোনা পানি বেয়ে পড়ছে। আপতত তাকে কেউ স্বান্তনা ও দিচ্ছে না। ভিতরে কি অবস্থা রোগীর তা এখনো কেউ জানে না।
সেদিন রাতে একটু তাড়াতাড়িই মলি বাচ্চাদের নিয়ে ঘুমিয়ে পরে। আসলে ঘুম তো ভালো হচ্ছিলোই না বার বার কেমন যেনো অস্থির লাগছিলো। শেষ পর্যন্ত ঘুমাতে ঘুমাতে রাত ১২ টা বেজে যায়। রাত বারোটা কিংবা সাড়ে বারোটা নাগাদ মলির নং এ কল আসে। বেশ কয়েকবার রিং বাজলেও মলি রিসিভ করতে পারেনি ঘুমের রেশ কাটছিলো না বলে। যখন কল রিসিভ করলো তখই টের পেলো সে জীবনের এক নতুন অধ্যায়ে পদার্পন করেছে।
ঘুম জড়ানো কণ্ঠে আতংক নিয়ে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে জানানো হলো আবিদ এক্সিডেন্ট করেছে। তারপর বাচ্চাদুইটাকে ময়নার কাছে রেখে ড্রাইভার কে নিয়ে হস্পিটালের পথে রউনা হলো মলি। পথিমধ্যে ফাহাদের কথা মনে পড়লো তার, বিপদে সবচেয়ে ভরসা করা যায় এমন বন্ধু কিংবা শুভাকাঙ্ক্ষী সে। এত রাতে মলির কল পেয়ে ফাহাদ ও ভরকে যায়। হ্যালো বলার পরিবর্তে বলে উঠে,
মলি, এত রাতে? কোনো সমস্যা? কান্নার দমকে মলি কথায় বলতে পারছিলো না। প্রচন্ড ভয়ে মলির গলা থেকে কোনো আওয়াজ বের হচ্ছিলো না। বুকের মধ্যে মনে হচ্ছিলো কেউ শক্ত কোনো ইট বা পাথর দিয়ে চেপে ধরেছে। তাই কান্না করে ওপাশ থেকে মলি কি বলছিলো তা ফাহাদ বুঝতেও পারছিলো না। চিন্তিত হয়ে ফাহাদ বলল,
তোমার সাথে কেউ থাকলে তাকে দাও। প্লিজ, আর শান্ত হউ। কিচ্ছু হবে না। আমি আসছি এখুনি। তারপর মলি ড্রাইভার কে ফোন টা ধরিয়ে দিলে ফাহাদ জানতে পারে আবিদের এক্সিডেন্ট হয়েছে। ফাহাদ হস্পিটালের ঠিকানা নিয়ে সেখানেই একেবারে চলে যাবে বলে ঠিক করলো।
হাসপাতালে তারা যখন পৌছালো ততক্ষণে আবিদ কে ওটি তে নিয়ে গিয়েছে। মলি ততক্ষণে শান্ত কিংবা বলতে পারেন একদম স্তব্ধ হয়ে গেলো। জলজ্যান্ত মানুষ টা হাসপাতালে শোয়া ভাবতেই গায়ে কাটা দিচ্ছিলো। আবিদের ডায়াল নং সোহেল সাহেবের নং ছিল বলে তার সাথেই আগে কন্টাক্ট করা হয়েছিল। আপাতত ফ্যামিলি মেম্বার হিসেবে উনার কথা মতোই ট্রিটমেন্ট শুরু করেছে ডাক্তার। প্রায় ৩ ঘন্টা পর মলি ফাহাদ আর সোহেল সাহেব কথা বলার সুযোগ পেয়েছে ডাক্তারের সাথে। ছোট এক টা কন্সাল্টেন্ট রুম। ডাক্তার বসে আছে তার টেবিলেই একটা কম্পিউটার রাখা।
মলি ফাহাদ আর সোহেল সাহেব ঢুকার সাথে সাথেই ডাক্তার তাদের বসার ইশারা করে জিজ্ঞেস করলেন মলিকে, আপনি কি হন উনার?
মলির আতংকগ্রস্ত কণ্ঠে বলে উঠলো, আমি উনার ওয়াইফ। কি অবস্থা উনার? উনি বাঁচবেন তো।
ডাক্তার মুখে কিছু না বলে একটা এক্স রে বের করলো, তারপর বুঝানো শুরু করলো, এই যে দেখুন, উনার কন্ডিশন, এই যে উনার বাপ পায়ের ফিমার, মাঝ বরাবর ভেংগে গিয়েছে। আর মাথায় তীব্র আঘাত পাবার ফলে প্রচুর ব্লিডিং হয়েছে। অলরেডি দুইব্যাগ ব্লাড দেয়া হয়েছে। মাথার আঘাত টা রিকভারি হতে অনেক বেশি সময় লাগবে। আমরা অলরেডি একজন নিউরোসার্জন কে ও এসাইন করেছি। মেইন সমস্যা অন্য জায়গায়।
ফাহাদ স্থিমিত কণ্ঠে বলল, জি বলুন। কি সমস্যা? মলির অবস্থা ততক্ষণে শোচনীয়। চোখ দিয়ে অনড়গল জল পরছে। মুখে কান্নার কোনো শব্দ করতে না পেরে গলায় দলা পাকিয়ে আসছে সব। তাই গলাটাও ব্যথা শুরু হয়েছে। সেদিকে পাত্তা না দিয়ে সেও বলল, আপনি বলুন ডাক্তার আর কি কি সমস্যা।
ডাক্তার এবার একটা ব্লাড রিপোর্ট দেখিয়ে বলল, উনি হার্ট এটাক করেছেন। এই যে দেখুন উনার ট্রোপোনিন আই এর মাত্রা প্রায় ২০ গুন বেশি। গাড়ি অনিয়ন্ত্রিতভাবে চালানো তে এক্সিডেন্ট করেছেন ঠিক ই।। কিন্তু কোনো কারণে হাইপার টেনশনে ছিলেন তাই একটা এটাক ও হয়েছে। আপাতত উনি অবসারভেশন আছেন।দুইদিনের মাঝে ইম্প্রুভ হলে আমরা ফারদার ট্রিটমেন্টএর কথা ভাববো।
মলি ঢুকরে কেঁদে উঠলো। ডাক্তার আর কিছু বলার সুযোগ দিলো না। মলির এমন অবস্থায় সোহেল সাহেব কিছু বলার সাহস পেলেন না। উনি ঠিক ই আন্দাজ করতে পেরেছেন উনার স্যার ঠিক কি কারণে এই দুর্ঘটনার সম্মুখীন হয়েছেন কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে মুখ খুলতে চান না। যাবার আগে শুধু বলে গেলেন,
ম্যাডাম আল্লাহ কে ডাকুন। আমি এসে এসে খোঁজ নিয়ে যাবো। আর অফিস সামলানোর জন্য আমি আছি। আপনি শুধু স্যারের পাশে থাকুন।
এই কয়টা দিন কি যে অমানবিক কষ্টে গিয়েছে মলির তা যারা ওকে কাছ থেকে দেখেছেন তারাই বুঝতে পেরেছেন। বাচ্চা দুইটা কে বাসায় রেখে সারাক্ষণ হাসপাতালে পরে থেকেছে। বেলা বেলা এসে রুমকি আর পলাশ খোঁজ নিয়েছে। ফাহাদ পাশ থেকে সরেই নি। এমন অবস্থা তে আসেনি কেবল মলির ভাই আর মা। ওদের কাছে যেন মলি মৃত।
৩২.
রুমকির বাসার টেরেসে ছোট খাট পার্টির আয়োজন করা হয়েছে। ঝলমলে তারার আলো ছাড়াও বিশাল এই ছাদ টাই যেন তারার মেলা হয়ে উঠেছে। মূলত আজ রুমকির অফিসে প্রোমোশন হয়েছে বলে পলাশ কাছের কিছু মানুষ কে নিয়ে পার্টির আয়োজন করেছে। সেখানে রুমকির কয়েকজন কলিগ ছাড়াও ফাহাদ ও মলি এসেছে।
গত এক দেড় মাসে টানা হাড় ভাংগা পরিশ্রমে মলি আরো শুকিয়ে গেছে। ব্ল্যাক হোয়াইট স্ট্রাইপ একটা জরজেট শাড়ি পরেছে আজ কে। তাকে দেখে রুমকি এগিয়ে এসে বলল,
এসেছো তাহলে, যা ব্যস্ত হয়েছো আজকাল।
মলিন হেসে মলি বলল, তা তো কিছুটা হয়েছি বটে। অফিস, বাচ্চাদের সামলে হিমসিম খাচ্ছি। আর আবিদ তো আছেই।
কি অবস্থা আবিদ ভাই এর? রুমকি কোকের গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে বলল।
কয়েকদিন যাবত ময়না অথবা আমি হুইলচেয়ার করেই বাইরে নিয়ে যাই। পা এর প্লাস্টার খুলতে খুলতে আরো এক মাস। কিন্তু সারারাত ঘুমায় না। জিজ্ঞেস করলে কি খারাপ লাগছে শুধু ঘন ঘন নি:শ্বাস ফেলে।
রুমকি দায়সারা ভাবে বলে, দেখো আমি চাইনা তোমার বাচ্চারা বাবার আদর না পাক, কিন্তু আল্লাহ পাক এর বিচার অনেক কঠিন। উনার শিক্ষা হউয়া দরকার ছিলো।
মলি কষ্ট নিয়ে বলে, প্লিজ এভাবে বলো না। আমি তো ওকে ভালোবেসেছিলাম। সে আসলেই কষ্ট পাচ্ছে। আজকাল তো কথা ও কম বলে। তবে রুমকি সত্যি বলি, আমার মনে হয় এখন আমার কেয়ার নেয়াটা ভালোবাসার পর্যায়ে পরে না বোধহয়। শুধু দায়িত্ব বোধ বলতে পারো।
রুমকি মাথা দুইদিকে হেলিয়ে দুলিয়ে বলে, তোমার বুকে অভিমানের পাহাড় জমেছে ডিয়ার। তাই এই কথা বলছো। অভিমান পরে গেলে তখন ভালোবাসাই দেখা যাবে।
মলি ম্লান হাসলো, তোমরা পাশে আছো বলেই আমি এখন কত কিছু করতে পারছি। ওর অফিস সামলানো খুব ই টাফ। সোহেল সাহেবের মতোন অনেস্ট লোক আছে বলে আমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারি।
ফাহাদ গিটারে ঠিক তখন ই টুং টাং শব্দ তুললো, রুমকি কথা না বাড়িয়ে মলিকে নিয়ে সেদিকেই এগিয়ে গেলো। ততক্ষণে গান গাওয়া শুরু করেছে সে,
“ভিজছে কাক,
আয়না থাক,
দেখুক তোমায় ফুলের দল।
পথের বাক,
আনতে যাক,
বৃষ্টি ধোয়া কলসি জল।
শহর তলি জুরে, গলির মোড়ে মোড়ে
তোমায় নিয়ে গল্প হোক।
জানি তোমার ছন্দে অন্তমিল তোমার উর্ধগামী
বালিশ ছেড়া স্বপ্ন ধোয়া উড়ছে উড়ুক। “
ফাহাদ বরাবর ই অনেক ভালো গান করে। গান গাওয়ার অভ্যাস একসময় মলির ও ছিলো। এখন ও মেয়ের সাথে সাথে গেয়ে উঠে। কিন্তু আগের মতোন কিছু কি আর হয়। ফাহাদ গান শেষ করলেই রুমকি মলি কে জোর শুরু করলো গান গাওয়ার জন্য। সাথে ফাহাদ আর পলাস ও জোর শুরু করলো। কিন্তু লজ্জায় জড়তায় মলি আড়ষ্ট হয়ে রইলো। তখন রুমকি অভিমানী গলায় বলছে প্লিজ এক্টু গাও না। আমার পার্টিতে তুমি গান গাইলে এর চেয়ে সুন্দর সময় আর কিছু কি পাবো বলো। মলি অপারগ হয়ে চেয়ে থাকে কিচ্ছুক্ষণ। তারপর শর্ত জুরে দেয়, আমি জায়গায় দাড়িঁয়েই গান গাইবো। রুমকি ইয়ে বলে বাচ্চাদের মতোন চিতকার করে। তখন মলি জায়গায় দাড়িঁয়েই গাওয়া শুরু করল,
” লাগ যা গালে কি ফির এ
হাসিন রাত হো না হো
শায়েদ কে ফিরছে জনম পে
মোলাকাত হো না হো।
লাগ যা গালে এ্য এ্য “
এত এত ছুঁয়ে যাচ্ছিলো এই গান এই সুর সবাইকে সবাই মোহে আবিষ্ট হয়ে শুধু মলির দিকেই তাকিয়ে ছিলো। গান শেষে সবাই অনেক বেশি প্রশংসা করে ওকে সুখের সাগরে ভাসাচ্ছিলো। আজকের দিন টা সত্যি ভালো কেটেছে।
********
আবিদের দিন কাটে বিছানায়। গত এক টা মাস বিছানায় কাটিয়ে এখন একটু আকটু হুইলচেয়ারে বসে এখানে সেখানে যায়। বেশির ভাগ সময় বারান্দায় কাটে। শুরুর দিকে মাথার তীব্র যন্ত্রনা ছিলো এখন সেটা অনেকটাই কমকিন্তু পায়ের ব্যথা টা এখনো আছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো রাতে বুক ধরফর করে অনেক। ঘুমাতে পারে না শ্বাসকষ্ট হয় খুব। ডাক্তারের কাছে সামনের রবিবার এপোয়েন্টমেন্ট দেয়া হয়েছে।
এক বিকালে ফেসবুকে আবিদ স্ক্রল করে যাচ্ছিলো কাছের দূরের অনেকেই খোজ নেয় তার। কিন্তু কারো মেসেজ বা ফোন কলের আন্সার দিতে ইচ্ছা হয় না তার। আজকাল তার মেজাজএর অসাভাবিক পরিবর্তন ঘটেছে। নিজের অসুস্থতার জন্য পরনির্ভরশীল হয়ে পরেছে পুরোপুরি। রাত ছাড়া মলির দেখাও পাওয়া যায় না ইদানীং। ব্যাবসা টা আপাতত সেই হাল ধরেছে। সাথে সংসারের হাল তো বটেই।
ফেসবুক স্ক্রল করতে করতে দেখলো মলিকে ট্যাগ করে তার কিছু ফ্রেন্ড পোস্ট করেছে। প্রশংসাতে উচ্ছ্বসিত সবাই। মলি গান গাইছে, রুমকি পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। সাথে আছে ফাহাদ লোক টাও। অসাধারণ গাইছে গান টা। কিন্তু এই যে মলিকে সবাই এত এত প্রশংসায় ভাসাচ্ছে, ফাহাদ লোক টা দাঁত কেলিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে এই সব দেখে আবিদের জাস্ট অসহ্য লাগছিলো। চারপাশ টা বিদঘুটে লাগলো। মনে হচ্ছিলো এই পৃথিবী তে মলির সব আছে বন্ধু বান্ধব, টাকা পয়সা কিংবা বিশ্বাস করার মতোন ভরসা করার মতোন কাছের মানুষ কিন্তু আবিদের কিচ্ছু নেই, আবিদ বড়ো একলা অসহায়।
চলবে……..