৩৩.
আবিদের অফিসে একটা মিটিং ছিলো। মলি চাচ্ছিলো না মিটিং সে এটেন্ড করুক। কিন্তু সোহেল সাহেবের কথায় রাজি হলো। সোহেল সাহেবের ভাষ্যমতে মালিক থাকা এক ব্যপার আর না থাকা আরেক ব্যপার।
এতদিন কারখানা শ্রমিক মিটিং তিতলির স্কুল সব মিলে মলি পুরোদস্তুর ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। তারপর ও রাতে মলি আবিদের রুমে আসে, নার্সের কাছে খোঁজ নেয়। রাত ১০ টার দিকে নার্স চলে গেলে মলি এই রুমে আবিদের টেককেয়ারের জন্য থাকে। এখন আবিদ অনেক টা সুস্থ হয়ে উঠেছে বলে মলি কয়েকদিন হলো আবার বাচ্চাদের কাছে ঘুমায়। এই ব্যপারটাই আবিদ মানতে পারছে না। এতদিন এত কাছাকাছি থেকে এখন মলির এই দূরে চলে যাওয়া আবার এত ব্যস্ত হয়ে যাওয়াটাও আবিদ ভাবছে।
এতদিন মলির উপরে আবিদ অনেক বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। উঠতে বসতে মলির সংগ পেয়েছে। এই দের মাসে সে এটাও বুঝতে পেরেছে মলিকে অবহেলা করা আর পরনারী আসক্ত হয়ে সে মলির সাথে, তার ছেলেমেয়ের সাথে কত বড় অন্যায় করেছে। কিন্তু কি এক অজানা ইগোর জন্য এখনো সরি বলা হয়ে উঠেনি। সেদিন ফেবুতে মলিকে নিয়ে তার ফ্রেন্ডদের মাতামাতিতে আবিদের ভিতরে একটা ভয় ঢুকে যায়। মলি যদি আবিদ কে ছেড়ে চলে যায়, এই সংসার ছেড়ে অন্য কারো সাথে ইনভলব হয় তাহলে আবিদ কি করবে। এসব ভেবেই সে সারা সন্দ্ধ্যা মাথা ব্যাথা করে ফেলেছে।
মলির বাসায় আসতে আসতে রাত ১০.২০ বেজে যায়। নার্স কেবল মাত্র ড্রয়িং রুমে অপেক্ষা করতে করতে বের হয়ে যাচ্ছিলো। তখন ই মলির প্রবেশ।
সরি নার্স আপু, আজ একটু লেট হয়ে গেল আপনার। মলি মলিন হেসে বলল।
ইটস ওকে ম্যাম। আসলে আমি একটু কথা বলতে চাচ্ছিলাম আপনার সাথে রোগীর ব্যপারে।
মলি একটু চিন্তিত ভংগীতে বলল, এন্যি প্রবলেম আপু?
নার্স বলে উঠে, না না তেমন সমস্যা না। আপনি প্লিজ টেনশন নিবেন না। আমি বলতে চাচ্ছি, মি.আবিদ অনেক টা রিকভার করেছে। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে উনি কিছু নিয়ে ভাবেন সারাক্ষণ। জিজ্ঞেস করলে কিছু বলেন না। আমার মনে হচ্ছে উনাকে একজন সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানো প্রয়োজন।
মলি আতংকিত হয়ে বলে, কি বলছেন?
নার্স অভয় দিয়ে বলল, আরে আরে আপু, উনার ফ্রাস্ট্রেশন দূর করার জন্য বলছিলাম। অন্য কিছুর জন্য নয়।
মলি নার্সের সাথে কথা শেষ করেই আবিদের রুমে এলো, আবিদ তখন এক মনে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে কিছু ভেবেই চলছে। মলি আসার শব্দে আবিদ ফিরে তাকায়, মুচকি হেসে বলে,
অনেক সুন্দর গান গাইলে। কেমন হলো প্রোগ্রাম।
মলি অবাক হবার ভংগীতে বলল, ভালো। তবে তুমি কিভাবে জানলে আমি গান গেয়েছি।
আবিদ কিছু বলল না, তবে ইশারায় কাছে ডাকলো মলি কে। মলি কাছে আসতেই বলল, একটু পাশে বসবে?
মলি একটু বিরক্ত হলো, ও প্রচন্ড টায়ার্ড ছিলো। এখন বসে আবিদের অদ্ভুত গল্প শুনতে মন চাইছে না। তবু মনের বিরুদ্ধে বসতেই আবিদ বলল,
মলি, আমি ভুল করেছি, আমি জানি আমি ক্ষমার অযোগ্য। তবু বলছি, আমাকে কি মাফ করে দেয়া যায় না।
মলির মনে হলো পৃথিবীর সপ্তার্শচর্য কোনো ঘটনা ঘটলো, তারপর নিজেকে সামলে বলল,আমি মাফ করার কে আবিদ? তুমি তো কোনো ভূল করো নি। ভূল আমি করেছি তোমাকে এত বিশ্বাস করে। ভূল করেছি সব সময় নিজেকে দূরবল হিসেবে তোমার সামনে প্রেজেন্ট করে। আর আরো ভূল করেছি এই ভেবে যে আমি যেমন তেমন ই তুমি পছন্দ করবে ভালোবাসবে। আমি ভূলেই গিয়েছিলাম আমি দুই বাচ্চার মা, আমাকে ভালোবাসার কিংবা ভালোলাগার কোনো কিছুই আর অবশিষ্ট নেই।
মলি আর বসলো না, উঠে চলে গেলো। পুরোনো স্মৃতি গুলো মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। বুকের ক্ষত গুলোতে মনে হচ্ছে কেউ মরিচ ঢেলে দিচ্ছে। মানতে পারছে না সে। এই সংসার ছেড়ে যেমন যেতে পারছে না আবার এই মানুষ টাকেই মেনে নিয়ে সামনে আগানোতে মন টানছে না। একদম ই না। যখন ই কিছু ভুলে চায় সে পুরোনো স্মৃতি গুলো চোখের সামনে ভেসে উঠবেই। আর তখন এই ঘর এই সংসার এই জীবন সব তেতো হয়ে উঠেছে।
৩৪.
জীবন নতুন করে ভাবাচ্ছে। এই দের মাসে মলি জীবিন কে নতুন ভাবে উপলব্ধি করতে শিখেছে। সে জীবনে নিজের জন্য বাচঁতে ইচ্ছা হয়। হাঁপিয়ে গেলেই ইদানীং গান গাইতে বসে পরে হারমোনিয়াম নিয়ে। ছেলে মেয়ে কে নিয়ে নিজের মতোন সময় কাটায়। আর আবিদ খুব করে চায় একটু সময় তার সাথেও কাটানো হোক। কিংবা তাদের সাথে সেও জয়েন করুক কিন্তু সম্ভব হয়না। যতবারই চেয়েছে ততবারই মলি এড়িয়ে গিয়েছে। একদিন তো রাতে মলি ঘুমানোর প্রস্তুতি নিতেই আবিদ এক নাগাড়ে ডাকতেই থাকে। মলি ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে তার রুমে আসতেই আবিদ বলে,
দরজা বন্ধ করে এসো। মলি তখন কপাল কুঁচকে বলে,
কি লাগবে সেটা বলো। আবিদ নিরবিকার ভংগীতে বলে,
তোমাকে লাগবে। মলি যেন এই কথা শুনে ভড়কে যায়। সব কিছু খেয়াল হতেই বলে,মানে?
কেন শুনতে পারছো না? নাকি বুঝতে পারছো না মলি। আমার তোমাকে চাই।
মলি কিছু না বলে চলে যেতে নিলেই আবিদ আবার ডেকে উঠে।
মলি তেঁতে উঠে বলে, কি সমস্যা আবিদ। এভাবে কেন চেচিঁয়ে ময়না আর বাচ্চাদের শুনিয়ে ডাকছো।
আমি বললাম তো তোমাকে লাগবে। তুমি শুনেও কেন চলে যাচ্ছো।
মলি তখন কঠোর ঠান্ডা চাহনি দিয়ে বলে, আমাদের মাঝে এ ধরনের কোনো সম্পর্ক নেই আবিদ। ভুলে গিয়েছো?
আবিদ নাছোড়বান্দা, তবু বলে বসে, কেন নেই। আমরা চাইলেই আগের মতন ভালো থাকতে পারি। আমরা চাইলেই সব আবার স্বাভাবিক হবে।
মলি অট্টহাসি হেসে বলে, স্বাভাবিক? ঠিক কতবছর আগে আমাদের সম্পর্ক স্বাভাবিক ছিলো আবিদ? বলতে পারো? শেষ কবে আমায় বুকে নিয়েছিলে ভালোবেসে। আমার হাত ধরেছিলে। আমার দিকে ভালো করে তাকিয়েছিলে। বলতে পারো?
আবিদ কথা খুজে পায় না। বুঝতে পারে এত সহজে কিছুই স্বাভাবিক হবে না। মলি আবার বলতে থাকে,
তোমার ভালোবাসা বলো আর মোহ কিংবা প্রয়োজন বলো সব ওই নষ্টা কেয়ার জন্যই ছিলো। আমার জন্য কিছুই ছিলো না। আগে যা স্বাভাবিক ছিলো না এখন তা স্বাভাবিক করতে এসো না।
আবিদ এক রাশ হতাশা নিয়ে বলে, আমার করা ভুল গুলো কে বার বার মনে করিয়ে দিতে হবে না মলি। এই যে প্রতিদিন তোমার সব কিছুতেই মনোযোগ থাকে। বাচ্চাদের প্রতি সংসারের প্রতি, অফিসের প্রতি কিংবা তোমার বন্ধুবান্ধবদের প্রতি। অথচ আমার প্রতি থাকে অবহেলা। আমি জানি এসবই তোমার অভিমান। আমাকে এখনো তুমি ভালোবাসো, তাই তো এক্সিডেন্টের পর থেকে সব সময় আগলে রেখেছো। কিন্তু যেই একটু সুস্থ হতে লাগলাম আবার দূরে সরে যাচ্ছো। নিজেকে আর আমাকে দুইজন কেই তুমি কষ্ট দিচ্ছো।
মলি কথা বাড়ালো না, অনেক রাত হলো। এখন ঘুমাও বলে বের হতে চাইলো। কিন্তু আবিদ হাত টা ধরে মলিকে কাছে টানতে টানতে অনড়গল বলতে লাগলো,
— প্লিজ ক্ষমা করে দাও। আমার প্রাপ্য শাস্তি তো আমি পাচ্ছি, কেয়া এত বড় চিটার, আমার ব্যাবসার ক্ষতি করলো, অনেক টাকা আত্মসাৎ করলো, আর আমার তো এক্সিডেন্ট হলো ই। আজ দের মাস বিছানায় পরেছিলাম। তুমিই ত যত্ন করলে। প্রতি রাতে যে মাথায় পেইন হতো তখন তুমিই জড়িয়ে ধরে শান্ত করতে। এত ব্যথা এত কষ্ট নিয়ে বেচে আছি। তবু কেন আমি ক্ষমা পাবো না। মলি ও জোড়াজুড়ি করতে লাগলো। আবিদ এখন অনেকটা সুস্থ হলেও পা টা বেশ ইঞ্জুর্ড। মলিকে জোর করে আটকাতে চাইলে মলিও নিজেকে ছাড়াতে আবিদ কে ধাক্কা দিলো। আর তাতেই হলো বিপত্তি। আবিদ এর পা টা আটকে গেলো হুইল চেয়ারে আর সে গিয়ে পড়লো পাশের টেবিলের কোনায়। ব্যথায় আবিদ চিতকার করে উঠলো। ঘটনা এত দ্রুত ঘটলো যে মলি হতবিহ্বল হয়ে পড়লো। মলি আবিদের কাছে আসতেই আবিদ তার পায়ে ধরে বসে পরে। তারপর চিতকার করে বলে উঠে, ডোন্ট টাচ মি মলি। প্লিজ লিভ মি এলোন, জাস্ট লিভ মি।
মলি না চাইতেও আবিদ পায়ে ব্যথা পেলো আর মনে একরাশ ব্যথা কষ্ট নিয়ে মলি নিজের রুমে ফিরে এলো। সারা রাত নির্ঘুম কাটলো দুজনের ই। আবিদ মনে মনে চাচ্ছিলো মলি আবার আসুক, একটু ছুয়ে দেখে যাক তাকে। আর ওইদিকে মলি অভিমান আর ভয় নিয়ে আবিদের রুমের সামনে বার বার গিয়েও ফেরত আসলো ভিতরে ঢুকার সাহস করল না।
********
সেদিন রুমকির প্রোগ্রামে গান গাইবার পর এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। পলাশের এক পরিচিত ভাই সে প্রোগ্রামে উপস্থিত থাকায় মলির গাওয়া গান শুনে খুব মুগ্ধ হয়। আর তাই পলাশ কে বলে মলির সাথে কথা বলিয়ে দিতে। কোনো একদিন ভর দুপুরে তিতলির স্কুল থেকে ফেরার পথে রুমকি ফোন করে মলি কে।
হ্যালো মলি, ফ্রি আছো?
হ্যা আছি বলতে এই তো তিতলি কে নিয়ে বাসায় যাবো। আর ১০ মিনিট পর ই ছুটি হবে।
আচ্ছা শোনো খুব আরজেন্ট আমার বাসায় একটু আসবে?
মলি একটু ভেবে বলে, এখন? আসতেই হবে?
রুমকি ফোনের ওপাশেই মাথা ঝাকিয়ে বলে হ্যা গো। প্লিজ একবার আসো না। প্লিজ।
মলি রাজি হয়ে যায়। ছুটির পর ওই দিকেই রউনা হয় তিতলি কে নিয়ে। রুমকির বাসায় পৌছেই ড্রয়িং রুমে পলাশ সহ আরেকজন কে দেখতে পায়। রুমকি তখন ভিতরে ওদের কে টানতে টানতে বলে
” মলি তুমি এখানে বসো। আমি তিতলি সোনাকে ভিতরে নিয়ে জুস দেই। আর ও ততক্ষণ একটু রেস্ট নিক। “
মলি আগা গোড়া কিছুই বুঝতে পারে না, তাই ঘাড় কাত করে সম্মতি জানায়। তারপর ই সোফার একটা পাশে বসে পরে। মলির দিকে তাকিয়েই পলাশ বলে উঠে,
মলি, এই হচ্ছে আমার বড় ভাই পার্থ। উনি জনপ্রিয় মিউজিক প্রডাকশন হাউজ এস কে মিউসিকে আছেন। বলতে পারো উনি এডিটর হিসেবে কাজ করেন।
মলি সৌজন্যতা মূলক চেহারা করে সালাম দিলো। পার্থ ডিরেক্ট বলেই ফেললো আসলে আমি ই আপনার সাথে দেখা করতে চাইলাম। তাই রুমকি ভাবী আর পলাশ ডেকে আনলো আপনাকে।
মলি বেশ অবাক হয়ে বলল, কেন বলুন তো। মানে আমার সাথে কি কথা?
পার্থ আর পলাশ একজন আরেকজনের দিক দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবলো। তারপর পার্থ মুচকি হেসে বলল, আপনি কি একটা জিংগেল এ কণ্ঠ দিতে পারবেন? আসলে আপনার গান সেদিন শুনে আমি আমার বস কে শুনিয়েছিলাম। উনার ভীষণ পছন্দ হয়েছে। তাই আপনার সাথে সরাসরি কথা বলতে এলাম।
মলির এতোই অবাক হয় যে ওর দুই ঠোঁট ফাকা হয়ে যায়। রুমকির চিতকারে তার হুস আসে। মলি হ্যা না বলার আগেই রুমকি তাকে জড়িয়ে ধরে বলে, কংগ্রাচুলেশনস দোস্ত।
চলবে…..