৩৭.
আজকাল মলির খুব ব্যস্ত সময় কাটছে। হাতে এখন বেশ কাজ, কাজের চাপে মলি একদম হাসফাস করছে। তবে আশার কথা হচ্ছে সে একনাগাড়ে কাজ শেষ করে প্রায় দুই সপ্তাহের লম্বা ছুটি নিবে সে। সেই দুই সপ্তাহ কোনো কাজ রাখবে না, খালি ঘুম, বাচ্চা কাচ্ছা আর রুমকি ফাহাদ আর পলাশের সাথে কাটাবে। রুমকি আর ফাহাদ অলরেডি অনেক অভিযোগ তুলছে যে সে নাকি আগের মতোন সময় দিচ্ছে না। রুমকি তো রীতিমতো নাকি কান্না শুরু করেছে। তাই মলি ভাবলো সামনের ছুটিতে কোথাও আউটিং এ যাবে।
প্রবলেম হলো আবিদ। আজকাল বেশি নাছোড়বান্দা হয়ে উঠেছে। তার রুমে মলি ঘুমাতে যায় না বলে আবিদ নিজেই বালিশ নিয়ে চলে আসে প্রতিরাতে। এতে অবশ্য বাচ্চারা জেগে থাকলে ভীষণ খুশী হয়। গাদা গাদি করে একটা লম্বা বিছানায় ৪ টা মানুষ শুয়ে ঘুমায়। না চাইতেও গা ঘেষাঘেষি হয়। যতবার আবিদের পা মলির পায়ে লাগে মলি পা সরিয়ে নেয় আর আবিদ মুচকি মুচকি হাসতে থাকে।
এক রাতের ঘটনা, মলি দরজা লাগিয়ে দিয়েছিলো এই অত্যাচার থেকে বাঁচতে। কিন্তু আবিদ দরজায় ধাক্কা দিতেই থাকে দিতেই থাকে। যতক্ষণ না দরজা খোলা হল ততক্ষণ ধাক্কা দিতেই থাকলো। পাছে বাচ্চাদের ঘুম ভেংগে যায় তাই মলি দরজা খুলতেই আবিদ স্নিগ্ধ হাসি দিয়ে বলে,
তোমাদের ছাড়া ঘুমাতে পারিনা। কি করবো বলো?
মলি কপাল কুঁচকে দরজা ছেড়ে দাঁড়াতেই আবিদ ভিতরে ঢুকে বিছানায় চলে যায়। আয়েশ করে শুয়ে বলে কই, আসো। চলে আসো তো ঘুমাতে। এত লজ্জা কিসের। এই বলে আবিদ হাসতে থাকে। এই যে আবিদ সেই আগেকার আবিদের মতন স্বাভাবিক আচরণ করে যাচ্ছে মলির এটাই সহ্য হচ্ছে না। এত দিনের রাগ দুঃখের পাহাড় কি এই কয়েকদিনেই ভাংগে বলুন?
মলি দীর্ঘশ্বাস ফেলে দরজা ভিজিয়ে বিছানায় আসে। আজকে আবিদ বাচ্চাদের এক পাশে দিয়ে মলির বালিশের পাশে নিজের বালিশ সেট করেছে। শুয়ে শুয়ে হাত দুইটা মাথার নিচে দিয়ে পায়ের উপর পা রেখে পা নাচাচ্ছিলো আর মলির অপেক্ষা করছিলো। মলি এসে শোয়ার বেশ কিছুক্ষণ সময় পর্যন্ত কারো কোনো সারাশব্দ নেই।
পাশাপাশি শুয়েও যেন যোজন যোজন দূরত্ব দুজনের মাঝে। যেভাবেই হোক এই দূরত্ব মিটাতে হবে আবিদের। আজ কতদিন যাবত আবিদ মাফ চাইছে মলিকে স্বাভাবিক করতে চাইছে কিন্তু মলি যেন সেই এক জায়গাতেই আটকে আছে। আবিদ বদ্ধপরিকর মলির মন জয় করবেই। আর এই সকল চিন্তার সাথে সাথেই দেরী না করে মলিকে পেঁচিয়ে ধরলো। মলি চুপচাপ হজম করছিলো বিষয় টা। ভেবেছিলো হয়ত আবিদ ঘুমিয়ে গেছে। আবিদ মলির কপালে চুমু খেলো গভীর আবেগে। কপালের কাছ ধার থেকে মলির রেশমী চুল সরিয়েই ঘাড়ে ডুব দিলো সে। এত এত প্রেম ভালোবাসা আবেগ নিয়ে মলি কে আদর করতে থাকলো কিন্তু মলি নির্বিকার। মূর্তির ন্যায় সটান হয়ে শুয়েই আছে। আবিদ তারপরও মলির দুই চোখে চুমু খেয়ে ঠোঁটে চুমু খেলো। এবার মলি আর থাকতে পারলো না চুপ। ধাক্কা দিয়ে আবিদ কে সরিয়ে দিলো, ধাক্কার বেগে আবিদ গিয়ে পরলো খাটের শেষ মাথায় দেয়ালের কাছটায়। প্রচন্ড রাগে কাপা স্বরে মলি চেঁচিয়ে উঠলো,
এসব ই পারো না? তোমার কাছে শরীরটাই মূখ্য। আমাকে লাগবে তো নাও, এই নাও খুবলে খাও। এই বলে শাড়ির আঁচল সরিয়ে ফেললো মলি। মলির এহেন আচরণে আবিদ হতভম্ব, নিজেকে গুছিয়ে নিতে যেন সময় লাগছে। মলি না থেমেই চেচিঁয়ে বলে,
এই রুপ সৌন্দর্যের কাছেই তো হেরে গিয়েছিলে তাই না আবিদ। কেয়া আমার থেকেও অনেক বেশি সুন্দরী আর ফিট ছিলো। তাই তো তাকে আদর ও করতে তোমার ভালো লাগতো। এখন কেয়া নেই, আর আমি ও আগের চেয়ে যথেষ্ট ফিট হউয়াতে এখন তোমার কাছে কি আমাকে আকর্ষণীয় লাগে। তাই না। এই তুমিই না বলেছিলে দুই বাচ্চার মা, দেখতে বুড়িয়ে গেছি। এখন কেন তবে? কেয়া নেই বলে?
আবিদ নিজের মেজাজ ধরে রাখতে পারলো না। মুষ্টি বদ্ধ করে রাগ কোন্ট্রোল করার চেষ্টা করছিলো। হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলো,
চুপ করো মলি, চুপ প্লিজ। বার বার আমার করা পাপ গুলো কে তুমি মনে করিয়ে দাও। আমি যতই তোমাদের নিয়েই সুখী হতে চাই ভালো থাকতে চাই এই তুমিই দাও না আমাকে ভালো থাকতে। আবিদ হাতের কাছে পাওয়া বালিশ ফ্লোরে ছুড়ে ফেলে। চিতকার করে বলতে থাকে, যেদিন এক্সিডেন্ট করি সেদিন থেকে দুই মাস বিছানায় পরেছিলাম। আমাকে যখন এখন আর ভালোই বাসো না তবে এত যত্ন এত দোয়া কেন করেছিলে। মাঝ রাতে আমি ব্যথায় কঁকিয়ে উঠলে তুমি কেন জড়িয়ে ধরে শান্ত করতে। এত ঘৃণা করলে আমাকে সুস্থ করতে এত কষ্ট কেন করলে। উত্তর দাও!!
আমার মরে যাওয়াটাই ভালো ছিলো। কেন মরে গেলাম না তোমার রাগ দুখ অভিমানের পাহাড় তো ভাংগতো। এট লিস্ট আমাকে এখন তোমার ঘৃণাভরা চোখ দেখতে হতো না। এত অবহেলা তাচ্ছিল্য সহ্য করতে হতো না।
মলি আবিদের রাগ দেখে চুপ হয়ে যায়। অনড়গল কান্নার ফোয়ারা ঝরতে থাকে দুই চোখে। আবিদ মলি কাছে এসে দুই বাহুতে চেপে ধরে বলে,
মলি আমার ভুল আমি স্বীকার করেছি। আমি কথা দিচ্ছি আর কখনো কোন দিন তোমার ভালোবাসার অসম্মান হতে দিব না, তোমাকে কষ্ট দিব না। তুমি শুধু একবার বলো আমাকে ক্ষমা করেছো। মলি নিরুত্তর, উত্তরে শুধু চোখের পানি ফেলছে। কাঁধ ঝাঁকিয়ে আবিদ আবার প্রশ্ন করে,
বলো প্লিজ, তুমি চাইলেই আবার আমরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারবো। আজকে যদি তুমি ক্ষমা না করো তাহলে আমি আর কখনো স্বামীর অধিকার নিয়ে তোমার সামনে দাঁড়াবো না।
মলি এবার ও নিশ্চুপ। বুকের ভিতরে উথালপাথাল ঝড় বয়ে চলছে। মন মস্তিষ্কের লড়াই চলছে। বাস্তবতা চিন্তা করলে আবিদকে মাফ করা উচিত অথচ অভিমানী মন সায় দিচ্ছে না কিছুতেই। আবিদ অসহায় চোখে কিচ্ছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে বলে,
তোমার উত্তর পেয়ে গেছি আমি। পারলে মাফ করে দিও আমাকে। আমি আর কখনো তোমাকে জ্বালাতে কষ্ট দিতে আসবো না। এই বলে আবিদ দরজা খুলে চলে গেলো। যাবার সময় ধরাম করে দরজা লাগানোর শব্দ টাই যেন মলির বুকের ভিতরে বাজতে লাগলো ঘন্টার মতোন । ঢং ঢং ঢং।
সেদিনের পর থেকে আবিদের দেখা মিলতো খুব কম। সে হয়তো ইচ্ছা করেই মলির সামনে কম আসতো। সেই রাতে মলি তো আর ঘুমাতেই পারেনি। আর আবিদের খোঁজ নিতেও সাহস হয়নি।
*******
মলি রুমকি ফাহাদ এবং পলাশ সামনের দুই সপ্তাহের ছুটির কয়েকটা দিন কাটাবে শ্রীমংগল টি রিসোর্টে। বাচ্চাদের নিয়েই যাবে সাথে করে তাই খুব বেশিদিন থাকতেও পারবে না। ৩ দিনের একটা প্ল্যান করেছে তারা। ব্রিটিশ বাংলো কে মূলত মোডিফাই করে কয়েকটা টিলা ও চা বাগান নিয়ে এই রিসোর্ট টি বানানো হয়েছে। তিন বেড রুমের একটা কটেজ ভাড়া করলো তারা, ফাহাদ ই মূলত খোজ খবর নিয়ে সব ঠিক করলো। যাওয়ার দুইদিন আগেই এক রাতে ফাহাদ কল করেছিলো মলি কে। এই যে মলির জীবনে এত কিছু, রুমকি আর ফাহাদ না থাকলে হয়তো মলির অস্তিত্ব এতদিনে বিলীন হয়ে যেতো এটা মলিরই ধারণা। ফোন ধরেই ফাহাদ বলল,
বাচ্চারা ঘুমিয়েছে? ব্যগ গুছানো কত দূর?
মলি হেসে বলল, এখনো আমার আর রুমকির শপিং বাকি আর তুমি বলছো ব্যগ গুছানো শেষ কিনা?
ফাহাদ হাসে। তারপর একটু গম্ভীর সুরে বলে,
মলি, আবিদ ভাই কে জানিয়েছো তো?
মলি চুপ বনে যায়, মিন মিনে কণ্ঠে বলে, ফাহাদ আবিদের সাথে কথা হয় না ভালো করে বেশ কয়েক দিন।
ফাহাদ আশ্চর্য হয়ে বলে, সেকি? তুমি যাচ্ছো ভাই এর অনুমতি নিবে না? অনুমতি না হোক এটলিস্ট জানাবা তো।
মলি প্রসংগ এড়াতে বলল, ফাহাদ জানো একটা সিনেমার গানের অফার পেয়েছি।
ফাহাদ বিরক্ত হয়, বলে, মলি যাবার আগে অবশ্যই ভাই কে বলে যাবা। এমন কেন করছো। এভাবে নিজেও কষ্ট পাচ্ছো ভাই কেও কষ্ট দিচ্ছো।
মলি কান্না আটকে রাখার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়,
ফাহাদ, কিভাবে স্বাভাবিক হবো বলোতো, নতুন করে স্বপ্ন দেখে যদি সেই স্বপ্ন আবারো ভেংগে যায়? এবার তাহলে আমি এই আঘাত নিতেই পারব না। বাচ্চাদের নিয়ে গলায় দড়ি দিব।
এর উত্তর জানা নেই ফাহাদের তবু আবিদের পক্ষ নিয়ে বলে, মানুষ টার চোখে সত্যি অনুশোচনা দেখেছি। তোমার ভালোবাসা পাবার আকুতি দেখেছি। আমাকে বিশ্বাস করো তো মলি, মাফ করে দাও উনাকে। একটু চেষ্টা তো করো সামনে আগানোর।
মলি রাখছি বলে ফোনের লাইন কেটে দেয়। বুকের ভিতরে আবারো ঝড় শুরু হয়েছে। সংসার ভাংগা গড়ার ঝড়।
৩৮.
শ্রী মংগল টি রিসোর্টে এসেই মলির এত দিনের ক্লান্তি দূর হয়ে গেলো। এত সুন্দর জায়গা, প্রকৃতির কাছাকাছি থাকলে বোধহয় সবার ই মন ভালো হয়ে যায়। কখনো কখনো উদাস হয়ে যায় মন।এই অপার সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারার জন্য সৃষ্টিকর্তার নিকট অশেষ শুকরিয়া জ্ঞাপন করে মলি। লম্বা লন পার হয়ে সামনের বারান্দার মতোন উচু অংশে এসে দাঁড়ায় সে। পরনে কালো একটা সালোয়ার কামিজ, চোখের সানগ্লাস সরিয়ে সামনের সারি সারি টিলা আর চা বাগান দেখে মলি মুগ্ধ হয়।
তিতলি আর তোতন ছোটাছুটি করছে। তাদের দিকে তাকিয়েই মলি কন্ঠ টাকে উঁচু করে বলে,
এই তিতলি তোতন আস্তে দৌড়াও, পরে গেলে কিন্তু ভীষণ ব্যথা পাবে মা। তিতলি দৌড়ায় আর বলতে থাকে কিচ্ছু হবে না মা। ওমনি করে তোতন পরে যাচ্ছিলোই সাথে সাথেই ফাহাদ ধরে ফেলে। ফাহাদ পলাশ আর রুমকি এদিকটাই আসছে দেখে মলি হেসে তাদের দিকে তাকিয়েই বলে,
দেখলে ফাহাদ, এখুনি পরে যেতো। কই আসলাম শান্তি করতে বাচ্চাদের জন্য একটা টেনশন তো থাকেই। রুমকি হেসে বলে,
আরে ধুর, ওরাই ত এঞ্জয় করবে। ওরা না আসলে কি আমাদের ভালো লাগতো বলো।
মলি হাসে, তারপর বলে, মা হয়ে একটা জিনিস ফ্রি পেয়েছি জানো? সেটা হলো টেনশন করা। সবাই হেসে উঠে। মলি হঠাৎ খেয়াল করে পলাশ গলা পরিস্কার করে কিছু বলতে চায়। রুমকিকেই ইশারা করছে। তাই সেই বলে উঠে,
কি ব্যাপার বলো তো। তোমরা কি কিছু বলবে? রুমকি বলে, তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে। কিন্তু আমাদের কথা দাও তুমি যাই হোক না কেন, তিনদিনের প্ল্যানে এসেছি খুব এঞ্জয় করে তবেই ফিরব ঢাকায়।
মলি অবাক হয়। বলে কি সারপ্রাইজ, কি করেছো তোমরা। ফাহাদ রুমকি আর পলাশ ঠেলতে ঠেলতে ওকে রুমের দিকে নিয়ে যায়। আর বলতে থাকে, আমাদের উপর বিশ্বাস আছে তো, যা সারপ্রাইজ দিব সেটাই গ্রহণ করবা কিন্তু। এই বলে মলিকে রুমের ভিতরে ঢুকিয়ে বাহির থেকে দরজা লাগিয়ে দেয় তারা।
মলি স্তব্ধ, অবাক, হতভম্ব, আবিদ বিছানায় বসে আছে। পরনে ব্ল্যাক ব্লেজার, এসি চলছে রুমে তাও ওকে নারভাস দেখাচ্ছে। মলি দরজায় ঠাঁই দাঁড়িয়েই আছে। হুস আসতেই দরজাতে ধাক্কা দিচ্ছে,
রুমকি, ফাহাদ, প্লিজ দরজা খোলো। এমন করার কি মানে বুঝলাম না। আমার কিন্তু ভীষণ রাগ হচ্ছে। তোমরা তো বুঝের মানুষ। দরজা খোলো বলছি।
আবিদ কাছে এসে দাঁড়ায়।মলি প্লিজ, বাজে দেখাচ্ছে তুমি এভাবে দরজা ধাক্কাচ্ছো। হাত ধরতে ধরতে বলে, প্লিজ রিলাক্স, বসো আমরা ঠান্ডা মাথায় কথা বলি।
মলি তীক্ষ্ণ চাহনিতে তাকায়, হাত ছাড়িয়ে বলে,
তুমি এখানে কেন এসেছো আবিদ। আর এসব কি? আমাকে কি এই ছুটি টা এঞ্জয় করতে দিবা না। আর আমি বুঝলাম না ওদেরকে তুমি কি বুঝিয়েছো। আশ্চর্য এখানে কেন এলে তুমি?
আবিদ শান্ত গলায় বলে, ওরা জাস্ট এতটুকু হেল্প করছে যেন আমরা আগের মতোন সংসার শুরু করি। মলি প্লিজ ঠান্ডা মাথায় ভাবো, আমাদের দুইটা ফুটফুটে বাচ্চা আছে। আমাদের সম্পর্কের অস্বাভাবিকতা কি তাদের উপরে প্রভাব ফেলবে না?
মলি তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে, ও এ কথা? এটা তোমার আগে মনে ছিলো না? তুমি পরকিয়া যখন করতে এসব জানলে কি আমার বাচ্চারা খুব ভালো ফিল করতো?
আবিদ মলির কাছে আসে, মলির সামনে হাত জোর করে বলে, ভুল করেছি, প্লিজ এভাবে আর দূরে সরিয়ে রেখো না। নিজেকে অনেক ছোট লাগে মলি।
মলি আবিদের দিকে তাকিয়েই থাকে, তারপর কথা বলতে থাকে, আচ্ছা তুমি যদি ব্যবসায় লস না খেতে, কেয়া তোমাকে ছেড়ে না যেতো, কিংবা তোমার যদি এক্সিডেন্ট না হতো তবে কি তুমি আমার কাছে ফিরে আসতে? সত্যি করে জবাব দাও আবিদ।
আবিদ চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ, অনুতপ্তএর রেশ এখন চোখের জল হয়ে পরছে,
আল্লাহ তায়ালা তো সব কিছুই একটা উছিলাতে সমাধান করে দেন, হয়ত এরই মাধ্যমে আমি সঠিক পথে ফিরবো তাই এসকল ঘটনা ঘটলো।
মলি হো হো করে হেসে উঠে, হাসির চোটে নুয়ে পরে। তারপর আবার উপরে তাকিয়ে বলে,
ছোটবেলার একটা গল্প পড়েছিলাম, মনে হয় ক্লাস সিক্সের ইংলিশ বইয়ে ছিলো। এক লোক ডাব চুরি করে, ডাব গাছের মালিক যখন তাকে ধরে ফেলে তখন সে জবাব দেয়, আমি চুরি করিনি, আমার আল্লাহ আমাকে দিয়ে করাচ্ছেন। তুমি কি এমন কোনো গল্প বানাচ্ছো? তুমি এই আশায় ছিলে যে আল্লাহ একটা উছিলায় তোমাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিবেন। তোমার তো ফেরার ইচ্ছা ছিলো না, তাই না?
আবিদ কিছু বলতে পারে না, ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে। এই মলিকে তার ভীষণ অচেনা লাগছে, এই মলি যে ভীষণ শক্ত, ভীষণ রুক্ষভাষী। তার মন টাও পাথুড়ে। মলি কথা বলতে বলতে আবার দরজা ধাক্কাতে থাকে, এই রুমকি কি বাচ্চাদের মতন আচরণ করছো তোমরা। দরজা খোলো।
আবিদ আজ যেভাবেই হোক সমাধান চায়, চায় সব কিছু আজ ই ঠিক হোক। তারপর আর কোনো দিন কোনো ঝড় না আসুক। তাই পিছন থেকেই মলিকে জড়িয়ে ধরে। মলিকে এলোপাথারি চুমুতে পিঠ ভরিয়ে ফেলে। বলতে থাকে, আজ তুমি আর ফিরিয়ে দিতে পারবে না, কেন কেন এত রাগ পুষে রাখছো মনে? আগে তো ঠিক ই চাইতে যেন আমি ফিরে আসি তোমার কাছে, আজ যেভাবেই হোক এসেছি তো। তাহলে কেন আমাকে মেনে নিতে পারছো না। আবিদের ঘন নি:শ্বাস,আবিদের অবাধ্য আদর সব কিছুই মলির অসহ্য লাগছে। মলি শুধু বলেই যাচ্ছে, ছাড়ো আমাকে, আবিদ লিভ মি। চেচিয়ে বলছে, রুমকি, ফাহাদ, পলাশ প্লিজ দরজা খোলো। এভাবে হয়না, তোমরা জোর করলেই কি, আমার মন থেকে সায় না দিয়ে কিভাবে ক্ষমা করব। প্লিজ দরজা খোলো ।
আবিদ মলিকে জড়িয়ে ধরেই রাখে, আস্তে আস্তে ঠেলে বিছানার দিকে নিয়ে যাচ্ছিলো মলিকে। যেন তাদের মিলনই কেবল এক মাত্র সমাধান।
আবিদের এই ধারণা টাই ছিলো মারাত্মক ভুল। মলি এক পর্যায়ে তেঁতে উঠে, ডান হাত টা কোনো রকমে সোজা করে একটা মেরে দেয় আবিদের গালে। ধাক্কা দিয়ে আবিদ কে বিছানায় ফেলে সে নিজে সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ায়। চিতকার করে বলতে থাকে,
এই যে তুমি ভাবছো আমাকে বিছানায় নিতে পারলেই আমি শান্ত হয়ে যাবো? ক্ষমা করে দিবো? আরে তোমার বেড পার্টনার হবার যোগ্যতা তো আমি অনেক আগেই হারিয়েছি। এটা তুমি ই বলেছো নিজ মুখে। তবে এখন কেনো? ঘন ঘন নি:শ্বাস ফেলতে থাকে মলি,
আবিদ, সব কিছু জোর করে হয় না, তোমার ইচ্ছাতেই সব হবে? চাইবে সংসার করতে করলে, ইচছে করলো না আমাকে দূরে ঠেলে দিলে। এখন আবার বলছো ভুল বুঝতে পেরেছো তাই ফিরে এসেছো। বাহ, আমার ইচ্ছা অনিচ্ছা নেই? সব কি তোমার ইচ্ছাতেই হবে? চলে যাও আবিদ, প্লিজ চলে যাও।
আবিদের মিশ্র অনুভূতি, বুকের ভিতরে ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। ভুলেও এমন টা ভাবেনি সে যে মলি তার গায়ে হাত তুলবে। আসলে সে আসতে চায় নি এখানে। ফাহাদ রুমকির অনুরোধে এসেছিলো। সে নিজেও চায়নি মলির ভ্যাকেশন টা নষ্ট হোক। অথবা মলির সাথে এখন যতটুকু সম্পর্ক বেঁচে আছে তা তিক্ততা তে রুপ নেক। কিন্তু বিধিবাম। আজকে এই মুহুর্তে যেন সব হাতছাড়া হয়ে গেল।
প্রচন্ড রাগে অপমানে আবিদ কাঠ মুর্তি হয়ে রইলো। থ মেরে কিচ্ছুক্ষণ বসে ছিলো। থম মারা কণ্ঠে বলে উঠলো, আমার পথ, আমার অবস্থান দেখিয়ে দেয়ার জন্য ধন্যবাদ। ভালো থেকো তুমি।
বাহির থেকে দরজা খুলে দিয়েছে কেউ একজন। সাথে সাথেই মলিকে পেরিয়ে আবিদ বের হয়ে যায়। যাবার সময় কারো সাথেই কোনো কথা বলেনি শুধু তিতলি তোতন কে সামনে পেয়ে ওদের মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে চুমু খেয়ে যায়।
মলি ঠাঁই দাঁড়িয়েই আছে,রুমকি ভিতরে প্রবেশ করতেই মলি রুমকিকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে উঠে। কান্নার তোড়ে কোনো কথা বের হচ্ছিলো না, যা বের হচ্ছিলো রুমকি কিছুই বুঝতে পারছিলো না। তাই রুমকি চেচিঁয়ে পলাশ কে আর ফাহাদ কে ডাকে। ফাহাদ আর পলাশ রুমে ঢুকে দেখে মলিকে জড়িয়ে রেখেছে রুমকি, বাচ্চারা এসে মায়ের এ অবস্থা দেখে কাঁন্না করে দেয়। আর তখন পলাশ তাড়াতাড়ি তাদের কে কোলে নিয়ে বাইরে চলে আসে। ফাহাদ এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিয়ে বলে,
আগে পানি টা খাও, তারপর বলো কি বলেছে আবিদ ভাই। কি হয়েছে তোমার?
মলি কাঁন্নার দমকে শুধু বলেছে,মেরেছি, ওর গালে চড় মেরেছি। আমি এমন টা চাইনি সত্যি! কিন্তু ওকে তো ক্ষমাও করতে পারছিনা আমি। মলি কাঁদতেই থাকে। রুমকি অসহায় চোখে ফাহাদের দিকে তাকায়,যার অর্থ ছিলো আবিদ ভাই কে এখানে এনে কাজের কাজ কিছুই হলো না বরঞ্চ জল আরো ঘোলা হলো।
চলবে……
বি:দ্র: আর এক পর্ব আছে। আপনাদের ভালোবাসায় আমি মুগ্ধ।