৬.
হাসপাতালের দিন গুলো ভীষণ ভয়ংকর ছিলো। মলির শাশুড়ী এত দিন বিছানায় পরে ছিলেন, মলি তার সেবা করতে একটু ও বিরক্ত হতো না। হাসপাতালের বেডে শুয়ে টের পাচ্ছিলো এভাবে শুয়ে থাকলে মন খানিকটা ছোট হয়ে আসে।
৫ দিন শেষ করে মলি বাসায় ফিরে একদম একা হয়ে গেলো। আবিদ সারাদিন অফিসে, মলি তিতলি নিয়ে বিজি থাকার চেষ্টা করে। কয়েক মাস পর ই তার কোল জুরে আসে তোতন।
তোতন আসার পর মলির ব্যস্ততা এত বেড়ে যায়, এদিকে আবিদের সাথে তার কখনো দেখা হয় তো কখনো দেখা হয়না। ওদের রুম টাও আলাদা হয়ে যায়। কারণ সারাদিন আবিদ অফিস শেষ করে ঘুমাতে চায় নিড়িবিলি।
তখনো মলির মাঝে এই বোধদোয় হয়নি যে আবিদ হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। প্রায় ৩ মাস পর একবার রাতে মলি একটু সময় করে বাচ্চাদের ঘুম পাড়িয়ে আবিদের রুমে আসে। কিন্তু এসেই আবিদের রুম লক পায়। দরজায় নক করার পর পর আবিদ দরজা খুলে দিয়েই অবাক দৃষ্টিতে মলির দিকে চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর বিছানায় গিয়ে শুয়ে পরে। মলির পাশে গিয়ে শুয়ে পরে৷ কিন্তু আবিদের কোনো সারা না পেয়ে সে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে।
প্রাণের মানুষ, কতদিন পর তার কাছে আসা। অথচ তার কাছ থেকে কোনো সারা শব্দ পাচ্ছে না। মলি আরেকটু ক্লোজ হবার চেষ্টা করলেই আবিদ হাত টাকে সরিয়ে দেয়। মলি মনে মনে কষ্ট পায়, আবিদ কে নিজের দিকে ঘুরানোর চেষটা করে। আবিদ মলির দিকে ঘুরে শোয়। মলি আবিদের বুকের কাছে এসেই আবিদের ঘাড়ে নাক মুখ ঘষতে থাকে। ঠিক যেন বিড়াল ছানা টা খুব শখ করে আদর খুজতে ব্যস্ত।
হঠাৎ ই আবিদ উঠে বসে, মলির দিকে তাকিয়ে বলে,
তুমি বাচ্চাদের রেখে কেন এসেছো মলি?
মলি এক রাশ কষ্ট চোখে নিয়ে আবিদের দিকে তাকিয়ে বলে,
কত দিন পর আমরা এক সাথে সময় পেলাম আবিদ। কেন তাড়িয়ে দিচছো আমাকে!
আবিদ চোখ বন্ধ করেই বলল, তুমি চলে এসেছো, বাচ্চাদের ঘুম ভেংগে যায় যদি তাই বললাম মলি। সত্যি বলতে খুব ঘুম পাচ্ছে আমার।
মলি টুপ করে কান্না গিলে ফেললো, তারপর বলল, সরি আবিদ তুমি ঘুমাও। কিছুক্ষন থাকি তোমার পাশে?
আবিদ ঘাড় কাত করে ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যেতে লাগল। কিন্তু সারা রাত মলির ঘুম হলো না, বার বার মনে হতে থাকলো আবিদ কি তাকে অবজ্ঞা অবহেলা করলো নাকি সত্যি ঘুম পেয়েছে। কষ্ট বুকে নিয়ে এক সময় রুম ত্যাগ করলো।
৭.
বর্তমান
তিতলি অনেক টাই সুস্থ হওয়াতে তিতলিকে নিয়ে মলি আজকে স্কুলে নিয়ে আসলো। স্কুলে দিয়েই সে একটা সুপার শপে গেলো কিছু টুকটাক জিনিসপত্র কিনবে। হঠাৎ কিছু পারফিউম এর অফার দেখে সেগুলোই হাতে নিয়ে নিয়ে দেখছিলো। পিছন থেকে কেউ একজন তাকে ডেকে উঠলো,
মলি?তুমি মলি না?
পিছন ফিরে তাকাতেই দেখলো ফাহাদ দাঁড়িয়ে আছে। ফাহাদের সাথে শেষ দেখা হয়েছিলো অনার্স ফাইনাল এক্সামে। তারপর আর দেখা হয়নি,
আরে ফাহাদ, তুমি এখানে, হ্যা অবশ্যই আমি মলি।
কত দিন পর দেখা হলো, সেই ফাইনাল এক্সামের দিন দেখেছিলাম তারপর আর কখনো দেখা হলো না।
মলি বেশ অস্বস্তি বোধ করলো, ফাহাদ এখনো সেই রকম ই হ্যান্ডসাম আছে। কলেজের ক্রাশ বয় ছিলো। আর মলি বরাবর ই সাদা সিধা। তেমন কথাই হতো না তাদের আর আজ এত দিন পর দেখা।
চলো কোথাও বসি, হেসে ফুয়াদ বলল।
ইতস্তত করলেও প্রথমে তারপর মলি ও হেসে বলল হ্যা চলো কোথাও বসি। কফি?
হ্যা অবশ্যই।
কফি খেতে খেতে আনমনে মলি বাইরে তাকালো। আবারো বৃষ্টি শুরু হয়েছে। সিজনের এই বৃষ্টি শুরু হলে আর থামাথামি নেই। গলা কেশে ফাহাদ কথা শুরু করলো, কি করছো আজকাল, তোমার হাজবেন্ড ভালো আছেন?
কফির মগ টা রেখে মলি বলল, মেয়েটাকে এই যে স্কুলে দিতে আসি, বাসায় ২ বছরের ছেলে আছে, আর বর, ব্যস আছি সব মিলে ভালো। আর তুমি? ছেলে মেয়ে কয়জন তোমার?
ফাহাদ উচ্চস্বরে হেসে বলল, কিসের ছেলে মেয়ে, বিয়েই ত করিনি আমি।
মলি অবাক নয়নে ফাহাদ কে দেখলো, তারপর আর কিছু বলতে পারলো না, তবে ফাহাদ চট করে বলে ফেললো, তোমার মতো কাউকে পাইনি তাই আর বিয়ে করা হলো না আমার। এই কথা বলে আবার উচ্চস্বরে হাসা শুরু করলো। আরে আরে মজা করলাম। জাস্ট ফান।
কিন্তু মলির এই মজা টা হজম হলো না, ও তো কখনো তেমন কথাই বলতো না ফাহাদের সাথে। সে কি আসলেই মজা করেছে?
ফাহাদ সেদিন মলির ফোন নং চেয়েছিলো, মলি ও সরল মনে ফোন নং দিয়ে দিলো। পরের দিন সকালে ঘুম ভাংগে হোয়াটস এপের মেসেজ টোনে,
-গুড মরনিং, মলি ফোন হাতে নিয়ে মেসেজ রিপ্লাই দিলো
– গুড মরনিং।
– ঘুম ভাংগলো? কিন্তু এই পর্যায়ে মলি আর মেসেজের আন্সার দিতে পারেনি, তোতন উঠে যাওয়াতে কোলে নিয়ে ওয়াশ রুমের দিকে ছুটলো। হাতে সময় একদম কম, নাস্তা হয়ত বুয়া কিছু একটা করে রাখবে কিন্তু টেবিলে সাজানো সে নিজ হাতেই করে। আবার আবিদের লান্স বক্স রেডি করে দেয়া সাথে তিতলির স্কুলের জন্য রেডি হউয়া সব মিলে সকাল বেলায় সে খুব খুব বিজি থাকে।
তিতলিকে রেডি করে নিচে নেমে দেখলো আবিদ নাস্তা করছে সাথে পেপারের হেডলাইন গুলোতে চোখ বুলাচ্ছে। তিতলি দৌড়ে গিয়ে বাবার গলা জড়িয়ে ধরে। আবিদ ও প্রতিউত্তরে মেয়ে কে কপালে চুমু খায়। কে বলল, তাদের সংসারে কোনো সুখ নেই? এই যে সুখ ঠিকরে পরছে চারপাশ। মলি ভাবে হয়ত আমাকে ভালোবাসে না আবিদ কিন্তু বাইরের মানুষ তো বুঝতে পারে না কিংবা বাচ্চারা তো আর বঞ্চিত হচ্ছে না কোনো কিছু থেকে। দীরঘশ্বাস ছেড়ে তিতলি কে তাড়া দেয় মলি।
প্লিজ আম্মু দ্রুত করো, চিতকার করে ড্রাইভার কে ডাকে গাড়ি বের করতে। যেতে যেতে কেউ কারো সাথে আর কোনো কথা বলল না, যাবার আগে বুয়া কে লান্স বক্স টা বলল আবিদের ড্রাইভার কে বঝিয়ে দিতে।
৮.
প্রতিদিনের সকাল এভাবেই শুরু হয় মলির। কিন্তু উপরে কাঠ কাঠ ভাব থাকলেও ভিতরে ভিতরে ভালোবাসার জন্য গুমরে মরে। আবিদের একটু খানি ভালোবাসাই কিন্তু তাকে মোমের মতোন গলিয়ে ফেলতে পারে। হয়ত একসময় ভিতর টাও কাঠে পরিনত হবে। এসব ভাবতে ভাবতেই স্কুলে চলে এসেছে। তিতলি কে দিয়ে স্কুল থেকে বের হয়েও ভাবলো একটু বাসায় চলে গিয়ে রেস্ট নিবে। পরে না হয় ড্রাইভার কে পাঠিয়ে দিবে। এমন সময় হোয়াটস এপে আবার মেসেজ আসলো।
কেমন আছো? গাড়িতে বসে বসেই মলি উত্তর দিলো,
ভালো, তুমি?
আজ স্কুলে আসো নি?
এসেছিলাম ত, ভালো লাগছে না, তাই বাসায় ফিরে যাচ্ছি।
অহ, তারপর অনেক্ক্ষণ আর কোন কথা হলো না ফাহাদের সাথে। বাসায় ঢুকেই ময়না কে বলল কড়া করে দুধ চা দিতে। কিছুক্ষণ পরেই ময়না চা নিয়ে হাজির। চায়ে চুমুক দিতেই ময়না বলে উঠলো,
ভাবিসাব, স্যার তো লাঞ্চ বক্স নেয় নাই,
বিস্মিত চোখে মলি তাকালো ফিরে, কেনো? তুমি ড্রাইভার কে দিলে না?
কাচুমাচু হয়ে ময়না বলল, কখন জানি চলে গেলো টের পাইনাইকা।
মলি বিরক্ত ভংগিতে বলে উঠলো, তুমি জানো তোমার স্যারের কম মশলার খাবার খাওয়া লাগে, তারপর আবার ভুল কিভাবে হয়। চা টা এক চুমুকে শেষ করে ঘড়ি দেখে উঠে পরলো মলি। পরনের শাড়ি ঠিক করতে করতে ময়না কে বলল ড্রাইভার কে বলো গাড়ি বের করতে।
হন্তদন্ত করে আবিদের অফিসের দিকেই ছুটলো মলি,লাঞ্চ বক্স দিয়ে তারপর আবার মেয়ের স্কুলে যাবে সে। রেস্ট নেবার জো নাই একদম, যা নিবে গাড়িতেই নিতে হবে।
প্রায় ৪৫ মিনিট পর আবিদের অফিসে পৌছাল মলি। অফিস ঢুকতেই রিসেপশনিস্ট সালাম দিয়ে বলল ম্যম বসুন স্যার মিটিং এ আছে। মলি কি মনে করে বলল,
বসবো না, শুনুন স্যারের লাঞ্চ বক্স টা দিবেন ওনাকে প্লিজ। আমি আবার মেয়ের স্কুলে যাবো।
রিসেপশনিস্ট হাসিমুখে বলল দিব ম্যম। মলি চলেই যাচ্ছিলো কি মনে করে আবার বলল আচ্ছা বক্স টা দিন আমি দেখা করে যাচ্ছি।
এবার মেয়েটা আমতাআমতা করছিলো আর বলছিলো ম্যম স্যার ত মিটিং এ৷ মলি যেন কিছুই শুনলো না, দ্রুত পায়ে আবিদের রুমের দিকে এগুলো,
দরজায় নক না করেই হুট করে ঢুকে গেলো সে, ঢুকেই এমন বাজে পরিস্থিতিতে পরেছে সে।
কেয়া, আবিদের এসিস্ট্যান্ট, এত কাছাকাছি বসে আবিদের মুখে পরোটা পুরে দিচ্ছিলো, আবিদ ও হাসিমুখে চিবুচ্ছিলো।
মলি এহেন অবস্থায় কি বলবে বুঝতে পারছে না, উলটা আবিদ ধমকে উঠলো,
আশ্চর্য তুমি এসেছো রিসেপশনিস্ট আমাকে জানায় নি কেন?
মলি ছল ছল চোখে বলল, হয়ত তোমাদের খাওয়া দাওয়ায় ব্যঘাত ঘটতো তাই জানায় নি। এঞ্জয় ইউর মিল। বলে লাঞ্চ বক্স ফেলেই দৌড়ে চলে যাচ্ছিলো সে।
কেয়া আর আবিদ একজন আরেকজন এর মুখের দিকে তাকিয়ে এমন ভাব করলো যে ন কিছুই হয়নি তাদের। আর ওইদিকে, মলির পা টলছিলো কোনো রকমে গাড়ি তে উঠে বসে বলল স্কুলে চলো ড্রাইভার। পুরো রাস্তায় নিঃশব্দে শুধু কেদেই যাচ্ছিলো। এই হচ্ছে তার সংসার আর সংসারে তার অবস্থান। যেখানে থাকা না থাকা কোনো ব্যপার না আবিদের কাছে।
চলবে…..