১১.
পুরো রাস্তায় গাড়ি দিয়ে আসতে আসতে মলি ভাবছিলো আসলে ভাবি যা বলল তা তো ঠিক ই,
কি নেই মলির মাঝে, যা কেয়ার আছে। মলি ও তো কম সুন্দরী ছিলো না এক কালে। সংসার জীবনে ঢুকলে সবাই নিজের জন্য আলাদা টাইম বের করতে পারে না। মলি সংসারে ঢুকার পর ই পুরো সংসারের দায়িত্ব, অসুস্থ শ্বশুর শাশুড়ি, নিজের বাচ্চা সব মিলে আর নিজেকে টাইম দিতে পারে নি। তবে নিজেকে সব সময় আদর্শ বউ হিসেবেই ভেবে এসেছে এতদিন।
কিন্তু এত কিছুর পর প্রতিদানে যদি নিজের স্বামীকে হারাতে হয় তবে এই আদর্শ বউ হিসেবে তো ব্যর্থ।
মলির ভাবি আজ এগুলোই বুঝিয়েছিল। বুঝাতে বুঝাতে আকার ইংগীতে আরো অনেক কিছুই বলেছিলো। বিকেলে বাচ্চাদের ঘুম পাড়াতে গিয়ে নিজের ও চোখ লেগে আসছিলো। এমন সময় ভাবি ঢুকলো ঘরে,
ঘুমাচ্ছো নাকি?
নাহ ভাবি বলো কিছু বলবে?
বলবো আর কি, আমি ত পরের মেয়ে, যা বলবো তাতেই আবার শত্রু মনে করো কিনা, এই বলে মলির ভাবি বিছানার এক ধারে বসে পরে।
শোনো মলি, ছেলে মানুষ আসলে বউ এর কাছে কি চায় বলো তো?
মলি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকায়,
তুমি শেষ কবে আবিদ কে সময় দিয়েছো? সংসারে যাবার পর থেকে শ্বশুর শাশুড়ি বাচ্চা নিয়ে পরে আছো! নিজেদের জন্য সময় কই তোমার?একটু থেমে আবার বলল,
মেয়েরা এখানেও বোকামি করে বুঝছো। সংসার সংসার করে জামাইটাকেই হারিয়ে বসে থাকে। অথচ জামাই ছাড়া সংসারের কি মূল্য? আর জামাইদের কথা কি বলবো, তারা কিন্তু এটা বুঝবে না, তার পরিবারের যত্ন নিতে গিয়েই মেয়েদের এই দশা। তারা চায়, মেয়েদের হোক মা দুর্গার মতোন দশ হাত। একজনই সব কাজ সামলাবে আবার জামাইকে সময়ও দিবে।
মলি এই পর্যায়ে চোখের জল ছেড়ে দিলো,
আমি কি করবো ভাবি, বলো তো?
কি করবা মানে, তুমি কি কম সুন্দরী? তোমাকে দেখে বিয়ে করে নাই আবিদ? ছেলে মানুষ আর বিড়ালের এই এক ছুঁকছুকাঁনি অভ্যাস। নিজের রুপের জালে আটকাও, সময় দাও আবিদ কে।
আবিদ তো এখন বাসায় ই আসে না ঠিক মতোন। রুমটাও আলাদা করে ফেলেছে।
তাহলে তুমিও সেই রুমে চলে যাবা, তার জন্য সাজুগুজু করবা, এক্টু আক্টু ঢং করবা, জামাইকে একটু আল্লাদ করা লাগে মলি। এত কিছু ছাড় দিয়ে ফেললে পরে তোমার হাতে কিছুই থাকবে না। নিজের বুদ্ধি খাটাও। তোমার ভাই এর যে অবস্থা, কিছু হলেই যে এই বাসায় রাগ করে চলে আসো, পরে কোনো বড় ঝামেলা হলে আমাদের দোষবা না কিন্তু। নিজের অবস্থান নিজেই শক্ত করো। বাপের বাড়িতে পরে থাকলে কোনো মেয়েই দাম পায় না বুঝছো। কথা তিতা হইলেও সত্য।
আসলেই তো কিছুই রইবে না, শূন্য হাত হয়ে যাচ্ছে মলির। নিজের অজান্তেই গাড়িতে বসে চোখের পানি ফেলে যাচ্ছে, বাচ্চা দুটো কে আঁকড়ে ধরে ভাবলো আজকেই আবিদের সাথে কথা বলবে সব কিছু খোলামেলা ভাবে।
বাসায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে মলিদের প্রায় রাত ৯ টা। বাচ্চাদের ফ্রেশ করে খাওয়া দাওয়া করিয়ে বিছানায় নিয়েই ঘুম পাড়িয়ে দিলো মলি। তাতে করেই রাত ১০/১০.৩০ টা বেজে গেছে। তারপর উঠে নিজে ফ্রেশ হলো, কাভার্ড থেকে একটা মেরুন রংগের শাড়ি বের করলো। আজকে সে সাজবে মনের মতোন করে। শুধু মাত্র আবিদের জন্য সাজবে, বিয়ের পর পর যেমন শাড়ি পরে আবিদের জন্য অপেক্ষা করতো ঠিক সেভাবেই। মলির প্রতিটি সাজে সাজে সেই দিন গুলোর ছোয়া লাগতে লাগলো। মেরুন রঙ, আবিদের খুব পছন্দের।
১২.
একবার আবিদের সাথে খুব কথা কাটাকাটি হয়েছিলো, আবিদ কে মানাতে দুপুরে গোসলের পর পর ই মলি এই মেরুন শাড়িটি পরে। খাওয়ার টেবিলে বসে আবিদ এমন ভাবে বিষম খায়, খাওয়াতে সে মনোযোগই দিতে পারছিলো না। তাড়াহুরা করে খাওয়া শেষ করেই রুমে গিয়ে মলির অপেক্ষাতে বসে রইলো আবিদ। কিন্তু এত অপেক্ষার পর ও মলির আসার নাম গন্ধ ও নেই। এক সময় আবিদ রাগ হয়ে রুম থেকে বের হয়ে এলো। এসে দেখলো মলি ডাইনিং এ কি যেন কাজ করছে, আশে পাশে তাকিয়ে কাউকে না দেখে মলিকে আবিদ কোলে তুলে নিলো। রুমে আসার পর মলির সে কি হাসি। মলির হাসি৷ দেখে আবিদ বলে৷ উঠলো,
খুব হাসি পাচ্ছে না?
মলি হাসি থামিয়ে অভিমানী সুরে বলে উঠলো
—আচ্ছা আর হাসবো না। এত রাগ কেন করো আবিদ?
মলির কোমড়ে জড়িয়ে ধরে আবিদ বলে উঠলো —- যাতে করে সুন্দর করে সেজে আবার আমাকে পাগল বানাতে পারো।
তারপর বিকেলের সোনা রোদের মতোন তারা ও একে অপরের ভালোবাসায় মাখামাখি হলো।
ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে মলি সেই দিন গুলোর কথা ভাবতে ভাবতে কখনো হাসছে আবার কখনো ভাবুক হচ্ছে। আজ কতদিন পর আবিদ এর জন্য সাজতে বসেছে। একটা অজানা ভয় ও মলির বুকের ভিতরে দুমরাচ্ছে, মোচড়াচ্ছে।
আজকের আবহাওয়া টা অন্যরকম। অদ্ভুত সুন্দর বাতাস সন্ধ্যা থেকে, যেকোনো সময় বৃষ্টির ঝাপটা চারপাশ টা মুখরিত করে ফেলতে পারে। প্রেমিক প্রেমিকাদের কিংবা সদ্য বিবাহিত যুগলদের কাছে এটা রোমান্টিক ওয়েদার, আবার কারো জন্য হয়ত স্মৃতি চারণ করার রাত। প্রতিটি দিনই কেউ মরছে, কেউ পুড়ছে কেউবা সুখের ঘর বাঁধছে। জীবন যার কাছে যেমন সেভাবেই কেটে যাচ্ছে।
আবিদ বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত ১১.৩০ মিনিট। মলি ডাইনিং টেবিলেই অপেক্ষা করছিলো। আবিদ যখন ঢুকলো তখন মলি কে খেয়াল না করেই উপরে চলে গেলো। শাওয়ার নিয়ে ফ্রেস হতেই ময়না এসে খবর দিলো,
ভাইজান, ভাবীসাব অপেক্ষা করতাছে। নিচে বুলায়তাছে খাওয়োনের লাগি। আবিদ কথা না বাড়িয়ে নিচে নামলো। কিন্তু নিচে নেমেই চমকে উঠলো। মলি মেরুন রংগা শাড়ি পরেছে। লাস্ট কবে শাড়ি পরেছিলো তার মনে পরছে না। বেশ পরিপাটি ই মনে হচ্ছে। আবিদ চেয়ার টেনে বসে পরলো। খেয়াল করলো তার সব পছন্দএর মেন্যু আজ টেবিলে সাজানো।
আবিদ খাচ্ছিলো বেশ আয়েশ করে কিন্তু মনে করার চেষ্টা করছিলো আজকে কি কোনো বিশেষ দিন? দুই জন ই চুপ চাপ খাচ্ছিলো। নীরবতা ভাংলো মলি নিজেই।
খাবার ভালো হয় নি?
না না ভালো হয়েছে। হঠাৎ এত আয়োজন এত রান্নাবান্না?
বাড়ে তোমার পছন্দের সব রান্না করা কি মানা?
আমি তা বলিনি, আবিদ থেমে তারপর আবার বলল, বাচ্চারা কোথায়?
ওরা কি এত রাত অবধি জেগে থাকে! ঘুমিয়ে পরেছে আরো আগেই। আসতেই চাচ্ছিলো না নানুর বাড়ি থেকে। তোতন তো অনেক কান্নাকাটি করলো।
মলি যথেষ্ট সাভাবিক থাকার চেষ্টা করলো যেন এত বছরে ওদের সম্পর্কে কোনো ফাটল আসেনি অথবা কোনো মনোমালিন্য হয় নি। খাওয়ার পর্ব শেষ করে আবিদ কিছুক্ষণ টিভি দেখলো আর এদিকে মলি সব গুছিয়ে বাচ্চাদের কাছে আসলো।
১৩.
রাত ১২.৩০ টা, বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে, মলির বুকের ভিতর টা ও অজানা ঝড়ের শব্দে মুখরিত। আবিদ ঘুমুতে যাবার আগে বাচ্চাদের এক নজর দেখতে এলো। আবিদ যখন বাইরে বের হয়ে এলো, মলিও তার পিছন পিছন চলে আসলো।
আবিদ খেয়াল ও করলো না, তার খেয়াল হলো ঠিক যখন মলি দরজা লক করলো।
কি ব্যাপার? আবিদ অবাক নয়নে প্রশ্ন করে বসলো।
কি আবার? তোমার কাছে আসতে পারিনা? মলি আবিদের খুব কাছে গিয়ে দাড়াতেই আবিদ খেয়াল করলো আজকে মলিকে বেশ মোহনীয় লাগছে। মলি আবিদের দুই হাত টেনে বিছনায় বসালো। তারপর আবিদের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পরলো চুপটি করে। আবিদ কে চুপচাপ দেখে মলি নিজেই দুই হাত সামনে এনে কয়েক টা চুমু খেয়ে নিলো। মায়া মায়া কন্ঠে বলতে লাগলো,
আবিদ! আমাদের মধ্যকার ভালোবাসা কি ফিঁকে হয়ে গেছে?
আবিদ ঠাই বসে রইলো মূর্তির মতোন নড়লো না এক চুল পরিমান। কিন্তু কেঁপে উঠা মলির শরীর জানান দিচ্ছে সে কাঁদছে। হঠাৎ আবিদেরো মায়া হলো, মনে হলো এই মেয়েটা তো বেশি কিছু চায় নি তার কাছে। স্ত্রীর অধিকার তো তার প্রাপ্যোই। আবিদ মাথা নিচু করে মলির কপালে নাকে চোখে মুখে বেশ আবেগে চুমু খেয়ে বলল,
মাঝে মাঝে শাড়ি পরলেও তো পারো। মলি রাজ্য জয় করা হাসি হেসে বুকে মাথা রেখে বলল,
তুমি চাইলে রোজ পরবো। একটু একটু করে ওদের ভালোবাসা গভীর থেকে গভীর তর হতে লাগলো। কিন্তু শেষ মেষ একটা অঘটন ঘটেই ছাড়লো।
আবিদের হোয়াটস এপের টুং টাং করে মেসেজ আসতেই থাকলো। বিরক্ত হয়ে মলি ফোন ধরে কল দিয়ে বসলো কেয়া কে। ঘটনা এতই দ্রুত ঘটলো যে আবিদ ভাবেনি এই কাজ টা মলি করে বসবে। কল করতেই কেয়া মধুমাখা কণ্ঠে বলে বসলো,
কি ব্যাপার আমাকে ভুলে গেলে? আর এদিকে আমি যে তোমাকে ভীষণ মিস করছি।
ঝাঝাঁলো কণ্ঠে তখন মলি বলে উঠলো, নির্লজ্জ মেয়ে কোথাকার, এত রাতে তুমি একের পর এক ফোন মেসেজ দিয়েই যাচ্ছো আমার স্বামী কে। একজন বিবাহিত পুরুষের সাথে সময় কাটাতে এত টুকু বিবেকে বাধে না তোমার নাকি সব টাই টাকার জন্য।
কেয়া হতভম্ব গলায় বলল, বিবাহিত পুরুষ হয়েও সে যদি আমার কাছে আসে তাহলে আমাকে কেন দোষ দিচ্ছেন ম্যাম। হয়ত আপনার কাছে সেই সুখ পায় না যা আমি দিয়ে থাকি। কেয়া ফোনের লাইন টা কাটতেই ছো মেরে আবিদ ফোন নিয়ে নিলো।
তোমার সাহস তো কম না তুমি কেয়া কে এসব কথা বলছো!
মলির সারা গা ঘেন্নায় রি রি করে উঠলো,
আবিদ, আমি তোমাকে সুখ দিতে ব্যর্থ? তাই তুমি কেয়ার কাছে যাও?
আবিদ কোনো কথা বলছে না, ফোনে ব্যস্ত হয়ে গেছে, তোমাদের কি এত টুকু লজ্জা করে না? এই কথায় আবিদের হুস ফিরলো।
আবিদ মলির বাহুতে চেপে ধরে বলতে লাগলো, স্ত্রীর অধিকার চাচ্ছো দিচ্ছি,বাচ্চা টাকা পয়সা গয়না গাটি কোনো কিছুর অভাব আছে তোমার? এই যে আজকে কাছে এসেছো আমি কি তোমাকে আদর করতে চাইনি? তোমার জায়গায় তোমাকে রেখে আমি যদি বাইরে থেকে অন্য কারো থেকে শান্তি পাই সুখ পাই তাহলে কি সমস্যা তোমার?
আমি কি কেয়া কে বিয়ে করে সতীন বানিয়ে এনেছি ঘরে?
মলি চিতকার করে বলল,কোনো ভদ্র মানুষের এক্সট্রা ম্যারিটাল এফ্যায়ার থাকে না। স্ত্রী থাকতে কেন তোমার বাহির থেকে সুখ শান্তি পেতে হবে।
আবিদ রেগে মলির গাল চেপে ধরলো, আমি অভদ্র? হ্যা হ্যা আমি অভদ্র, দিনের পর দিনের আমি তোমার সাথে সময় কাটাতে চেয়েছি, তুমি বাবা মা সংসার বাচ্চা সামলে আমাকে বিন্দু পরিমান সময় দাও নি। আর সত্যি বলতে এখন তো তোমাকে আমার থেকেও বয়স্ক লাগে। কেয়া নিজেও কিন্তু এক সন্তানের জননী কিন্তু ওর ফিটনেস দেখেছো? তুমি জানো ও আমাকে কত টা যত্নে রাখে? তুমি আমার সংসার সামলানোর জন্য আর কেয়া আছে আমাকে সামলানোর জন্য। মাঝে মাঝে তোমার কাছে আসি এই কি বেশি না?
মলি স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো। আবিদ চিতকার করে বলে উঠলো, তোমার কোনো যোগ্যতা নেই কেয়া কে অপমান করার। এখুনি সরি বলবে ওকে।
মলি শূন্য চোখে চেয়ে রইলো আবিদের দিকে। বাইরে বৃষ্টির সাথে পাল্লা দিয়ে বাতাস বেড়েছে। এ যেন মলির মনের অবস্থার সাথে মিল মিশ করে তাকেই সংগ দিয়ে চলছে। মলি আচল গুটিয়ে ধীর পায়ে রুম ত্যাগ করার পূর্বে বলল, আমি জীবন থাকতে কখনো সরি বলবো না সেই বেয়াহা বেশ্যা কে।
চলবে……