আমি একটা মেয়ে মানুষ হয়ে নির্লজ্জের মতো পরিবারে নিজের বিয়ের কথা বলেছি। যথেষ্ট অপেক্ষা করেছিলাম তাদের জন্য , কিন্তু কেউ মজার ছলেও আমার বিয়ের উল্লেখ করেতোনা। আমি বলার পরে তারা বাধ্য হয়ে সমন্ধ দেখতে শুরু করেছিলো। আমি অনেক বেশি খুশি ছিলাম, তবুও তো বিয়েটা হচ্ছে!
ছলছল চোখে মেহুলের কথাগুলো শেষ হতেই তার মনোযোগী শ্রোতা প্রশ্ন করলো,
‘ এত সাধনার বিয়ে অথচ বিয়ের আগেরদিন পালালেন? একটু অদ্ভুত না?
‘ আপনি ভালো করেই জানেন বিয়ের বয়সে মেয়েরা তখনি বিয়ে করতে চায়না, যখন বিয়েটা তার প্রিয় মানুষের সাথে হয়না, কিংবা ক্যারিয়ার নিয়ে কোনো চিন্তা থাকে। এছাড়া যেকোনো মেয়েই বিয়ের জন্য প্রস্তুত থাকে৷ আমিও ছিলাম, আমার কোনো প্রিয় মানুষও নেই আবার ক্যারিয়ার নিয়েও মাথা ব্যথা নেই। কিন্তু সমস্যাটা কি হয়েছে আশা করি আপনিও জানেন। এতটাও পঁচে যাইনি তো! পালানো ছাড়া উপায় কি ছিলো?
শব্দ করে হাসতে লাগলো ছেলেটা। আসলেই সে জানে সবটা। সে জানবেনা তো কে জানবে? মেহুলের বিয়েটা তো তার সাথেই ঠিক হয়েছিলো। আপাতত দুজনে একসাথেই ট্রেনে করে গন্তব্যহীনতায় ছুটছে। অথচ আগামীকাল তাদের বিয়ের তারিখ।
একটু পেছনে ,
বিয়ে করবে খুশিতে মেহুল একমাস আগেই হল ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো।
সব বন্ধু বান্ধবদেরকে বিয়ের আগেই ট্রিট দিয়েছে। তার বিয়ে সমন্ধ চলছে বলে কথা! বেচারির জীবনের একটাই লক্ষ্য ছিলো সেটা হচ্ছে বিয়ে করা৷ সেটা যেখানে পূরণ হয়ে যাচ্ছে সেখানে সবাইকে ট্রিট তো দিতেই হবে! কিছুটা অগোছালো আর তার পুরুষালি চলাফেরার জন্য ছেলেরা তার প্রতি কখনোই আকৃষ্ট হতোনা। জীবনে একটা প্রেম অব্দি করতে পারেনি৷ কোনো ছেলে তাকে আসলে মেয়ে বলেই চিন্তা করতে পারতোনা, তার ব্যাচের সবাই তাকে ‘বেডা’ ছাড়া কিছু সম্বোধনই করেনা ৷ এসব নিয়ে তার ক্ষোভের শেষ নেই। তাই সে যে আট দশটা মেয়ের মতোই একটা মেয়ে সেটা প্রমাণ করার অপেক্ষাতেই দিন গুনে যাচ্ছিলো, সবাইকে চ্যালেঞ্জ করতো বিয়ের পর তাকে যে কেউ এক পলক দেখলেই বলে ফেলবে এটা ঘরের লক্ষী লাজুক বউ এবং প্রথম বিবাহবার্ষিকীটা সে বাচ্চাসহ উদযাপন করবে।
এসব শুনলে তার বন্ধুবান্ধব হাসতে হাসতে লুটোপুটি খেতো।
বিয়েটিয়ের ইচ্ছে খুব আগেও থেকেও ছিলোনা। কিন্তু যখন রাহুল তার প্রেমপ্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলো, আর বলেছিলো প্রয়োজনে সে সারাজীবন একা মরবে তবুও মেহুলকে সঙ্গী করার রুচি হবেনা।
তখন থেকে গত দুই আড়াই বছর ধরে মেহুলেরও খুব ইচ্ছা এই ছন্নছাড়া জীবন থেকে বেড়িয়ে আসবে। অন্য সবার মতো পরিপাটি রুচিশীল একটা মেয়ে হবে। কাজ করবে, সংসার করবে। সবাইকে জিনিসগুলো ভালোভাবে উপলব্ধি করাবে সেও কোনো মেয়ের চেয়ে কোনোদিকে কম নয়। কিন্তু সেই সুযোগটাই যেন তার জন্য বিয়ে ছিলো। এছাড়া তার হঠাৎ পরিবর্তন তাকে উপহাস্য করে তুলবে। এদিকে বিয়েটাই হচ্ছিলোনা তার। সে খুব করে শুধু নিজের বলে একটা মানুষ চাইতো! অবশেষে যখন সেই দিন চলে এলো, সব ছেড়ে বাড়ি চলে আসলো। সবাইকে আড়াল করে এই কয়দিন নিজেকে গুছানো জরুরী তার।
মেহুল পরিবারের ৭ম সদস্য। তার কোনো ভাই নেই, সবার ছোট সে ছিলো। একটা ভাইয়ের অভাব ভুলতে তার পরিবারই ছোট থেকে তাকে ছেলের কায়দায় বড় করছে। ফ্রগ কিনে দেওয়ার বদলে তাকে কিনে দিয়েছে শার্ট, প্যান্ট। মেয়েদের চাকচিক্য জুতোর বদলে তাকে কিনে দিয়েছে ছেলেদের সাদাসিধা চামড়ার জুতো ৷ তার চুলও কখনো ছোট থেকে বড় হতে দেয়নি, সেলুনে নিয়ে গিয়ে ছেলেদের কাট দিয়ে এনেছে । তার বাবা তাকে পুতুল নিয়ে খেলতে পর্যন্ত দেয়নি, তাকে নিয়ে যেতো ক্রিকেট, ফুটবলের মাঠে। সেই সুবাদে সেও এসবে বেশ এগিয়ে। একেকটা ছেলেকে অনায়েসে টক্কর দিতে পারে।
সবাই প্রেম করে, বিয়ে করে, নানান কেচ্ছাকাহীনি শুনে শুনে তারও মাঝেমধ্যে ইচ্ছে হতো ব্যপারগুলোকে কাছ থেকে দেখার।
কিন্তু সব তো সবাইকে দিয়ে হয়না। তার হুটহাট কিল-ঘুষি, গালিগালাজের জন্য তার ক্লাসের ছেলেরাই তাকে ভয় পেতো।
প্রেমিক হওয়ার সাধ কারোরই জাগেনি, তবে ইউনিভার্সিটিতে তার বন্ধুর সংখ্যা ছিলো অগণিত। যাদের বেশিরভাগই ছেলে।
মেহুল বাড়িতে আসার দুই সপ্তাহ পরে তাকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসে। এর মধ্যে সে যথেষ্ট গুছিয়ে যায়। নিয়মিত পার্লারে যাতায়াত, কথাবার্তায় নম্রতা তার মধ্যে স্বইচ্ছাতেই ফুটে ওঠে। তাকে পাত্রপক্ষও এক দেখাতে পছন্দ করে ফেলে। তবে পাত্রকে সরাসরি সে দেখেনি। পাত্রসহ পাত্রের বাড়িঘর দেখেছে তার পরিবারের লোকজন। তারা বলেছে ছেলে দেখতে শুনতে খুবই ভালো। সব শুনে তার আর আপত্তি রইলোনা।
কিন্তু বিপত্তি ঘটলো গায়ে হলুদের দিনের বেলা। হঠাৎই তাকে পাত্র ফোন দিলো। দিয়ে বললো,
‘ আপনি তো আমাকে সম্পূর্ণ অন্ধের মতো বিয়ে করতে যাচ্ছেন, বিয়ের আগে একবার কি আমাকে কি দেখার ইচ্ছে নেই?
মেহুল বলেছে,
‘ সেটা অবশ্যই আছে, আপনি সমস্যা না থাকলে আমাকে ছবি পাঠাতে পারেন।
কিন্তু যখন ছবি পাঠালো, মেহুল দেখলো পাত্রের মাথা টাক। এটাও বড় বিষয় ছিলোনা, যেটা বিষয় ছিলো সেটা হচ্ছে দেখতে তাকে ৪৫-৫০ বছর বয়সী কোনো বৃদ্ধ মনে হচ্ছে৷ বিয়ের জন্য মেহুল পাগল হতে পারে, কিন্তু সে তো এতটাও পাগল না যে এমন বাবার বয়সী কাউকে বিয়ে করে জীবন শেষ করে দিবে! জীবনে যা যা টিপ্পনী শুনেছে তা যে কয়েকগুণ বেড়ে যাবে তা সে টের পেয়ে গিয়েছিলো। সবাই সত্যিকার অর্থেই তাকে নিয়ে আরো হাসবে৷ বলবে শেষমেষ তাকে কোনো বুড়ার গলায় ঝুলতে হয়েছে।
পরিবারে বলেকয়ে সে বিয়ে করতে যাচ্ছে, তারা যে আসলে তার জন্য এমন কিছু রাখবে সেটা কল্পনাও করতে পারেনি৷ মেহুল তার ছয়বোনের জামাইকেই দেখেছে, সবাই-ই ১০/১০ পাওয়ার ক্ষমতা রাখে৷
সেও তো দেখতে কম সুন্দরী না, শুধু চলাফেরাটাই অসুন্দর ছিলো৷ এসব তো সে ধীরে ধীরে পরিবর্তন করেই ফেলতো!
পরিবারের সবার উপর তার প্রচন্ড জেদও কাজ করছিলো।
তবে যাই মনে আসুক, সে ইতোমধ্যে তা বুঝে গেছে এই বিয়ে সে ফেরাতে পারবেনা৷ নিজে সব ঠিক করে এখন যদি বিয়ে করবেনা বলে তাকে আস্ত রাখবেনা৷ তার চেয়ে ভালো পালিয়ে যাওয়া৷
এরপর যেভাবে ছিলো সেভাবেই একটা ব্যাগ নিয়ে সোজা রাস্তায়। কোথায় যাবে কি করবে এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতেই তার রাত হয়ে গেলো। টাকাপয়সাও বেশি নিয়ে বের হয়নি। চিন্তা করতে করতে হঠাৎ তার মনে হলো তার কানে তো এক জোড়া সোনার দুল আছে। বাড়িতে আসার পরে পার্লারে গিয়ে কান ফুঁড়ানোর পরে দুলজোড়া তার মা তাকে উপহার দিয়েছিলো।
কিছু না পেয়ে সেগুলোকে বিক্রি করে দিলো। তারপর রিকশা নিয়ে চলে গেলো স্টেশন। তার সিদ্ধান্ত স্টেশনে যে ট্রেন পাবে তাতেই চড়ে বসবে৷ বিয়ে ভেঙে গেলে পরে বাড়ি গিয়ে ক্ষমা চেয়ে নিবে। এরপর মেহুল স্টেশনে গিয়ে বসে রইলো। অনেক্ষণ বসে থাকার পরে রাত ৯ টার দিকে একটা ট্রেন এসে থামলো। মেহুল তাড়াহুড়ো করে উঠেই সামনের যাত্রীদের উদ্দেশ্য করে বললো,
ট্রেন কোথায় যাচ্ছে জানেন?
এমন প্রশ্নে আশেপাশের কয়েকজন অবাক হয়ে বললো,
‘ একি আপনি না জেনে উঠে গেছেন?
তৎক্ষনাৎ মেহুলের জবাব,
‘ আসলে আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছি। স্টেশনে যে ট্রেন পেয়েছি সেটাতেই উঠে গেছি।
কোথা থেকে যেন একটা ছেলে এসে মেহুলকে বললো,
‘ আপনার কাল বিয়ে তাই পালিয়ে এসেছেন তাইনা?
আমতা আমতা করে মেহুল বললো,
‘ আপনি কীভাবে জানেন?
ছেলে হাসতে হাসতে বললো,
‘ পাত্র তো আমিই ছিলাম। বউ পালিয়ে গেছে শুনে খুশিতে ট্যুরে যাচ্ছি।
মেহুল তার দিকে বড় বড় চোখে বললো,
‘ আপনি ভুল ভাবছেন! হয়তো আপনার পাত্রী অন্য কেউ হবে, আমি পাত্রের ছবি দেখেছি, সে আপনি নন।
কিন্তু ছেলেটা তার ফোন বের করে দেখালো,
‘ দেখুন আমার ফোনে আপনার ছবি। মেহুল দেখলো ছেলেটা সত্যি বলছে। তাকে পাত্রের বাড়ি থেকে যেদিন দেখতে এসেছিলো, ছবিগুলো তখনকার।
মেহুল এবার বুঝতে পারছেনা তাহলে তাকে ওই ছবি কে পাঠিয়েছে! তার পরিবার তো তাকে এক দন্ডও মিথ্যা বলেনি। পাত্র দেখার মতোই নয় শুধু, দেখলে প্রেমে পড়ে যাওয়ার মতো! কিন্তু মেহুলের পরেই মনে হলো ছেলেটা বিয়ে ভেঙে যাওয়ায় অনেক খুশি, যার জন্য ট্যুরে যাচ্ছে। হয়তো তাকে বিয়ে করতে কোনো কারণে আপত্তি ছিলো তাই এভাবে তাকে বিয়ে ভেঙে পালাতে বাধ্য করেছে।
সে কিছু বলার আগেই ছেলেটা বললো,
‘ আসুন ওখানে একটা খালি সীট আছে, বসে গল্প করি।
মেহুল গিয়ে বসলো। ছেলেটা বসেই বললো,
‘ আমি উদয়, আপনি মেহুল। আমাদের বিয়ের কার্ডে সুন্দর করে লেখা আছে আগামী সোমবার উদয় মেহুলের শুভ বিবাহ। অথচ উদয় আর মেহুল সেদিন থাকবেই না, হাহাহাহা।
মেহুল কিছু না বলে তার দিকে তাকিয়ে আছে। উদয় হাসি বাদ দিয়ে সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললো,
‘ তারপর বলুন কেন বিয়েটা করতে চাইলেন না?
এমন প্রশ্নে এক প্রকার বিব্রতই হলো মেহুল, বিয়ে নিয়ে তার বিশদ আগ্রহ শুনে উদয় বেশ মজা করতে লাগলো। এসবের মধ্যেও মেহুল বলে ফেললো,
‘ আপনি চাইলে আমরা কিন্তু ফিরে যেতে পারি, আমাদের বিয়েটা ভালোভাবেই হতে পারে।
মেহুল এই কথা বলার পরেই উদয় এমন করে হাসতে লাগলো যেন মেহুল কোনো জোকস বলেছে। সে সীট ছেড়ে উঠে বললো,
‘ বিয়ে করবোনা বলেই তো রফিক মামার ছবি পাঠিয়েছি। হাহাহা আমি একটা ছেলে হয়ে আরেকটা ছেলেকে তো বিয়ে করতে পারিনা, শত হোক আমি গে তো নই!
চলবে…….
তার_বিকল্পে ০১
লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার
#তার_বিকল্পে (০২)
‘আমি একটা ছেলে হয়ে আরেকটা ছেলেকে তো বিয়ে করতে পারিনা’
উদয়ের এই কথাটা মেহুলের মগজে গিয়ে এমনভাবে ধাক্কা দিলো যে সে সাথে সাথে দুহাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিজের চোখ বন্ধ করে ফেললো!
এতো বাজেভাবে তাকে তার কোনো শত্রুও বলেনি। মেহুল কয়েক সেকেন্ড সেভাবে বসে থেকে তড়িঘড়ি করে উঠে এখান থেকে চলে যেতে লাগলো। পেছন থেকে উদয় ডাকলো,
‘ রাগ করলেন নাকি?
মেহুল হাতের মুষ্টি আরো শক্ত করলো। এই মূহুর্তে সে শুধু রাগ না, প্রচন্ডরকম জেদ আর নিজের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে আছে। তারই তো দোষ! কেন বিয়ের জন্য এতো লাফালাফি করছিলো? যেভাবে ছিলো সেভাবে একজীবন একাও তো কাটিয়ে দেওয়া যেতো!
যেতে যেতে সে সামনে কয়েকটা বগি পার হয়ে একটা দরজার সামনে গেলো,গিয়ে সম্পূর্ণ দরজা খুলে বাইরে তাকালো! ট্রেন থেকে রাতের দৃশ্য অদ্ভুত সুন্দর। মাঝেমাঝে গাছপালায় কিছুই দেখা যায়না, আবার মূহুর্তেই সেটা পাল্টে খোলা আকাশের অর্ধচন্দ্রের আলো তারার ঝিকিমিকি চোখ ধাঁধিয়ে দেয়! রাতের ট্রেনের বেশিরভাগ দরজাগুলোই বন্ধ থাকে , সবাই নিজেদের সীটে গা এলিয়ে শুয়ে থাকে, কিংবা ফোন টিপে।
এদিকে খোলা দরজায় মেহুল কোথাও না ধরে দরজার একদম কর্ণারে দাঁড়িয়ে চিন্তা করছে বাড়ি চলে যাবে। এরপর ট্রেনে যেই স্টেশনেই থামুক নেমে ফিরতি ট্রেন খুঁজে নিবে। বাড়ি গিয়ে সবার কাছে হাত জোর করে ক্ষমা চেয়ে প্রতিজ্ঞা করবে তার বিয়ে নিয়ে যেন কেউ কোনোদিন কথা না বলে! তার জীবন অপরিবর্তিতই থাকুক, পরিবর্তনের আশায় জীবনে কাউকে জড়ানো তারই বোকামি ছিলো। এর শাস্তি কাউকে ভালোবাসতে গিয়েও পেয়েছে এখন বিয়ে করতে গিয়েও।
মেহুল উদয়ের কাছ থেকে নিরবে চলে এলেও কিছু প্রশ্ন তার মনে উঠে এসেছে। উদয় তাকে এভাবে ছেলে বললো কেন? অন্তত এই সময়ে এসে তাকে কেউই এভাবে বলতে পারবেনা। তবে কি তাকে আগে থেকে চিনতো? তার চলাফেরা সম্পর্কে উদয় অবগত ছিলো?
মেহুল কপালের চুলগুলোকে মুঠো করে ধরে কিছুটা স্বস্তি পাওয়ার চেষ্টা করলো। হঠাৎ পাশ থেকে কিছু একটা মেহুলের অল্প বেড়িয়ে থাকা কনুইয়ে ঘর্ষণ খেলো। মেহুল সেটার টাল সামলাতে না পেরে ছিঁটকে যাচ্ছিলো, হাতলটা ধরতে পারার আগেই পেছন থেকে কেউ একজন তাকে টেনে ধরে বললো,
‘ ম্যাম আপনি এভাবে সুইসাইড করবেন না, আমার কথা শুনুন।
মেহুল চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে দেখলো তাকে একটা অপরিচিত ছেলে টেনে ধরে আছে। সে তাড়াতাড়ি হাত সরিয়ে বললো,
‘ না এমন কিছু নয়৷
‘ আমি দেখলাম তো! আর আপনি রাতের বেলা দরজা খোলার সাহস পেলেন কীভাবে? এখানকার কোনো কর্মকর্তা ব্যপারটা দেখেনি? এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে লাফ দিতে হবেনা, জঙ্গলের ভেতরে রামদা দিয়ে কল্লাকাটা লোকেরা যেভাবে বসে থাকে, এক কোপে শরীর থেকে মাথা আলাদা করে দিবে। সেই মাথা তারা বিক্রি করে দিবে। ভাবেন কি ভয়ংকর। আচ্ছা আপনি কি এটা জানেন না?
মেহুল ভয়েভয়ে বললো,
‘ ন’না’নাতো! আচ্ছা দরজা লাগিয়ে দিচ্ছি।
‘ উমমম শুনুন মরে গেলে কেউ মনে রাখেনা, বেঁচে থেকে সবার মনে থাকতে হয়। যান সীটে গিয়ে বসুন।
‘ আমি বিনা সীটের টিকিট নিয়েছি। আমার কোনো সীট নেই।
‘ কিছু মনে না করলে আমার সাথে যেতে পারেন। আমি আর আমার মা একটা আস্ত কেবিন নিয়েছি, আমি আসলে ওয়াশরুমে যাওয়ার জন্য বের হয়েছিলাম। তাহলে আপনি একটু অপেক্ষা করুন আমি ওয়াশরুম থেকে আসছি, তারপর আপনাকে আমাদের কেবিনে নিয়ে যাবো।
মেহুল মাথা নাড়লো। কিন্তু যখনি ছেলেটা ওয়াশরুমে চলে গেলো, মেহুল দ্রুত এই জায়গা থেকে পালাতে লাগলো। না না এভাবে কোনো ছেলের পাল্লায় পড়া যাবেনা৷ এরা ভালো মানুষী দেখিয়ে কখন তার কলিজা ছিদ্র করে দিবে তার ঠিক নেই।
মেহুল এক বগির পর এক বগি পার হতে হতে একবারে শেষ বগিতে গিয়ে থামলো। অনেকেই এখানে দুই সীট নিয়ে আছে। অথচ মেহুল স্টেশন কাউন্টার থেকে একটা টিকিটও ম্যনেজ করতে পারেনি।
মেহুল সর্ব পেছনে গিয়ে ধীরে ব্যাগটা রেখে, মেঝেতেই বসলো । গিয়েই সে তার কনুইয়ে লক্ষ্য করে দেখলো সেখানটা ছুঁলে গেছে। ট্রেনের স্পিডের সাথে কোনো গাছের শক্ত ধাঁরালো পাতার আঁচড়ে এমনটা হয়েছে। লোকটার প্রতি তার একটা কৃতজ্ঞাতাও কাজ করছে। না থাকলে বোধহয় পড়েই যেতো! এদিকে তাকে এভাবে মেঝেতে বসতে দেখে আশেপাশে থাকা কয়েকজন তার দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে। মেহুল সেসবদিকে কোনো প্রকার ভ্রুক্ষেপ করছেনা।
মেহুল ভাবছে ফোনটা খুলে তার মাকে একটা ফোন দিবে, জানাবে সে সকালে বাড়ি আসছে। এই বিয়ে এমনিতেও হতোনা, কারণ ছেলেই সেটা চাচ্ছেনা। কিন্তু আবার সাহস করতে পারছেনা। একে তো কানের দুলগুলো বিক্রি করে দিয়েছে আবার পালিয়ে এসে সম্মান খুইয়েছে। এদিকে তার ভেতরকার অবস্থাও ক্ষতবিক্ষত! এই সময় তাকে তারা বকাঝকা করলে তার অনেক অভিমান হবে। একসাথে বাড়ি গিয়েই না হয় সবকিছু সহ্য করে নিবে!
মেহুল ইউনিভার্সিটিতে কিভাবে ফিরে যাবে এই লজ্জায়ও নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। তার বন্ধুরা তাকে কতো কতো কথা শোনাবে তার কোনো সীমান্তই নেই। তাদের সাথে অনেক বড় বড় কথা বলে এসেছে, ভাব করেছে, চ্যালেঞ্জ করেছে, সবশেষে যদি দেখে সে এভাবেই ফিরে গেছে তাহলে ইজ্জতভ্রষ্ট হওয়া ছাড়া আর কি উপায়! তাছাড়াও তাকে তো এমনিতেও কেউ সম্মান দেয়না। মেহুল ভাবছে সে ঠিকি ফিরে যাবে কিন্তু সবার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে। একদম একা হয়ে যাবে, কোনো টক্সিক মানুষের আশেপাশে নিজেকে রাখবেনা।
তার ভাবনার মধ্যে হঠাৎ ট্রেনের টিটিই ডেকে বললো,
‘ ম্যাডাম আপনি এখান থেকে উঠুন। এখানে আমাদের কাজ আছে।
মেহুল চোখ উপরে তুলে তাকিয়ে দেখলো টিটিইর পেছনে ওই ছেলেটাও দাঁড়িয়ে আছে। যে তাকে বাঁচিয়েছিলো। টিটিই বললো,
‘ আপনি চাইলে উনার মার সাথে গিয়ে বসতে পারেন৷ উনার পুরো কেবিন নেওয়া আছে।
মেহুল ব্যাগটা নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
‘ আচ্ছা চলুন।
ছেলেটা আগে আগে যেতে লাগলো। মেহুল পেছনে পেছনে যেতে যেতে ভাবছে, ছেলেটা কে? অন্য কোনো মতলব নেই তো? এই ট্রেনে তো তাকে চেনে শুধু উদয়৷ কোনোভাবে তাকে বিপদে ফেলার চেষ্টা হচ্ছেনা তো?
এসব চিন্তা মাথায় এলেও মেহুল ভয় পেলোনা। মেহুল তো ভয় পাওয়ার মতো মেয়েই না!
ছেলেটা পেছনে তাকিয়ে বললো,
‘ আমার নাম শোভন। তবে যাতায়াতে শোভন চেয়ারে যাওয়ার অভ্যাস নেই কিন্তু,হাহাহাহা! কেবিনই নেওয়া হয়, মাকে ছাড়া কোথাও যাইনা তো। আমার মা বেশি মানুষের মধ্যে দিয়ে চলতে অস্বস্তিবোধ করে। কেবিন বলে মেয়ে মানুষ হিসেবে আপনার ভয়ও লাগতে পারে, আমরা মা ছেলে মিলে আপনাকে স্প্রে মেরে সবকিছু ছিনিয়ে নেই নাকি! কিন্তু বিশ্বাস করতে পারেন, আমি এতটা ভালো না হলেও আমার মা খুব ভালো মানুষ।
মেহুল হাঁটার মধ্যে প্রশ্ন করলো,
‘ আপনার মা কিছু মনে করবেনা?
শোভন পেছনে তাকিয়ে বললো,
‘ আরে আপনাকে না পেয়ে মার কাছে গিয়ে সবটা বলেছিলাম, তারপর মা আমাকে বললো ট্রেন তো একটা সীমাবদ্ধ জায়গা, খুঁজে পেতে সমস্যা হবেনা, খুঁজে যেন নিয়ে যাই! বিপদে পড়া একটা মেয়েকে আমার মা ছেড়ে দিতে রাজী নয়।
মেহুল আর কিছু বললোনা। অবশেষে তারা কেবিনের সামনে এলো, শোভন কেবিনের দরজা খুলতেই মেহুল দেখলো, দরজার সামনে তার মা দাঁড়িয়ে আছে। বয়স না হলেও ৬০ হবে। নামাজের বড় হিজাব পরিধান করা, হাতে একটা তছবী ঘুরছে। সালাম দেওয়ার ততটা অভ্যাস না থাকলেও মেহুল অজান্তে বলে উঠলো,
‘ আসসালামু আলাইকুম।
শোভনের মা সালামের জবাব দিয়ে একটা মুচকি হাসি দিয়ে বললো,
‘ কি সুন্দর মেয়েটা মাশাল্লাহ! এই তুমি কেন আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলে বলোতো? বসো এখানে।
মেহুল আস্তে করে বসতে বসতে গলায় পেঁচিয়ে রাখা ওড়নাটা টেনে খানিকটা মাথায় দিলো। এদিকে শোভন মেহুলকে দিয়েই সেখান থেকে বের হয়ে গেলো। শোভনের মা মেহুলের গালে স্পর্শ করে বললো,
‘ জানো আমার ভীষণ শখ ছিলো আমার একটা মেয়ে হবে। কিন্তু আল্লাহ আমাকে কোনো মেয়ে দেয়নি। শোভনের বড় আমার দুইটা ছেলে ছিলো, একটা ছেলে তিন বছর অবস্থায় কিডনি বিকল হয়ে মারা গেছে, আর একজনের যখন ১৩ বছর বয়স, তখন আমার বয়স ৩০ পেরিয়ে,আমি আল্লাহর কাছে মেয়ের উদ্দেশ্যে শেষ একটা সন্তান চাইলাম। আমার প্রেগ্ন্যাসির যখন ৪ মাস চলে, তখন আমার স্বামী সন্তান দুইজন একটা বিয়ে অনুষ্ঠান থেকে ফেরার পথে রোড এক্সিডেন্টে আমাকে একেবারে একেবারে নিঃস্ব করে করে দিয়ে চলে যায়। আমার সারা দুনিয়া তখন ঘোর অন্ধকারে তলিয়ে গিয়েছিলো। চোখেমুখে কোনো দিশা খুঁজে পেতাম না। বেঁচে থাকার ইচ্ছে হারিয়ে ফেলেছিলাম। কিন্তু নিজের সাথে আরেকটা প্রাণ বিসর্জন দিতে চাইনি বলে জীবনের সাথে যুদ্ধ করেছি।
আল্লাহর ইচ্ছে বদলেছি, মেয়ের বদলে আবার ছেলে চেয়েছি। আমার মেয়ে হলে সেতো পরের ঘরে চলে যাবে তখন আমি আবার একা হয়ে যাবো। আর ছেলে হলে সে আমার ঘরে ঠিকি আরেকটা মেয়ে নিয়ে আসবে। আল্লাহ আমার কথা শুনেছিলো হয়তো, তাইতো আমার শোভন আমার পৃথিবী আলো করে এসেছে। এখন আমার মরতে ইচ্ছে করেনা জানো? নিজ চোখে সন্তানের সফলতা দেখছি, অনেকদূর দেখার ইচ্ছে। দেখো মা আমি যদি স্বামী সন্তান হারিয়ে সেই অবস্থা থেকে বেঁচে থাকতে পারি, তাহলে তোমার কিসের দুঃখ! দেখো একটা সময় তোমার মনে হবে দুনিয়ার সবকিছু উপভোগ করতে জীবনটা অতি সামান্য!
মেহুল বুঝতে পারলোনা তার আসলে কি বলা উচিত। সে তো আসলে সুইসাইড করতে যায়নি, শুধু একটা এক্সিডেন্ট ছিলো। কিছু না পেয়ে আস্তে করে বললো,
‘ আলহামদুলিল্লাহ! আমি বেঁচে থাকবো।
তখনি দরজা খুলে শোভন কিছু খাবারের প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বললো,
‘ মা খেতে খেতে কথা বলো, কিন্তু বলতে বলতে ছেলের সমন্ধ পাকা করে ফেলোনা। আমি কিন্তু এখন বিয়ে করবোনা।
শোভনের মা বলে উঠলো,
‘ সেটা আমার ইচ্ছা, তুই কথা বলার কেরে?
শোভন সাথে সাথে আবার দরজা বন্ধ করে চলে গেলো।
মেহুল দুদিকেই বোকার মতো তাকিয়ে আছে।
লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার
তার বিকল্পে ৩
‘ আচ্ছা তোমার বিয়ে হয়েছে?
মেহুল একটু নড়েচড়ে বললো,
‘ না আন্টি। আসলে..
মেহুল বিস্তারিত বলতে যাবে তখনি শোভনের মা বললো,
‘ শোনো মা তোমাকে একটা কথা বলি, আজকাল মানুষকে বিশ্বাস করাটা ভীষণ কঠিন। হারাম সম্পর্কে ডুবে থেকে তার থেকে সেরাটা আশা করা যায়না। সে কেবল কষ্টই দিবে, তার চেয়ে ভালো বিয়ে করে নাও।
মেহুল বুঝতে পারছেনা তারা মা ছেলে তার সম্পর্কে নিজেরাই কেন নিজেদের মতো বলছে! ব্যপারগুলো তো একদমই এমন নয়। কিন্তু বেয়াদবি হবে ভেবে প্রসঙ্গ থেকে বের হতে চাইলোনা, থাক বলুক৷ অন্য সময় হলে মেহুল এভাবে নিজের সম্পর্কে ভুলভাল কথাকে গ্রহণ করতোনা, পাল্টা জবাব কিছু একটা দিয়েই সরে যেতো। কিন্তু এখানে সে পারছেনা। মহিলাটা তার মায়ের চেয়েও বৃদ্ধ, কতো সরল! সে সুইসাইড করতে যাচ্ছিলো ভেবে এতকিছু বুঝানোর চেষ্টা করছে। শোভনের মা খাবারের প্যাকেট খুলতে খুলতে বললো,
‘ আচ্ছা তোমার নাম কি মা? কে কে আছে পরিবারে?
‘ মেহুল সুলতানা। আমার পরিবারে আমার মা-বাবা আর ছয়বোন ছিলো, যাদের সবারই বিয়ে হয়ে গেছে। বাড়িতে কেবল মা-বাবা আছেন।
‘ তোমার স্বপ্ন কি? কি করতে চাও জীবনে?
মেহুল একটু ভাবলো। কাল পর্যন্তও তো তার স্বপ্ন ছিলো বিয়ে করা। সে তড়িঘড়ি করে বললো,
‘ ইউনিভার্সিটি শেষ হলেই দেশের বাইরে চলে যাওয়া।
‘ তোমার দেশে থাকার ইচ্ছে নেই কি বলো?
‘ না না আন্টি, ইচ্ছে আছে। উচ্চশিক্ষা লাভ করে প্রফেশনের উপর ভিত্তি করে যেখানে থাকার থাকবো আরকি!
‘ না না দেশের বাইরে যাওয়ারই দরকার নেই। দেশেই ভালো শিক্ষা ব্যবস্থা আছে। এখানেই পড়ালেখা শেষ করো, প্রয়োজনে বিয়ে করে ফেলো। এরপর পড়াশোনা সংসার দুটোই করো।
মেহুল ইতস্তত হলো। কোনো জবাব দিলোনা আর। এর মধ্যে শোভন দরজা খুলে বললো,
‘ মা আমি বাইরে একটা সীট ম্যনেজ করেছি। তোমরা থাকো, আমি আছি। প্রয়োজনে ফোন দিও।
‘ সেকি শোভন তুমি বাইরে থাকবে কেন? মেহুলের কোনো সমস্যা হবেনা, বসো এখানেই। সামনের এতো বড় সীট খালি আছে। আসো ভেতরে আসো।
মেহুল সাথে সাথে বললো,
‘ হ্যাঁ আমার কোনো সমস্যা নাই।
শোভন থুতনিতে হাত বুলাতে বুলাতে বললো,
‘ তাহলে আমি টিটিইকে বলে দিয়ে আসি।
শোভনের মা মেহুলকে খেতে বলে নিজের ফোনের এলবাম খুললো,তারপর খেতে খেতে মেহুলকে দেখাতে লাগলো,
‘ দেখো এটা আমার ছোট ভাই ভাবি, আর এটা হলো তার বড় ছেলে। কয়েকমাস আগে আমরা সবাই তার বিয়েতে গিয়েছিলাম। সেখানে এই মেয়েটাকে আমার ভীষণ ভালো লেগেছিলো।
বলে একটা গ্রুপ ছবির অনেক পেছনে একটা ছবি জুম করে মেহুলকে দেখালো। মেহুল দেখলো মেয়েটা বেশ সুন্দরী। তারপর শোভনের মা বলতে লাগলো,
‘ আমি আমার ছেলেকে দেখিয়েছি, বলেছি মেয়েটাকে আমার খুব ভালো লেগেছে দেখ তোর কেমন লাগে! শোভন আমাকে পাত্তাই দেয়নি। কিছুদিন পরে বুঝলাম পাত্তা না দেওয়ার কারণ। মেয়েটা ফেইসবুকে প্রেম করে এক ছেলের সাথে পালিয়ে গেলো। সেই ছেলে নাকি তাকে বরিশাল নিয়ে গিয়ে কিছু একটা বলে এক জায়গা বসিয়ে রেখে উধাও হয়ে গেছে। মেয়ের মোবাইল ব্যাগ,টাকাপয়সাও সব নিয়ে গেছে৷ পরে সেই মেয়ে নাকি গলায় ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলো, এলাকার লোকজন ধরে খোঁজ খবর নিয়ে তাকে বাড়িতে ফিরিয়ে দিয়ে গেছে। জানো দুই সপ্তাহ আগে মেয়েটার বিয়েও হয়েছে। তার জামাই তাকে নিয়ে নাকি ফ্রান্স চলে যাবে। এখন জামাইয়ের সাথে মেয়েটা কি যে খুশি! এই দেখো তাদের বিয়ের পরের ছবি। বুঝলে কিছু খারাপ সময় ধৈর্য নিয়ে পার করলেই সুখ দল বেঁধে আসে।
মেহুল উঁকি দিয়ে ছবিগুলো দেখার মধ্যেই শোভন প্রবেশ করে বললো,
‘ মা তুমি কি রাজ্যের কথা একেবারে শেষ করে ফেলছো নাকি?
‘ আরেনা, আমি সোনিয়ার ছবি দেখাচ্ছিলাম। সোনিয়াও তো আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলো, মেয়েটা কি এখন ভালো আছেনা বল?
‘ হ্যাঁ আছে, কারণ তার ভালো একজনের সাথে বিয়ে হয়েছে।
তখনি শোভনের মা বলে উঠলো,
‘ এই মেহুল তুমি বিয়ে করবে? আমার ছোট ভাইয়ের মেঝো ছেলেটা খুব লক্ষী। তারা বড় ভাইয়ের পরে মেঝোটার জন্যও বউ খুঁজছে!
মেহুলের মাথা ভনভন করছে। তার বলতে ইচ্ছে করছে,
‘ আপনারা অহেতুক কথা থামান! আমি বিয়েসাদী করবোনা, এই শব্দটাই ভালো লাগছেনা!
কিন্তু তার কিছু বলার আগেই আবার শোভনের মা বললো,
‘ মেহুল কিন্তু দেখতে ভারী মিষ্টি। সাইদ পছন্দ করবে নিশ্চিত।
শোভন মোবাইলের স্ক্রিনে চোখ রেখে বললো,
‘ আমিও করেছি।
কিছু একটা বলার জন্য মুখ খুলেও শোভনের মা ছেলের কথা শুনে থেমে গেলো। মেহুলের দিকে সাথে সাথে নজর করে দেখলো মেহুলের প্রতিক্রিয়া শূন্য। সাথে সাথে মেহুলকে ঝাঁকিয়ে বললো,
‘ মেহুল শুনেছো শোভন কি বলেছে? তোমাকে ওর ভালো লেগেছে। আমার ছেলে কতো বছর আগে এক সুস্মিতাকে ভালোবেসেছিলো, এখনো পর্যন্ত তাকে আর কোনো মেয়ের দিকে দৃষ্টি দেওয়াতে পারিনি। আমার ছেলে তোমাকে পছন্দ করলে আমি তোমাকেই….
‘ আন্টি কাল আমার বিয়ের তারিখ।
মেহুলের এই সহজ উত্তরটা শোভনের মার চেহেরাটাকে মূহুর্তেই বিমর্ষ করে দিলো। অসমাপ্ত কথাটা আর সমাপ্ত হওয়ার প্রয়োজনবোধ করলোনা। শোভনও মেহুলের দিকে তাকিয়ে আছে। মেহুল ইচ্ছে করেই বলেছে! কাল বিয়ের তারিখ বলে তাদেরকে সেখানেই থামাতে চাচ্ছে, কিন্তু মেহুল এই মূহুর্তে কোনোভাবেই বিয়ে করবেনা। শুধু সবাইকে থামানোর যুদ্ধ করতে হবে। শোভনের মা ধীরে ধীরে মেহুলের মাথায় হাত রেখে বললো,
‘ মা আমি তোমার মনের অবস্থা বুঝতে পারছি। দেখো নিজের অমতে কিছু করা উচিত নয়। তুমি আরেকটু ভাবো মা।
মেহুল ব্যাগটা হাতে নিয়ে বললো,
‘ আসলে আমার মা-বাবা আমার অনিচ্ছায় বিয়ে ঠিক করেনি। দোয়া করবেন আমার জন্য, আমি এখানে নেমে যাবো।
একটা অচেনা স্টেশনে ট্রেন থেমেছে মিনিটখানেক হলো। মেহুল দ্রুত পায়ে বের হওয়ার সময় পেছনে পেছনে শোভনও উঠে এলো। মেহুল নেমে যাওয়ার জন্য দরজায় কাছে পৌঁছাতেই উদয় তার সামনে পড়ে গেলো, তাকে দেখেই বললো,
‘ রাত বাজে সাড়ে বারোটা। অচেনা স্টেশনে একটা পুরুষ মানুষও নেমে যাওয়ার সাহস করতোনা। আপনি সত্যিই যে কি আল্লাহ মালুম!
মেহুল একদম কিছুতে কর্ণপাত করলোনা। তাড়াহুড়ো করে নেমে এক দৌঁড়ে স্টেশনের ভেতরে চলে গেলো। দুই মিনিট পর ট্রেন ছেড়ে দিলো, ছেড়ে দেওয়ার সময় মেহুল আড়াল থেকে ট্রেনের চলে যাওয়াকে লক্ষ্য করতে লাগলো। তারপর যখন বুঝলো গোটা একটা ট্রেনের সাথে তার সব অস্বস্তির বিদায় হয়েছে তখন একটা লম্বা নিঃশ্বাস ছাড়লো। তারপর মেহুল ট্রেনের সময়সূচীতে নজর দিলো, দেখলো ফিরে যাওয়ার জন্য একটা ট্রেন আছে, যেটা ভোর চারটায়৷ অন্যভাবে যেতেও তার চার-পাঁচ ঘন্টা লাগবে, যা আবার একটু রিস্কি। তাই সে ভেবে উঠতে পারছেনা কি করবে!
স্টেশনের আশেপাশে এখনো অনেক মানুষ। বসার জায়গায় অনেকেই ঘুমিয়ে আছে, মেঝেতেও অনেক পথশিশু কিংবা বাসস্থানহীন মানুষরা ঘুমুচ্ছে।
মেহুল ধীরে ধীরে তাদেরই কাছে গেলো। দেখলো মশার কামড়ে তারা অনেক নড়াচড়া করছে। মেহুল ব্যাগটা রেখে বসলো, এখানে তিন ঘন্টার মতো সময় তো না ঘুমিয়ে অনায়েসে কাটাতে পারবে।
তার বসাকে খেয়াল করে শুয়ে থাকা একজন মাথা তুলে বললো,
‘ আফা আফনে এইহানে থাকতে ফারবেন? হোটেলে যানগা।
মেহুল হেসে বললো,
‘ তোমরা সবসময় পারো, আমি কেন একদিন পারবোনা?
মহিলাটা নিজের বাচ্চাদের দিকে নজর দিয়ে আবার শুতে শুতে বললো,
‘ আইচ্ছা ফারলে থাহেন।
মেহুল ব্যাগটা কোলে তুলে দুই হাঁটুতে কপাল ঠেকিয়ে ভাবতে লাগলো সেই দুইটা মানুষ তার আচরণে কষ্ট পায়নি তো? তারা তো সর্বস্বটা দিয়ে তার পাশে থাকতে চেয়েছিলো। মানুষ যা চায় তা নাহয় পায়না, কিন্তু যা পায় তাকে অবহেলা করাটাও তো উচিত নয়। তার সারা জীবনে কেউই তো তাকে এভাবে সুন্দর বলে অমায়িকতার সাথে অভিহিত করেনি। হয়তো কখনো তার সৌন্দর্যটা কারো চোখে পড়েনি!
তারা কি সত্যিই মেহুলের জন্য মঙ্গল ছিলো? আল্লাহর ইচ্ছেতেই কিনা এই আকস্মিক পরিচয়? তারপর আবারও নিজের এই ভাবনাটা পাল্টালো, নাহ এসব ভেবে কি লাভ? সে তো এই মূহুর্তে জীবনকে আর পরিবর্তন করার কথা ভাব্বেনা! এভাবেই চালিয়ে নিবে যতদূর পারে। বিয়ে জিনিসটা তার জন্য নয়!
হঠাৎ তার মাথায় কেউ হাত রাখলো। মেহুল সাথে সাথে মাথা তুলে দেখলো তার সামনে সেই মহিলা বসে আছে, পেছনে তার ছেলে। সে থতমত করে বললো,
‘ আ’আ’আপনি,আপনারা?
মাথায় দেওয়া হাতটা মেহুলের এলোমেলো চুলগুলোকে পেছনে সরাতে ব্যস্ত। মেহুল দেখলো বৃদ্ধ মানুষটার চোখে পানি। মেহুল বুঝে উঠতে পারছেনা তারা কখন, কেন এভাবে নেমে গেলো! দুইজনের কেউ কিছু বলছেনা বলে মেহুল আবার বললো,
‘ আপনাদের তো এখানে নামার কথা ছিলোনা।
থরথরে কাঁপা গলায় শোভনের মা বলতে লাগলো,
‘ তোমার পেছন পেছন দরজার সামনে আমি আসার পর ওখানে একটা ছেলে হাসতে হাসতে শোভনকে বলছিলো, ভাই জানেন আমার বাবা মা আস্ত একটা বেডার সাথে আমার বিয়ে ঠিক করেছিলো, রাতবেরাতে যেভাবে চলাফেরা করে, মনে হয়না আশেপাশের কোনো মেয়েছেলের সাথে শোয়া বাদ আছে। তার উপর আজকে আমার কপাল খারাপ, বারবার এরেই সামনে দেখতেছি। দেখেন মধ্যরাতে কীভাবে নেমে গেলো আবার!
আরো কি কি যেন বলছিলো, আর কিছু না শুনে তখনি আমার ছেলেকে বললাম আমি নেমে যাচ্ছি তুই ব্যাগ দুইটা নিয়ে তাড়াতাড়ি নাম৷
বলেই শোভনের মা মেহুলের চোখবেয়ে আসা পানিকে ঠোঁট পর্যন্ত পৌঁছানোর আগে আঁচল দিয়ে মুছে দিলো।
মেহুল কাঁদতে কাঁদতে বললো,
‘ এসব শুনেও তাহলে কেন নামলেন?
‘ কারণ আমি এই বেডা সম্বোধিত মানুষটাকে নিজ হাতে আমার মেয়ে বানাবো! ওখাবে আমি এতকিছু বললাম,তুমি একবারও আমার কথাকে আটকালেনা, বললেনা যে আমি সঠিক আন্দাজ করিনি। তার উপর শেষ পর্যন্ত বলে এলে তোমার কাল বিয়ে! আরে মা বিয়ে কীভাবে হবে? বর-ই তো নেই! কেন জেদ করো? আমার ছেলে খুব ভালো বিশ্বাস করো! যে তার মাকে ছাড়া তার একটা সিঙ্গেল ছুটি কাটায়না, সে তার বউকে কেমন রাখবে বুঝতে পারো? সে তোমাকে অনেক পছন্দ করেছে। তুমি যদি রাজী হও আমরা দুজন তোমার সাথে তোমার বাড়ি যাচ্ছি, কালকে তোমার বিয়ের তারিখেই বিয়ে হবে। কিন্তু সেটা আমার ছেলের সাথে হবে!
মেহুল কেবল কাঁদছে! অন্তত এই মানুষটাকে ফিরিয়ে দেওয়ার সাধ্য তার নাই।
আল্লাহ উত্তম কিছু পাইয়ে দিতে বহু উছিলা করেন, যা আশা করা যায়না, ভাবা যায়না, কল্পনায়ও আসেনা। দুনিয়ার সব ভুল কিছুরই বিকল্প থাকে। এই যে, যা ভুল হওয়ার ছিলো তা পাল্টে কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে তার বিকল্পে সঠিকটার উপস্থিতি! মেহুল কিংবা শোভন দুজনের কেউ কি তা আগে ভাবতে পেরেছিলো?!
(সমাপ্ত)
লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার