#এক কাপ চা.
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
#পর্বঃ৪২
(২০৫)
তাশদীদ দুই হাতে সাগরিকা এবং তাজবীদের কান ধরে আছে। সাগরিকা ব্যথা পাওয়ার ভঙ্গি করলে তার দিকে চোখ কটমট করে তাকালো সে।
কান ছাড়িয়ে নিয়ে মেয়েটা সীমার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।তাশদীদ তখনো ভাইয়ের কান ছাড়েনি বরঙ আরো শক্ত হাতে ধরে সীমাকে বলল,
“কান মলা খাওয়ার ভাগীদার তো তুমিও কিন্তু আফসোস পারছি না।”
তাশদীদের এহেন কথায় সাগরিকা তার দিকে সীমাকে ঠেলে দিয়ে বলল,
“কাছে এনে দিয়েছি এবার দেন। জোরে দিবেন, আপনি চাইলে ওর চুলেও ধরতে পারেন। ও কিছু বলবে না। তাই না রে বান্ধবী?”
সীমা বিস্ময় চোখে তাকিয়ে আছে তাশদীদের দিকে। তাদের এত কঠিন পরিকল্পনা তাশদীদের কাছে ধরা পড়ে যাবে এটা ভাবতে পারেনি।রেস্তোরাঁয় বসে তাজবিদ বার কয়েক তার ভাইয়ের কাছে মাফ চাইলো।সে যখন জানতে চাইলো যে এমন পরিকল্পনা কার ছিল তখন তাজবিদের নিশ্চুপ থাকাটা তার সন্দেহকে আরো বাড়িয়ে তুলল।তাজবীদ কে সীমার পাশে বসতে বলে সাগরিকাকে নিজের কাছে এনে বলল,
“এবার এটা যেন না শুনি এই সবের পিছনে তোর বুদ্ধি!”
সাগরিকা উপর নিচ মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানালো।সীমা কখনো অন্তঃসত্ত্বা ছিলোই না।এমনকি তাদের বিয়েও হয়নি।তাজবিদ গ্রামে থাকা কালীন সময়ে তার মা কে একবার সীমার কথা বলেছিল কিন্তু তার মা সরাসরি না করে দেয়।এক দিকে সীমার পরিবারে বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে অন্য দিকে তাজবিদের মন খারাপ দেখে এই বুদ্ধি বের করেছিল সাগরিকা।সে এহেন আচরণ করে কারণ বিগত কয়েক দিনে তাজবিদের মা সাগরিকার না কে নিজের হ্যাঁ বলছিল।তারা ৫০ /৫০ চান্স ধরে নিয়ে একটা গল্প তৈরী করে ফেলে।এসব কিছুর কিছুই জানে না সীমার পরিবার।তারা জানে সাগরিকার মন ভালো না আর সামনে পরীক্ষা বলেই সীমা এই বাসায় আছে৷ এদিকে পুরো পরিবার সীমার পরিবারের সাথে যোগাযোগ করতে চাইলেও তাজবিদ কিংবা লোকচক্ষুর আড়ালে সাগরিকা করতে দেয়নি।
কিন্তু সমস্যা ছিল তাশদীদ। সে কোনো ভাবেই তাদের এই প্ল্যান কাজ করতো না।তাই সাগরিকার বুদ্ধিতে তাজবিদ ওই ম্যাসেজ করে। যেহেতু তাশদীদের বাচ্চা ছেলে মেয়ে পছন্দ,নিশ্চয়ই সে সীমাকে কিছু বলবে না।
“আর তুই ওর কথা মেনে নিলি?”
তাজবিদ আমতা আমতা করে বলল,
“আসলে ভাই হয়েছে কি?আমি সীমার কথা ভেবে না করতে পারিনি। আর দেখ আমাদের প্ল্যান কাজ করেছে। মা কিন্তু মেনে নিয়েছে। তাছাড়া সীমার প্রতি সাগরিকার জেদ, রাগ সব কিছুই বাস্তব মেনে নিয়েছে মা।”
“তোরা কি পাগল না কি?এসব লুকিয়ে থাকবে?বাচ্চাদের বুদ্ধি দিয়ে এসব করে ফেললি?আর সাগরিকা তুই?পুরো বাড়ির মানুষ তোর উপর বিরক্ত হয়ে উঠেছে। বাবা অবধি বিরক্ত তোর রাগে।”
“আপনি ওদের বিয়ের ব্যবস্থা করে দিন।কথা দিচ্ছি আর এমন করবো না।”
আজ অবধি সাগরিকার কথা তাশদীদ খুব একটা রেখেছে বলে মনে পড়ে না তার৷ অথচ আজ সে রাখলো, বিষয়টা গোপন রেখেই সীমার পরিবারের সাথে কথা বলল।তাদের পরিবারে মাত্র চার জন মানুষ। সীমার বাবা-মা আর তারা দুই ভাই বোন।ভাই ছোটো, সীমার বাবা বিয়েতে সম্মতি দিলে তৎক্ষনাৎ কাজী ডেকে বিয়ের ব্যবস্থা করলেন তিনি।তাশদীদ একা এসব করেছে এমন নয়, রাশেদ, মুনির,সাগরিকার বাবা এসেছিলেন।তারা এসে বিয়ের প্রস্তাব দিলে সীমার বাবা না করেননি।
সাগরিকা যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো।একটা তুলতুলে অনুভূতি হচ্ছে তার। মনে হচ্ছে সে মন খুলে শ্বাস নিতে পারছে।
সকল কাজ শেষ করে হাসপাতাল যাওয়ার পথে সাগরিকার মাথা যেন হুট করে কাজ করা শুরু করেছে। তার হঠাৎ মনে হলো তাশদীদ এসব জানলো কী করে? তারা কখনো এই বিষয়ে বাড়িতে কথা বলেনি, এমনকি সীমা এই বাড়িতে আসার দিন সাতেক আগ থেকে এই বিষয়ে কথা বলে না তারা।
ভ্রু-বিলাস করে সাগরিকা তার স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলল,
“আপনি কী করে জানলেন এসব?”
“কী সব?”
“এই যে এই সব।মানে সীমার ব্যাপার?”
“কেন তুই নিজেই তো বলেছিস।”
“কবে?কখন?”
“গতকাল রাতে, ঘুমের ঘোরে কিছু বিড়বিড় করছিলি। জিজ্ঞেস করাতে সব বলে দিয়েছিস।”
হতভম্ব হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল মেয়েটা। দুটো ফাঁকা ঢোক গিলে বলল,
“আর কী বলেছি?”
“এত ভালোবাসিস আমায় যে তোর মাঝেমধ্যে ইচ্ছে করে আমাকে ব্যাগের ভিতর ঢুকিয়ে রাখতে।”
এবার মেয়েটার বিশ্বাস হলো সে ঘুমের ঘোরে সত্যি এসব বলেছে। কারণ তার মাঝেমধ্যে বড্ড ইচ্ছে করে তাশদীদকে একটা ব্যাগের ভিতর ঢুকিয়ে রাখতে যাতে কেউ দেখতে না পারে।
(২০৬)
হাসপাতালে ওয়েটিং রুমে বসে বসে ধৈর্যের প্রহর গুনছে সাগরিকা। তার হাতের চুড়ি বার বার খুলছে আর পড়ছে। দাদীর জন্য অধীর আগ্রহে তার অপেক্ষা কোনো দিন অপেক্ষা করেনি সে।মাঝেমধ্যে রাগের বশে সে অনেক বাজে কথা শোনালেও আজ তার দাদীকে খুব ভালোবাসতে ইচ্ছে করছে৷ তাশদীদ বিল পে করে তার পাশে এসে বসলো।তাকে তাগাদা দিয়ে সাগরিকা বলল,
“আর কতক্ষণ?”
“বেরিয়ে এলো বলে।”
“তবে আমরা এখানে কেন? যাই নিয়ে আসি?”
“জুলি খালা আছে। তাছাড়া স্টাফরাই নামিয়ে দিয়ে যাবে। অযথা ভীড় করে অন্য রোগীদের বিরক্ত করা উচিৎ হবে না।”
এমন কথায় প্রচন্ড বিরক্ত হলো সাগরিকা।কণ্ঠে বিরক্তি নিয়ে বলল,
“এটা কেমন কথা? এক জন অসুস্থ মানুষ। বাড়ি যাচ্ছে কত দিন পর আর আপনি?”
“আজ কী হয়েছে বল তো?ভাতের সাথে কিছু খেয়েছিস না কী?”
সাগরিকা দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। লিফটের দিকে তাকিয়ে উদাস ভঙ্গিতে বলল,
“আজ ভাত খাইনি।সময় কোথায় পেলাম?”
(২০৭)
বাড়ির প্রবীণ মানুষ মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসায় সবার মুখেই হাসি। তবে ইখুম তাদের থেকে কিছুটা দূরেই রয়েছে। শাশুড়ি বসে আছে ড্রয়িং রুমে। জুলি খালা আপাতত রান্না ঘরে। তার চাচার শালার ভাইয়ের মেয়ের জামাই কল দিয়েছে।তার সাথে কথা বলছে সে। রান্নাঘর কিছুটা ফাঁকা পেতেই সে কিছুটা রাগত স্বরে বলল,
“কি নষ্ট করছিস তোরা?ওরা আজ বুড়িকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এলো কীভাবে?কতবার বললাম? ছোটো লোকের বাচ্চা, আমি কী টাকা কম দিয়েছি?”
অপর পাশ থেকে কী বলল বুঝা গেল না।ফোনে কথা শেষ করে পিছন ফিরে চাইতেই দেখতে পেল স্নেহা দাঁড়িয়ে আছে। নিশ্চয়ই সে সব কথা শুনেছে।এর আগেও একবার এমন করে কথা শুনেছিল সে। এর জন্য অনেক কাঠ কয়লা পুড়াতে হয়েছে জুলিকে। টাকাও খরচ হয়েছে অনেক।কিন্তু এই বার সে কী করবে?
স্নেহা কিছু বলল না, তাকে ডাক দিতেই সে বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে।
বাড়ি ফেরার পর শাশুড়ীর প্রতি সব থেকে যার বেশি মায়া হতে লাগলো সে হলো তাজবিদের মা।সাগরিকার মা কিংবা সামিনা যতটা প্রয়োজন ততটা করছে।ইখুম দূরে দূরেই থাকছে। সে চাইছে না কোনো কথা হোক কিন্তু তাজবিদের মা আসার পর থেকে কান্নাকাটি করেই চলেছে। বাড়িতে আসার পরেই সে সীমার হাত ধরে নিয়ে শাশুড়ির সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো।আঁচলে বারবার চোখ মুছতে ব্যস্ত। তার চোখের পানি দেখে বিরক্ত লাগছিল সাগরিকার মা।স্নেহা এসে দাদীর পাশে বসলো।তার দাদী প্রথম যে কথাটা বলল তা হলো,
“আমার রাশেদের পোলা কই?ওরে আনো তো চিনহা বু। আমার বাবার পোলারে আনো।”
ইখুমের কোল থেকে ছেলেকে নিয়ে তার কোলে দিলো সাগরিকার মা।বৃদ্ধা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন বাচ্চার দিকে।
কান্নায় দুচোখ বুজে এলো তার। বাচ্চাকে কোল থেকে নিয়ে তাজবিদের মা এক গ্লাস হলুদ মেশানো দুধ এগিয়ে দিলো তার দিকে।আবেগী সুরে শাশুড়ীকে বলল,
“আম্মা আপনার কষ্ট এখন আমি বুঝি।থাক বাদ দেন।পোলারা খুশি হইলেই হয়।নেন দুধটা।”
বৃদ্ধা তার দিকে তাকিয়ে দুধ হাতে নিলেন।এক চুমুক খেয়েই মুখ থেকে বের করে দিলেন। পুরো দুধের গ্লাস ফ্লোরে ফেলে দিয়ে বললেন,
“তুই কী আমাকে মারতে চাইছিস?কি খাওয়ালি? আমার অন্তর পুইড়া যাইতেছে।”
দাদীর এমন কথায় সবাই অবাক হলেও তার মুখের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট টিপে হাসছে সাগরিকা।কারণ শাশুড়ির ও শাশুড়ি থাকে।
চলবে ….