# রেহানা
ছেলে ও ছেলের বউয়ের সংগে কক্সবাজার ঘুরতে এসেছি, জীবনে এই প্রথম। আসতে চাইনি আমি। কেমন বাধো বাধো ঠেকছিল, ছেলে বউয়ের সংগে ঘুরতে যাব! কিন্তু ছেলে নাছোড়বান্দা। আমাকে নিয়ে যাবেই। বউমা আরও এক ডিগ্রী উপরে,
ঃ আপনি যাচ্ছেন ব্যাস আমাদের সাথে। কোন কথা নেই। কি কি নেবেন ব্যাগ গুছান, নয়তো আমি গুছিয়ে দেই।’
রাতে ঘুমানোর আগে বউমা এসে বললো,
ঃ মা, দুএকটি সিল্কের জামা নেবেন। সমুদ্রে নামবেন তো। সুতির জামা পরলে গায়ের মধ্যে বালু আটকে যাবে। তাছাড়া সিল্কের জামা ধুতে সুবিধা হবে।’
ঃ কি! আমিও সমুদ্রে নামবো!
ঃ হ্যা, নামবেন। আমাদের সাথে নামবেন। আপনার কত দিনের শখ সমুদ্র দেখার। ভাল করে ঘুরে সব উপভোগ করে আসবেন।’
কক্সবাজারে হোটেলে খাবার খেতে বসে আমি বললাম,
ঃ হ্যা রে মঈন, এই যে তিনটি রূপচাঁদা মাছ নিয়েছিস, রূপচাঁদা মাছের অনেক দাম না রে!
ঃহ্যা মা,তা তো হবেই। অন্য মাছের চেয়ে দাম একটু বেশি।
ঃ তাহলে এক কাজ কর্। আমার জন্য একটা রুই মাছ ফ্রাই নে।
ঃ মা তুমি খাও তো। তোমার এতো টাকার চিন্তা করতে হবে না।
ঃ না, আমি রূপচাঁদা মাছ বেশি পছন্দ করি না। আমার ভাল লাগে না।
বউমা পাশ দিয়ে বলে উঠল,
ঃ পছন্দ না করলেও আপনার খেতে হবে মা। আমরা সবাই একরকম খাব।
এই হচ্ছে আমার বউমা। ছেলের চেয়ে বউমা ই গল্প করে বেশি। আমার বান্ধবী। খবরদারিও করে খুব। সেটা আমি উপভোগ করি খুব।
আমি রেহানা আক্তার। প্রায় ক্লাসেই দু’একবার করে ফেল করে করে নবম শ্রেণি পযর্ন্ত উঠেছি। তখনই আমার বয়স একুশ। আমার আর অন্য সাত ভাই-বোনরা পড়াশুনায় ভাল। আমারই কেন যেন মাথা নেই। নবম শ্রেণিতে আবারও ফেল করায় আমার মধ্যবিত্ত বাবা বললেন,
ঃতোর আর পড়াশুনায় কোন কাজ নেই।
ঃতুই ঘরে থাক্।
আমার আগে পরে আরও ভাই-বোন আছে। তাদের পড়াশুনার খরচ আছে। পড়াশুনা আমার বন্ধ হয়ে গেল। আমি ঘরকন্নার কাজ, রান্নাবান্না শুরু করলাম। করলাম কি! আমাকে দিয়ে করানো হতো। ধীরে ধীরে আমি খেয়াল করলাম, আমার উপরে দায়িত্ব বেড়ে গ্যাছে। দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়া হতো। বাবা, বড় ভাইবোনেরা আমার সংগে খারাপ ব্যবহার করতে শুরু করলো। এমনকি ছোট ভাইবোনেরাও আমার উপরে খবরদারি,হুকুম, তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতো। শুধু মা একা আমাকে ভালবাসতেন।
ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে, এর মধ্যে আমার মায়ের ক্যান্সার ধরা পড়ে। প্রথম প্রথম আমার মায়ের চিকিৎসা হয়েছিল। শেষের দিকে বাবার পক্ষে আর সম্ভব হয়নি চিকিৎসা চালিয়ে নেয়া। ডাক্তার তিন মাস সময় দিয়েছে। আমার কাজ আরও বেড়ে গ্যাছে। মায়ের সেবা করা, মাকে দেখতে আসা মেহমানদের আপ্যায়ন করা, ঘরের সমস্ত কাজ করা— সব আমার। বাড়তি উপরি দুর্ব্যবহার। আমার মা সবসময় কাঁদতেন আর আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করতেন
ঃ দেখিস, তোর ভাল হবে। তোর ভাল হবে। আমি দোয়া করে গেলাম।
তিন মাস হওয়ার ঊনিশ দিন আগেই, একদিন সকালে প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে আমার মা মারা গেলেন। আমি আরও কোণঠাসা হয়ে পড়লাম। পুরোদস্তুর একজন কাজের মেয়ে।
পাশের বাসার এক মুরুব্বি, যিনি আমার মায়ের সঙ্গে এসে প্রায়ই গল্প করতেন। তিনি বিষয়টি খেয়াল করে, যেন আমার উদ্ধারকর্তা হয়ে আসলেন। তিনি আমার জন্যে একটি বিয়ের প্রস্তাব এনেছেন। ছেলে বিপত্নীক, বয়স্ক, দুটি বাচ্চা আছে। তাদের মা দরকার। দোকান আছে। ঘর সংসারের কাজে পটু একজন মেয়ে চান। আমি দু’দিন শুধু কেঁদেছি কিন্তু কাউকে কিছু বলতে সাহস করি নাই। কারণ আমার কথা কেউ শুনবে না। ঘরোয়া পরিবেশে, অল্প খরচে আমার বিয়ে হয়ে গেল।
বাসররাতে ঘরে ঢুকে আমার স্বামী ‘রেহানা’ বলে ডাক দিল। আমার মনে হচ্ছিল আমার সমস্ত শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গ্যাছে। এতো ভারী, ঠাণ্ডা অথচ স্নেহময়, মায়াভরা কণ্ঠ, আমি এর আগে কোন পুরুষের শুনিনি। আমি আমার বাবার দাম্ভিক হুংকার শুনেছি মায়ের সঙ্গে এবং আমার সঙ্গে। তাছাড়া আমার নাম ‘রেহানা’ কেউ পুরো ডাকতো না। ‘রেউন্না’ ‘রিউন্না’ ‘রেন্না’ এভাবে ডাকতো। তিনি আচমকা আমার হাত দুটি ধরে বললেন,
ঃ রেহানা, তোমার কাছে আমি কিচ্ছু চাই না। আমার বাচ্চা দুটোকে একটু ভালবেসো, যত্ন নিও। আমাকে তোমার ভালবাসতে হবে না। আমি কোনদিন তোমার কাছে ভালবাসার দাবী করবো না। আমার বাচ্চা দুটোকে আদর করো’ বলে তিনি কাঁদতে শুরু করলেন। আমিও কাঁদছি। আমরা দু’জন হাত ধরাধরি করে কাঁদছি। আমাদের দু’জনের কান্না মিলেমিশে এক হয়ে গেল। দুঃখ ভাগাভাগি করেছি।
শুরু হয়েছে আমার নতুন জীবন। সংসার। আমি সত্যি সত্যিই তাকে ও সন্তানদের ভালবেসেছি। হৃদয়ের পুরোটা দিয়ে। একটুও বাকি রাখিনি। তিনিও আমাকে ভালবেসেছেন। সবচেয়ে ভাল লাগতো আমার প্রতি তার মায়ার দৃষ্টি আর নরম কণ্ঠে ‘রেহানা’ ডাক। এই দৃষ্টি আমি আর কোথাও দেখিনি। ধীরে ধীরে, তার দুটি ছেলে এবং আমার গর্ভে দুটি ছেলে– এই চার ছেলে হলো আমাদের। আমাদের সংসারে প্রচুর টাকা ছিল না। কিন্তু খেয়ে-পরে ভাল থাকা বলতে যা বুঝায়, তা ছিল। কিন্তু সুখ উপচানো ছিল। তিনি প্রায়ই আফসোস করতেন,
ঃতোমাকে নিয়ে কখনও একটু বাইরে ঘুরতে যাওয়া হয় না। একটু সমুদ্র দেখানো, পাহাড় দেখানো, এসব হয় না। আমি মরে গেলে দাবী ছেড়ে দিও।
আমি হাত দিয়ে তার মুখ চেপে ধরি।
সংসার খরচ বাদে আমাদের কোন বাড়তি টাকা থাকতো না। কিন্তু যেখানেই যেতাম,চার সন্তানকে একসাথে করে নিয়ে যেতাম। আর নয়তো না। তার ভালবাসা আমার কাছে ভালবাসা মনে হতো না, স্নেহের মতো লাগতো। তিনিই সন্তানদের শিখিয়েছেন আমাকে সম্মান করতে ও মায়ার দৃষ্টিতে দেখতে। যতদিন বেঁচেছিলেন, আমাকে স্নেহের মতো ভালবাসতেন। বড় ছেলে মঈন তার বাবার পুরোটাই পেয়েছে।
চার দিন কক্সবাজার ঘুরে আমরা ঢাকায় ফিরেছি। ফেরার পথে এসি কোচে আমার ঠান্ডা লাগছিল। আমি আধো ঘুম আধো জাগরণে শুনতে পাচ্ছি মঈন ওর বউকে বলছে,
ঃ দেখ তো, মা বারবার নড়ছে। মায়ের ঠান্ডা লাগছে কিনা?
বউমা ‘দেখছি’ বলে আমার গায়ে একটি চাদর জড়িয়ে দিল। আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।
ঢাকায় ফিরে, ফজর নামাজ পড়ে তন্দ্রার মতো ঘুম আসছে। স্বপ্নে দেখলাম, মঈনের বাবা মুচকি মুচকি হাসছে। সেই স্নেহের মতো ভালবাসা আর মায়া ভরা নরম কণ্ঠে আমার মাথায় হাত বুলালো,
ঃ ছেলের সংগে বুঝি কক্সবাজার ঘুরে এলে! ভাল করেছো। গিয়ে খুব ভাল করেছো।
সকালবেলা ব্যালকনিতে বসে দূরের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। বউমা এসে বললো,
ঃ মা,কি ব্যাপার! এতো সকালে উঠেছেন। মন টন, শরীর খারাপ নাকি আপনার! চা দেবো আপনাকে?
ঃ দাও, মা।
রুমে এসে মঈনের বাবার ছবির উপরে এবার, আমি স্নেহের হাত বুলালাম। দৃষ্টি আদ্র হয়ে ছবিটা ঝাপসা দেখছি