ভাবীর সংসার সিজন ২ পর্ব ৪
পাঁচদিন পরে সাঈদ কে হাসপাতাল থেকে ছুটি দিল, মাইনোর স্ট্রোক হয়েছিল। আর মাথার পিছনের স্টিচ আছে, এটা পরে এসে চেক আপ করতে বলেছে ডাক্তার। এই পাঁচদিন জাহিদ সাথে ছিল।
সাঈদ খুবই দূর্বল হয়ে পড়েছে। যেন বয়স পাঁচ বছর বেড়ে গিয়েছে। জাহিদ এই অবস্থা দেখে সাঈদ কে বললো,
ভাইজান একটা কথা বলি?
– বল
– এখন যদি, আপনি বাড়ীতে চলে যান, ভালো হয়। আমরাও আছি। আর মা ও দেখে শান্তি পাবেন। বাসায় একা থাকবেন, যদি সমস্যা হয়!
সাঈদ বেশ রাগ দেখিয়ে বললেন তোর পরামর্শের জন্য ধন্যবাদ।
– ভাইজান আপনার শরীরের যে অবস্থা এখন!
– শরীর খারাপ এজন্য আমি শহর ছেড়ে গ্রামে চলে যাবো! আর কথা বলিস না!
জাহিদের ও আর কথা বলার ইচ্ছে হয় নি! মাঝে এসে শাহিদ একদিন দেখা করে গিয়েছে, তাতে ভাইজান খুশি না! কিন্তু শাহিদের টানাটানির সংসার, তাই সহজেই এতো টাকা দিয়ে আসা-যাওয়া করতে পারেনা। এই জিনিস টাই সাঊদ বুঝতে চায়না
শারমিন গাড়ীতে উঠেই জাহিদ কে অনেক বকাবকি করছেন, আর বলছেন তোমার আক্কেল এতো কম কেন জাহিদ! এই অবস্থায় কেউ গ্রামে যায়!
জাহিদ তখন বেশ রাগ দেখিয়ে বললো যত্ন হবে এজন্য বলেছি, এই মুহুর্তে ভাইজানের যত্ন দরকার। আমার ও স্কুল আর ছুটি দিবেনা।
– আমি কি যত্ন করিনা?
– ভাবী আমি এতো কথা বলতে চাইনা! আপনারা যা ভালো মনে করেছেন, করেন। আমার সমস্যা নেই।
আবিদের আজ দুই মাস ধরে শুধু সময়ে অসময়ে গলা ব্যাথা হয়। কিছু খেতে গেলেই গলায় মনে হয় আটকে থাকে। কিন্তু ডাক্তারে যেতেই ভয় লাগে। কারণ তার টনসিলের প্রবলেম, গেলেই বলবে সার্জারী। কিন্তু এখন সার্জারী করার সময় নাই। তাছাড়া সার্জারী মানে ছুটি নেওয়া, বিশাল ঝামেলা। স্কুলের এতো বড় দায়িত্ব, সামনে বাচ্চাদের এস.এস.সি পরীক্ষা। তাই, আর এই মুহুর্তে ডাক্তার নিয়ে ভাবছেনা আবিদ। ফার্মেসি থেকে বিভিন্ন ট্যাবলেট এনে এনে খাচ্ছে।
অনেক হিসাব কষে আবিদ চলে, বার বার মনে হয়, আর মাত্র কয়েকদিন। তারপর ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারের গর্বিত বাবা সে! এখন একটু কষ্ট করে চলতে হয়। দুই ছেলে দুই জায়গায়, পলি ঢাকায়। সে চট্টগ্রাম, চার জায়গায় চার ধরনের খরচ! তানিমের বইয়ের অনেক দাম। পলিকে যে টাকা দেওয়া হয়, তাতে তার অনেক কষ্ট হয় চলতে, কিন্তু উপায় নেই। কারণ এই অল্প বেতনেই চলতে হবে। ভাগ্য ভালো ছেলেরা নিজেদের পকেট খরচ চালিয়ে নিতে পারে।
আবিদ দুপুরে স্কুলে স্টাফ রুমে ভাত খায়, এটাই সারাদিনের মূল খাবার। রাতে মেসে সে খায়না, বাইরে গিয়ে চা-পরোটা। নয়তো ডাল-ভর্তা খেয়ে নেয়। আর কিচ্ছু করার নেই। মেসেই রুম ভাড়া চলে যায় সাড়ে চার হাজার টাকা, আবার স্কুলের দুপুরের মিল আসে সাড়ে তিন হাজার টাকা। সকালের নাশতা স্কিপ করলেও রাতে হালকা খাবার খেলেই একশো টাকা চলে যায়! পলিকে দশ/বারো হাজার দিতে হয়। বেতন টা নিতান্ত অল্প! এম.পি.ও ভুক্ত স্কুলের বেতন অতি সামান্য! তাছাড়া প্রধান শিক্ষক হওয়ার পর, টিউশনির সময় পাওয়া যায়না! বাড়তি আয়ের ব্যবস্থা নাই।
এখন সব অভিভাবক ভার্সাটি কিংবা মেডিকেল ছাত্রদের টিউশনিতে প্রাধান্য দেন, তার বয়েসী শিক্ষক দের প্রাধন্য কম। আর তার স্কুলে প্রধান শিক্ষকের ব্যাচ পড়ানো সম্পূর্ণ নিষেধ। এজন্য অনেক হিসাব করেই চলতে হয়।
আবিদের মাঝে মাঝে মনে হয়, পলিকে গলার সমস্যা বলতে, কিন্তু পলি অস্থির হয়ে যাবে সার্জারীর জন্য তাই বলা হয় না!
আবিদ সন্ধ্যার পরে, ভুবন বাবুর ফার্মেসি তে গিয়ে বললো দাদা, আজ ও পরোটা শেষ করতে পারিনি। মনে হয়, কি যেন দলা পাকিয়ে বসে আছে।
– দাদা, আমি আর আপনাকে ঔষুধ দিব না! আপনি ই.এন.টির ভালো ডাক্তার দেখান।
– অনেক দেখিয়েছি, এসব টনসিল, গেলেই বলবে সার্জারী করান, এজন্য আমি যাইনা।
– আমি বার বার বলছি, আপনার গলা কিন্তু ফোলা না! টনসিল হলে অবশ্যই ফুলে যেতো।
– ভুবন দা! আমি ছাত্রদের পরীক্ষা শেষ হলেই ঢাকা যাবো। আপনি আপাতত কিছু দেন। চলি আমি!
– আপনাকে চিনি, আজ পঁচিশ বছর ধরে। আপনি বারবারই নিজের প্রতি অসচেতন।
– না, এইবার ঢাকা গিয়ে সার্জারী করাবো। পরীক্ষা টা শেষ হউক!
কলি বিকাল বেলা, পলিকে ফোন দিয়ে বললো আপা, দুলাভাইয়ের যে, গলায় ব্যাথা তোকে বলেনি?
– টনসিলের সমস্যা! কত বলি সার্জারী করো, শুধু বলবে হ্যা হ্যা করছি।
– এখন অনেক বেড়েছে জানিস?
– কে বললো।
– আজ ফোন দিয়েছিলাম দুপুরে, তখন ভাত খাচ্ছিলো, বললো ব্যাথায় গিলতে পারছেনা। প্রচন্ড ব্যাথা!
– কি বলিস তুই?
– তুই চিন্তা করিস না! ঢাকায় আসতে বল।
– হ্যা, তুই রাখ, পরে কথা বলছি। আমি কিছুই জানিনা, ওকে কল দেই।
– আচ্ছা। রাখছি, চিন্তা করিস না!
পলির সাথে সাথে মনে হলো, আবিদের খারাপ কিছু হয়নি তো! পলি জানে, আবিদ কে যদি সে অসুখের জন্য আসতে বলে, সে কখনোই আসবেনা। তবে, আবিদ বরাবরই বউ-ছেলেদের সামান্য অসুখে উতলা হয়ে যায়!
এজন্য পলি ফোন দিয়ে বললো তার পেটে প্রচন্ড ব্যাথা। মনে হচ্ছে যেন বড় কোন সমস্যা হয়েছে। রাতের ট্রেনেই যেন সে ঢাকা আসে।
নাহিদ আজ সাঈদকে দেখতে বাসায় গেল। এই কয়েকদিনে ছুটি পায়নি।
সাঈদ বললেন তোরা অনেক ব্যস্ত! তাই এক সপ্তাহ পিরে আসলি!
– ভাইজান ছুটি পাইনি। আর এখন তিন দিনের ছুটি পেলাম। তাই, ভাবলাম আপনাকে দেখে, মাকে দেখে যাবো।
– বুঝলাম। তোর বউ কোথায়?
– ও নিজের চাকরি নিয়ে ব্যস্ত। আপনি আমার সাথে বাড়ী চলেন, মায়ের সাথে কয়েকদিন থাকলে ভালো হয়ে যাবেন।
– তোদের বয়স হয়েছে ঠিকই কিন্তু অযৌক্তিক কথা বলা যায়নি।
নাহিদ চুপ করে আছে। থাক, সে তার মতো। অথচ এই জায়গায় পরিচিত কেউ নেই। বিশাল বাসায় দুজন মানুষ একা থাকে। হঠাৎ শরীর অসুস্থ হলে কি হবে, ভাবতেই ভয় লাগে।
ডাক্তার সুমন কুমার সাহা, আবিদ কে ভালো করে দেখে বললেন এটা আপনার টনসিলের সমস্যা না! অন্য সমস্যা! আপনাকে কিছু টেস্ট দিব, দ্রুত করে নিয়ে আসবেন। দেরী করবেন না! তা আপনি এতো দেরী করলেন কেন আসতে?
– না, আমি ভেবেছিলাম হয়তো টনসিল।
– অবহেলায় রোগ কয়েকগুণ বৃদ্ধি পায়। রাত আট্টায় রিপোর্ট দেখিয়ে যাবেন।
– কাল করি?
– নো ওয়ে, আজই।
পলির সারা শরীর ঘেমে গিয়েছে চিন্তায়। কি হলো আবিদের!
অথচ আবিদ বের হয়ে বলছে, কেন যে মিথ্যা কথা বলে আনলে, এখন এক গাদা টেস্ট দিয়ে বলবে, রিপোর্ট নরমাল। চলো বাসায়! কিসের টেস্ট।
– আমি টেস্ট না করিয়ে, রিপোর্ট না দেখিয়ে হাসপাতাল ত্যাগ করবো না! চলো!
আবিদ শেষ পর্যন্ত টেস্ট করাতে রাজি হয়েছে। পলির মনে হচ্ছে এই পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় মানুষ সে। তানিম কে ফোন দিয়ে আসতে বলেছে, যাতে সে ডাক্তার রিপোর্ট দেখার আগে, সে যদি কিছু বলতে পারে!
আবিদের বিভিন্ন টেস্ট হচ্ছে, আর পলির মাথা বেয়ে ঘাম পড়ছে! চিন্তায় সারা শরীর ঘেমে গিয়েছে! কি হলো আবিদের……
চলবে….
আন্নামা চৌধুরী।