ভাবীর সংসার সিজন ২ পর্ব ৭
রাহেলা খানম বেশ কষ্ট করে তিন তলা বেয়ে উঠেছেন, আসার সময় অনেক কিছু বাজার করে এনেছে জাহিদ। নিজের পেনশনের টাকা থেকে দুই হাজার টাকা দিয়েছেন আবিদের হাতে।
আবিদ বার বার বলছে, আম্মা আপনি শুধু দোয়া করেন, আমার আম্মা মারা গিয়েছেন, আপনার দোয়া আমার অনেক কাজে লাগবে! আপনি আমার শ্বাশুড়ি আম্মা।
– তুমি বলবে, আর আমি দোয়া করবো বাবা? আমি সব সময় তোমাদের জন্য দোয়া করি। আল্লাহ তোমাকে সুস্থ করুন। এই টাকা সামান্য কিছু। তুমি ফল খেয়ে নিও।
জলি, রান্নাঘরে এসে বললো তুই অনেক বড়লোক রে পলি! নিজের বাসায় থাকিস। কি বড় বড় রুম।
– এটা কি আমি করেছি? শ্বশুর করে দিয়েছেন, তাই থাকছি রে আপা।
– এইটা কি রে পলি?
– কোন টারে আপা?
– এই যে বাক্স?
– এটা ওভেন। খাবার গরম করে।
– কত দাম এটার?
– আঠারো হাজার।
– ওরে বাপ রে! আজ পর্যন্ত একটা ভালো ফ্রিজ কিনতে পারলাম না! পুরোনো এক ফ্রিজ দিয়ে চলছি। আল্লাহ তোরে অনেক সুখ দিয়েছেন।
– সব তোর ও হবে চিন্তা করিস না। এখন, আবিদের জন্য দোয়া কর আপা!
– তাই তো করছি বনু। চিন্তা করিস না! আল্লাহ ভালো করবো। আমি বেশি সামনে যাইনা, শরম লাগে।
বিকাল বেলা, রাহেলা খানম বাড়ীর উদ্দেশ্য বের হতে গেলে, পলি কিছুতেই রাজী হচ্ছেনা। এতো দিন পর, মা তার বাসায় এসেছেন। এভাবে দিনে এসে দিনে যাবেন।
রাহেলা খানম বললেন, অসুস্থ রোগীর যত্ন কর, আমরা আছি। আসবো! অসুস্থ বাসায় বেশি মানুষ থাক্স ঠিক না!
– তুমি কি আমার পর? আমার মা তুমি।
– আমি এখন শিশু বাচ্চা হয়ে গিয়েছি। নিজের কাপড় টাও মেলতে পারিনা, ঔষুধ আরেকজন রেডি করা লাগে।
– আমি তো আছি গো মা!
– তুই আবিদের যত্ন নেয়। সে এই বাসার বটবৃক্ষ মনে রাখিস।
– মা, আবিদের ভালো রিপোর্টের জন্য দোয়া কর!
পলির চোখে পানি ছলছল করছে, সাথে সাথে জাহিদ ইশারা দিল পলিকে।
রাহেলা খানম বললেন আর কিসের রিপোর্ট?
– ওই আর কি! যেন তাড়াতাড়ি শুকায়।
– কমবে, আল্লাহ কমাবেন।
জাহিদ ইশারা দিয়েছে, কারণ রাহেলা বেগম জানলে, বিরাট সমস্যা! পলি সাথে সাথে বুঝে কথা, বদলে দিয়েছে।
পলি, গাড়ীতে তুলে দিয়ে, জাহিদের কাছে এসে জানালা দিয়ে বলছে, মেজ ভাই দোয়া করিস, আমার চিন্তায় ভালো লাগছেনা।
– তুই এভাবে ভেঙে পরলে হবে পলি? কিচ্ছু হবেনা আবিদ ভাইয়ের, আর আমরা আছি তো!
রাহেলা খানম পিছন থেকে বললেন কি বলে পলি? কান্দে কেন?
– সব বোনেরা বিয়ের পর, ভাইদের বিদায় দিতে কান্দে মা!
– ওহ! আচ্ছা। পলি, কান্দিস না মা! জাহিদ আবার আগামী সপ্তাহে আসবে। দুধ পাঠিয়ে দিব, আবিদ্ম রে দিস। আর আবিদের যত্ন নিস।
– আচ্ছা, মা।
রিপোর্ট দেখছেন ডা. সুমন কুমার সাহা। তিনি ভ্রু কুঁচকে বেশ খানিকক্ষণ মাথা নিচু করে রিপোর্ট দেখছেন।
সামনে উৎসুক চোখে বসে আছে পলি ও তানিম, দুজনেই ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে আছে।
মিসেস আবিদ, রিপোর্ট খুব কিন্তু খারাপ আসেনি, আমি এরচেয়ে ও বেশি খারাপ কিছু ভেবেছিলাম।
– কি হয়েছে উনার।
– তুমিই কি এম.বি.বি.এস পড়ছো?
– জি, আমার এই ছেলে পড়ছে।
– ও কিছুটা বুঝবে, বলি! প্রথমেই বলছি, আপনার শক্ত হতে হবে, মনোবল হারালে হবেনা।
– খারাপ কিছু কি?
– ইয়েস, সামান্য খারাপ। সহজ বাংলায় উনার ক্যান্সার হয়েছে, এটাকে কারসিনোমা বলে। টিউমার টাই ক্যান্সারে রুপ নিয়েছে।
পলির দুচোখ বেয়ে পানি পরছে।
তানিম বললো স্যার কোন স্টেজে আছে?
– এটাই সবচেয়ে ভালো সংবাদ, একদম প্রাইমারী স্টেজে আছে। ক্যামো থেরাপি দিলে, নিরাময় হবে। অথবা রেডিও থেরাপি। তবে, এটা আমি বলতে পারছিনা, কতগুলো ক্যামো বা রেডিও থেরাপি লাগবে। এজন্য আমি ক্যান্দার বিশেষজ্ঞ ডাক্তারকে রেফার করছি।
– উনি কি বাঁচবেন?
– প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। তবে, এখন দ্রুত ট্রিটমেন্ট শুরু করতে হবে। একদম দ্রুত, কোন দেরী করা যাবেনা। যতো দ্রুত ট্রিটমেন্ট শুরু করবেন, উনি ততো দ্রুত ভালো হবেন।
– কত টাকা খরচ হতে পারে?
দিস ইজ দ্যা ফেক্ট, এজন্য আপনাদের লাস্ট আওয়ারে, আসতে বলেছি। কারণ রোগী রেখে কথা বলা যায়না। আমি যখন পড়া শেষ করেছি তখন আমার মা, তাপসী সাহার ক্যান্সার ফোর্থ স্টেজ ছিল।কিন্তু আমি আমার বাবা, মোটেও ভেঙে পড়িনি। বাবা, বলছেন এই যুদ্ধে বাবা জিততেই হবে। আমরা মাকে মুম্বাই টাটা মেমোরিয়াল হসপিটাল নিয়ে গিয়ে টানা তিন মাস থেকে চিকিৎসা করে এসেছি। আজ প্রায় পনেরো বছর হয়ে যাচ্ছে, তিনি ভালো আছেন। কিন্তু আবিদ সাহেবের ইন্ডিয়া যাওয়ার দরকার নেই। ঢাকায় এর চিকিৎসা আছে।
আমি ডাক্তার সাজেস্ট করে দিচ্ছি, দেখান আগে। আর ক্যামো না দিয়ে শুধু রেডিও থেরাপিও দিতে পারেন। একেকবার ২৫/৩০ হাজার টাকা লাগতে পারে। কিন্তু এর আগে অনেক টেস্ট মেডিসিন আছে। আপনি উনাকে সাহস দিবেন। বিলিভ মি, উনি খুব ভালো আছেন। তবে, যদি আরোও মাস দুয়েক আগে আসতেন, সার্জারী করলেই ভালো হয়ে যেতেন।
– উনি নিজের অসুখ কখনো পাত্তা দেন না!
– এটাই যে, ভুল। পরিবারের আর্নিং মেম্বার কে, আগে নিজের খেয়াল বেশি করে রাখতে হয়।
– উনি বাঁচবেন তো?
– প্লিজ! ধৈর্য্য ধরুন। ইয়াং ম্যান, বাবাকে বুঝিয়ে আস্তে ধীরে বলবে। যাতে ভয় ঢুকে না যায়। আর না বলে উপায় নেই কারণ আগামীকালই ক্যান্সার হাসপাতালে যেতে হবে। আমি লিখে দিয়েছি, ডাক্তারের নাম, ঠিকানা। আপনারা দেখা করুন।
পলির পায়ের নিচের মাটি সরে গিয়েছে। এই মরণ ব্যাধি কেন হলো তার আবিদের? সারা জীবন হিসেব কষতে কষতে নিজের অসুখের দিকেই খেয়াল করেনি লোক টা! পলি বের হয়ে, কেঁদেই যাচ্ছে।
তানিম তালহাকে ফোন দিয়ে বলছে, দুই ভাইয়ের মুখ চিন্তায় শুকিয়ে গিয়েছে।
পলি, হাসপাতালে বসেই জাহিদ কে কল দিয়ে জানালো, তার সারা শরীর কাঁপছে। এতো টাকা কোথায় পাবে সে? শেষ পর্যন্ত কি ভালো হবে আবিদ?
সারা রাস্তা বাসের জানালায় মাথা রেখে কাঁদছে পলি। তারা মনে হচ্ছে, মাথা ঘুরছে, বমি আসছে। হালকা লাগছে পুরো শরীর।
তানিম শক্ত হয়ে বাসে বসে আছে। বার বার চোখে মুছে যাচ্ছে। পানি আসেনি, কিন্তু চোখ দুটি লাল হয়ে গিয়েছে।
পলি বার বার বলছে, বাবারে তোদের বাবার কি হলো? কিভাবে বাঁচাবো তাকে? আমাদের কি আছে সম্বল?
তানিম শক্ত হয়ে বসে, স্থির দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে আছে। বাসে এতো লোকের ভিড়, এতো কথা বার্তা, কিছুই আজ তানিমের কানে যাচ্ছেনা।
পলির মাথায় আসছেনা, কেমনে সে, আবিদ কে এখন বলবে? বললে লোক টা আগেই মরে যাবে। না বলেও উপায় নেই, চিকিৎসা শুরু করতে হবে। অপারেশন পরে, ছয় হাজার টাকার মতো আছে। এই টাকায় কি চিকিৎসা শুরু হবে? তার জমানো কোন অর্থ নেই! কি করবে কিছুই বুঝতে পারছেনা পলি! সারা শরীর যেন অবশ হয়ে যাচ্ছে……
চলবে….
আন্নামা চৌধুরী