ভার্সিটি ভর্তি পরীক্ষার দিন ক্যালকুলেটর ছাড়াই চলে গিয়েছিলাম পরীক্ষা দিতে! ক্যালকুলেটর ছাড়া অংক আর মেলাতে পারছিলাম না, তাই পাশের মেয়েটার কাছে ক্যালকুলেটর চাইলাম।
মেয়ে অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে বলল, ক্যালকুলেটর ছাড়া আসছেন ভর্তি পরীক্ষা দিতে? এত ইরেস্পন্সিবল কেন? মেয়ের কথা শুনে হলের ছেলে মেয়ে সব হেসে ফেলল। আর আমার মুখটা করুন হয়ে গেলে মেয়েটা বলল, স্যরি, এই নেন ক্যালকুলেটর।
পরীক্ষা শেষে বাহিরে দাঁড়িয়ে আছি রিকশার জন্যে আর তখন হলের ওই মেয়েটা এসে বলল, শুনুন আমি ঢাকার বাহিরে থাকি, ছোট মামার বাসায় উঠেছি ভর্তি পরীক্ষার জন্যে।
আমার সাথে মামা এসেছিল, এখন মামাকে খুঁজে পাচ্ছি না। আর আমি মামার বাসার ঠিকানা জানি কিন্তু ভালোভাবে ঢাকার কিছুই চিনি না। আমার সাথে একটু অপেক্ষা করবেন মামার জন্যে?
এইবার আমার প্রতিশোধের পালা। চিৎকার দিয়ে বললাম, ঢাকা শহর চেনেন না আবার আসছেন ঢাকায় পরীক্ষা দিতে? আমার চিৎকার শুনে যে মেয়ে কেঁদে ফেলবে তা বুঝি নাই! আইসক্রিম দিলাম, চীনাবাদাম দিলাম, ঝালমুড়ি খাওয়ালাম তবুও বালিকা ফুঁপিয়েই যাচ্ছে! ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল,
এই জন্যে আমি ঢাকা আসতে চাই না। ঢাকার মানুষজন খুব খারাপ হয়। নাহ, ঢাকার মানুষকে আর খারাপ বানালাম না। আধা ঘন্টা অপেক্ষা করে বালিকার মামাকে না পেয়ে নিজেই নিয়ে গেলাম বালিকাকে তার মামার বাসায়।
ক্যালকুলেটর ছাড়া পরীক্ষা দিতে যায় যে ছেলে সে কি আর চান্স পাবে ভর্তি পরীক্ষাতে? নাহ, চান্স পেলাম না! তবে রেজাল্ট জানতে গিয়ে দেখি সেই মেয়েটা মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছে। পাশে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, চান্স পান নাই বুঝি? বালিকা বলল, চান্স পাবো না কেন! আজব কথা বলেন!
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললাম, তো মন খারাপ কেন? বালিকা বলল, এখন থেকে আমাকে ঢাকা থাকতে হবে আর আমি তো ঢাকার কিছুই চিনি না তাই ভয় ভয় লাগছে। একটা রিকশা ডেকে বালিকাকে বললাম, আসুন। বালিকা বলল, কই? বললাম, আপনাকে শহর চেনাবো। এই শহর আমার খুব পরিচিত। আমার যখন খুব মন খারাপ হয় তখন আমি শহর ঘুরতে বের হই।
জানেন, রাতের ঢাকা এই পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর শহর। এই সুন্দরের উপরে আর কোন সুন্দর থাকতে পারে না! আবার কাক ডাকা ভোরে এই শহরের বুকে বেয়ে চলা শীতল হাওয়া গায়ে মাখতে মাখতে যদি ফুটপাত ধরে হেটে যান মনে হবে আপনি যেন স্বর্গে আছেন।
আমার কথা শেষ হতেই বালিকা আমার পাশে রিকশায় বসতে বসতে বলল, তো কবে দেখাবেন আমাকে রাতের ঢাকা শুনি? কবে হাটবো শহরের ফুটপাত ধরে কাক ডাকা ভোরে?
দেখতে দেখতে কয়েকটা বছর পার হয়ে গেল। এখন এই শহরের প্রতিটা গলি বালিকা চেনে। তবুও কোথাও হারিয়ে গেলে কারো সাহায্য না চেয়ে বালিকা আমাকেই খুঁজে। “কই আছো তুমি?? আমি হারিয়ে গেছি, আমাকে এসে নিয়ে যাও!!” নাহ, আমি বালিকাকে হারাতে দেই না।
যেখানেই থাকে খুঁজে বের করি। রাতের শহরের রুপ দেখে মুগ্ধ বালিকার মুখখানি যে আমার কাছে বেশি সুন্দর লাগে। নাহ, এই মুখের চেয়ে সুন্দর মুখ আর কোনটা থাকতে পারে না। নাহ, পারে না।
ফাইনাল এক্সাম শেষে বালিকা গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছে। বালিকাকে বিদায় জানাতে গেলাম রেলষ্টেশন। ট্রেন ছাড়ার আগে বালিকা বলল, শুনো আমি কয়দিন থাকবো না তাই বলে তুমি আবার অন্য কাউকে নিয়ে রিকশায় ঘুইরো না। বললাম, নাহ, ঘুরবো না।
রিকশার এক পাশে সব সময় আমার জন্যে যায়গা রাখবা? বললাম, রাখবো। কোন পাশে রাখবা বলতো? বললাম, ডান পাশে। কেন? কেন? ডান পাশে কেন? বাম পাশে কারে যায়গা দিয়ে রাখছো? আচ্ছা যাও, বাম পাশেই রাখবো। হুম, বাম পাশেই রাখবা। মনে থাকে যেন। হুম, থাকবে।
গ্রামে যাওয়ার দুই দিন পর বালিকার ফোন আসলো। ওপাশ থেকে বালিকার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার কারণ বুঝতে আমার সমস্যা হল না। বালিকা তার পিতার কথা ফেলতে পারে নাই, আমিও বালিকার কান্না সহ্য করতে পারলাম না। ফোনের লাইন কেটে বের হয়ে পরলাম শহর ঘুরতে।
আমার এত চেনা শহরটা আজ বড় অচেনা লাগছে! আমি এই শহরের কিছুই চিনছি না! শহরের বাড়িগুলো আজ এত ঝাপসা লাগছে কেন?
বছর দুই এক পর যানজটের এই শহরে বালিকার সাথে দেখা হয় আমার। দামি গাড়ি থেকে নেমে আমার পাশে এসে রিকশায় বসলো সে। বলল, কাঁচ উঠানো দামি ওই এসি গাড়িতে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। তুমি আমাকে নিয়ে ঘন্টা খানেক এই শহরের খোলা আকাশের নিচে ঘুরবে?
রিকশা থেকে নেমে বললাম, না! এই শহর এখন আমার খুব অপরিচিত। এখন আমি এই শহরের কিছুই চিনি না। বলেই চলে আসলাম। পেছনে রিকশায় বসে কাঁদছে বালিকা। একবার ভাবলাম কাছে গিয়ে বালিকার চোখটা মুছে দেই। আবার ভাবলাম কি দরকার, বালিকার চোখের জল মুছে দেয়ার দায়িত্বতো এখন অন্যকারো।
শহরের ফুটপাত ধরে হেঁটে যাচ্ছি আমি। ঠিকমত পা পড়ছে না আমার। রাস্তাটা আঁকাবাঁকা লাগছে, বহুদিন পর শহরের বাড়িগুলো আবার ঝাপসা হয়ে উঠছে। তবে শহরের এই শত শত ঝাপসা মুখের মধ্যে একটা মুখ আমার কাছে সব সময় খুব স্পষ্ট। খুব স্পষ্ট।
-রি পোস্ট।