।পর্ব : বারো
রাতে অন্ধকার আকাশে বিদ্যুৎ চমকাতে দেখেছেন কখনো?
এক ঝটকায় চারপাশ আলোকিত হয়ে আবার অন্ধকার। ঠিক তেমনি কিছু একটা দেখে জ্ঞান ফিরল। হাত-পা বাঁধা থাকায় নড়াচড়া করতে না পেরে অবশেষে শুধু মাথা নাড়িয়ে যতদূর দেখা যায় দেখে নিলাম।
বিশাল বড়ো ঘরের মতো। মাথার উপর ঢেউটিন। চারপাশ খালি। মনে হচ্ছে বিশাল বড়ো গাড়ির গ্যারেজ। আপাতত গাড়ি নেই। কয়েকজন মানুষ আছে। এই লোকগুলোই আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে। আচ্ছা, ওরা আমার সাথে কিছু করে-টরেনি তো?
ঘাড় ঘুরিয়ে, বাঁকিয়ে, উঁচু-নিচু করে যতটুকু দেখলাম, আমার গায়ে কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই। হাত, পায়ের আঙুলগুলো ভালো করে দেখে নিলাম। সিনেমায় দেখেছি এমন কেসে কিডন্যাপাররটা হাত-পায়ের আঙুল কেটে টর্চার করতে সবচে’ বেশি আনন্দ লাভ করে। সে যা-ই হোক, আঙুলগুলোও ঠিকঠাক আছে দেখে বেশ স্বস্তি পেলাম। কিন্তু যখনই দিজার কথা মনে পড়ল তখন আমার ভেতরটা শূন্য হয়ে গেল। চারপাশটা ভালো করে দেখে নিয়ে যা বুঝলাম, দিজা এখানটায় নেই। তা হলে? কোথায় রাখা হয়েছে তাকে? ওঁর সাথে আবার…
ঘেন্নায় গা ঘিনঘিন করে উঠল আমার। ছিঃ! এরা পুরুষ? সত্যিকারের পুরুষ কখনো মেয়েদের সাথে অন্যায় অবিচার করতে পারে? অবশ্য এদের জন্য মেয়ে যা ছেলেও তা। এরা যেকোনো সময় যে কারোর সাথে যা খুশি করে ফেলতে পারে। তাই ভয়ে ভয়ে আরো একবার চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিলাম। নাঃ, কোথাও তো নেই! পেছনের দিকটা দেখে নিয়ে সামনে ফিরে তাকিয়েছি কেবল, একটা লোক পুরো এক বালতি পানি আমার দিকে ছুঁড়ে মারল। কিছু বুঝতে পারার আগেই চেয়ার সহ মাটিতে পড়ে গেলাম। আবার আমাকে টেনে তুলে বসাল।
আমি তখন হাপাচ্ছি। যে লোকটা আমার মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে সে-ই আমার বুকে লাথি মেরেছিল। পরপর দু’টি। আর তাতেই আমার অবস্থা খারাপ। যাকে বলে একেবারে হালুয়া টাইট। আমি ভেবেই অবাক হচ্ছি যে, এই লোকটার গায়ে এত শক্তি! হাতি একটা! সেই হাতিটাই, ইয়ে মানে লোকটাই আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পিছন ফিরে তাকিয়ে বাকি লোকদের উদ্দেশ্য করে বলল, “এই হাদা লোকটাকে বাঁচিয়ে রাখার কী দরকার বল তো? শুধু শুধু সময় নষ্ট। একে এক গুলিতে শেষ করে দিয়ে লাশটা পুঁতে ফেললেই তো ল্যাটা চুকে যায়! বশির ভাই কী ভেবে যে একে বাঁচিয়ে রাখার কথা ভাবছে ওফ!”
এতক্ষণে জানতে পারলাম এদেরকে যারা অর্ডার দিচ্ছে তার নাম বশির। তো হাতিটা মানে লোকটা এ-কথা বলার পরপরই সেই সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরা রিটায়ার্ড অফিসার এল। বলল, “এতই যদি বুঝতিস তা হলে তুই হতি আমার লিডার আর আমি হতাম তোর চ্যালা। বুঝলি?”
লোকটা সঙ্গে সঙ্গে অপ্রস্তুত হয়ে অফিসারের দিকে তাকাল। ব্যস্ত হয়ে বলল, “ভাই! ইয়ে আমি তা বলতে চাইনি। আমি বলতে চাচ্ছিলাম…”
পুরো কথা বলার আগে বশির ভাই ওরফে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরা লোক ওরফে সেই রিটায়ার অফিসার গম্ভীর গলায় বলল, “একটা জিনিস খেয়াল করেছিস? এই ব্যাটা কিন্তু সব জানে। অমিশা রেপ হওয়া, মার্ডার হওয়া, কে এসব করেছে, কে তাকে সাহায্য করেছে সব জানে।”
বাকি লোকগুলো ভাবতে লাগল আর রিটায়ার্ড অফিসার বশির আমার দিকে আঙুল তাক করে বলল, “সব প্রমাণ মিটিয়ে ফেলার পর এতকিছু জেনে গেছে। কোনো সাধারণ মানুষের পক্ষে এতকিছু সম্ভব নয়। এ হয় গোয়েন্দা নাহয় সাংবাদিক।”
আমি সঙ্গে সঙ্গে বাধা দিয়ে বললাম, “না না, আমি এসবের কিছুই নই। আমি তো ক্যানাডা থেকে এসেছি। আবার সেখানে চলে যাব। আপনারা প্লিজ আমাকে যেতে দিন।”
“হ্যাঁ, দেব। তার আগে আপনি সব প্রমাণ আমার হাতে তুলে দিন।” আমার সামনে ঝুঁকে চোখ বরাবর চোখ রেখে বলল অফিসার বশির।
“কীসের প্রমাণ? আমার কাছে তো কোনো প্রমাণ-টমান নেই! আমি ওসব কোত্থেকে পাব?” আমি বললাম।
“তার মানে আপনি স্পাইং করেননি? ইনভেস্টিগেশন করেননি? এমনি এমনি এত সব তথ্য আপনি জেনে গেছেন?”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, এমনটাই হয়েছে।”
“ওঃ! তাহলে কি সব তথ্য আপনি কোনো প্রকার অলৌকিক শক্তির মাধ্যমে জেনেছেন? না কি ভূত আপনাকে বলে দিয়েছে?” তাচ্ছিল্য করে বলল লোকটা।
প্রশ্নটা শুনতেই আমার চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল। সেইসঙ্গে অমিশার সেই অন্ধকার কালো ছায়াটা চোখের সামনে ভেসে উঠল। তার সেই কান্নাভেজা কণ্ঠ, সেই চিৎকার, সেই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগিয়ে আসা, সেই ভেজা ভেজা দু’টো চোখ সবকিছুই যেন মনে হলো আমি এখনি দেখলাম, এখনি শুনলাম। ব্যাপারটা ওরা বিশ্বাস করবে কি না কে জানে! তবে আমি সত্যিটাই বললাম। বললাম, “হ্যাঁ, ভূত বলেছে। অমিশার ভূত।”
আমার কথার প্রভাব লোকগুলোর উপর পরল না। বশির বলল, “বুঝেছি, ভূত তাড়াতে হবে। এই, ভূত তাড়ানোর ব্যবস্থা করো তো।”
সঙ্গে সঙ্গে দু’টো লোক বেরিয়ে গেল। মিনিট দু’-এক পর ফিরে এল ড্রিল মেশিন সহ কিছু জিনিসপত্র নিয়ে। একটা চেয়ারও আনল। চেয়ারটা আমার মুখোমুখি বসিয়ে দিতেই অফিসার বশির আয়েশ করে বসল। শুকনো গলায় বলল, “এই জায়গাটা বেশ নির্জন। দূর দূর পর্যন্ত কেউ নেই। এখান থেকে চিৎকার দিলে কেউ শুনবে না। তবে আমি আপনাকে কষ্ট দিতে চাই না। তাই ভালোয় ভালোয় সব প্রমাণ আমাকে দিয়ে দিলেই আমি খুশি হব।”
“বললাম তো আমার কাছে প্রমাণ নেই। আমি কোনো প্রকার ইনভেস্টিগেশন করিনি। সবকিছু অমিশা নিজেই আমাকে বলেছে।” আমি চেঁচিয়ে বললাম।
এরপর যে অত্যাচার ওরা শুরু করল তা বলে বা লিখে বিশ্লেষণ করা যাবে না। তবুও শুনুন, ওই অফিসার বশির ড্রিল মেশিন চালু করে আমার বাঁ হাত বরাবর চালিয়ে দিলো। সে কী যন্ত্রণা! সে কী আত্মচিৎকার! তখন আমি মরে যেতে পারলে বাঁচি। ড্রিল মেশিনের লোহার বিট হাতের একদিক দিয়ে ঢুকিয়ে অন্যদিকে বের করেছে। আমি শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে চিৎকার করে বলেছি, “সত্যি আমার কাছে প্রমাণ নেই। আমি নির্দোষ। আমাকে ছেড়ে দাও।”
মেশিনটা নামিয়ে রেখে বশির বলল, “আপনি নির্দোষ তা আমরা সবাই জানি। নতুন কিছু বলুন। প্রমাণ কোথায় রেখেছেন সেটা বলুন। এতে অন্তত আপনার প্রাণ বেঁচে যেতে পারে।”
এরপর আমার এতটাই রাগ হলো যে আমি লোকটার মুখে থুতু ছিটিয়ে দিলাম। বললাম, “আর কতবার বললে বিশ্বাস করবে তোমরা? কতবার বলব আমার কাছে প্রমাণ নেই?”
লোকটা প্লাস হাতে তুলে নিল। সেটা দিয়ে আমার ডান হাতের দু’টো নখ উপড়ে ফেলল। কিন্তু এরপরও যখন প্রমাণ দিতে রাজি হলাম না তখন সে বাঁকা হেসে বলল, “ভূতে ধরেছে না? ভূত কী করে তাড়াতে হয় তা আমি ভালো করেই জানি মিস্টার আরজু।”
বলে চুটকি দিতেই দু’টো লোক বেরিয়ে গেল।
খানিক বাদে, তখন আমি অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছি এমন অবস্থা। চোখদু’টো আপনাআপনি লেগে আসছিল। ঠিক তখন দু’জন লোক টেনে টেনে দিজাকে নিয়ে এল। দিজার পুরো শরীর ভেজা। গায়ের ওড়না নেই। ভেজা কাপড়গুলো শরীরের সাথে একদম লেগে আছে। সে বড়ো বড়ো নিঃশ্বাস নিতে নিতে অসহায় দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাচ্ছিল। আমি এবার জ্বলে উঠে বললাম, “আমার ওয়াইফের কিছু হলে আমি কাউকে ছেড়ে দেব না বলে দিলাম।”
বশির ঘাড় বাঁকিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “কী করবি রে তুই? তোকে ভূতে ধরেছে না? এবার তোর ভূত তাড়াব।” বলেই দিজার দিকে এগিয়ে গেল। আমি চিৎকার দিলাম, “ওঁকে কিছু করবেনে না। ওঁকে ছেড়ে দিন! আপনার যা করার আমার সাথে করুন। ওকে ছেড়ে দিন প্লিজ!”
কে শোনে কার কথা? বশির আমার কথা কানে না নিয়ে দিজার দিকে এগিয়ে গেল। দিজা তখন সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে কাঁপছে। এই অবস্থায় সে এমন একটা কান্ড ঘটিয়ে ফেলবে তা আমার ভাবনার বাইরে ছিল।
রিটায়ার অফিসার বশির দিজার সামনে যেতেই দিজা ঠাস করে এক চড় বসিয়ে দিলো লোকটার গালে! উপস্থিত সবার মুখ হাঁ হয়ে গেল। দিজার এমন কান্ড দেখে অসম্ভব বিপদের মুখে দাঁড়িয়েও আমি হেসে ফেললাম। বাকি লোগুলো দিজাকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য এগিয়ে যাচ্ছিল, বশির সবাইকে হাতের ইশারায় থামিয়ে দিলো। দিজার মুখের সামনে মুখ নিয়ে বলল, “আবার মার!”
অবাক করার মতো বিষয় হলো, দিজা আবারো চড় বসিয়ে দিলো লোকটার গালে। আমি এবার শব্দ করে হেসে ফেললাম। কিন্তু রাগে, ক্ষোভে লাল হয়ে যাওয়া দিজার মুখ দেখে আমার হাসি উবে গেল। বশির লোকটা লম্বা লম্বা নিঃশ্বাস নিতে নিতে দিজার চুল মুঠোয় ভরে এক টানে তাকে মাটিতে ফেলে দিলো। তখন পৃথিবীর সবচে’ অসহায় মানুষ হয়ে পড়লাম আমি। নিজের স্ত্রীকে আমারই সামনে অন্য একটা লোক অত্যাচার করছে অথচ আমি কিছুই করতে পারছি না! পাপবোধে ভেতরটা ছিঁড়ে যাচ্ছিল। আমি চেয়ার ভেঙে ছুটে যেতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু পারলাম কই? অতটা জোর আমার গায়ে নেই।
বশির দিজার গালে চড় মারল পরপর তিনবার। আমি চিৎকার দিলাম, “শালা কাপুরুষ! পারলে আমার সামনে আয়!”
কথাটা বশিরের কানে গেল কি না কে জানে! সে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে দিজার গায়ের কামিজ ছিঁড়তে লাগল। পুরোটা ছিঁড়ে ফেলার পর আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম। ভয়ে ভয়ে আবারো চোখ খুলে দেখি লোকটা এবার দিজার কোমড় লক্ষ্য করেছে। সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার দিয়ে বললাম, “বলছি! সব বলছি। সব প্রমাণ দিয়ে দিচ্ছি তোমাদের। তোমরা ওঁকে ছেড়ে দাও।”
লোকটা দিজার গালে চড় মেরে বলল, “তোকে আমি দেখে নেব।”
এরপর আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। আর আমি তীব্র ঘৃণা বুকে চেপে রেখে লোকটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। মাঝবয়েসি লোক। চুল-দাড়িতে পাক ধরেছে। সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরায় ভালোই লাগে দেখতে। অথচ এই লোকটাই এত বড়ো ক্রিমিনাল সেটা কে বিশ্বাস করবে!
চলবে…………….