পর্ব : নয়
সকাল থেকেই চার-পাঁচজন লোক এদিকটায় নজর রাখছিল। প্রথম প্রথম ভেবেছিলাম হয়তো এখানকারই লোক এমনিতেই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে আসছে। কিন্তু যখন বারবার লোকগুলোকে বাড়ির ভেতর উঁকি দিতে দেখলাম তখন আমার সন্দেহ মিটে গেল। সেইসাথে একটু একটু ভয় কাবু করে নিল। কারণ বাইরে পাহারারত লোকগুলোকে দেখে ভালোমানুষ বলে মনে হয় না। দূর থেকে যতটুকু দেখা যায়, সবগুলোর পরনে ময়লা পুরনো রঙচঙে শার্ট। মাথায় এলোমেলো চুল। মুখে অনেক দিনের দাড়ি। গায়ের রং ময়লা হতে হতে কালো কুচকুচে হয়ে গেছে। কিংবা হতে পারে লোকগুলো ছোটোবেলা থেকেই কালো। ওদের কেউ কেউ সিগারেটের ধোঁয়া টানছে তো কেউ পান চাবাতে চাবাতে পায়চারি করছে। কখনো-সখনো এক আধবার অতি সন্তর্পণে বাড়ির ভেতর উঁকি দিচ্ছে।
দুপুর নাগাদ যখন ওরা গেল না এবং যখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো তখনও বাড়ির বাইরে পাহারারত অবস্থায় ওদের দেখা গেল তখন চিন্তায় আমার গলা অবধি শুকিয়ে গেল। কারণ এখন তো আর আমি একা নই। আমার সঙ্গে দিজাও আছে। কী যে করি!
সূর্য যখন পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে তখন একবার ভালো করে দেখে নিলাম ওদের। দেখে মনে হয় সব ক’টা ভাড়াটে গুন্ডা। “ভাড়াটে গুন্ডা” শব্দটা ফিল্মি বলে মনে হতে পারে। তবে শুধু ফিল্মে নয়, বাস্তবেও এদের পাওয়া যায়। এরা টাকার বিনিময়ে খুন করে, রেপ করে, লোটপাট করে, জমি দখল করে, মারপিট-ভাঙচুর সব করে। উদ্দেশ্য শুধু টাকা। টাকা দিয়ে ওদেরকে আঙুলের ইশারায় নাচানো যায়। যার ফলে ভয়টা আরো বেশি।
অন্ধকার হতে শুরু করেছে। সুইচ টিপে বৈদ্যুতিক বাতি জ্বালিয়ে দিলাম। এতদিন একটা কথা বলাই হয়নি। এ-বাড়িটা চারতলা সেটা আপনারা জানেন। কিন্তু আমি ক’তালায় আছি জানেন কি? বলিনি তাই না? আমি দোতলায় আছি। নিচতলা খালি। উপরের তিনতলা চারতলাও। যাহোক, মূল কথায় আসি।
বেলকনিতে একটা ইজি চেয়ার পাতা। চেয়ারটায় কখনো বসা হয়নি। আজ বসব বসব করছিলাম হটাৎ মনে হলো, শুধু শুধু বসে থেকে কী লাভ? এরচে’ বরং বই নিয়ে বসা যাক। এই বাহানায় সময় কেটে যাবে। আজকের রাতটা কোনোমতে চলে যাক। দিজা নিজে বলেছে কাল সে আমার সঙ্গে এ-বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। কিন্তু আমি তখনও জানতাম না এক বিশাল কালো ঝড় থাবা উঁচিয়ে ছুটে আসছে আমাদের দিকে।
বুকশেলফ থেকে বই নিয়ে এসে ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে দিলাম। কিন্তু বইয়ে মনোযোগ দেওয়া কিছুতেই সম্ভব হলো না। একটি কথা আমাকে বেশ ভাবিয়ে তুলছে। সেটা হলো, দুপুরবেলা দিজা এত এত কেঁদেছে এরপর সে গাল ফুলিয়ে লাগেজ টেনে টেনে বেরিয়ে যাওয়ার কথা। যাতে করে আমি তাকে টেনে আনি। আদর করে কোলে বসিয়ে রাগ ভাঙাই। হ্যাঁ, এতটাই বাচ্চা স্বভাবের সে। কিন্তু আজ ঘটনা পুরো উল্টো। দিজা তেমন কিছুই করছে না। তার আচরণ খুবই স্বাভাবিক। দুপুরবেলা নিজেই অনলাইনে অর্ডার করে খাবার এনেছে। এবং সেই খাবার আমরা একসঙ্গে বসে খেয়েছি। শুধু এটুকু পরিবর্তন যে, দুপুরের পর এখন পর্যন্ত দিজা আমার সঙ্গে একটি কথাও বলেনি। এই অভিমানটুকু ঠিকই আছে। কিন্তু এত সহজেই ছেড়ে দেওয়ার মানুষ তো সে নয়!
বই খুলে রেখে ইজি চেয়ারে বসে বসে ভাবনায় ডুবে গিয়েছিলাম। ঠিক তখন দিজা আমার সামনে হাজির হলো। তার চোখের কোলে জল। অতিরিক্ত কান্নার ফলে নাক দিয়ে ফ্যাৎ ফ্যাৎ শব্দ বেরোচ্ছে। আমি আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে রইলাম। দিজা ধরা গলায় বলল, “আমি চলে যাচ্ছি।”
“যাচ্ছো মানে! কোথায় যাচ্ছো!” ধড়মড় করে উঠে দাঁড়ালাম আমি।
দিজা দৃষ্টি নামিয়ে বলল, “আছে এক আত্মীয়। তাদের ওখানে ক’দিন থাকব। এরপর ক্যানাডায় মায়ের কাছে চলে যাব।”
“মায়ের কাছে! তুমি কি আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছো দিজা? চিরতরে?”
দিজা প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বলল, “ডিভোর্স পেপারে সাইন করতে একটুও আপত্তি নেই আমার। আমি শুধু চাই যাকে ভালোবেসেছি সেই মানুষটা সুখে থাকুক।” বলতে বলতে কেঁদেই ফেলল দিজা। আমি অবাক হয়ে বললাম, “ডিভোর্স কেন দিজা? এমন কী হয়েছে আমাদের মধ্যে? তুমি কি দুপুরে পাওয়া সেই কাগজের টুকরোয় লেখাগুলো পড়ে এসব বলছো! ওসব ভুল দিজা! সব ভুল। এটা হতে পারে না।”
“সেগুলো তোমার হাতের লেখা। তুমিই লিখেছো। এখন সেটা অস্বীকার করতে পারবে?”
আমি মাথা নিচু করে ফেললাম। দিজা চোখ মুছে বলল, “আসছি।” বলেই লাগেজ টানতে টানতে পা চালাতে লাগল। আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম। দিজা আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে। ব্যাপারটা বেদনাদায়ক। তবে একদিক থেকে সুখেরও। সে যতক্ষণ এ-বাড়িতে থাকবে ততক্ষণ তার জীবনের ঝুঁকি থাকবে। এরচে’ এখান থেকে চলে যাওয়াই ভালো। আমার সাথে না থাকুক অন্তত বেঁচে থাকবে!
কিন্তু কথায় আছে না, যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যে হয়। এখনও তা-ই হলো। দিজা দরজা পর্যন্ত যেতে পারেনি তার আগেই একটা সাদা প্রাডো গেটের ভেতর প্রবেশ করল। দিয়া যাবার জন্য দরজা খুলেছে ঠিকই তবে যেতে পারেনি। কারণ ততক্ষণে সেই রিটায়ার্ড অফিসার দরজা পর্যন্ত চলে এসেছে। লোকটা দিজাকে সঙ্গে নিয়ে বেলকনিতে এল। বলল, “কেমন মানুষ আপনি বলুন তো! রাতের বেলা উনাকে একা একা কোথায় পাঠাচ্ছিলেন? চারপাশে কত খারাপ লোকের বাস। কখন কী হয়ে যায় বলতে পারেন? আপনিও সঙ্গে যাওয়া উচিৎ।” বলে থামল লোকটা। দিজা কিছু বুঝতে না পেরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। একবার হতভম্বের মতো আমার মুখের দিকে তাকাচ্ছে আর একবার ওই লোকটার মুখের দিকে।
লোকটা এবার একটু জোর দিয়ে বলল, “বলেছিলাম না চলে যাওয়ার জন্য? তার পরও স্পাইং করছেন কেন?”
“আমি এত সহজে কোথাও যাচ্ছি না।” আমি কড়া গলায় জবাব দিলাম।
লোকটা দু’বার মুখ দিয়ে চুঁ চুঁ শব্দ করে বলল, “ভুল করছেন আরজু সাহেব, ভুল করছেন। কেন শুধু শুধু বিপদ ডেকে আনতে চাইছেন বলুন তো? হুম? কেউ আপনার স্ত্রীর বিবস্ত্র শরীর দেখুন, তার এখানে ওখানে হাত দিক, নির্যাতন করুক এটা কি আপনি চাইবেন? আপনি কি চাইবেন কেউ আপনাকে বেঁধে রেখে আপনার চোখের সামনে আপনার স্ত্রীকে…” বলতে বলতে বাঁকা হাসল লোকটা।
মুহূর্তের মধ্যেই দিজা ছুটে এসে আমার কলার চেপে ধরল। ফুঁপাতে ফুঁপাতে বলল, “কী হচ্ছে এসব? কী করছো তুমি আরজু? কী হচ্ছে এখানে? এই লোক তোমাকে এমন জঘন্য কথা বলছে অথচ তুমি চুপ করে আছো? কেন? বলো কী করেছো তুমি?”
লোকটা মৃদু হেসে বলল, “ভাবি, ভুল বুঝবেন না। আমি শুধু উনাকে সতর্ক করে দিচ্ছিলাম। যাতে উনি উনার ভুলগুলো শুধরে নেন।” বলেই চলে গেল লোকটা।
দিজা এবার আমার কলার ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল, “বলো না কী করেছো? কী ভুল করেছো তুমি? কেন একজন তোমার স্ত্রীকে নিয়ে এমন বাজে বন্তব্য করবে? কী করেছো তুমি?”
আমি পাথরের মতো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে বললাম, “অমিশা।”
সঙ্গে সঙ্গে দিজা আমার কলার ছেড়ে দিলো। হতাশ হলায় বলল, “কী করেছো তুমি মেয়েটার সঙ্গে?”
“রেপ, মার্ডার।”
“কী!” দিজা চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে ঢলে পড়ে যাচ্ছিল। আমি তখনই তাকে সামলে নিলাম। দু’হাতে তুলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিয়েছি অনেক্ষণ। দিজা নিশ্চুপ পড়ে আছে। আমি ঘোরগ্রস্তের মতো দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ দেয়াল ঘড়িটা বেজে উঠল। রাত বারোটা। কোত্থেকে যেন তুমুল হাওয়া বইতে শুরু করেছে। ঘরের সব আসবাবপত্র থরথর করে কাঁপছে। কাচের জানালায় খচখচ শব্দ হচ্ছে। আমি দুরুদুরু বুকে জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। বিদ্যুৎ চলে গেছে। জানালার ওপাশে অন্ধকারে একটা ছায়া পা টেনে টেনে এগিয়ে আসছে। হঠাৎ পেছন থেকে দিজার কণ্ঠস্বর ভেসে এল, “শুনো, এক গ্লাস পানি দাও প্লিজ।”
চলবে……..