অনির কলমে আদ্রিয়ান পর্ব ৩২
হিংসা, শব্দটা মোটেও কোন পজেটিভ ভাইব দেয়না। বরং বরাবরই এক ঋণাত্মক অনুভূতি দেয়। হিংসা ব্যপারটা মাথায় এলেই সবার আগে মনে পরে কোন রূপকথার গল্পের দ্বিতীয়রাণী, কোন অহংকারী-রূপসী জাদুকরনী, সিন্ডেরেলার দুই বোন অথবা আধুনিক সিরিয়ালের কোন খলনায়িকা। হঠাৎ উপলব্ধি করলাম এই ঋণাত্মক গুন আমার মধ্যেও বাসা বেঁধেছে। আত্মসম্মানে প্রবল এক ধাক্কা লাগল আমার। আমি কেন কাউকে হিংসে করব? আমি দ্বিতীয় রাণী, জাদুকরনী, কিংবা সিন্ডেরেলার সৎ বোন নই। সুতরাং হিংসে করা আমার বৈশিষ্ট্য হতে পারেনা। আদ্রিয়ান ভাইকে নিয়ে যে যা খুশি বলুক। প্রেমপত্র পাঠাক, আপত্তিকর ছবি পাঠাক, নজর দিক। আরে বিয়েই করে ফেলুক। সেসব নিয়ে আমার এমন খলনায়িকা টাইপ আচরণের মানে কী! কোন মানে নেই। এটা তাদের এবং আদ্রিয়ান ভাইয়ের নিজস্ব ব্যপার। সেখানে আমার কিছু বলার নেই। থাকতে পারেনা। এবং থাকা উচিৎ না। কথাগুলো গভীরভাবে চিন্তা করে ফোঁস শ্বাস ফেললাম আমি। নিজের কাছেই দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হলাম। এসব নিয়ে আর মাথা ঘামবোনা আমি। এসবে আমার কিচ্ছু যায় আসেনা।
ঘন্টাখানেক আগে মামণীকে কীসব ভয়ানক কথা বলে ফেলেছি মনে পড়তেই চমকে উঠলাম। কারা নজর-টজর দিয়ে তার ক্ষীরের পুতুলকে কুলসিত করে ফেলবে। তার সোনার টুকরো ছেলের বিশাল ক্ষতি হয়ে যাবে। উনি হয়তো এই চিন্তাতেই গোটা রাত পাড় করে দেবেন। এতক্ষণে পাল্টা কল করে ফেলার কথা। নিশ্চয়ই ফোনে ব্যালেন্স নেই। তাই কল করতে পারছেনা। তার চিন্তা দূর করে দেওয়া উচিৎ। আর এদিকে আমার ফোনেও ব্যালেন্স নেই। কিন্তু আদ্রিয়ান ভাইয়ের ফোনটা এখনো আমার হাতে। আম্মুর ডাকে সে ফ্রেশ হতে বেরিয়েছিলেন। কিন্তু ফ্রেশ হতে আর জাননি। আব্বু ডেকে বসল। দুজন মিলে গল্প করতে করতে পুরাণবাজার চলে গেল। এখনো ফেরার নাম নেই। সেই নিয়েও আম্মুর তীব্র অসন্তোষ। একজন বাপের বয়সী, আরেকজন ছেলের বয়সী। তবুও দুজনের এতো কীসের কথা, এতো কীসের আড্ডা? সেটা যেমন আম্মুর বুঝতে পারেন না, বুঝতে পারিনা আমিও।
আর কী লোক রে বাবা! নিজের ফোনটা আমার হাতে দিয়ে অনায়াসে হাওয়া হয়ে গেল! ভুলে রেখে বাইরে গেছেন সেটা হতে পারেনা। যথেষ্ট সচেতন উনি। নিশ্চয়ই মাথায় আছে যে ফোনটা আমার রুমে রেখে গেছে। তবুও কোন পাত্তা নেই! আশ্চর্য!
ভাবলাম ওনার ফোনেতো ব্যালেন্সের সমুদ্র দৌড়াদৌড়ি করে। ওনার ফোন দিয়েই মামণীকে কলটা দেই। পাসওয়ার্ড দিতেই লক খুলল। একটু অবাক হলাম আমি। এখনো পাসওয়ার্ড বদলায় নি? না বদলাক! আমার কাজটা হলেই হলো।
মামণীকে কল লাগালাম। রিং হতে না হতেই রিসিভ করে ফেললেন। ভীষণ অবাক হলাম আমি। মনে হল এই ঘন্টা যেন ফোনের ওপরেই বসে ছিলেন কলের অপেক্ষায়। ভীষণ ব্যস্ত কন্ঠে মামণি বলল, ‘আদ্রি?’
‘না অনি।’
‘ওহ্ তুই। আদ্রি কই? খাওয়া শেষ হয়নি ওর?’
‘আর খাওয়া। তোমার ছেলে আর আমার আব্বু সেইযে আড্ডা দিতে দিতে বেরিয়েছেন। এখনো ফেরার নাম নেই। এদিকে আম্মু বিরিয়ানি নিয়ে বসে আছে।’
‘এই দুজনে একসঙ্গে হলে এতো কী গুজুরগুজুর ফুসুরফুসুর করে বলতো?’
আমি হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, ‘জানিনা। তুমি তোমার ছেলেকে জিজ্ঞেস করো। আমার আম্মু স্বামীকে জিজ্ঞেস করবে।’
মামণি সামান্য হেসে বলল, ‘আর তুই কী করবি?’
আমি কপট বিরক্তি নিয়ে বললাম, ‘আমি আবার কী করব? আমার কিছু করার-টরার নেই। আমার স্বামীও নেই, ছেলেও নেই। তোমাদের আছে তোমরা বুঝে নাও।’
‘যখন হবে তখন বুঝবি। তোর স্বামী আর ছেলে যদি আমার ছেলের মতো হয়। তখন বুঝবি চিন্তা, দুশ্চিন্তা, মানসিক চাপ কাকে বলে। তবে গর্ব আর অহংকারও কম নেই। অমন ছেলে_’
পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে বুঝতেই দ্রুত বললাম, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ বুঝেছি।’
মামণি হেসে ফেললেন, ‘ফাজিল মেয়ে।’ হঠাৎই চিন্তিত কন্ঠে বলল, ‘আচ্ছা শোন না। তখন কী বলছিলি? কীসের নজর? কী হবে আমার আদ্রির? কেউ কী কিছু বলেছে ছেলেটাকে?’
আমি আবার হতাশ নিঃশ্বাস ফেললাম। ঠিক জানতাম, মামণি আমার দুশ্চিন্তায় মাথা খারাপ করে ফেলছে। বললাম, ‘তোমার ছেলেকে কেউ কিছু বলে বা করে সে আস্ত থাকবে? তোমার মনে হয়? এতো ভোলাভালা তোমার ছেলে তোমার?’
‘আমার ছেলে খারাপ, অনি?’
‘মামণি!’ রীতিমতো কান্না পেল আমার।
মামণি শব্দ করে হাসলেন। বললেন, ‘আচ্ছা জ্বালাচ্ছিনা। আচ্ছা বলনা কী হয়েছে? তখন ওভাবে বললি কেন?’
‘মজা করছিলাম। তোমার ছেলের বারান্দায় সুন্দরী রমনীদের চিরকুটের বর্ষণ হয় সে খবর আমার জানা মামণি। শীঘ্রই ছেলেকে আবার বিলেতে ফেরত পাঠাও। নইলে দেখবে একটা অঘটন ঠিক ঘটে যাবে।’
মামণির সঙ্গে জাবিন আর সারার অট্টোহাসির আওয়াজ আমি ফোনের এপাশ থেকেও পেলাম। অর্থাৎ তিনজন এক জায়গাতেই আছে! সবার আগে হাসি থামাতে সক্ষম হল জাবিন। কোনমতে বলল, ‘কী মনে করালে অনিপু। সেদিন আসার পর খাবার টেবিলে আম্মু ভাইয়াকে যা জ্বালিয়েছিলো না। আমরাতো ভয়ে কিছু বলিনি। কিন্তু সে বিরক্ত হয়ে কী বলল জানো?’
‘কী বলল?’
‘বলল “দেশে ইভটিজিং নিয়ে এতো হৈ হুল্লোড়। এতো আইন। অথচ এডামটিজিং এর মতো এতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কারো মাথাব্যথাই নেই! সারপ্রাইজিং!” ‘
আমি হেসে ফেললাম। মামণি আর সারার হাসি আরও তীব্র হল। জাবিনেরও সে কী হাসি! মা-বেটির এই অট্টোহাসির মুহূর্ত সামনাসামনি দেখার বড্ড ইচ্ছে হল আমার। তখনই আম্মুর ডাক শুনে হাসি থামিয়ে বললাম, ‘তোমরা হাসো। আমি রাখছি। আম্মু ডাকছে বোধ হয়।’
সারা হালকা আওয়াজ দিয়ে বলল, ‘অনিপু লাভ ইউ।’
আমি হেসে দিয়ে বললাম, ‘লাভ ইউ টু সোনা।’
ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফোন রাখলাম। লম্বা শ্বাস বেরিয়ে এলো ভেতর থেকে। আজব এক ফ্যামলি! যাই হয়ে যাক। এসব সিলি মেটার নিয়ে অযথা মেজাজ খারাপ করব না আমি। আমারতো কিছু না। অযথাই এসব ঢং করে লাভ কী?
এরমধ্যেই আম্মু আবার ডেকে বসলেন, ‘অনু! তোমার আব্বু আর আদ্রিয়ান চলে এসেছে। হাত ধুয়ে এসো।’
আমি ছোট্ট শব্দ ফেলে হাতের কয়েকটা কাজ সেড়ে নিলাম।ওনার ফোনটা নিয়ে বের হয়ে এগুতেই দেখতে পেলাম ওনাকে। নেভিব্লু রঙের ফুল হাতা গেঞ্জিটা কুনুই অবধি ফোল্ড করা। ফর্সা হাতে-মুখে বিন্দু বিন্দু পানি জমে আছে। কপালে পড়া চুলগুলোও হালকা ভিজে গেছে। নিঃশ্বাস আটকে নিজের হৃদস্পন্দনের নিয়মিত গতি ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করলাম আমি। অতঃপর জোরে জোরে শ্বাস নিলাম। হাত দিয়ে বুকের বা পাঁশটা চেপে ধরার তীব্র ইচ্ছা হলেও তা করলাম না। মেয়েগুলোর কী দোষ! দোষতো এই আশ্চর্য পুরুষের।
মুখটা যথাসম্ভব গোমড়া রাখার চেষ্টা করে ফোনটা তার দিকে এগিয়ে দিলাম। কিছু বললাম না। উনি আমার দিকে তাকিয়ে ফোনটা নিলেন। ভ্রুটা কিছুটা বাঁকিয়ে বললেন, ‘বড়দের জিনিস পার্মিশন ছাড়া ধরতে নেই জানিসনা? তাও পার্সোনাল জিনিস। কানে ধরে ম্যানারস্ শেখাতে হবে।’
আমি কাঠকাঠ গলায় বললাম, ‘সে না হয় শেখাবেন। কিন্তু নিজেও একটু কেয়ারফুল হওয়া শিখুন। আপনার পাসওয়ার্ড ছোটদের মস্তিষ্কে দৌড়াদৌড়ি করছে। চেঞ্জ করবেন।’
আমার কথায় তার ঠোঁটে হাসি ফুটল। কৌতুকপূর্ণ কন্ঠে বললেন, ‘তোর সেন্স অফ হিউমারের যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে।
ইদানীং মুখে মুখে তর্কটা বেশি হচ্ছে তোর। তবে মন্দ লাগছে না। লজিক্যাল কথাবার্তা বলছিস। আগের মতো বোকা বোকা ঝগড়া করিস না। সবই আমার শিক্ষার ফল। যোগ্য গুরু আমি। মানছিস?’
‘মানছি। আপনাকে গরু_ আই মিন গুরু রূপে পেয়ে জীবন ধন্য হয়ে গেছে আমার। ফোন দিতে এসেছিলাম। এবার গেলাম আমি।’
চরম বিরক্তি নিয়ে কথাগুলো বলে চলে যাচ্ছিলাম। কিন্তু ওনাকে পাশ কাটাতে গেলেই আমার হাতের বাহু ধরে আটকে ফেললেন উনি। ঘাড় বাঁকিয়ে আমার দিকে ফিরে বললেন, ‘সেন্স অফ হিউমারের উন্নতি হয়েছে, দ্যাটস্ গুড। বাট শিষ্য গুরুকে টেক্কা দিয়ে ফুল এটিটিউডে চলে যাবে! ব্যপারটা ভালো দেখায় না। উত্তরটা নিয়ে যা।’
ভ্রু আপনাআপনি কুঁচকে গেল আমার, ‘কীসের উত্তর?’
দরজার দিকে একবার তাকালেন উনি। কেউ আসছে কি-না সেটাই দেখলেন বোধ হয়। দেখা শেষে বাহুতে টান দিয়ে নিজের আরেকটু কাছে টেনে নিলেন আমায়। বিস্মিত আমি তাকালাম ওনার চোখে। উনি ফিসফিসে কন্ঠে বললেন, ‘আদ্রিয়ানের জিনিস তার অনুমতি ছাড়া নড়ার সাহসও দেখায় না। আমার পাসওয়ার্ড কোন পিচ্চির মস্তিষ্কে দৌড়াদৌড়ি করছে মানে আমি তাকে সেই অনুমতি দিয়েছি। বুঝলে মায়াবিনী?’
আমি বলার মতো কিছু পেলাম না। আরও একবার দম আটকে ফেললাম। শক্ত করে ফেললাম শরীর। নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। উনি নিজের চার আঙ্গুলের উল্টো পিঠ দিয়ে আমার গালের চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘পাসওয়ার্ড যে চেঞ্জ করিনি তা আপনি কীকরে জানলেন ম্যাম? চেক করছিলে বুঝি? কোন কোন রমনী মেসেজ করেছে। এতো পুড়ছিল?’
আত্মসম্মানে সেই আঘাতটা আবার অনুভব করলাম আমি। নিজেকে খলনায়িকা চরিত্রে কল্পনা করেও যেন জ্ব/লে উঠল ভেতরটা। কপট রাগ দেখিয়ে বললাম, ‘মোটেও না। ওসবে আমার কিছু যায় আসেনা আদ্রিয়ান ভাই। কারা আপনাকে চিঠি দিচ্ছে, কারা ম্যাসেজ পাঠাচ্ছে, ছবি পাঠাচ্ছে তাতে আমার কী? এসবের সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক নেই।’
ওনার কৌতুকপূর্ণ চেহারা মিলিয়ে গেল। ভ্রু কুঁচকে বললেন, ‘কোন সম্পর্ক নেই?’
‘না নেই। থাকার কথাও না।’ কোনকিছু না ভেবেই বলে ফেললাম আমি।
ওনার মুখ গম্ভীর হল। ধীর গতিতে ছেড়ে দিলেন আমার হাত। আমার মুখের দিকে দু সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেললেন। ফোন অন করে দেখলেন সময়টা। তারপর উল্টো ঘুরে চলে গেলেন ভেতরে। আর আমি ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম বেসিংয়ের কাছে।
–
আদ্রিয়ান ভাইয়ের সামনে কোনদিনও মনখুলে খাওয়াদাওয়া করতে পারিনা আমি। অনেক ধরণের খাবারই আমি কম খাই। যখনই অল্প খেতে উঠতে নেই। তখনই আম্মুকে বলবেন, ‘ওর জন্যে রান্না করো কেন মামণী? ওতো হাওয়া খেয়েই দিব্যি কাজ চালিয়ে নিতে পারবে।’
আবার যখন পছন্দের খাবার সামনে থাকে। তখন আমি বরাবরই বেশি খাই। যেমন ফাস্টফুড, ভাজাপোড়া, ফুসকা, বিরিয়ানি ইত্যাদি। তখন সে অর্ধেক খেতে না খেতেই বলে উঠবেন, ‘আঙ্কেল? তোমার মেয়েরতো কাজ নেই, কর্ম নেই। সারাদিন গান্ডেপিণ্ডে গিলছে। তা খাবারগুলো যাচ্ছে কোথায়? না হাইটে বাড়ছে, না ওয়েইটে।
এই হল এক সমস্যা। কিন্তু সমস্যা তো আর এক না, অনেক। আমি বরাবরই আরামপ্রিয় মানুষ। আরাম করে চেয়ারে পা তুলে বসে খাবো তার উপায় নেই। এমন ভয়ানক দৃষ্টি উপহার দেবেন যে আমার পা দুটো সুরসুর করে নিজের জায়গায় চলে যাবে। অটোম্যাটিক্যালি। তাকে কে বোঝাবে? অমন চমৎকার বাদামি গভীর নেশামাখা চোখে প্রেমিক দৃষ্টি মানায়। ‘চিবিয়ে খেয়ে ফেলব’ টাইপ দৃষ্টি না। একদমই না।
সমস্যার লিস্ট তবুও শেষ হয়নি। আর হবেও না। তাকে নিয়ে সমস্যার কথন লিখতে শুরু করলে আমার কলমের কালি ফুরিয়ে যাবে। ডায়েরির পাতা শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু সমস্যা শেষ হবেনা। তাই সেসব আর ব্যাখ্যা নাই বা করলাম।
আম্মু টেবিলে বিরিয়ানি সাজিয়েছে। বিরিয়ানির ঘ্রাণেই খিদে লাফিয়ে দ্বিগুণ বেড়ে গেছে আমার। কিন্তু ডাইনিং টেবিলে আদ্রিয়ান ভাইও বসে আছেন। চিকেন বিরিয়ানি আবার তার ভীষণ প্রিয়। আপাতত সে তার প্রিয় হাসান আঙ্কেল অর্থাৎ আব্বুর সঙ্গে আড্ডাতে ব্যস্ত। এক ঘন্টা যাবত বাইরে থেকে আড্ডা দিয়ে এসেও এদের কথা শেষ হয়না! আম্মুও আমাকে তাগাদা দিলো খেতে বসার জন্যে।
সেই বিখ্যাত সমস্যার কথা মাথায় আসতেই মুখ ছোট হল আমার। কিন্তু খাবার নিয়ে রুমে যেতে চাইলেই আম্মু রেগে যাবে। চরম অসন্তোষ নিয়ে বলবে, ঘরে মেহমান রেখে আমি খাবার নিয়ে রুমে চলে যাচ্ছি। এ কেমন অভদ্রতা! আম্মুকে কে বোঝাবে? কোন বড় সাইজের অভদ্রর অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্যে ছোট্ট সাইজেই অভদ্রতামি করাই যায়। তাতে পাপ হয়না।
তার ঐসব বিরক্তিকর শব্দবাণ থেকে বাঁচার উদ্দেশ্যে আব্বুকেই উপযুক্ত মাধ্যমে মনে হল আমার। বললাম, ‘আব্বু, আমি রুমে গিয়ে খাই?’
আব্বু অবাক হয়ে বললেন, ‘কেন মা? এখানে কী সমস্যা?’
‘ভালো লাগছেনা। রুমে গেলে একটু কমফরটেবল ফিল করতাম।’
আব্বু কিছু বলার আগেই আম্মু বলল, ‘তা যাও। তবে প্লেটটা কষ্ট করে সিঙ্কে রেখে এসে উদ্ধার কোরো আমাকে।’
আমি হাসলাম। প্লেটে দ্রুত হাতে বিরিয়ানি তুলতে তুলতে বললাম, ‘যথা আজ্ঞা, মা জননী।’
কাব্য নিজের প্লেট নিতে নিতে বলল, ‘নিশ্চয়ই বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে ভিডিও কলে আড্ডা দিতে দিতে খাবে। আমাদের সামনেতো সেসব হবেনা।’
‘এক চড়ে বত্রিশ_ সরি, তোরতো এখনো আটাশটা। আটাশটা দাঁত ফেলে দেব, বেয়াদব।’
বলতে বলতে বিরিয়ানি তোলা হয়ে গেল। আব্বু মৃদু হাসলেন।আম্মুকে বকুনি দেওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে যখনই রুমের দিকে দৌড় দিতে যাব, পেছন থেকে গম্ভীর স্বরে ডেকে উঠলেন আদ্রিয়ান ভাই, ‘দাঁড়া।’
থমকে গেলাম আমি। আমার শান্তির অশান্তি পিছু ডেকে ফেলেছে। ঝামেলা! উনি আবার কেন ডাকছেন? কী দরকার? যারা তার ব্যালকনিতে চিরকুট ছুড়ে, তার কথা ভাবতেই যেসব রূপসীরা বুক ব্যথায় মরে যায়, কারা কারা যেন আবার হার্টবিট মিস করে। ইউকে থেকে শরীয়তপুর পর্যন্ততো তার বিশাল নেটওয়ার্ক। তাদের ডাকুক। ডেকে ডেকে মুখে ফ্যানা তুলে ফেলুক। কেউতো বারণ করেনি। আমায় কেন ভাই!
‘এদিকে আয়।’
তার দ্বিতীয় ডাকে ভাবনার সুতো ছিড়ল। একবার আব্বু-আম্মুর দিকে চোখ বুলিয়ে দু হাতে প্লেট আকড়ে ধরলাম। বেড়ালের মতো গুটিগুটি পায়ে গিয়ে দাঁড়ালাম তার পাশে। সে হাত বাড়িয়ে স্যালাডের প্লেটটা এগিয়ে আনলেন। টমেটো গুলো বাদ দিয়ে বেশ কয়েকটা শসা তুলে বললেন, ‘প্লেট আগা।’
আমি চাবি দেওয়া পুতুলের মতো তাই করলাম। উনি আমার পাতে শসা আর এক পিস লেবু দিলেন। টমেটো দিলেন না। আমি কাঁচা টমেটো পছন্দ করিনা। সেটা তার জানা। অতঃপর এমন একটা ভাব করলেন যেন কিছুই হয়নি। চুপচাপ মামণীর দিকে তাকিয়ে অমায়িক এক হাসি দিলেন। এগিয়ে দিলেন নিজের প্লেট। আম্মু ওনার প্লেটে বিরিয়ানি দিতে দিতে বললেন, ‘সবসময় এমন দৌড়াদৌড়ির মধ্যে থাকে মেয়েটা। এতো কিসের তাড়াহুড়ো বুঝিনা। কোথাও বের হওয়ার সময়ও তিনচারবার করে ফিরে আসে ফেলে যাওয়া জিনিস নিতে। খালি বেখেয়ালিপণা।’
আব্বু আমার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললেন, ‘এখনো ছোট তো। ঠিক হয়ে যাবে আস্তে আস্তে।’
কাব্য ঠোঁট চেপে খানিকটা হেসে বলল, ‘আর কত বড় হবে আপনার মেয়ে?’
আব্বু গরম চোখে তাকাতেই গলা ঝেড়ে খাওয়ায় মনোযোগ দিল ও। আদ্রিয়ান ভাই প্লেটে শসা নিচ্ছিলেন। হঠাৎই গম্ভীর স্বরে বললেন, ‘ঘরে ফেলে যাওয়া জিনিস নেওয়ার জন্যে আবার ফিরে আসা যায়। কিন্তু জীবনে কিছু ফেলে গেলে সেটা নেওয়ার জন্যে আর ফেরা যায়না। তখন ফেলে যাওয়া জিনিসগুলোকে ফেলেই এগিয়ে যেতে হয়। সঙ্গে যায় কেবল আফসোস। তাই জীবনে এতোটাও বেখেয়ালি হওয়ার উচিৎ না, যাতে বাকি জীবনটা আফসোস নিয়ে এগিয়ে যেতে হয়।’
বড্ড অকারণেই মনে এক ধাক্কা খেলাম আমি। সাধারণ একটা কথা। অথচ ভেতর থেকে কেমন নাড়িয়ে দিল আমাকে। উপলব্ধি করলাম শরীরের সব পশমগুলো দাঁড়িয়ে গেছে। তারপর আব্বু কিছু বলেছিলেন বোধ হয়। কিন্তু আমার মনে নেই। কেমন এক ঘোরে চলে গেলাম আমি। আশেপাশের সবকিছু কেমন ফাঁকা লাগছিল। সে অবস্থাতেই কখন যেন আস্তে আস্তে রুমে চলে গেছি আজও মনে পড়েনা।
যখন ঘোর কাটল তখন বিছানায় বসে আছি আমি। সামনে বিরিয়ানির প্লেট। ভ্যাঁপসা গরম অনুভব করলাম। ভেতর থেকেও অস্থির লাগছে খুব। উঠে গিয়ে ফ্যানটা বাড়িয়ে দিলাম। বিছানায় স্থির হয়ে বসে ওয়াটার পট থেকে বেশ খানিকটা পানি খেলাম। কিন্তু মন? মন স্থির হলোনা। আর সেই অস্থির মনেই আপির কথা মনে পড়ল। মন খারাপ করে তাকালাম খাবারের প্লেটটার দিকে। আপি থাকলে দুজন একসঙ্গে বসে আড্ডা দিয়ে খেতে পারতাম। আপির ভার্সিট অফ। আর ছুটি পেলেই আপি ছুটে আসতো শরীয়তপুর। মামাবাড়ির চেয়েও বেশি সময় কাটাতো এ বাড়ি। কত চমৎকার সময় কাটাতাম আমরা। কিন্তু এখন বন্ধ পেয়েও ও ঢাকায় আছে। রায়হান ভাইয়ের কাছে।
একটা কথা সত্যি। শ্বশুরবাড়ির লোক, স্বামী যত ভালোই হোক। বিয়ের পর আগের সম্পর্কের সমীকরণগুলো কিছুটা হলেও বদলায়। চাইলেও সব আগের মতো রাখা যায়না। দীর্ঘশ্বাস চাপলাম আমি। যদিও কদিন পরেই মামাবাড়ি চলে আসবে আপি। সামনের মাসেই ডেলিভারি ওর। খুব শীঘ্রই একটা পুচকে সোনা আসবে। ব্যপারটা ভেবে ঠোঁটে সামান্য হাসি ফুটল আমার। আশেপাশে কয়েক সেকেন্ড খুঁজে ফোন বের করলাম। বিরিয়ানির একটা ছবি তুলে আপিকে পাঠিয়ে লিখলাম, ‘এইযে উড বি মাদার? খাবা?’
মেসেজটা পাঠিয়ে দিয়ে খেতে বসলাম আমি। খিদে পেয়েছে। তিন লোকমার মতো মুখে দিতেই আপির কল এলো। খুশি হয়ে দ্রুত রিসিভ করলাম। ওপাশ থেকে আপি বলল, ‘কীরে? বিরিয়ানি রান্না হয়েছে। সেটা তুই আবার সুন্দরভাবে রেখে ছবিও তুলেছিস? এতোটা অপেক্ষা সহ্য হয়েছে তোর? এতো ধৈর্য্য কোথ থেকে আমদানি করলি?’
খাবার চিবুতে চিবুতে আপির কথা শুনছিলাম আমি। আপি একথা বলতেই থেমে গেলাম আমি। সময় নিয়ে মুখের খাবার শেষ করলাম। তারপর বললাম, ‘আমি কী খুব বেশি অধৈর্য্য আপি?’
আপি একটু অবাক কন্ঠে বলল, ‘কী হয়েছে বলতো? হঠাৎ এমন প্রশ্ন করলি কেন?’
‘কিছুনা। মিস করছিলাম তোমাকে।’
‘আমিও। আসছি সামনের সপ্তাহে।’
‘বাহ্। তোমার ডেলিভারির ডেইটটা যেন কবে?’
‘জুলাইর নয় তারিখ বলেছে ডক্টর।’
‘শরীয়তপুরেই করানোর প্লান আছে না-কি?’
‘এখনো তাই প্লান।’
‘আচ্ছা এসো তাহলে। রায়হান ভাই কেমন আছেন?’
‘বেশ ভালো।’
‘এক্সাইটেড?’
‘নেক্সট লেভেলের।’
আমি হাসলাম। আপিও শব্দ করে হাসল। তারপর বলল, ‘তা ময়নাপ্পি আজ বিরিয়ানি রান্না করল যে?’
আমি হতাশ এক শ্বাস ফেলে বললাম, ‘তোমাদের সবার সেরা আদ্রিয়ান ভাই। নিজের এতো এতো মূল্যবান সময়ের মধ্যে থেকে সময় বের করে। সপ্তাহে তিনটে দিন এক ঘন্টার নাম করে টানা দু ঘন্টা যে আমাকে ফ্রিতে পড়িয়ে যাচ্ছে। তারতো একটা দাম আছে না-কি? তাই আম্মুর শখ জাগে মাঝেমাঝে তাকে ভালোমন্দ খাওয়ানোর। খাওয়াচ্ছে আজ বিরিয়ানি। তার বদৌলতে আমাদের কপালেও একটু জুটলো।’
আপি মিষ্টি কন্ঠে বলল, ‘যাই বলিস। আদ্রিয়ান ভাই মানুষটাই কিন্তু এমন বল। একদম চমৎকার সুন্দর রত্নের মতো। দেখলেই ইচ্ছে করে একদম যত্ন করে কোথাও তুলে রাখি। যাতে কোথাও একটুও দাগ না লাগে। সেখানে ওনারাতো মা। অমন ছেলেকে আদর করে আগলে রাখতে কার না ভালো লাগে?’
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, ‘হইছে থামো। তোমার কথায় আমার খিদে বেড়ে গেছে। রাতে কল দেব। এখন বাই!’
‘আচ্ছা বাই।’
কলটা কেটে লম্বা শ্বাস ফেললাম আমি। আপির সঙ্গে কথা বলে বেশ হালকা লাগছে এখন। এবার কিছুটা হলেও স্বস্তিতে খেতে পারব।
কিন্তু এই স্বস্তি ব্যপারটা বোধ হয় আমার কপালে চিরস্থায়ী হয়না। এমনিতেই দুপুর দুপুর ভ্যাঁপসা গরমে টানা দুঘন্টা পড়াশোনা নামক অত্যাচার করেছেন ইঞ্জিনিয়ার সাহেব। ভেবেছিলাম ভরপেট বিরিয়ানি খেয়ে বিকেলে একটা ঘুম দেব। কিন্তু কীসের কী? হঠাৎই উনি বলে উঠলেন, মামণি নাকি আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে বলেছে আজ। আজ রাত আমায় মানিক আঙ্কেলের বাড়িতেই কাটাতে হবে। সবে শুয়েছিলাম। তন্দ্রাভাব এসেছিল চোখে। তখনই আমার রুমে এসে কথাটা পাড়লেন আম্মু। বলে গেলেন দ্রুত তৈরী হয়ে নিতে। বিছানায় আসাম করে কাঁদোকাঁদো মুখে বসে রইলাম কিছুক্ষণ। চরম বিদ্রোহ করে না করব তারও উপায় নেই। সেই বিষয়ে কড়া রেস্ট্রিকশন দিয়ে দিয়েছেন বাবা-মা দুজনেই। কারণ এমন আলসেমি আমি এর আগেও বহুবার করেছি। ওনাদের ধারণা আলসেমিকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে চরম অসমাজিক জীবে পরিণত হচ্ছি আমি। সুতরাং যেতে হবে।
–
মেঘলা আকাশ। ভ্যাঁপসা গরম। হালকা-পাতলা বাতাস বইছে। বোঝাই যাচ্ছে যেকোনো সময় বৃষ্টি নামবে। আদ্রিয়ান ভাইয়ের বাইকটা মাঝারির চেয়ে কিছুটা দ্রুত গতিতে ছুটছে জাজিরা টু শরীয়তপুর সদর রাস্তা দিয়ে। ওনার কাঁধে একহাত রেখে পেছনে বসে আছি আমি। পদ্মাসেতু উদ্বোধনের পর বিশাল বিশাল বাস যাচ্ছে এই রাস্তা দিয়ে। যার ফলে রাস্তাটার অবনতি হতে শুরু করেছে। ভাঙা পড়ছে প্রচুর। ফলসরূপ বারবার ভাঙনের ঝাকিতে ওনার ওপর ঢলে পড়ছি আমি। ঐসময়ের পর থেকে সরাসরি আমার সঙ্গে একটাও কথা বলেন নি উনি। আমিও বলিনি। কী দরকার?
কিন্তু যখন দেখলাম বাইকটা আজও তার বাড়ির দিকে না গিয়ে অন্যদিকে যাচ্ছে, বিরক্ত হয়ে বললাম, ‘আজ আবার কোথায় যাচ্ছেন?’
উনি কিছু বললেন না। তবে বাইকের স্পিডটা একটু বাড়ল। আমি একটু আওয়াজ করে বললাম, ‘দেখুন আজ যদি আপনি আমাকে কোথাও নিয়ে টিয়ে যাওয়ার প্লান করেন আমি কিন্তু আব্বুকে বলে দেব। এসব কী? কিডন্যাপার নাকি আপনি? হুটহাট বাড়ির লোকেদের উল্টাপাল্টা বুঝিয়ে আমায় তুলে নিয়ে চলে যান। এগুলোতো ক্রি/মি/নাল এক্টিভিটিস্।’
হঠাৎই ভয়ংকরভাবে ব্রেক কষলেন উনি। আমি ধাক্কা খেয়ে প্রায় উঠে গেলাম ওনার পিঠে। নিজেকে কোনমতে সামলে নিয়ে বললাম, ‘সমস্যা কী আপনার? খু/নটুন করে ফেলবেন নাকি?’
উনি দাঁতে দাঁত পিষে বললেন, ‘এই মুহূর্তে চুপ না থাকলে ক্রি/মি/নাল এক্টিভিটিস্ ঠিক কীরকম হয় ডেফিনেশন, এক্সপ্লেনেশন, এক্সামপলসহ বুঝিয়ে দেব। একদম প্রাকটিক্যালি। কীপ কোয়াইট।’
কথাগুলো ঠান্ডাগলায় বললেও এটাকেই পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ানক হুমকি মনে হল। টু শব্দ করার সাহস পেলাম না আমি আর।
–
চিলেকোঠা ক্যাফে এন্ড রেস্টুরেন্ট। পাশাপাশি দুটো চেয়ারে বসে আছি আমি আর আদ্রিয়ান ভাই। তার ঠিক অপরপাশে বসে আছেন দোলা আপু। নতদৃষ্টি, গোমড়া মুখ। এই মুহূর্তে বোকা হয়ে গেছি আমি। দোলা আপু এখানে কী করছে? আদ্রিয়ান ভাই আমায় এখানে কেন আনলেন? উনিই বা কেন এলেন? এতোগুলো প্রশ্ন মগজে গিজগিজ করলেন কোনটারই উত্তর নেই আমার কাছে। সেইযে ভয়ানক হুমকিসহ উনি বলেছেন, কীপ কোয়াইট। তখন থেকে আমি কোয়াইট-ই আছি। আর বোঝার চেষ্টা করছি যে ঘটনা আসলে কী ঘটছে।
ওয়েটার এসে তিন মগ কফি সার্ভ করে দিয়ে চলে গেলেন। এতক্ষণ নিজের মত ফোন ঘাটছিলেন আদ্রিয়ান ভাই। ওয়েটার যেতেই ফোন থেকে চোখ তুলে তাকালেন কাচুমাচু হয়ে বসে থাকা দোলা আপুর দিকে। হালকা গলা ঝেড়ে বললেন, ‘দোলা, তোমাকে এখানে আমি কেন ডেকেছি নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারছো?’
একবার চোখ তুলে আবার নামিয়ে ফেললেন দোলা আপু। হালকা করে মাথা ঝাঁকালেন। আদ্রিয়ান ভাই বললেন, ‘তোমাকে কিছু কথা বলব আমি এখন। প্লিজ, কান্নাকাটি করবে না। এটা পাবলিক প্লেস। আমি চাইনা কোন সিনক্রিয়েট হোক।’
দোলা এবারেও চুপ। একটু থেমে আদ্রিয়ান ভাই বললেন, ‘তুমি যে ছবিগুলি আমাকে পাঠিয়েছিলে সেগুলো আমি আমার ফোন থেকে ডিলিট করে দিয়েছি। কিন্তু তোমার ফোনে নিশ্চয়ই আছে? তুমি নিজেই সেই মেসেজগুলো একবার চেক করোতো। এখনই, আমার সামনে।’
দোলা আপু তাকিয়ে রইলেন। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর আদ্রিয়ান ভাই আবার বললেন, ‘করো।’
কাঁপাকাঁপা হাতে ফোন বের করলেন দোলা আপু। মেসেজগুলো বের করলেন বোধ হয়। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন ফোনের স্ক্রিনের দিকে। আদ্রিয়ান ভাই বললেন, ‘দেখেছো? এবার কিছুক্ষণের জন্যে চিন্তা করো। এই ছবিগুলি তোমার বাবা-মা, ফ্যামলি, রায়হান ভাই, তোমার বন্ধুরা সবাই দেখল। কেমন হবে ব্যপারটা?’
চোখ টলমল করে উঠল দোলা আপুর। এক্ষুনি যেন জল গড়িয়ে পড়বে। সেটা দেখে মায়া হল আমার। কিন্তু নিজের জায়গা থেকে নড়তে পারলাম না। আদ্রিয়ান ভাই আবার বললেন, ‘তুমি বুঝতে পারছো আমি কী বলতে চাইছি?’
নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে মাথা ঝাঁকালেন দোলা আপু। ছোট একটা শ্বাস ফেলে আদ্রিয়ান ভাই এবার একটু রুক্ষ ভাবেই বললেন, ‘তুমি আমাকে চিনতে না দোলা। ইভেন এখনো চেনোনা। আমি কেমন মানুষ, আমার স্বভাব কী, কিছুই জানোনা তুমি। দুদিন দেখেই একটা অ্যট্রাকশন ফিল করেছো। হুইচ ইজ ফাইন। সেটা দোষের কিছু না। দিস ইজ হিউম্যান সাইকোলজি। হতেই পারে। তাই বলে ছেলেটা পাত্তা দিচ্ছেনা বলে, ইগনোর করছে বলে এধরণের ছবি পাঠাবে তার এটেনশন পেতে? এতো আবেগ! তুমি কী করে নিশ্চিত হলে এই ছবিগুলো আমি ভাইরাল করে দেবোনা? কীকরে শিওর হলে আমি এগুলো নিয়ে খারাপ কিছু করব না? চেহারা দেখে? শুধুমাত্র একজনের লুক দেখে তাকে এতোটা বিশ্বাস করে ফেললে? যদি করতাম? কী করতে? দুদিন হাতে-পায়ে ধরে কান্নাকাটি করতে। এরপর সু/ই/সাইড করতে। এছাড়া আর কোন অপশন থাকতো তোমার কাছে?’
দোলা আপু প্রচন্ডভাবে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে রাখলেন। বাঁ চোখ দিয়ে একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। আমি তখনও মূর্তির মতো বসে আছি। আর দেখছি দুজনকে। এতো রুড ভাবে বলার কী আছে? কষ্ট পাচ্ছেতো মেয়েটা। কাঁদছে। আবার নিচে নেমে এলো আদ্রিয়ান ভাইয়ের গলা, ‘কান্না করোনা। আমি জানি দোলা তুমি ভদ্র বাড়ির মেয়ে। রায়হান ভাইয়ের মতো লোক যে বাড়িতে বড় হয়েছে সে বাড়ির মেয়ে খারাপ হতে পারেনা। আবেগে পড়ে এসব করেছো বুঝতে পারছি। তাই ঠান্ডা মাথায় বোঝাচ্ছি। কারো প্রতি অনুভূতি আসতেই পারে। তারমানে এই নয় তাকে তুমি আযথা ডিসটার্ব করবে। তারচেয়েও বড় কথা আবেগে ভেসে গিয়ে এমন কিছু করবেনা যাতে ভবিষ্যতে তোমাকে পস্তাতে হয়। আজ আমার জায়গায় নিচু মানসিকতার কোন মানুষ থাকলে অবশ্যই ছবিগুলোর মিসইউজ করতো। তাই প্লিজ এধরণের ভুল আর করোনা।’
দোলাপু মাথা নিচু করে আছেন। কেঁপে কেঁপে উঠছে তার শরীর। বাতাসের তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলাম গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়ছে। উনি উঠে দাঁড়ালেন। দোলাপুর কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে হালকা করে ওনার মাথায় হাত রেখে বললেন, ‘তুমি আমার ছোট বোনের মতো। তাই এতগুলো কথা বললাম। কষ্ট পেওনা। সবটাই তোমার ভালোর জন্যে ছিল। বিশ্বাস করো, তোমাকে ঠাটিয়ে কয়েকটা চড় মারার জন্যে আমার হাত এখনো চুলকাচ্ছে। এই স্যয়ার। কিন্তু আমি বহু কষ্টে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছি। কারণ ব্যপারটা জানাজানি হলে শুধু তোমার না তোমার পরিবারের মানসম্মান নিয়ে টানাটানি হবে। যে পরিবারের সাথে আমার খুব কাছের একটা পরিবার জড়িয়ে আছে। যা আমি চাইছিনা। টিনেজার নও তুমি। হে বয়স অলরেডী পাড় করে এসেছো। এতোটা আবেগী হওয়ার কিছু নেই। আশা করব এরকম কিছু আর করবেনা তুমি। শুধু আমি বলে না, কারো ক্ষেত্রেই না।’
দশ সেকেন্ড পিনপতন নিরবতায় কেটে গেল। মুগ্ধতায় স্তব্ধ হয়ে গেছি আমি। আমার সেসময়কার অনুভূতি ব্যখ্যা করার মতো শব্দ এখন মাথায় আসছেনা আমার। উনি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তোমরা দুজন কফি খেতে থাকো। আমি পাঁচ মিনিটে নিচ থেকে আসছি।’
দুজনের কেউই কিছু বললাম না। উনি চলে গেলেন। উনি যাওয়া পর দু মিনিট একদম চুপ ছিলাম আমি। আনমনেই কফির মগে চুমক দিচ্ছিলাম। ঘোর তখনও কাটেনি আমার। কাটল দোলাপুর ডাকে। উনি মৃদু কন্ঠে বললেন, ‘আমি খুব লজ্জিত অনিমা।’
আমি থতমত খেয়ে গেলাম। কোনমতে নিজেকে সামলে বললাম, ‘আপনিতো আমার সঙ্গে কিছু করেননি। আমার কাছে লজ্জিত হয়ে কী লাভ? তারচেয়ে ওনাকে বলুন কথাটা।’
‘তুমি সত্যিই খুব লাকী।’
আমি ভ্রু কোঁচকালাম। বুঝতে না পেরে বললাম, ‘কেন?’
দোলা আপু মলিন হেসে বললেন, ‘এমন অসাধারণ এক মানুষ তোমার ব্যক্তিগত।’
আমি থমকে গেলাম। মগটা টেবিলে রেখে বললাম, ‘ভুল ভাবছেন আপু। তেমন কিছু না।’
দোলা আপুর হাসি প্রসারিত হল। কফির মগের চারপাশে আঙুল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বললেন, ‘এই ব্যপারটা কিন্তু উনি কাউকে বলেননি। কাউকে জানতেও দেননি। কিন্তু তোমাকে জানতে দিয়েছেন। এখানে আমার সঙ্গে দেখা করতেও কিন্তু একা আসেন নি। তোমাকে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। কারণগুলোতো পরিষ্কার তাইনা অনি? উনি যা কাউকে বলতে পারেন না, তা একমাত্র তোমাকে বলতে পারেন। যেখানে কাউকে নিয়ে যেতে পারেননা, সেখানে কেবল তোমাকে নিয়ে যেতে পারেন। কারো জীবনের কতটা জায়গা জুড়ে থাকলে এটা সম্ভব বলোতো?’
দোলা আপু কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে আবার বললেন, ‘এমন অমূল্য জায়গা হেলায় হারাতে নেই। শক্ত করে ধরে রাখো। বহু মানুষ কপাল ঠুকেও কারো জীবনে এই জায়গাটা করতে পারেনা। তুমি নিঃসন্দেহে ভাগ্যবতী।’
আমি কিছু বললাম না। অবশিষ্ট কফিটুকু ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সেদিকে আর খেয়াল রইল না আমার। আস্তে করে উঠে গেলাম। ধীরপায়ে গিয়ে দাঁড়ালাম জানালার কাছে। গুড়িগুড়ি বৃষ্টির গতি সামান্য বৃষ্টি পেয়েছে। বাতাসের দমকে মৃদু ছেঁটা এসে লাগছে চোখেমুখে। লম্বা শ্বাস ফেললাম। আর বোঝার চেষ্টা করলাম, কারো জীবনের কতটা জায়গা জুড়ে থাকলে এটা সম্ভব?
…
[ রি-চেক হয়নি। এটা পেলে সকলেই মারাত্মক খুশি হন, সারপ্রাইজড হন আমি জানি। কিন্তু কমেন্টে সেই খুশির হওয়ার খবরটা শোনানোর সঙ্গে সঙ্গে গল্পভিত্তিক গঠমূলক মন্তব্যও করবেন প্লিজ।]