#সাদিয়া_শওকত_বাবলি
#পর্ব_৩
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )
সম্মুখের গাড়িটা ওভারটেক করে উঠতেই হুট করেই কেউ একজন এসে পড়লো গাড়ির সম্মুখে। হকচকিয়ে উঠলো আরুশ। দ্রুত ব্রেক কষলো। আচমকা ব্রেক কষায় বেজায় বিরক্ত হলো তুর্য। হাতের ল্যাপটপটা পড়ে যেতে যেতে ধরে ফেললো। কপালে ভাঁজ ফেলে উদ্যত হলো কিছু শক্ত কথা বলতে। তবে সম্মুখ ভাগের অবস্থা অবলোকনে আর কিছু বলল না। বিরক্তি ভঙ্গিতে আবারও দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো ল্যাপটপে। আরুশ হন্তদন্ত হয়ে গাড়ি থেকে বের হলো। দেখলো কলেজের পোশাকে একটা মেয়ে বসে আছে গাড়ির সম্মুখে। বসে বসে কিছু একটা নিয়ে টানাটানি করছে ভীষণভাবে। আরুশ এগিয়ে গেল তার পানে। অপরাধীর ন্যায় বলল,
-“দুঃখিত, আমি বুঝতে পারিনি।”
মেয়েটা চোখ তুলে তাকালো আরুশের পানে। গোলগাল চেহারার দারুন এক কন্যা সে। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা মুখশ্রীতে ক্রোধ স্পষ্ট। আরুশের কন্ঠ শুনে যেন ক্ষেপে গেল আরও, মুহুর্তেই অগ্নিমুর্তি ধারন করলো। গলা থেকে কিছু একটা খুলে উঠে দাঁড়ালো। ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল,
-“কিসের দুঃখিত? দেখেশুনে গাড়ি চালাতে পারেন না? দেখেছেন আপনার জন্য আমার কত বড় ক্ষতি হলো। হাতটা ছুলে গেছে, কলেজ কার্ডটাও আপনার গাড়ির নিচে পিষে ই’ন্তে’কা’ল করেছে।”
আরুশ পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো মেয়েটার পানে। সত্যিই কনুইয়ের কাছ থেকে ছুঁলে গেছে মেয়েটার। লাল রক্তেরও আবির্ভাব দেখা যাচ্ছে। আসলে দোষটা আরুশেরই। সে দেখেছে তার সম্মুখের গাড়িটা দাঁড় করানো। তখনই বুঝে যাওয়া উচিৎ ছিল সামনে কোনো ঘাপলা আছে। নয়তো যানযট ছাড়তেও গাড়িটা এগুচ্ছে না কেন? কিন্তু সে তা করেনি। উল্টো দু’র্নী’তি করে পাশ থেকে একটু ফাঁকা জায়গা দেখেই গাড়ি সামনে তুলে দিয়েছে। অনুতপ্ত হলো ছেলেটা। আমতা আমতা করে বলল,
-“দুঃখিত।”
-“কিসের দুঃখিত? আপনার দুঃখিত ধুয়ে ধুয়ে কি আমি পানি খাবো? কত বড় সাহস! সামনে গাড়ি দাঁড় করানো দেখেও পিছন থেকে গাড়ি সামনে ঠেলে দিয়েছিলে আপনি।”
থমলো মেয়েটা। আবারও ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল,
-“এই! এই আপনাকে গাড়ি চালানোর লাইসেন্স কে দিয়েছে? আমি আপনার গাড়ি চালানোর লাইসেন্সই কেড়ে নেব এক্ষুনি, বেয়াদব ড্রাইভার।”
আরুশ কাঁচুমাচু মুখ করলো। হয়তো আবারও একবার দুঃখিত বলতে চাইলো। তবে সে মুখ খোলার আগেই গাড়ির ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো ভারী এক কন্ঠস্বর। তুর্য ল্যাপটপে দৃষ্টি রেখেই গম্ভীর কন্ঠে বলল,
-“কিছু টাকা ধরিয়ে দিয়ে বিদায় কর এটাকে, আরুশ।”
তুর্যের কথায় আরও ফুঁসে উঠলো মেয়েটা। গাড়ির খোলা জানালা গলিয়ে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো তুর্যর পানে। দাঁতে দাঁত চেপে উদ্যত হলো কিছু শক্ত কথা বলার জন্য। তবে সে সুযোগ আর হয়ে উঠলো না। সামনের বাস থেকে ডাক পড়লো তার আগেই। বাসের জানালা থেকে অন্য আরেকটা মেয়ে হাত বাড়িয়ে বলল,
-“এই ছে’ম’ড়ি গাড়ি ছেড়ে দিচ্ছে তাড়াতাড়ি আয়।”
মেয়েটা আর কথা বাড়ালো না। তীব্র সুচালো দৃষ্টিতে শেষ একবার সে তাকালো তুর্য এবং আরুশের পানে। যেন দৃষ্টি দিয়েই বুঝিয়ে গেল,
-“তোদের আমি দেখে নেব। সাহস থাকলে আমার সামনে পড়িস আবার।”
এই টুকু মেয়ের এমন ধারালো দৃষ্টিতে প্রথমে আরুশ ভরকে গেলেও পরক্ষনে নিজেকে সামলে নিল। মেয়েটা দৌড়ে চলে গেল বাসের পানে। আরুশ স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে গাড়ির দিকে যেতেই চোখ পড়লো চাকার নিচে পড়া কলেজ কার্ডটার দিকে। ছেলেটা একটু ঝুঁকে কৌতুহল বশত হাতে তুললো কলেজ কার্ডটা। কার্ডের উপরের অংশাটা নষ্ট হয়ে গেছে। ছবি বা কলেজের নামটা বোঝা যাচ্ছে না তেমন তবে মেয়েটার নাম পরিচয় এখনও স্পষ্ট। আরুশ পড়লো মেয়েটার নাম পরিচয়। চমকে উঠলো সাথে সাথে। হাত পায়ে কাঁপন ধরলো। এটা কি সত্যিই? নাকি ভুল দেখছে? আরুশ আবারও পড়লো কার্ডে থাকা মেয়েটার নাম পরিচয়। ঘাড় বাঁকিয়ে একবার তাকালো তুর্যের পানে। তার কি এখনই তুর্যকে কিছু বলা উচিৎ? নাকি চেপে যাওয়া উচিৎ। কিন্তু পরে যদি তুর্য কিছু জানতে পারে নির্ঘাত তাকে কু’চি কু’চি করে কা’ট’বে। এলোমেলো পা ফেলে তুর্যের পানে এগিয়ে গেল আরুশ। এদিক ওদিক নজর ঘুরিয়ে ডাকলো,
-“স্যার!”
তুর্য ল্যাপটপের কিবোর্ডে হাত চালাতে চালাতে বলল,
-“হুম, গাড়ি ছাড়বি নাকি আমি এই মাঝ রাস্তায় অন্য ড্রাইভারের খোঁজ লাগাবো?”
আরুশ ঢোক গিলল। আমতা আমতা করে বলল,
-“স্যার একটু আগের মেয়েটা!”
-“হুম, কি হয়েছে?”
-“মেয়েটা তার কলেজ কার্ড ফেলে গেছে।”
তুর্য বিরক্ত হলো বেজায়। ছেলেটা মাঝ রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে কি মেয়ে মেয়ে করে হেদিয়ে ম’র’ছে। কন্ঠে বেশ বিরক্তি নিয়েই তুর্য বলল,
-“তো!”
-“কলেজ কার্ড অনুযায়ী মেয়েটার নাম পৃথা ইসলাম, বাবার নাম পলাশ সিকদার, মায়ের নাম সুফিয়া বেগম।”
ল্যাপটপের কিবোর্ডে হাত থেমে গেল তুর্যর। তড়িৎ গতিতে সে ফিরে তাকালো আরুশের পানে। নিজের কানকে যেন বিশ্বাস করতে পারছে না ছেলেটা। অবিশ্বাস্য কন্ঠে বলল,
-“কি বললি তুই, আবার বলল তো?”
আরুশ আর একবার উল্টে পাল্টে দেখলো কলেজ কার্ডটা অতঃপর আবার বলল,
-“স্যার এই মেয়েটাই সম্ভবত আপনার মুরগির বাচ্চার মতো বউ ছিল। কার্ডের জন্ম তারিখ অনুসরে এই মেয়েটার বয়সও ১৭।”
তুর্য নিজের কোল থেকে ল্যাপটপটা পাশে রাখলো দ্রুত। হুরমুরিয়ে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালো। ব্যস্ত ভঙ্গিতে আশেপাশে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। অস্থির কন্ঠে শুধালো,
-“কোথায়? আমার বউ কোথায়?”
আরুশ হাত দিয়ে সম্মুখের দিকে একটা চলন্ত বাস দেখিয়ে দিল। মিনমিনিয়ে বলল,
-“আপনার বউ ঐ বাসে চলে গেছে স্যার।”
তুর্য তাকালো বাসের পানে। কপাল কুঁচকে বলল,
-“তাহলে তুই এখানে এখনও দাঁড়িয়ে আছিস কেন আহাম্মক। তাড়াতাড়ি বাসটার পিছু নে।”
আরুশ ব্যস্ত পায়ে গাড়িতে উঠে বসলো। তুর্য উঠে বসতেই গাড়ি স্টার্ট দিলো। ছুটে চললো বাসটার পিছু পিছু। কিন্তু হায়! ভাগ্য বুঝি এবারেও সহায় হলো না। কিছুটা দূরে গিয়েই আবার জ্যামে পড়ে বাসটা হারিয়ে ফেললো তুর্য আর আরুশ। হতাশ হলো তুর্য। গাড়ির সিটের সাথে গা এলিয়ে দিয়ে থমথমে কন্ঠে বলল,
-“একবার দেখা পাই আমার বেয়াদব বউটার। আগে দুই চারটা থাপ্পর মেরে নেব তারপর আদর ভালোবাসা। জ্বালিয়ে মা’র’ছে শুধু আমায়।”
আরুশ চুপ রইলো উত্তর দিল না কোনো। কিঞ্চিৎ সময় পর আবার নিজেই মুখ খুললো তুর্য। হতাশ কন্ঠে বলল,
-“আমি বউকে খুঁজে ম’র’ছি আর বউটা আমার থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।”
এবার মুখ খুললো আরুশ। মিনমিনে কন্ঠে বলল,
-“কিন্তু স্যার আপনার বউ তো জানে না আপনি তাকে খুঁজছেন।”
তেতে উঠলো তুর্য। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
-“কেন জানবে না? মাত্র ১০ বছর বয়সে আমার মতো একটা দামড়া ছেলেকে বিয়ে করে জামাই জুটিয়ে ফেলতে পারলো। অথচ তার জামাই যে তাকে খুঁজতে পারে তা জানে না। ল্যাদা বউ আমার।”
ফোঁস ফোঁস করে কয়েকটা নিঃশ্বাস ফেললো তুর্য। চোখ বন্ধ করে নিল সিটের সাথে মাথা এলিয়েই। কিঞ্চিৎ সময় অতিবাহিত হতেই কিছু একটা ভেবে ধপ করে চোখ দুটো খুললো আবারও। সোজা হয়ে বসে বলল,
-“আমার বউ কি আমাদের গাড়ির সামনে পড়ে কোনো ব্যথা পেয়েছে?”
আরুশ আমতা আমতা শুরু করলো। এখন যদি সে বলে দেয় যে মেয়েটার হাত ছুলে গেছে তাহলে কেমন রিয়েক্ট করবে তুর্য? নিশ্চই তাকে এই মাঝ রাস্তায় গাড়ি থেকে ঠেলে ফেলে দিবে। আর যদি না বলে বা মিথ্যা বলে তবে পরে জানতে পারলে ঘাড় থেকে মাথা আলাদা করে দিবে। সে হিসেবে সত্যিটা বলাই বাঞ্ছনীয়। আরুশ সময় নিল একটু অতঃপর তুতলিয়ে বলল,
-“হহহাতের কনুইটা একটু ছুঁলে গেছে। রক্তও বেরিয়েছিল।”
তুর্যের বুকটা ছ্যাত করে উঠলো যেন। এতদিন পর বউকে যাও একটু খুঁজে পেয়েছিল। তাও বউটা তার তরফ থেকে আঘাত নিয়ে গেল? মুহুর্তেই চেতে গেল তুর্য। ক্ষ্যাপাটে কন্ঠে বলল,
-“তুই দেখে শুনে গাড়ি চালাবি না আহাম্মক? আজ তোর জন্য আমার মুরগির বাচ্চার মতো বউটা আঘাত পেল। তোর গাড়ি চালানোর লাইসেন্স আমি কেড়ে নেব, বেয়াদব। এই তোকে গাড়ি চালানোর লাইসেন্স দিয়েছে কে বল তো?”
আরুশ পড়লো মহা ফ্যাসাদে। যেমন স্বামী তেমন তার স্ত্রী। দুজনেরই নজর তার নিস্পাপ লাইসেন্সের উপর। তবে এই লাইসেন্স তো তুর্যই তাকে এনে দিয়েছিল। আরুশ ঘাড় বাঁকিয়ে তাকালো তুর্যর পানে। কিছুটা ঠান্ডা কন্ঠেই বলল,
-“লাইসেন্স তো দিয়েছে সরকার। তবে এই লাইসেন্স করার পিছনে টাকা ঢেলেছেন আপনি।”
আরুশের কথায় থতমত খেয়ে গেল তুর্য। আমতা আমতা করে বলল,
-“ব্যাটা বদমাইশ। চোখ কোথায় রেখে গাড়ি চালাস? বাসর সারার আগেই বউকে পিষে দিয়ে আমাকে বিধবা করার পায়তারা করছিলি? মীর জাফরের বংশধর কোথাকার।”
৫.
রাতের পরে দিনের দেখা মিলেছে। সকালের সূর্যটা ধীর গতিতে তার উজ্জ্বলতা বাড়াচ্ছে। সকাল হতেই তুর্য নেমে পড়েছে তার বউয়ের খোঁজে। কাল এখানে আসতে আসতেই বিকাল গড়িয়েছিল। তারপর আবার হোটেল ঠিক করে হোটেলে উঠেছে তাই আর গতকাল খোঁজাখুঁজির সুযোগ পায়নি। তাছাড়া যেহেতু রাজশাহীর এই এলাকাতেই মেয়েটার দেখা মিলেছে এবং কলেজ কার্ড পেয়েছে তার মানে মেয়েটা এই এলাকাতেই থাকবে এবং এই এলাকারই কোনো কলেজে পড়বে। তুর্য দুইটা কলেজ খুঁজে ফেলেছে ইতমধ্যে। কিন্তু বউয়ের দেখা পায়নি কোথাও। তুর্যর বুঝে আসে না শহরের বুকে এক একটা এলাকাতে এত কলেজের কি প্রয়োজন? একটা কলেজ হলেই তো পারতো। এখনও আশেপাশে দুই তিনটা কলেজ আছে। এই দুই তিনটায় খুঁজে না পেলে আবার নতুন করে খোঁজ লাগাতে হবে বউয়ের। ছেলেটার ভাবনার মধ্যেই তারা এসে থামলো একটা মহিলা কলেজের সম্মুখে। আরুশ আর তুর্য একসাথেই নামলো গাড়ি থেকে। গেট পর্যন্ত যেতেই হঠাৎ পকেটে প্রবল ঝংকার তুলে বেজে উঠলো তুর্যর মুঠোফোনটা। ছেলেটা পকেট ঘেটে মোবাইলটা বের করলো। মোবাইলের স্ক্রীনে তাকিয়ে আরুশকে বলল,
-“তুই গিয়ে খোঁজ নে আমি কথা বলে আসছি।”
চলবে…..