ফ্রিজ পর্ব ৩
সন্ধ্যার সময় আকাশ কেমন ডাকতে শুরু করল। মনে হয় কঠিন ঝড় শুরু হবে। আপা বলল,” রুনু মনে হয় ঝড় আসবে রে।”
“হ্যাঁ, আপা।”
“বাবা আসার পরে যেন ঝড়টা শুরু হয়।”
“রুনু, এই রুনু।” মায়ের গলা শুনা যাচ্ছে।
“আসছি মা।”
দৌড়ে মায়ের ঘরে গেলাম। মা খাটে শুয়ে আছে।
“কী হয়েছে মা?”
“মনে হয় ঝড় হবে। জানালাগুলো সব বন্ধ করে দে তো মা।”
“আচ্ছা।”
“চার্জার লাইটা কোথায়? ওটা কি চার্জে দিয়েছিস?”
আমি চার্জার লাইটটা খুঁজে বের করলাম। লাইটে কোনো চার্জ নাই! এ সময় বিদুৎ চলে গেল। পুরো ঘর অন্ধকার কিছুই দেখা যায় না। মা বলছে,” রেনু লাইটটা খুঁজে পাসনি! কোথায় রাখোস সব?”
“লাইটে চার্জ নাই মা।”
“দুইটা দামড়া মাইয়া ঘরে থাকোস একটা লাইট চার্জে দিবি তাও পারোস না! দ্যাখ মোমবাতি আছে কি-না?”
আপা মায়ের রুমে এসে মায়ের পাশে বসেছে। এখন ঝাপসা ঝাপসা দেখা যাচ্ছে। আপা মাকে জড়িয়ে ধরে বসে বলল, “রুনু এখানে এসে বস তো। কোনো আলো লাগবে না। আজ মায়ের গল্প শোনব।”
মা কে এখন কেমন শান্ত দেখাচ্ছে। বিরক্তি ভাবটা চলে গেছে। আপা কী করে যেন সবাইকে আয়ত্ত করে ফেলে! মা আমার সাথে আর বকাবকি করত। যেন সব দোষ আমার!
আমি খাটে উঠে মায়ের পাশে বসলাম। আপা মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলল, ” একটা গল্প বলো না মা।”
মায়ের মুখে এখন একটা হালকা হাসি ফুটেছে! “কী গল্প বলব?”
“মা নানা বাড়ির গল্প বলো না।”
মা আমাকে কাছে টেনে নিলো। আমার এখন খুব ভালো লাগছে! বাহিরে ঝনঝন করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে।
তোদের নানা বাড়িতে বড়ো একটা আম বাগান ছিলো। কী মিষ্টি আম হতো!
আপা বলল,” বাড়ির পশ্চিম দিকের আম বাগানটা?”
“না রে ওই বাগানটা তোরা দেখিসনি। পূর্ব পাশে এখন যেখানে তোর মামা ঘর তুলেছে।
ঝড়ের মধ্যে আমরা দল বেঁধে আম কুড়াতে বের হতাম। একবার আম কুড়াতে বের হয়েছি। সেদিন এমন ঝড় শুরু হলো মনে হচ্ছিল আমাদের উড়িয়ে নিয়ে যাবে। ঝপঝপ করে আম পড়ছে। তোর শাহিদা খালার মাথায় পড়ল একটা আম। মা গো বলে মাথা ডলতে লাগল এরমধ্যে আরেকটা পড়ল! ভয়ে দিলো দৌড়।
আপা খিলখিল করে হেসে উঠল। আমারও খুব হাসি পাচ্ছে। আমি বললাম” তোমার মাথায় পড়েনি মা?”
“মাথায় পড়েনি তয় পিঠে পড়েছে।”
“খুব ব্যথা পেয়েছিলে মা?”
সে তো একটু লেগেছিল!
মা একটা ছোটো শ্বাস নিয়ে বলল, “কয়টা বাজে রে মিলি?”
“মনে হয় সাতটা সাড়ে সাতটা হবে।”
“তোর বাবার অফিস তো ছুটি হয়ে গেছে অনেক আগে। মানুষটা কোথায় আটকা পড়ল কে জানে!”
“মা বাবার সাথে তোমার পরিচয়ের ঘটনাটা বলো না।”
বাবার কথা বললেই মা কেমন একটু লজ্জা পায়। মায়ের লজ্জা লজ্জা ভাবটা দেখতে ভালোই লাগে!
মা বলল, বান্ধবীদের সাথে ঘুরতে বের হয়েছি। একজন বলল, “দেখ কত বড়ো বড়ো বড়ই ধরেছে ওই গাছটায়।”
বড়ই দেখতে বেশ ভালো লাগছিল। কী করে বড়ই পারব? তখন ঢিল মারা শুরু করলাম।
হঠাৎ কোথা থেকে একজন লোক এসে পড়ল। ঢিল গিয়ে পড়ল তার কপালে! কপাল চেপে আমার দিকে হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।
আমরা দ্রুত পালিয়ে এলাম।
কয়েকদিন পরে দেখি সেই মানুষটা আমাদের বাড়িতে উপস্থিত। ভাবলাম বাবার কাছে নালিশ করতে এসেছে মনে হয়। কী যে ভয় পেয়েছিলাম!
আপা আহ্লাদী গলায় বলল, তারপর শুনলে উনি তোমাকে বিয়ে করতে চায়? তুমি বাবার কপাল ফাটিয়ে দিলে!
মা একটা শ্বাস ছেড়ে বলল, “তোর বাবারটা ফাটিয়েছিলাম না আমারটা! “
এ সময় বাবার গলা শোনা গেল, “রেনু কই রে আমার কুট্টি রানি।”
আমি দৌড়ে গেলাম। দরজা খুলে দেখি বাবা কাক ভিজা হয়ে গেছে। জামা থেকে টপটপ করে বৃষ্টির পানি পড়ছে।
“কী রে ঘর আন্ধার ক্যা?”
“লাইটের চার্জ শেষ হয়ে গেছে বাবা।”
“আমার লুঙ্গি আর গামছটা নিয়ে আয়ত মা। আমি যাই দোকান থেকে মোমবাতি নিয়ে আসি।”
বাবা মোমবাতি আনতে আবার বেরিয়ে গেল। আমি দরজায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি। বৃষ্টির মধ্যে বাবা হেঁটে যাচ্ছে। বাবার কোনো ক্লান্তি নেই! একটুও বিরক্ত হলো না। সারাদিন কাজ করে ঘরে এসে দেখল একটু আলোও নেই! সেটাও তাকে ব্যবস্থা করতে হবে।
বাবা গোসল করে বলল,” মিলি একটু চা বানাত মা।”
মিলি আপা চা বানাচ্ছে বাবা আর আমি বসে আছি আমাদের ঘরের মেঝেতে। মা বলল, “এমন বৃষ্টিতে ভিজে আবার না জ্বর বাঁধাও! “
কিছু হবে না। এটা হলো রহমতের বৃষ্টি। কী গরমটা পড়েছিল। রমজান আসল আল্লাহ বৃষ্টি দিয়ে কেমন শীতল করে দিলেন!
রমজান মাসটা খুব ভালো লাগে! এ মাস শেষে ইদ হবে। আবার এ মাসে বাবা সন্ধার আগে ফিরে আসে। আমরা সবাই একসাথে ইফতারি করি। আপার কলেজ বন্ধ। সারাদিন কী সব বই পড়ে না হলে ঘুমায়।
আপা কী যেন একটা বই পড়ছে। রমজান মাসের দুপুরটা বড্ড বিরক্তকর হয়! কিছুই করতে ভালো লাগে না! মা মনে হয় ইফতারি বানাচ্ছে। আমি ছাদে গেলাম। আমাদের ছাদটা একটু বৃষ্টি হলেই কেমন ছ্যাতছ্যাতে হয়ে যায়। ছাদের রেলিংটা খুব ছোটো। ছাদের কিনারে যেতে ভয় লাগে। দেখলাম আনোয়ার চাচা ছাদে বসে আছেন। আমাকে দেখেই ডাক দিলেন, ” কে রুনু?কী খবর রে মা?”
আমি ওনার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলাম।
“ছাদটা ভিজা সাবধানে আয়।”
আমি পা টিপেটিপে হাঁটছি। আমার ভালোই লাগছে! পা পিছলে যে কোনো সয়ম পড়ে যেতে পারি, এই ভয়টাও ভালো লাগছে। মাঝে মাঝে ভয় পেতেও ভালো লাগে!
চলবে–
® নাবিল মাহমুদ