ফ্রিজ পর্ব ২
“মা তুমি চাল বাড়িয়ে দাও। আনোয়ার চাচাকে ভাত দিবো। রহিমার মা আসেনি।”
“মানুষটা সকালে কী খাইছে? “
“রহিমার মা রেঁধে ফ্রিজে রেখেছিল তাই হয়ত খাইছে।”
“তুই এক কাজ করত মা দোকান থেকে এক হালি ডিম নিয়ে আয়।”
মা আমাকে পঞ্চাশ টাকা দিলো ডিম আনতে। আমাদের বাড়ির সামনের গলিতে একটা মুদি দোকান আছে।
আপার ঘরে উঁকি দিলাম। আপার ঘর বলতে আমরা দুই বোন একই ঘরে ঘুমাই। একটা সাদামাটা খাট, পড়ার দুইটা টেবিল, কাঠের দুইটা চেয়ার আর এটা কী বলে? বড়ো আয়না লাগানো থাকে নীচে ড্রয়ের। যেটার সামনে দাঁড়িয়ে মেয়েরা নিজেকে দেখে। মনে হয় ড্রেসিং টেবিল বলে। অনেকটা ড্রেসিং টেবিলের মতো একটা বড়ো আয়না আছে।
রাতের বেলা আপা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে৷ আমি ঘুমের ভান করে শুয়ে শুয়ে দেখি। আপা নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে, কী যেন বলে! মিটিমিটি হাসে। আপাকে তখন পাগল পাগল মনে হয়।
আপা গুটিশুটি মেরে ঘুমিয়ে আছে। আমি ঘরে ঢুকলাম না। বাড়ি থেকে বের হলাম। ডিম আনতে হবে। গলিটা পার হয়ে দেখলাম লিটন ছেলেরা দাঁড়িয়ে আছে। একটা জিন্স প্যান্ট, সাদা রংয়ের টি-শার্ট পরা। পাশে আরো দুইজন ছেলে হয়ত ওনার বন্ধু হবে। আমাকে দেখেই ডাকল, “এই পিচ্চি। ” কেউ পিচ্চি বললে আমার খুব খারাপ লাগে! পিচ্চি বলে ছোটো বাবুদের। আমি মোটেই পিচ্চি না। এবার ক্লাস সেভেনে উঠব। আমি ওদের দিকে তাকালাম না।
লিটনের পাশে লাল রংয়ের টি-শার্ট পরা ছেলেটা বলল, “তোর শালি মনে হয় রাগ করেছে পিচ্চি বলায়?” বলেই হো হো করে হাসা শুরু করল।
লিটন বলল, “চুপ করত।”
আমি দোকানদার কে এক হালি ডিম দিতে বললাম। ডিম আর বাকি টাকা নিয়ে ফিরে আসছি। লিটন ভাই আমাকে ডাকল,” এই রুনু।”
আমি ওনার দিকে তাকালাম।
” কেমন আছ?”
আমি কিছু না বলে সোজা চলে আসলাম। ওরা কী যেন বলছে আর হাসছে।
রান্না ঘরে গেলাম ডিম নিয়ে। মা বলল, “এত দেরি করলি ক্যান?”
আমি কিছু বললাম না। আমার মনটা খারাপ হয়ে গেছে! মনখারাপ হলে আমার কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে না।
ডিম রেখে চলে আসলাম। আপার মতো ঘুমাতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু আপার মতো ঘুমাতে পারি না।
আপা যে কী করে যখন-তখন ঘুমিয়ে পড়ে কে জানে! বাবা বাসায় থাকলে ভালো হতো। আমার মনখারাপ হলে বাবা কেমন করে যেন বুঝে ফেলে। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় আর বলে, “কী আমার কুট্টি রাজকন্যার মনখারাপ?”
আমি কিছু বলি না।বাবাকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকি। তখন আমার ভিতরে ভালো লাগে! ধীরে ধীরে মনখারাপটা চলে যায়। বাবা ফিরে রাত করে। ছুটিরদিন ছাড়া বাবাকে দিনেরবেলা দেখা যায় না। আমার বাবা খুব ছোটো চাকরি করে তাই অনেক সময় অফিসে থাকতে হয়। আমার বাবা খুব ভালো ছাত্র ছিলো। বাবার হাতের লেখা কী সুন্দর! মেট্রিক পরীক্ষায় বাবা ভালো রেজাল্ট করেছিলো। তারপর আর পড়ালেখা করতে পারেনি! দাদা মারা যাওয়ায় পুরো পরিবারের দায়িত্ব বাবার কাঁধে এসে পড়ে। ঢাকায় এসে ছোটখাটো কাজ করতে শুরু করে।
বাবা অবশ্য এ সব নিয়ে দুঃখ করে না। আমাদের কে ভালো করে পড়াশোনা করতে বলে। বাবা বলে, “আমার দুইটা রাজকন্যা এক সময় অনেক বড়ো হবে।”
আমি পড়ার টেবিলে এসে বসে আছি। একটা গল্পের বই পড়া যায়। আপু অনেক বই পড়ে। আমাদের এলাকায় একটা লাইব্রেরি আছে। সেখানে অনেক বই আছে। আপু লাইব্রেরি থেকে বই আনে।
মায়ের গলা শুনা যাচ্ছে। ” রুনু এই রুনু” বলে ডাকছে। রান্না মনে হয় শেষ। মা এখন গোসল করতে যাবে। সারাদিন মা কোনো না কোনো কাজ করতেই থাকেন। মায়ের কোনো ক্লান্তি নেই। এই যে আপা কলেজ থেকে এসেই শুয়ে পড়েছে ক্লান্তিতে। মা ভোরে ঘুম থেকে উঠে কাজ করেই যাচ্ছে! কী করে যে এত কাজ মা করে?
“কী মা?”
“বাটিতে ভাত তরকারি বেড়ে রেখেছি তুই চট করে দিয়ে আয়। আমি গোসল করতে যাব। তুই গোসল করেছিস? “
“না।”
“কী করিস সারাদিন? শুধু টইটই করে ঘুরে বেড়ান! বই নিয়েও তো একটু বসতে দেখি না।”
আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম। কিছু বললে মা আর ক্ষেপে যাবে। মা গোসল করতে চলে গেল।
খাবার নিয়ে এসে দেখি আনোয়ার চাচা শুয়ে আছেন। এ সময় উনি ঘুমান না। আজ কেন জানি ঘুমিয়েছে। আমি খাবার টেবিলে রাখলাম। শব্দ শুনে আনোয়ার চাচা বললেন, ” কে রুনু?”
“আপনার খাবার দিয়ে গেলাম।”
“কী যে পাগলামি করোস না তোরা! ফ্রিজে তো খাবারছিলো। এককাজ করতো মা। ফ্রিজের খাবারটা নিয়ে যা।”
“আপনি গরম গরম খেয়ে নিন।”
বড়ো আপা ঘুম থেকে উঠে বসে আছে। চোখদুটি ফুলে গেছে, চেহেরাটা কেমন বরাট দেখা যাচ্ছে। এখন ওকে আর সুন্দর লাগছে! চোখ রগড়াতে রগড়াতে বলল, “মা কী করে রে রুনু?”
“গোসল করছে।”
“কখন গেছে? “
মায়ের গোসল করতে অনেক সময় লাগে। মিলি আপাও লম্বা সময় ধরে গোসল করে।
“দেখ তো মা বের হয়েছে কি না? খুব ক্ষিধা লাগছে। “
এ সময় মা এসে দরজায় দাঁড়াল। মায়ের চুল এখনো ভিজা। মা কে স্নিগ্ধ লাগছে! আমার মা দেখতে খুব সুন্দর ছিলো। সংসারের চাপে মায়ের সৌন্দর্য অনেকটা ম্লান হয়ে গেছে।
“কী রে তোরা গোসল করবি না?”
“মা ক্ষুধা লাগছে, তুমি ভাত বাড় আমি পরে গোসল করব।” আপাটা এমনই! এখন খেয়ে দেয়ে শুয়ে থাকবে না হলে কোনো একটা বই নিয়ে পড়া শুরু করবে। গোসল করবে সন্ধ্যার সময়।
আমি চট করে গোসল করে এসে দেখি আপা খেতে বসেছে। ঘরের মেঝেতে একটা প্লাস্টিকের পাটি বিছিয়ে আমরা খাই।
রাতেরবেলা আমরা সবাই একসাথে খেতে বসি। বাবা মাঝখানে আমরা দুইবোন দুই পাশে। আমার মনে হয় বাবা আপাকে বেশি ভালোবাসে। আপাকে সবাই খুব পছন্দ করে। আমাকেও করে তবে আপাকে বেশি। আমার এক মামা আছে রাজশাহীতে থাকে। কল দিলে আপার সাথে কথা বলে লম্বা সময় ধরে। মাঝেসাঝে আমাকে শুধু জিজ্ঞেস করে, “কেমন আছে আমার রুনু মা? পড়ালেখা কেমন চলছে?’
ব্যস কথা শেষ! আর আপার সাথে কত যে কথা বলে। কী এত কথা বলে জানি না।
আমি আপার পাশে খেতে বসলাম। মা আলু দিয়ে ডিম রান্না করেছে। মায়ের রান্না খেতে বেশ ভালো লাগে!
মা বলল,” শোন এবার ইদে তোরা কোনো জামা কিনতে পারবি না।”
“কেন মা? ইদের সময় তো শুধু একটা জামা কিনি, সারাবছর তো আর কিছুই দাও না।”
“এবার ফ্রিজটা কিনে ফেলব। তাই বোনাসটা খরচ করা যাবে না। দুই ইদের বোনাস আর জমানো টাকা মিলালে ফ্রিজটা কেনা যাবে।”
“সত্যি বলছ মা! খুব ভালো হবে ফ্রিজ থাকলে। অন্যের বাসায় যেতে হয় একটু পানি খেতে।”
আমি কিছুই বললাম না। আমারাও ভালো লাগছে! আবার একটু খারাপ লাগছে। বাবা ঠিকই আপার জন্য শাড়ি কিনবে শুধু বাদ পড়ব আমি!
চলবে–
® নাবিল মাহমুদ