ফ্রিজ পর্ব ৭
ছেলেটা এখনো তাকিয়ে আছে! আমার ইচ্ছে করছে ছেলেটা কে গিয়ে কষে একটা চড় মারতে। আপাকে বিচলিত মনে হচ্ছে না। আমার মনে হয় আপার খুব বেশি খারাপ লাগে না। না-কি লাগে আমি ঠিক বুঝতে পারি না। আপাকে কখনো বিরক্ত হতে দেখিনি। কেমন নির্লিপ্ত হয়ে থাকে। যেন তেমন কিছুই হয়নি।
ছেলেটা অবশ্য কিছু বলেনি শুধু হা করে তাকিয়ে ছিলো পুরোটা সময়।
মামা একগাদা বাজার করে নিয়ে আসছে। ইদের জন্য বাজার করেছে। আজ চাঁদ উঠলে আগামীকাল ইদ হবে। না হলে আরও একদিন রোজা রাখতে হবে।
সামিন দৌড়ে গিয়ে মামার হাত থেকে বাজারের ব্যাগটা নিলো। মামা একটু হেসে বলল, ” কেমন লাগছে রে মা?”
আমি কিছু বললাম না। একটুখানি হাসলাম। মামার সাথে বাড়িতে গেলাম।
মামার বাড়ির উঠানে একটা পেয়ারা গাছ আছে। মামা সামিন কে বলল, ” কোটাটা নিয়ে আয়ত বাবা।”
একটা লম্বা চিকন বাঁশের মাথায় একটা কঞ্চি বেধেঁ বাঁকা করা হয়েছে। এটা দিয়ে পেয়ারা পারা হয়।
কিছু পেয়ারা পলিথিন দিয়ে মুড়িয়ে রাখা হয়েছে। অন্য পেয়েরা থেকে এগুলো একটু ভালো মনে হচ্ছে। মামা আমাদের জন্য এই পেয়েরাগুলো আলাদা করে রেখেছে!
সামিন একটা কোটা নিয়ে আসল। মামা পলিথিন মুড়িয়ে রাখা পেয়ারাগুলো পারছে। পেয়েরা পেরে মামা বলল, “নে মা খেয়ে দেখত কেমন?”
একটা পেয়েরা নিয়ে কামড় দিলাম। বেশ মিষ্টি লাগছে খেতে!
আমি আর সামিন ঘরের সামনে সিঁড়িতে বসে পেয়েরা খাচ্ছি। আপা এখন পেয়েরা খাবে না। আপা নাস্তাও খায়নি! সম্ভবত সে রোজা রেখেছে। যদিও সে সেহরি খায়নি। মামাও না খেয়ে রোজা রেখেছে। আমারও একটু খারাপ লাগছে! আজ যদি চাঁদ উঠে যায় তাহলে এটা হবে শেষ রোজা। শেষ রোজাটা রাখা হলো না! আমি দোয়া করছি আজ যেন চাঁদ না উঠে।
আপা কী করছে জানি না। না খেয়ে রোজা রেখে মনে হয় খুব ক্লান্ত হয়ে গেছে! আমি সামিনের সাথে ঘুরতে বের হয়েছি। আমার মামাত ভাইটা কে ভালোই লাগছে! কী সুন্দর করে কথা বলে! আমাকে বলল, “রুনু আমাদের স্কুল দেখতে যাবা?”
“না, এখন দূরে কোথাও যাব না।”
“তাহলে চলো বাসায় চলে যাই। বিকাল হয়ে গেছে বেশি দেরি করলে মা বকবে।”
“তোমার মা কি খুব বকা দেয়?”
“হ্যাঁ, মা একটু কিছু হলেই বকে। জানো বাবা আমাকে কখনো কিছু বলে না।”
সব মা ই মনে হয় এমন! আমার মাও তো একটু কিছু হলেই রেগে যায়। বাবা আমাকে কখনো কিছু বলে না।
“চলো সামিন বাড়ি ফিরে যাই।”
বাড়ি ফিরে দেখি মামি ইফতারি বানাচ্ছে। আপাও বসে আছে মামির পাশে। মামি সামিনের দিকে কটকটে চোখে তাকাল। মুখে তেমন কিছু বলল না। আমরা আছি বলে হয়ত কিছু বলেনি। না হলে বেচারা এখন বকা খেত।
ইফতারের সময় হয়ে গেছে। আমরা বসে আছি মামাদের রান্না ঘরের পাশে আরেকটা ঘর আছে খাওয়ার জন্য। সবাই বড়ো একটা শীতল পাটিতে বসে আছি। মামি কত কী বানিয়েছে! এত ইফতারি মনে হয় না শেষ হবে। কেন যে এত কিছু বানাল মামি?
পাশের বাড়ি থেকেও মনে হয় কিছু ইফতারি পাঠিয়েছে আমরা এসেছি বলে।নানা বাড়ির সবাই আমাদের খুব আদর করে।
সন্ধ্যার সময় আমরা চাঁদ দেখার জন্য একটা মাঠে দাঁড়িয়ে আছি। ছোটরা সবাই হইচই করছে। অনেকেই এসেছে ইদের চাঁদ দেখার জন্য। কেউ হুট করে বলছে ওই যে চাঁদ। সবাই ওদিকে খোঁজ করে পরে দেখা চাঁদ না। সবাই হো হো করে হেসে উঠে। আমার খুব ভালো লাগছে!
চাঁদ দেখা গেল না। খালি দেখা যায়নি পরে খবর শুনে বুঝা যাবে চাঁদ উঠেছে কি-না?
রাত আটটার খবরে জানা গেল ইদের চাঁদ দেখা গেছে! আগামীকাল ইদ। ছেলেরা বাজি ফোটাচ্ছ। সামিনের জন্য মামা বাজি কিনে এনেছে। আমাদের জন্য তারাবাতি এনেছে। তারাবাতি জ্বালাতে বেশ ভালো লাগছে! মামি আগামীকালকের জন্য কী সব পিঠা বানাচ্ছে। আপা মামির সাথে কাজ করছে যদিও মামি মানা করছে।
আজ ইদের দিন। খুব ভোরে উঠে মামি ঘরদোর সব পরিস্কার করছে। মামা সামিন কে নিয়ে ফজর নামাজ পড়তে গেছেন। আপা আর আমি মামির সাথে টুকটাক কাজ করছি। মামি হেসে বলছে,” তোরা কেন এ সব করছিস! যা শুয়ে থাক গিয়ে।”
গ্রামে কাজের লোক নেই। সবকিছু মামিকেই করতে হয়। খুব বেশি ঝামেলা হলে পাশের বাড়ির খালারা এসে হয়ত সাহায্য করে। মামিও ওদের কে সাহায্য করে। শহরের মতো না। এখানে সবার সাথে কথাবার্তা হয়। যখন-তখন সবাই সবার বাড়ি আসা-যাওয়া করে।
ইদের নামাজের পরেই অনেকেই আসছে দেখা করতে। আমার মা-বাবার খবর জানতে চাচ্ছে। অনেকেই আমাদের চিনে না। মামা হাসিমুখে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে।
সামিন খুব সুন্দর একটা শার্ট পরেছে। ওকে শার্টটায় দারুণ মানিয়েছ। আমাকে বলল, “রুনু চল ঘুরে আসি।”
আমার কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না! বাবার কথা মনে পড়ছে শুধু। সকালে বাবার মোবাইলে কথা হয়েছে। বাবার মনখারাপ বুঝা যাচ্ছে। আমাদের দুইবোন কে ছাড়া বাবার মনে হয় এটাই প্রথম ইদ করা।
ইদেরদিন মা কী করছে কে জানে? বাবা মনে হয় ইদের বাজারই করেনি আমরা নেই বলে! মাও হয়ত বলেছে টাকা খরচ করার কী দরকার মেয়েদুটি নেই আমরা কিছু একটা খেলেই হবে। আমার মা ঠিক এমনই নিজের কথা একটুও ভাবে না।
আপাকেও কেমন মনমরা মনে হচ্ছে! মনে হয় বাবার কথা ভাবছে। মামা বলল, “কই রে মা তোরা? “
আমি মামার কাছে গেলাম। “জি মামা।”
“মিলি কই?”
“নানির ঘরে বসে আছে মামা।” যদিও এটা এখন আর নানির ঘর না। এই ঘরে এখন সামিন থাকে। সামিনের ঘর বলা দরকার। আমরা নানির ঘরই বলছি। ইচ্ছে করে বলছি এমন না। কেমন কের যেন এসে পড়ছে! হয়ত আমাদের মন নানির অস্তিত্ব ধরে রাখতে চাইছে!
“তোরা রেডি হ্। আমরা ঘুরতে বের হব।”
আমি আপাকে বলার জন্য যাচ্ছি। মামা বলল,” শোন তোর মামিকেও বল তো মা রেডি হতে সবাই একসাথে যাই।”
মামি বের হতে চাচ্ছে না। আমি আর আপা জোর করে মামি কে রেডি করিয়েছি। মামি কে বেশ ভালো লাগছে! হালকা আকাশি রংয়া একটা শাড়ি পরেছে। আপা মামার দেয়া শাড়িটা পরেছে। আপাকে কী যে ভালো লাগছে! মামি বলল,” মিলি তোকে এ শাড়িটাতে খুব সুন্দর লাগছে রে!”
আপা একটু হাসল। কিছু বলল না। আপা কে কেউ সুন্দর বললে আপা কিছু বলে না। আপাকে নিয়ে বের হতে আমার ভালো লাগে না! কতসব ঝামেলা যে হয়? কেন যে মানুষগুলো এমন হয়! কে জানে?
আমরা এসেছি মামিদের বাড়িতে। মামি কে এখন খুব খুশি খুশি লাগছে! আমাদের কে নিজের ঘরে এনে বসিয়েছে। এক সময় এটা মামির ঘরছিল হয়ত। এখনো কি আছে? মনে হয় না আছে। মেয়েদের নিজের বলতে কিছু থাকে না! এ বাড়িটা কি আসলেই মামির বাড়ি এখন? না-কি সেও আমাদের মতো মেহমান এ বাড়ির!
মামা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছি। সামিন আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আপু কোথায় আছে জানি না। এ সময় দেখলাম একজন মধ্যবস্ক লোক সাথে কয়েকজন কে নিয়ে মামা বাড়িতে আসল। একজনের হাতে মিষ্টির প্যাকেট। আমি সামিন কে জিজ্ঞেস করলাম,” কে রে?”
সামিন আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “জামশেদ চাচা, আমাদের চেয়ারম্যান। “
“চল তো ভিতরে গিয়ে দেখি।”
আমরা বাড়ির ভিতরে ঢুকে দেখলাম ওনারা মামাদের বসার ঘরে বসেছেন। মামা ওনাদের সাথে বসে আছেন। আমি বাইরে দাঁড়িয়ে দেখছি। আপা মনে হয় মামির সাথে আছে।
চলবে–
® নাবিল মাহমুদ