অনির কলমে আদ্রিয়ান
পর্ব ২৬
সুগার ফল করে অসুস্থ হয়ে পড়ার পর মাঝে আটটা দিন কেটে গেল। সুস্থ হয়ে উঠেছিলাম সেদিনই। এরপর আর তেমন কোন অসুবিধা হয়নি আমার। সুস্থ এবং স্বাভাবিক আছি। ভালোবাসার সপ্তাহ পার হল। নিউজফিড জুড়ে চলমান প্রেমময় পোস্টের ধারা এবার বিরতি নিল। এরমধ্যে ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের সাথে কোন কথা হয়নি আমার আর। হয়নি বললে ভুল হবে সে হতে দেয়নি। ঐদিন চলে যাওয়ার পর দুদিন তারসাথে কোনরকম যোগাযোগের চেষ্টা করিনি আমি। আমি জানতাম তার সাথে এখন কথা বলা মানেই নিজের পায়ে নিজ দায়িত্বে সযত্নে কুড়াল মারা। সেই ভুলটা ভুল করেও করিনি। কিন্তু দুদিন পরে নিজেই ফোন করেছি তার নাম্বারে, বারবার করেছি। কিন্তু সে আমার ফোন তোলেনি, প্রতিবারই কেটে দিয়েছে। পরে জাবিনের কাছ থেকে জানতে পেরেছিলাম যে ঐদিন বাড়ি গিয়েই ভীষণ রেগে ছিলেন উনি। ওনার আশেপাশেও কাউকে ঘেঁষতে নিষেধ করেছেন। কী হয়েছে ওরা কেউই বুঝতে পারেনি। কিন্তু দুদিন পরেই নাকি আবার সব নরমাল হয়ে গেছে। স্বাভাবিকভাবেই বাইক নিয়ে ঘোরাফেরা, খেলাধুলো, পড়াশোনা সব রুটিন মোতাবেকই চলেছে তার। শুনে বিশাল মাপের রাগ লেগেছিল আমার। নিজে বিন্দাস ঘুরে বেড়াচ্ছে আর আমি? আমি কি-না ছ্যাঁকা খাওয়া দেবদাসী হয়ে ওনাকে ফোনের ওপর ফোন করে যাচ্ছি? কারণ ছাড়াই সেন্টি খাচ্ছি? ভাবা যায়! তবে আমিও আর করব না ফোন। কিন্তু এই বিশাল মাপের রাগটা ঠিক বিশাল হলোনা। একটু পরেই আবার আমার কল করার ধারাবাহিকতা চলতে থাকল। ওনার সাথে আমি একমাস কথা না বলেও থাকতে পারি। কিন্ত যদি শুনি আমার ওপর উনি রেগে আছেন এবং সেই রাগের কারণটা সঙ্গত তখন আমি নিজেই ওনার রাগ ভাঙাতে অস্হির হয়ে পড়ি।
তবে তার রাগ ভাঙল না। কিন্তু এরমধ্যেই দুবার কল রিসিভ করেছে। আমি এপাশ থেকে ‘হ্যালো’ ‘হ্যালো’ করে মরে গেলেও ওপাশ থেকে ‘টু’ শব্দও আসেনি। কী ধুরন্ধর লোক! নিজে ঠিক কায়দা করে আমার গলা শুনে নিয়েছে অথচ আমাকে শুনতে দিলোনা। এমনভাবেই কেটে গেল এই আটদিন। এবার আমারও খানিকটা রাগ হল। নিজের দোষে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম তাই ওনার রাগ হয়েছে। ফাইন! একটু শাসন করে দিলেই তো হয়। কথা বন্ধ করে দেওয়ার মানে কী? তাই আমিও কল দেওয়া বন্ধ করলাম। চলুক যেভাবে চলছে। দেখি কতদিন থাকতে পারে।
পরেরদিন বিকেলবেলা গেলাম আমার সেই অতি প্রিয় জায়গা কাঠবাগানে। একা! আগেই বলেছি আমার মন ভালো থাকলে বা খারাপ থাকলেই শুধুমাত্র ওখানে যাই আমি। কিন্তু কাঠবাগানে গিয়ে থমকে গেলাম আমি। অপ্রত্যাশিত এরকম চমক আশা করিনি একদমই। ইঞ্জিনিয়ার সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন কাঠবাগানে। তবে উনি একা নেই ওনার বন্ধু ফরহাদ ভাই আছেন, ফরহাদ ভাইয়ের বড় ভাই ফারুক ভাইও আছে সাথে। ফরহাদ আর ফারুক ভাই সম্পর্কে আমারও ভাই লাগে। আম্মুর চাচাতো বোনের ছেলে দুজন। একসঙ্গে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছিল হয়তো। ঠান্ডার মধ্যে কী সুন্দর পাতলা একটা টিশার্ট পরে ঘুরে বেরাচ্ছে। চুলগুলো দেখে হাত দিয়ে নেড়ে দেওয়ার প্রবল এক ইচ্ছা হল আমার। কিন্তু উনি জাজিরা কখন এলেন? কেন এলেন? কী প্রয়োজন ছিল আসার? এসব ভাবতে ভাবতেই ফরহাদ ভাইয়ের চোখ পড়ল আমার ওপর। আমাকে দেখেই হালকা হেসে বললেন, ‘কী ব্যপার অনি? তুই এখানে কী করিস?’
ফরহাদ ভাইয়ের কথা শুনে আদ্রিয়ান ভাই আর ফারুক ভাই দুজনেই তাকাল আমার দিকে। কিন্তু সেই অতি ভাব নিয়ে চলা ইঞ্জিনিয়ার সাথেসাথেই চোখ সরিয়ে নিলেন। যেন আমাকে দেখলে তার চোখ অশুদ্ধ হয়ে যাবে। তাই আমিও সেদিকে পাত্তা না দিয়ে মৃদু হেসে বললাম, ‘আমি জানতাম আপনারা থাকবেন তাই জমিয়ে আড্ডা দিতে চলে এলাম। বাড়ি বসে বোর হচ্ছি।’
হেসে ফেললেন ফরহাদ ভাই আর ফারুক ভাই। হাসল না শুধু গোমড়ামুখোটা। সে তখন ফোনে ব্যস্ত। ফারুক ভাই বলল, ‘তাই নাকি?’
আমি উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বললাম, ‘পাক্কা ধরে নিন!’
ফারুক ভাই আবার হাসলেন। বললেন, ‘আচ্ছা বল, কী খাবি?’
আমি ঠোঁট চেপে আরেকটু হেসে নিয়ে বললাম, ‘আজ না অন্য একদিন। সন্ধ্যাবেলার বিশ-ত্রিশ টাকার স্ন্যাক্সে আমার পোষাবে না। একদিন বড়সর বাজি মেরে দেব। সেদিন পকেট বাঁচিয়ে রেখো, বস!’
এবার একটু জোরেই হেসে দিল দুজন। আমিও সেই হাসিতে তাল মেলালাম। হাসি থামিয়ে বললাম, ‘তা আছেন কেমন দুজনে?’
‘ হ্যাঁ, এইতো ভালোই আছি। তোর কী খবর?’ সরল হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন ফরহাদ ভাই।
আমি মৃদু হেসে বললাম, ‘ আমিও ভালো আছি।’
এমনই কথার মাঝেই হঠাৎ আদ্রিয়ান ভাই শক্ত কন্ঠে বলে উঠলেন, ‘তোদের গল্পগুজব হয়েছে? হলে চল না হলে আমি গেলাম তোরা গল্প সেরে আয়।’
বলে কাঠবাগানের ঠিক সামনের ক্ষেতটার দিকে এগোলেন উনি। ফরহাদ ভাই আর ফারুক ভাইও একটু অবাক হলেন ওনার এমন ব্যবহারে। কিন্তু কিছু না বলে হাসি মুখে আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। আমি একা পড়ে রইলাম নিরিবিলি বাগানটাতে। ওনারা যাওয়াতে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম একটা। ভালোই হলো, একা একা কিছুক্ষণ কাটানো যাবে।
কাঠবাগান আমার শান্তির জায়গা। এখানে এলে আমি দিন-দুনিয়া ভুলে যাই, জগত ভুলে যাই। এতো এতো পাখিদের কিচিরমিচির, মৃদু হাওয়া, সাথে মিষ্টি নিরবতা। আর কী চাই? নিরব সময় কাটাতে কাটাতে কখন যে সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছিল খেয়ালই নেই আমার। আচমকাই কেউ হাত ধরে টান দেওয়াতে চমকে উঠলাম আমি। হৃদস্পন্দন যেন থেমে গেল কয়েক মুহূর্তের জন্যে। তাকিয়ে দেখলাম আর কেউ নয় স্বয়ং আদ্রিয়ান ভাই। এভাবে হঠাৎ টানে কেউ? হৃদপিণ্ড বেরিয়ে আসবে বলে মনে হচ্ছে। আমি হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম, ‘হার্ট ফেইল করিয়ে মারবেন বলে ঠিক করেছেন না-কি? আর এই কাঠবাগানে আসলেই আপনাকে জ্বিনে ধরে নাকি? হুটহাট হাত টেনে ধরেন। কবে যেন ঘাড়টাই মটকে দেন।’
উনি আমার কথাকে আমলে নিলেন না। পাত্তাও দিলেন না। চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে ধমকের সুরে বললেন, ‘সন্ধ্যাবেলা পেত্নীর মতো ঘুরে বেড়াচ্ছিস কেন? বাড়ি যা!’
আমার মাথায় আমার সেই চিরপরিচিত জেদ চাপল। এতোদিন একটা কথাও না বলে এখন এসেছে শাসন করতে! আমিও ঘাড়ত্যাড়ামি করে বললাম, ‘আমার ইচ্ছে করছে তাই। আপনার তাতে কী?’
তখনই একটা ভয়ানক কাজ করে ফেললেন উনি। আমার বাঁ হাত মুচড়ে ধরলেন পেছন মোড়া করে। হতভম্ব আমি ব্যথায় কুঁকিয়ে ওঠার কথাও যেন ভুলে গেলাম। স্তম্ভিত দৃষ্টিতে তাকালাম ওনার বাদামি লেন্সের চোখ দুটোর দিকে। কিন্তু আমি জানি আমার হাতের রগে মারাত্মক টান লাগছে। উনি দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, ‘আমি যতদিন আছি আপনার এইসব ইচ্ছা-টিচ্ছা দাফন করে ফেলুন।’ কথাটা বলতে বলতে হাতের চাপ বৃদ্ধি পেয়েছে। ‘আমার অপছন্দের কাজগুলো যত কম করবেন ততই ভালো থাকবেন। ভালো থাকার ইচ্ছেটা যদি আপনার না থাকে আমারও কিছু করার নেই। বাড়ি ছেড়ে দিয়ে আসছি, চল!’
আমার কিছু বলার মতো রইল না। আকস্মিক ঘটনায় বোকা বনে গেছি আমি। উনিও আর কিছু বললেন না। আমার হাত কনুইয়ের ওপর দিয়ে ধরে হাঁটতে শুরু করলেন। বাইকে ওঠার সময় আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘ফোন ধরতেন না কেন?’
উনি গম্ভীর কন্ঠে বললেন, ‘ আমি সুস্থ স্বাভাবিক মানুষদের সাথে কথা বলি। বিপি, সুগার, ওয়েইট সবকিছু তলানিতে পড়ে থাকা রুগীদের সাথে না।’
আমি গাল ফুলিয়ে উঠে বসলাম বাইকে। বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে গেলেন উনি আমায়। পথে না উনি আমাকে কিছু বলেছেন আর না আমি ওনাকে।
নিজের রুমে এসে এতক্ষণের বিস্ময় কাটিয়ে উঠতেই খেয়াল করলাম বাঁ হাতের কবজির নিচে ব্যথা হয়ে আছে। তবে তেমন গুরুত্ব দিলাম না। এসব ছোটখাটো ব্যথায় আমার কিছু হয়না। আ’ম স্ট্রং। তবে রাতের দিকে ধীরে ধীরে ব্যথাটা বাড়ল। আর তার সাথে পাল্লা দিয়ে তার প্রতি আমার অভিমানটাও বাড়তে থাকল। আমি জানতাম উনি ইচ্ছে করে দেননি। কিন্তু তবুও আমি রেগে ছিলাম। কারণ আমার ওনার ওপর রাগ করতে ভালোলাগে। হাতে ব্যথা পাওয়া সত্ত্বেও কোন ঔষধ খেলাম না আমি। অনেকটা জেদ করে।
মাঝখানে কাটল আরও দুটো দিন। এরমধ্যে ওনার সঙ্গে আমার কোনরকম যোগাযোগ হয়নি। আমিও আর কল করিনি, উনিও করেননি। হাতের ব্যথাটাও সেরে গেছে আপনাআপনি।
রাত তখন সম্ভবত দুটো বাজে। আমি বিছানায় শুয়ে শুয়ে ফোন স্ক্রোল করছিলাম। ভালো লাগছিল না কিছুই। হঠাৎই আমার ফোনটা ভাইব্রেট করে উঠল। আমি হালকা চমকে উঠলাম। আরও বেশি চমকালাম স্ক্রিনে ‘ইঞ্জিনিয়ার সাহেব’ নামটা দেখে। কতগুলো দিন পরে নিজে থেকে ফোন করল আমায়। ডিসেম্বরে ফোন না ধরার পরের সেই ঝাড়ি খাওয়া সন্ধ্যাটা মনে পড়তেই আর অপেক্ষা করলাম না দ্রুত ফোন রিসিভ করে ফেললাম। মৃদু কন্ঠে বললাম, ‘হ্যালো?’
উনি কোনরকম ভনিতা না করে সোজা কথায় আসলেন। গম্ভীর কন্ঠে বললেন, ‘হাতে ব্যথা লাগল কীকরে?’
আমি যেন বিষম খেলাম। ব্যথা লাগল কীকরে? উনি সত্যিই বোঝেন নি আমার কখন, কোথায় ব্যথা লেগেছে? সাধে ওনাকে উগান্ডার জীব বলি? বাহ! উনি উগান্ডার জীবের মতো আচরণ করবেন আর আমি ওনাকে উগান্ডার জীব বললেই যত দোষ। স্বাধীনভাবে নিজের মতামত প্রকাশ করাটাও পাপ দেখছি! কিন্তু উনি জানল কীকরে ব্যথার কথা? যদিও কয়েকজনকে বলেছি হাতে ব্যথা ছিল। কিন্তু ওনাকে তো বলিনি! মুখে বললাম, ‘কী হবে? কিছুই হয়নি।’
কিছুক্ষণ চুপ থেকে উনি বললেন, ‘কাঠবাগানে ঐসময় লেগেছিল তাইনা?’
যাক, এটুকু খেয়াল অন্তত আছে সাহেবের। ভালো! মুখে কিছু বললাম না। কৃত্রিম এক রাগ দেখিয়ে চুপ থাকলাম। আবার কিছুক্ষণের নিরবতা চলল। উনি এবার অনেকটা নরম গলায় বললেন, ‘ঔষধ খেয়েছিলে?’
‘ না।’
‘ ব্যথা আছে এখনো?’
‘ না।’
আবারও কয়েক সেকেন্ডের নিরবতার পর উনি বললেন, ‘খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।’
কথাটা বলতে দেরী হলেও ফোনটা রাখতে দেরী করেন নি উনি। আমি ‘থ’ মেরে বসে ছিলাম কয়েকসেকেন্ড। কী অদ্ভুত! হাতে ব্যথা পেয়েছি শুনে তার মন খারাপ হয়েছে, ভেতরে ভেতরে প্রচন্ড গিল্ট ফিলও হচ্ছে। এগুলো সে বুঝতে না দিলেও আমি জানি। কিন্তু তবুও মুখ ফুটে বলবে না ‘আ’ম সরি’। যদিও এখন আর এসবে অবাক হই না আমি। ওনার এরকম সব ব্যবহারে আমি অভ্যস্ত হয়ে গেছি। কিন্তু এগুলোর মানে হয়!
ঠিক তার পরেরদিন বিকেলবেলার কথা। আমি দুপুরে ভাত খেয়ে শুয়ে শুয়ে ফোন স্ক্রোল করতে করতে কোন একটা সময় ঘুমিয়ে পড়েছি। ঘুমের মধ্যেই অনুভব করলাম যে ছোট্ট নরম দুটো হাত আমার গলা জড়িয়ে ধরল। গালে পরপর দুটো চুমু পড়তেই চোখ খুলে তাকালাম আমি। পিটপিটে চোখে তাকিয়ে দেখি হিমু আমার গলা জড়িয়ে ধরে হাসছে। ওকে দেখে আমি হেসে ফেললাম। অবাক হইনি কারণ ছোট মামির সাথে মাঝেমাঝেই বাড়িতে আসে ও। উঠে বসে দু’হাতে জড়িয়ে ধরলাম ওকে। গালে একটা চুমু দিয়ে বললাম, ‘ কার সাথে এসেছো হিমুরাণী? আম্মুর সাথে?’
হিমু না বোধক মাথা নেড়ে বলল, ‘উহু, দুলাইর সাথে।’
ভ্রু জোড়া কুঁচকে গেল আমার। কোন দুলাইর কথা বলছে? আজম ভাইয়া, সবুজ ভাইয়া নাকি রায়হান ভাইয়া? আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কোন দুলাইর কথা বলছো?’
বলতে পারল না হিমু। হিমু নাম বলতে না পারাতে আমি বুঝে ফেললাম আদ্রিয়ান ভাইয়ের কথাই বলছে। কারণ আদ্রিয়ান ভাইয়ের নাম জানেনা হিমু। যেকোন অনুষ্ঠানে যতবার-ই উনি এসেছে দুলাই বলেই সম্বোধন করেছে হিমু তাকে। কিন্তু হিমুকে নিয়ে এখন এই বাড়িতে আসার কারণটা বোধগম্য হলোনা আমার। আমি উঠে গিয়ে দাঁড়ালাম দরজার কাছে। দরজায় দাঁড়িয়েই উঁকি দিয়ে দেখলাম বসার ঘরে বসে আব্বুর সাথে কথা বলছেন আদ্রিয়ান ভাই। আমি নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে ফিরে এলাম। উনি বাড়িতে আসাতে অবাক হইনি। সে উনি মাঝেমাঝেই আসেন আব্বুর সাথে দেখা করতে কিংবা এদিকে এলে। কিন্তু আজ হিমুকে কেন নিয়ে এলো? আমি বিছানায় বসে হিমুর দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘তোকে তোর দুলাই বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছে?’
হিমু দ্রুত মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ‘ হুঁ। আম্মুকে বলে এনেছে। বলেছে তোমার কাছে নিয়ে আসবে।’
‘ বাহ, আমায় জ্বালাতে পারবি শুনেই দুলাইর সাথে লাফিয়ে লাফিয়ে চলে এলি?’
হিমু খিলখিলিয়ে হেসে বলল, ‘ দুষ্টামি করতে আসছি।’
আমি ওকে ভেংচি কেটে বললাম, ‘অ্যাঁহ! দুষ্টামি করতে আসছি। যা নিজের দুলাইর কাছে যা। আমার কাছে কী?’
‘ তোমার কাছেই থাকব।’
বলে প্রায় লাফিয়ে আমার গলা জড়িয়ে ধরল হিমু। আমি হেসে ফেললাম। হিমুকে জড়িয়ে ধরে বললাম, ‘কিছু খাবে হিমুসোনা?’
হিমু না বোধক মাথা নাড়ল। আমি বললাম, ‘বিস্কুট? চানাচুর?’
এবারেও না বোধক মাথা নাড়ল মেয়েটা। আমি হতাশ নিঃশ্বাস ফেললাম। এখন বলছে খাবেনা কিন্তু একটু পরেই বায়না জুড়ে দেবে। ওকে হাড়ে হাড়ে চিনি আমি। আস্ত বিচ্ছু একটা মেয়ে।
হিমুর সাথে দুষ্টুমি করতে করতে কখন সময় কেটে গেল বুঝতেই পারলাম না। মেয়েটা যেমন দুষ্টু তেমনই কিউটের ডিব্বা। মনটা একদম ফুরফুরে হয়ে গেল। এদিকে আদ্রিয়ান ভাই আছেন না চলে গেছেন সেটাও জানিনা। সেসব নিয়ে মাথাব্যথা নেই আমার।
হিমু আমার ল্যাপটপে কার্টুন দেখছে আর আমি বিছানায় শুয়ে শুয়ে ফোন স্ক্রোল করছি। কার্টুন দেখে দেখে ক্লান্ত হয়ে হিমু বলল, ‘ অনিপু! চিপস্ খাবো।’
আমি অবাক হলাম না। জানতাম একটু পরেই বায়না ধরবে। কিন্তু এখন চিপস্ কোথায় পাবো? আমি ফোনটা সাইডে রেখে বললাম, ‘চানাচুর দেই?’
হিমু জেদ ধরে বলল, ‘ না, আমি চিপস্ খাবো।’
আমি হতাশ হলাম। গোমড়া মুখ করে তাকিয়ে রইলাম ওর দিকে। কাব্যও বাড়িতে নেই যে চিপস এনে দেবে। কোন কিছু বলে বোঝাতে পারলাম না। মেয়ে একেবারে নাছোড়বান্দা। আমি এবার একটু বিরক্তি নিয়ে বললাম, ‘ আমাকে বলছিস কেন? আমি কী রোজগার করি? আবদার সব নিজের দুলাভাইয়ের কাছে করবি। আমার কাছে না।’
ঐ বিচ্ছু মেয়েটা কী বুঝলো কে জানে? কয়েক মুহূর্ত আমার দিকে তাকিয়ে থেকে লাফিয়ে বিছানা থেকে নেমে গেল। আমি বোকার মতো তাকিয়ে রইলাম ওর যাওয়ার দিকে। আচমকা ঘটা ব্যপারটা আমার মাথার কয়েক হাত ওপর দিয়ে গেল। তখনই আমার মনে পড়ল হিমু আদ্রিয়ান ভাইকে ‘দুলাই’ বলে ডাকে। তারমানে আদ্রিয়ান ভাইয়ের কাছে চাইতে গেছে না-কি? কিন্তু আমিতো অতোটা ভেবে কিছু বলিনি। দুলাভাই বলতে তো আমি আমার ফিউচার হাজবেন্ড এর কথা বুঝিয়েছিলাম। ও আদ্রিয়ান ভাইয়ের কথা ভাবল নাতো? সর্বনাশ! না জানি এই মেয়ে এখন কী বলবে ওখানে গিয়ে। ‘এই হিমু দাঁড়া’ বলে আমিও ছুটলাম ওর পেছনে। কিন্তু ততক্ষণে দেরী হয়ে গেছে। গিয়ে দেখি ম্যাডাম আদ্রিয়ান ভাইয়ের কোলে চড়ে গেছে ইতিমধ্যে। বসার ঘরে আর কেউ নেই। টিভি চলছে। উনি টিভি দেখছিলেন হয়তো বসে বসে। হিমু ওনাকে বলছে, ‘অনিপু চিপস কিনে দিতে বলেছে।’
উনি ভ্রু বাঁকালেন। আমার রুমের দরজার দিকে তাকাতেই দেখতে পেলেন আমায়। দ্রুত সরে যাওয়ার যথেষ্ট ইচ্ছা থাকলেও সরতে পারলাম না। ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম ওখানে। উনি আমার দিকে তাকিয়ে থেকেই হিমুকে বললেন, ‘কী বলেছে তোমার অনিপু?’
হিমু এক মুহূর্তও দেরী না করে আনন্দে আত্মহারা হয়ে বলল, ‘বলেছে দুলাইর কাছে চিপস চাইতে।’
উনি একবার হিমুর দিকে তাকিয়ে আবার আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন। বললেন, ‘ম্যাডাম যখন অর্ডার করেছে তখন তো দিতেই হচ্ছে। চলো!’
কথাটা বলে হিমুকে কোলে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন উনি দোকানের উদ্দেশ্যে। আমি হ্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে রইলাম কয়েক সেকেন্ড। এদের কাজকর্ম বোঝা আমার সাধ্যে নেই। এ বাড়ির সবগুলো মানুষ অদ্ভুত, একমাত্র আমিই ভালো। রুমে এসে নিজেই ল্যাপটপটা নিয়ে বসলাম। অযথাই কিছুক্ষণ ইউটিউব ঘাটলাম বসে বসে । কাজকর্ম না থাকলে যা হয় আরকি।
দশমিনিটের মাথায় হিমু ফিরে এলো রুমে। হাতে চিপস্, ললিপপ, লিচি আরও কতকিছু। আমি একপলক সেদিকে তাকিয়ে বললাম, ‘ চমৎকার! দোকানটাই তো দেখছি তুলে নিয়ে এসেছিস।’
হিমু ফোকলা দাঁতে হেসে দিয়ে বলল, ‘ অনেককিছু কিনেছি।’
‘ আমার জন্যে কিছু দিলোনা?’
হিমু মাথা নেড়ে না করল। আমি ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে আবার হিমুকে কার্টুন বের করে দিয়ে নিজে ফোন নিয়ে বসে পড়লাম। আমাকে কেন দেবে? আমি কে হই? আমার ওপর তো খালি রাগটাই ঝাড়া যায়। আড়চোখে একবার হিমুর দিকে তাকিয়ে থমথমে গলায় বললাম, ‘তা তোর দুলাই কই?’
হিমু হাতের ইশারায় দেখাল বসার ঘরে আছে। আমি আস্তে করে উঠে গিয়ে একটু উঁকি দিয়ে দেখলাম সোফায় হেলান দিয়ে আয়েশ করে টিভি দেখছেন। জগতের সবচেয়ে সুখী ব্যক্তি। এমন সুখ আমার কপালে কেন জোটেনা সেটাই বুঝিনা। এ যুগে সবকিছুই অপাত্রে দান হয়।
সন্ধ্যার খানিকক্ষণ আগে হিমুকে নিয়ে ফিরে গেলেন আদ্রিয়ান ভাই। ওকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে নিজে সদরে ফিরে যাবেন। এমনটাই শুনলাম। মন খানিকটা খারাপ হল। এতক্ষণ হিমুর সাথে দুষ্টুমি করে ভালোই কাটছিল সময়। আম্মু চা বানাতে গেছে। এমন সময় দরজায় টোকা পড়ল। আম্মু রান্নাঘর থেকে হাঁক ছেড়ে বলল, ‘অনু, দেখোতো কে এসেছে।’
কী আরাম করে বিছানায় শুয়ে শুয়ে ফোন স্ক্রোল করছিলাম। দিলো সব ভেস্তে। বিরক্তি নিয়ে উঠে গিয়ে দরজাটা খুলে দেখি আদ্রিয়ান ভাই দাঁড়িয়ে আছেন। আমায় দেখে হাসলেন উনি। আমি ভ্রু কুঁচকে ফেললাম। উনি আমার হাতে একটা পলিথিনের প্যাকেট ধরিয়ে দিলেন। তাকিয়ে দেখলাম ওখানে পুরি আছে। আমি কিছু বলার আগেই আম্মু দ্বিতীয়বার হাঁক ছেড়ে বলল, ‘কে এসেছে?’
উনি একটু জোরে বললেন, ‘মামণি আমি।’
‘ ও, ভেতরে আয়। চা বানাচ্ছি।’
আমি কটমটে চোখে তাকালাম ওনার দিকে। দাঁতে দাঁত চেপে ফিসফিসে আওয়াজে বললাম, ‘খবরদার আসবেন না। আপনাকে আমার একদমই সহ্য হবেনা। বলে দিন কাজ আছে, চলে যাবেন।’
উনি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আবার হেসে ফেললেন। এই হাসি দেখলে যে কেউ গলে যাবে। কী সুন্দর! উনি আমার দিকে তাকিয়ে এক হাতে দরজায় ভর দিয়ে বললেন, ‘আচ্ছা, আসলাম না। মায়াবিনীর ইচ্ছা, আদ্রিয়ানের জন্যে আদেশ।’
কিন্তু আমি বোকা বনে গেলাম। হয়েছে কী আজ এর? উনি ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে রেখেই আমার বাঁ হাতটা ধরে সামনে এগিয়ে এনে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কিছুক্ষণ দেখলেন। আমি মুখ ঘুরিয়ে অভিমানী কন্ঠে বললাম, ‘আপনি এসে দেখবেন সেই আশাতে তিনদিন অবধি দাগ বা ব্যথা বসে থাকবে না। দুটোই সেরে গেছে।’
উনি ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরে নিজের সেই ইউনিক স্টাইলে ভ্রু বাঁকিয়ে তাকালেন আমার দিকে। হাত ধরে নিজের দিকে কিছুটা টেনে নিয়ে বললেন, ‘রেগে গিয়ে ব্যথা দিয়েছিলাম তো তাই দাগটা আর নেই। ভালোবেসে দিলে দুটোই থাকবে।’
আমিও এমনি এক হ্যাবলা যে ওনার কথাটা শুনে কিছু না ভেবেই এক ভয়ানক প্রশ্ন করে ফেললাম। প্রশ্নটা করে দু সেকেন্ডের মধ্যেই বুঝতে পারলাম কী বলে ফেলেছি। কিন্তু ততক্ষণে ইটস্ ঠু লেইট। ধনুক থেকে তীর বেরিয়ে গেছে। আমার প্রশ্নে উনিও দু-তিন সেকেন্ড বোকার মতো তাকিয়ে ছিলেন আমার দিকে। এরপরই ফিক করে হেসে ফেললেন। আমার মাথায় একটা চাটা মেরে বললেন, ‘এইজন্যই তোকে বাচ্চা বলি। ভেতরে যা।’
আমি ঠোঁটে ঠোঁট চেপে চোখ বন্ধ করে ইউটার্ন নিলাম। নিজের বোকামির জন্যে নিজেই নিজের গোষ্ঠী উদ্ধার করতে করতে চলে এলাম নিজের রুমে। যেচে পরে কীভাবে নিজেকে লজ্জায় ফেলা যায় সেটা আমার কাছে সবার শেখা উচিত। কী ভয়ানক লজ্জার ব্যপার। রুম থেকেই ওনার গলার আওয়াজ পেলাম, ‘মামণি, চা খাবোনা এখন আর। দোকান থেকে খেয়ে এসেছি। বাড়ি যেতে হবে, আসছি।’
…
[ নববর্ষের শুভেচ্ছা সবাইকে। আজাইরা বসে আছি তাই দুপুরবেলাই একটা পার্ট দিয়ে দিলাম। রেসপন্স করবেন সবাই। আর #অন্তর্হিত কালকূট আজ ইফতারের পরে নয়তো রাতে দেব।]