#ইলমা_বেহেরোজ
তাই বাধ্য হয়ে এই শ্বশান ঘাট বেছে নিতে হয়েছে। সাদিক মনে মনে, আমিরকে কঠিন গালি দিল।
একটা কালো ছায়া হেঁটে আসছে। বাতাসের সঙ্গে তখন বজ্রপাত হচ্ছিল। সাদিক টর্চ জ্বালিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। টর্চের আলো কালো ছায়াটির হাতে থাকা কাচের বৈয়ামে পড়ে। বৈয়ামে রক্তাক্ত সদ্য কাটা দশটি মনুষ্য আঙুল, দুটি চোখ, জিহবার অর্ধেক। শ্বশানের সামনে দাঁড়িয়ে এমন দৃশ্য দেখে কিঞ্চিৎ সময়ের জন্য সাদিক তালগোল পাকিয়ে ফেলল। আমিরকে যে গালি দিয়েছে সেটা যদি কোনোভাবে আমির জেনে যায়? পর মুহূর্তে নিজেকে বুঝাল, মনে মনে কী বললাম আমির কী করে জানবে?
আমির এসেই বৈয়ামটি সাদিকের হাতে দিয়ে বলল, ‘পরে নেব।’
সাদিক বৈয়ামটি নিয়ে দ্রুত কাঁধের ব্যাগে ঢুকাল।
আমির তাড়াহুড়ো করে বলল, ‘ওদিকের কী অবস্থা?’
সাদিক খ্যাঁক করে গলা পরিষ্কার করে বলতে শুরু
করল, ‘কুতুবউদ্দিন গোপন সূত্রে জেনেছে, আদাকত
তার বড় ছেলের ফাঁসির রায় দিবে। উনি চেষ্টা
করছেন ফাঁসি আটকানোর। ছোট ছেলেকে পুলিশ খুঁজে বেড়াচ্ছে। তার বর্তমান অবস্থা নাজেহাল। বেশ কিছুদিন ধরেই এসব চলছে। মুমিনুল সাহেব কুতুবউদ্দিনকে শর্ত দিয়েছেন, যদি কুতুবউদ্দিন নিজের পদ ছেড়ে দিয়ে সেই পদে মুমিনুলের বড় ছেলেকে বসার সুযোগ করে দেয় তবে সে কুতুবউদ্দিনের দুই ছেলেকে রক্ষা করবে।’
‘কী মনে হয়, রাজি হবে কুতুবউদ্দিন?’
‘আমার মনে হয় রাজি হবে। এমনিতেও তার পদ টিকবে না বেশিদিন। তার থেকে মুমিনুলের কথায় এখন অবসর নিলে দুই ছেলেকে বাঁচাতে পারবে।’
আমির আশার আলো দেখতে পায়। তাহলে অনেকদিন ধরেই কুতুবউদ্দিন ঝামেলায় আছে। চারপাশ থেকে বিপদ আঁকড়ে ধরেছে তাকে। এমতাবস্থায় আমিরকে হুমকি দেয়ার মতো কাজ কীভাবে করল? করলে করতেও পারে। ইয়াকিসাফির অর্ডারের মাধ্যমে যে টাকা পেত তাতে পরিস্থিতি হয়তো পরিবর্তন করতে পারত। যখন পেল না রেগে গেল আমিরের উপর। কিন্তু জাহাজ কেন চাইবে? কুতুবউদ্দিনের জাহাজের অভাব নেই। সে জাহাজ চাইতে যাবে কোন দুঃখে? নাকি ছোট ছেলেকে দেশ থেকে বের করার জন্য তার একটি জাহাজ প্রয়োজন? যে জাহাজ নিরাপদ! হঠাৎ আমিরের মাথায় একটা ব্যাপার আসল।কুতুবউদ্দিনের কোনো লোককে আমার অফিস কিংবা বাড়ির আশেপাশে দেখা গেছে?’
‘না, সবাই রফিক মাওলার লোক।’
আমিরের চোখ দুটি জ্বলজ্বল করে উঠে। এমন নয়তো কুতুবউদ্দিন এ বিষয়ে জানেই না। ভাবনাটা মনে আসতেই আমিরের মেরুদণ্ড সোজা হয়ে গেল। যদি সত্যি এরকম হয়, রফিক মাওলাকে থামানোর পরিকল্পনা তার জানা আছে! কাজটা তার জন্য সহজ হবে। সে সাদিককে নিজের পরিকল্পনা বুঝিয়ে দিল। নিশ্চিত হতে হবে আগে, তার ধারণা ঠিক কি না। অফিসেও কিছু সমস্যা হচ্ছে। কাল একবার অফিসে যেতে হবে।
আমির বলল, ‘আলমগীর ভাই কাল যেন অফিসে থাকে।’
মুজ্জা কলোনির মাঠে আগামীকাল থেকে মেলা বসবে। গানের আসর হবে প্রতিদিন। তারই কাজ চলেছে সারারাত জুড়ে। গানের আসরের জন্য কয়েক পাড়া থেকে চাঁদা তোলা হয়েছে। আমির মাঠের কাছাকাছি এসে বিপাকে পড়ে যায়। সবার সামনে দিয়ে যাওয়া যাবে না। আকাশের অবস্থা বিকাল থেকে মেঘলা। সন্ধ্যার পর গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হয়েছিল তারপর থেকে শুধু বাতাস হচ্ছে। যেকোনো মুহূর্তে বৃষ্টি হতে পারে। রাতও প্রায় শেষ। তবুও এই লোকগুলো কাজ করে যাচ্ছে। ও এদিক-ওদিক খুঁজে একটা আগাছা ভর্তি পরিত্যক্ত পথ আবিষ্কার করে। ওই পথ দিয়েই শুকতারাতে পৌঁছায়। পদ্মজাকে দূর্বলতার ঔষধের সঙ্গে ঘুমের ঔষধ মিশিয়ে দিয়েছিল। এই কাজ করার পর থেকে অশান্তি হচ্ছে বুকে! কিন্তু সে নিরুপায় ছিল!
সিঁড়ির কাছাকাছি আসতেই পায়ের শব্দ শুনতে পায়। পদ্মজা কি জেগে গেছে? আমির টর্চ জ্বালাতে গিয়ে দেখে টর্চে রক্ত! গুদামঘরে রক্তের উপর টর্চ রেখেছিল! শার্ট পরিবর্তন করে অন্য শার্ট পরেছিল কিন্তু টর্চে যে রক্ত লেগেছিল ব্যাপারটা খেয়ালই করেনি। সে শার্টের বুকে খেয়াল করে দেখে, সেখানে রক্ত লেগে আছো পায়ের শব্দ আরো নিকটে চলে এসেছে। আমির দ্রুত শার্ট খুলে ফেলতে নেয় কিন্তু পরমুহূর্তেই মনে পড়ে, এখন ঠান্ডা পরিবেশ। পদ্মজাকে গরম লাগার অজুহাত দেয়া যাবে না। তবে মাঝেমধ্যেই ও রাতে বাড়িজুড়ে হাঁটে। সেটা বললে পদ্মজা বিশ্বাস করবে। কিন্তু এই রক্তের দাগ!
পায়ের শব্দ একদম নিকটো আমিরের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। দ্রুত টর্চ ফেলে পাশে রাখা টিনে হাত চেপে ধরে ও, তারপর সেই হাত বুকের সাথে চেপে ধরে সিঁড়িতে বসে পড়ে উল্টো হয়ে। ঠিক তখনই পদ্মজা নামল হাতে হারিকেন নিয়ে। আমিরকে বিছানায় না পেয়ে, নিচে নেমে এসেছে সো মাথাটা ঝিমঝিম করছে। হুট করে এতো ঘুম পেল! শরীরটা সত্যি খুব দূর্বল।
আমিরকে ওভাবে বসে থাকতে দেখে পদ্মজা অবাক হলো। ডাকল, ‘শুনছেন?’
আমির চট করে তাকাল। যেন মাত্রই পদ্মজার উপস্থিতি অনুভব করেছে। বলল, ‘ঘুম ভেঙে গেছে?’
পদ্মজা নেমে আসল,’ এখনো ঘুম পাচ্ছে।’
ওর চোখ দুটি নিভে আসছে। আমির ডান হাতে পদ্মজাকে টেনে পাশে বসায়। হারিকেনের আলোয় আমিরের বাম হাতের রক্তাক্ত বুড়ো আঙুল দেখে পদ্মজা আঁতকে উঠে। রক্তে শার্টের উপরিভাগ
#পদ্মমির -পার্ট – ১৬
#ইলমা_বেহেরোজ
কেউ যেন পদ্মজা কলিজা চিপ মেরে ধরে ওমন করে আর্তনাদ করে উঠল, ‘ও আল্লাহ! কীভাবে হলো?’
‘টিনগুলো পড়ে ছিল। ঠিক করতে গিয়ে অসাবধান -‘
পদ্মজার চোখে অশ্রু দেখে আমিরের কথা থেমে যায়। রোদ উঠলেও যাতে পদ্মজা ছাদে বসে আকাশ দেখতে পারে সেজন্য গতকাল টিনগুলো আনা হয়েছিল ছাদের এক কোণে ছাউনি দিতে।
হাতে যন্ত্রণা হচ্ছে। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে ধারালো টিনে গভীর ক্ষত তৈরি হয়েছে। গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে। তাৎক্ষণিক যুক্তিগত কী করবে ভেবে না পেয়ে এই কাজটা করতে বাধ্য হয়েছিল আমির। প্রাথমিক চিকিৎসা করেও যখন রক্তপাত বন্ধ হলো না, ফজরের আযানের সঙ্গে সঙ্গে ভুবন বেরিয়ে পড়ে ডাক্তার আনার জন্য। আমিরের আঙুল থেকে যত না রক্ত পড়ছে তার থেকে বেশি জল পড়ছে পদ্মজা চোখ থেকে। হাতের পীড়ায় মাথা ধরে যায় আমিরের। নতুন টিন হওয়াতে বেশি কেটে গেছে।
আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে শুকতারাতে ডাক্তার পৌঁছাল। তিনি ঈমানদার পুরুষ। তাহাজ্জুদ ও ফজরের নামায আদায় করে সবেমাত্র কোরান শরীফ নিয়ে বসেছিলেন তখনই ভুবন যায় সেখানে। রোগীর বিপদের কথা শুনে দৌড়ে চলে আসলেন। এসে দেখলেন, আমিরের বুড়ো আঙুল সহ হাতের তালু কালচে হয়ে গেছে। পর্ব দশ
সকাল থেকে বৃষ্টি হচ্ছে। ডাক্তার চলে যাবার পর খাবার গরম করে আমিরকে খাইয়ে দিয়েছিল পদ্মজা। তারপর চুলে বিলি কেটে দেয়। আমির ঘুমানোর পর পদ্মজার দুই চোখও লেগে আসে। যখন ঘুম ভাঙল, জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে মনে সন্ধ্যার অনুভূতি হয়। চারদিক ঘনকালো মেঘ। উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম কোন দিক দিয়ে যে বাতাস বইছিল তা ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না। পদ্মজা জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে মনোহর মুখখানা খানিকটা ভিজিয়ে নিল। যখন গ্রামে থাকত তখন এরকম বৃষ্টির দিনে বাড়ির পিছনের জানালা দিয়ে নদীর দিকে তাকিয়ে থাকত। চোখের সামনে নদীর জলে টুপটাপ বৃষ্টির ফোঁটা পড়ার দৃশ্য মন উদাসীন করে দিত। বাতাসের তোড়ে ঘাটে থাকা নৌকা দুলত এতগুলো বছর হলো শহরে আসার, এখনো গ্রামের জন্য মনটা আনচান করে। পদ্মজা আমিরের আহত হাতের ব্যান্ডেজে আলতো করে চুমু খায়।
টেবিলে বসে পেন্সিল আর সাদা পৃষ্ঠা নিয়ে দীর্ঘক্ষণ
সময় নিয়ে মনের মাধুরি মিশিয়ে একটা ছবি আঁকে।
আমির হালকা নড়তেই সে টেবিল ছেড়ে বিছানায় চলে আসল। আমির চোখ খুললে পদ্মজা উৎকণ্ঠিত হয়ে জানতে চাইল, ‘আঙুলে ব্যথা করছে?’
আমির হাত বাড়ায়, পদ্মজা ওর পাশে গিয়ে বসল। ‘কিছু খাবেন? কী রান্না করব বলুন। বাজার থেকে কিছু আনাব?’
‘এখানে মাথা রাখো।’ নিজের ডান বাহু দেখিয়ে মৃদু গলায় বলল।
পদ্মজা তার বাহুতে মাথা রাখল। আমির বাম হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরতে চাইলে সে আটকাল, ‘আমি জড়িয়ে ধরছি।’
বলেই সে আমিরের গায়ের উপর হাত রাখল। আমির আহত হাতের তর্জনী দ্বারা পদ্মজার কপাল থেকে চুল সরিয়ে দিয়ে বলল, ‘আমার সবকিছু মিথ্যে হলেও, তুমি মিথ্যে নও।’
‘কেউ কী বলেছে আমি মিথ্যে?’
ওর ঠোঁটে চুমু খেল আমির, ‘তুমি ভীষণ সুন্দর। চলো, আরেকবার বিয়ে করি।’পদ্মজা মজা করে বলল, ‘চলুন।’
‘সামনে তো তোমার জন্মদিন। সেদিন বিয়ে করা যায়, কী বলো?
পদ্মজা নিচের ঠোঁট কামড়ে মনে করার চেষ্টা করল, কবে ওর জন্মদিন। আমির বলে দিল, ‘এক সপ্তাহ পর।’
‘এতো দ্রুত! সেদিন না গেল। সময় কত দ্রুত চলে যায়।’
‘সময় যাচ্ছে ঠিকই কিন্তু তোমার বয়স বাড়ছে না: লাল বেনারসি পরবে? আমি শেরওয়ানী পরব নাকি-
‘থামুন। আপনি সত্যি বলছেন নাকি? বিয়ে করতে হবে না। ওইদিন সারাদিন আমার সঙ্গে থাকলেই হবে। গতবার তো থাকেননি।’ অভিমানী কণ্ঠে বলল পদদ্মজা।
‘ও কথা বলো না। অনুতাপ হয়। কাজের এতো চাপ পড়েছিল! কিন্তু এইবার আমি তোমার সঙ্গেই থাকব। কোনোকিছু আমাকে আটকাতে পারবে না।’
পদ্মজা আমিরের চোখের দিকে তাকাল। কী জানিকেন, আমিরের কাছে এলেই ওর পুরো পৃথিবী স্বর্গ মনে হয়। বাবা- মায়ের দাম্পত্যকলহ দেখে বড় হওয়াতে কখনো ভাবেনি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এতো প্রেম, ভালোবাসা, মায়া থাকতে পারে। ওর বন্ধুরা কেউই দাম্পত্য জীবনে পরিপূর্ণ সুখী নয়। প্রত্যেকে কিছু ত্যাগ করছে নয়তো মানিয়ে নিচ্ছে। কিন্তু আমির অন্যরকম, সারাক্ষণ ভালোবাসে, যত্ন করে।
ও আমিরের গাল আলতো করে ছুঁয়ে প্রশ্ন করল, ‘কোন পুণ্যের ফল আপনি?’ পদ্মজার অন্তঃস্থলের আবেগ দারুণভাবে ছুঁয়ে যায় আমিরকে। সে কিছু বলল না। পদ্মজা ওর বুকে মুখ গুঁজে বলল, ‘জানেন, মাঝেমধ্যে আপনাকে হারানোর ভয়ে বুকের ভেতরটা তরটা বড় কাঁপে। নিজেকে এলোমেলো লাগে।’
বলতে বলতে পদ্মজার চোখ দুটি অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠল। মানুষটাকে সে কখনো হারাতে পারবে না। এবারও আমির কিছু বলল না। চিৎ হয়ে ডান হাতে পদ্মজাকে বুকের উপর টেনে শক্ত করে ধরে রাখল। পদ্মজা পরিষ্কার শুনতে পেল আমিরের হৃৎস্পন্দন।
ঘড়ির কাঁটা বলছে দুপুর হয়েছে। কিন্তু বেলা ঠিক
যেখানে ছিল সেখানেই আছে। এর মধ্যে বৃষ্টি
তার গতি বাড়িয়েছে। মেঘমালা জড়িয়ে রেখেছে
আকাশের কোল। অন্ধকার চারদিক। গতকালের
কাপড়গুলো পত পত শব্দে বারান্দায় টানানো রশিতে উড়ছে।
#চলবে,,
সম্পূর্ণ গল্প