সুমির প্রতিদিন মন খারাপ হয় আয়াজকে স্কুলে নামিয়ে দেয়ার সময়। আয়াজ তার দিকে ছলছল চোখে তাকায়। আস্তে করে বলে
মা সন্ধ্যায় তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরো।
সুমি অন্য দিকে তাকিয়ে চোখের পানি আড়াল করার চেষ্টা করে। ছেলেটা কাজের বুয়ার কাছে বড় হচ্ছে। সুমি বাসায় ফিরলে সখিনা খালা বের হয়। প্রায় দিন চিল্লাচিল্লি করে
আপা আমি আর আপনার বাসায় কাজ করমু না। সেই সকাল বেলায় আপনার ছেলেরে স্কুল থেকে আনি, তারপর সারাদিন আপনার বাসায় থাকা লাগে। আমি কোনদিকে যাইতে পারি না। আপনার বাসার কাজ করার জ্বালা বেশী। ঘুরাঘুরি করা যায় না।
সুমি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে যতদিন খালেদ বেঁচে ছিলো তাদের জীবনটা অন্যরকম ছিলো। সকালবেলায় ঘুম থেকে উঠেই খালেদ চিল্লাচিল্লি শুরু করতো।
এই তোমাকে কেউ ছোটবেলায় পড়ায় নি? যারা তাড়াতাড়ি ঘুমাতে যায় এবং ঘুম থেকে তাড়াতাড়ি উঠে, তার স্বাস্থ্যবান, ধনী এবং জ্ঞানী হয়।
সুমি তবুও উঠতো না। সে বিছানায় শুয়েই বলতো
হুম পড়েছিলাম। কিন্তু তোমাকে দেখে বুঝতে পেরেছি এই কথার কোন সত্যতা নাই। কেননা তুমি কিছুই হও নাই।
তারপর থেকে খালেদ শুরু করতো বিরক্ত করা। লাইট জ্বালিয়ে দিতো। ফ্যান বাড়িয়ে দিতো। কত কিছু যে করতো। অফিস থেকে ফিরে তার সুমিকে নিয়ে টিভি দেখা চাই চাই। খুব নাটক দেখার শখ ছিলো। শুক্র, শনিবার হলে ঢাকা ইউনিভার্সিটি ঘুরতে যেতেই হবে। হাকিম চত্বরের ভাজা পোড়া না খেলে তার নাকি শান্তির ঘুম হয় না। টি এস সি-তে তার গান শুনতে হবে, সংসদ ভবনের কৃষ্ণচূড়া গাছ দেখতে যেতে হবে, শখের কোন শেষ ছিল না। আর ছেলে মানে সাত রাজার ধন। ছেলেকে কোল থেকে নামাতেই চাইতো না। একজন মানুষের মৃত্যুর সঙ্গে কত কিছুর পরিবর্তন ঘটে।
আয়াজের ক্লাস টিচার সুমির দিকে এগিয়ে আসে।
আপু জানেনতো আজকে বারোটায় ওদের ক্লাসের ইন হাউজ প্রোগ্রাম আছে। আপনার ছেলে সেখানে কোরাসে গান গাইবে। ও কিন্তু প্রতিটি অনুষ্ঠানে আপনাকে খোঁজে এবং না পেয়ে মন খারাপ করে। অধিকাংশের বাবা অথবা মা আসে। শুধুমাত্র মনে হয় ওর কেউ আসে না।
সুমির মন খারাপ হয়। আয়াজের মিসও জানে। সে না আসার কারন কি? অনেকবার বলেছে। এখন আর বলতে ইচ্ছে করে না।
সুমির অফিসে নতুন বস জয়েন করেছে পাঁচ দিন হয়েছে। লোকটা কেমন এখনো বুঝা যাচ্ছে না। সুমি এখনো কোন কাজ নিয়ে তার কাছে যায়নি। কিন্তু আজকে একটা ফাইলে সাইন করাতে যেতে হবে।
লোকটা বেশ সুদর্শন আছে। বেশ খুটিয়ে খুটিয়ে ফাইল দেখছে। একবারও সুমির দিকে তাকাইনি। ওরে বেশ হাসি পায়। এখানে যারা এতদিন বসেছে সবাই তাকে আগে দেখে তারপর ফাইল দেখে। এই লোক তার দিকে তেমন তাকাচ্ছে না।
বলবে না বলবে না করতে করতে সুমি আলভি সাহেবকে বলে ফেলে
স্যার আমাকে কি দুই ঘন্টার জন্য ছুটি দেয়া সম্ভব। আমার ছেলে স্কুলে একটা পারফর্ম করছে। আমি কখনো যেতে পারি না। ও খুব মন খারাপ করে।
আলভি সাহেব কিছুক্ষনের জন্য চুপ হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকলো। তারপর জিজ্ঞেস করলো
কয়টার সময় ওর প্রোগ্রাম?
স্যার ১২ টায়। ত্রিশ মিনিট পরেই শুরু হবে। খিলগাওতে।
আপনার জন্যতো বেশ কষ্ট হবে। এখন রিক্সা অথবা সি এন জি পাওয়া বেশ কষ্টের। আপনি এক কাজ করুন অফিসের গাড়ি নিয়ে দ্রুত চলে যান।
সুমি বিস্মিত হয়। আনন্দের তার চোখে পানি চলে এসেছে। সে এর আগেও সব বসের কাছেই এমন অনুরোধ করেছিল। সবাই একবাক্যে না করে দিয়েছে।
কি বলছেন এই অফিস টাইমে ছেলের অনুষ্ঠানে যাবেন। অন্য কাউকে পাঠিয়ে দিন। ছেলের এমন কত অনুষ্ঠান হবে সবকিছুতে কি আপনি যেতে পারবেন? আর অফিসের একটা কোরাম আছে, আপনার অনেক দায়িত্ব আছে।
সুমি দ্রুত অফিস থেকে বের হয়। আজকে সে আয়াজকে সারপ্রাইজ দিতে পারবে। ছেলেটা নিশ্চয় তাকে দেখে কেঁদে ফেলবে। ছেলেটা বড় কাঁদুনে হয়েছে তার মতো।
২।
স্যার আপনি নাকি সুমিকে উনার ছেলের অনুষ্ঠান দেখতে যাওয়ার জন্য ছুটি দিয়েছেন?
আলভি মাহমুদ সাহেবের দিকে তাকায়।
জি দিয়েছি।
স্যার মেয়েরা সম অধিকার চায় কিন্তু আবার নানান ধরনের সুযোগ সুবিধে চায়। তাদের মেটারনিটি লিভ লাগে, বাচ্চাদের জন্য ছুটি লাগে, বাসার কাজের জন্য ছুটি লাগে। সিঙ্গেল মাদারদের নিয়ে আরো সমস্যা। প্রায় এদের ছুটির দরকার হয়। এদেরকে অফিসে না রাখাই ভালো। অফিসের কালচার নষ্ট হয়। অন্যরা এ নিয়ে কথা বলে।
আলভি মাহমুদ সাহেবের চোখে চোখ রাখে
দেখুন আমি অফিসের প্রতিটি মানুষের ফাইল পর্যালোচনা করে দেখেছি যে সুমি বেশ ভালো কাজ করেন। উনার সেলস বুকিং ভালো। অফিসে সময়ের আগেই চলে আসেন। উনার কাছে ফাইল আটকে থাকে না। উনি যে খুব বেশি ছুটি নিয়েছেন এমনও না।
স্যার এই যে আজকে আপনি দুই ঘন্টার ছুটি দিলেন দেখবেন কালকে থেকে নানান বাহানা শুরু হবে। ওর এগুলো দেখে অন্যরাও তখন আর কাজ করতে চাইবে না। এটা সেটার জন্য ছুটি চাইবে।
মাহমুদ সাহেব আমার মা একজন সিঙ্গেল মাদার।
মাহমুদ একটু হতচকিত হয়ে যায়। স্যারের এই ইনফরমেশন তার জানা ছিল না। সে সব স্যারের প্রিয় পাত্র ছিল। অফিসের অন্য লোকজনের নামে বদনাম করলে সব স্যারই খুশী হয়। মাহমুদ তেল মারাতেও ওস্তাদ। এতদিন সে সুমিকে বেশ চাপে রেখেছে। মেয়েটা বেশ ত্যাদর আছে। একদিন সে সুমিকে বলেছিল
চলুন না কোথাও থেকে দুই দিনের জন্য ঘুরে আসি।
এরপর থেকে সুমি তার সঙ্গে প্রয়োজন ছাড়া কথাই বলে না।
আলভি আবার বলতে থাকে
আমার মা একজন সিঙ্গেল মাদার। জানেন একজন সিঙ্গেল মাদারকে কি পরিমাণ কষ্ট করতে হয়। বলতে পারেন তাকে আসলে ঈশ্বরের কাছাকাছি হতে হয়। তাকে মা হতে হয়, বাবা হতে হয়, ডাক্তার হতে হয়, নার্স হতে হয়, কাজের মানুষ হতে হয়, এই সমাজের টিটাকারি শোনার মানুষ হতে হয়। আপনার কোন ধারনা নেই নিশ্চয়। জানেন আমি আমার মায়ের জন্য খুব অপেক্ষা করতাম। বিভিন্ন দিনে খুব ইচ্ছে করতো মা যদি একটু সময় দিতো। আমরা কেন জানি মানবিক হতে পারি না। আমার মা যদি পরিশ্রম না করতেন তবে কি আজকের আমি হতে পারতাম? এই সমাজ খুব সাধারনভাবে চিন্তা করে। একটা ছেলে অফিসের এই কাজ করে একটা মেয়েকে তাই করতে হবে।
আরে একটা মেয়ে পরিবার গঠন করে। এই যে আমরা ছেলেরা এত বেশী কথা বলছি কোথা থেকে আমরা এসেছি? আমাদের পরিবারগুলো কে আগলে রাখে। আমরা কত সহজে বলে ফেলি ও কি কাজ করে? উনারা কাজ করেন বলেই প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম টিকে আছে। উনারা জানপ্রান দিয়ে পৃথিবীর সঙ্গে টিকে থাকার লড়াই করেন।
একজন সিঙ্গেল মাদার বলেন অথবা ফাদার বলেন আমার কাছে তারা স্বয়ং দেবতা অথবা দেবীর মতন।
আরেকটা কথা কি জানেন মাহমুদ সাহেব। বলতে চাই না তবুও বলছি। আমি আপনার ফাইলও দেখেছি। সারাদিন, রাত পর্যন্ত অফিস করেন কিন্তু আপনার কাছে ফাইল আটকে থাকে, কাস্টমাররা হ্যারেসম্যান্ট হয়, সেলস এচিভম্যান্ট অন্যদেরটা নিজের বলে চালিয়ে দেন । এবং অফিসের পরিবেশ নষ্ট করেন। তবুও আপনাকে বলবো
কাজের সময় শুধু কাজ করুন। অন্য সময় জীবনটাকে জীবনের মত উপভোগ করুন। দেখবেন জীবন সুন্দর।
৩।
আয়াজ যখন স্টেজে উঠেছে। সে এখন আর তার মা-কে খোঁজে না। সে জানে তার মা-র পক্ষে আসা সম্ভব না। সবার বাবা, মা অডিয়েন্সে বসে হাত তালি দিচ্ছে। সে জানে এর মধ্যে তার মা নেই।
হটাৎ সে শুনতে পায় কেউ তার নাম ধরে ডাকছে অডিয়েন্স থেকে।
আয়াজ বাবা, আয়াজ বাবা।
আয়াজ তাকিয়ে দেখে তার মা হাত তালি দিচ্ছে। তাকে ফ্লাইং কিস দিচ্ছে।
আয়াজের চোখ দিয়ে পানি পরছে।
সিঙ্গেল মাদার
#আমিনুলের_গল্প_সমগ্র
গল্প পোকা?
kobitor আছে আপনার পাশে