আমি যখন প্রেমে তলিয়ে গেছি তখন শুনলাম আমার ফুপাত বোন চারুও তাকে ভালোবাসে। ফুপু মারা গিয়েছেন চারুর বয়স যখন ছয় বছর তখন। তারপর বাবা চারুকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে এলেন। সেই থেকে সে এখানেই থাকে। মা বাবা কখনও তাকে বাবা মায়ের অভাব বুঝতে দেননি। ফুপা আবার বিয়ে করে সংসার শুরু করলেও চারুর খোঁজ খবর নেন। মা মরা এই মেয়েটার প্রতি সবার ভালোবাসাই যেন একটু বেশি। আমি নিজেও তাকে খুব ভালোবাসি। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে বাবা মায়ের ভালোবাসার ভাগ দিয়েছি বলে প্রেমিকের ভাগও দেবো? অবশ্য অশ্রুনীলকে প্রেমিক বললে ভুল হবে। সে বাবার বন্ধুর ছেলে। আজও তাকে বলা হয়নি যে, ছোটবেলা থেকেই আমি তাকে ভালোবাসি। ঠিক কবে থেকে সেই ভালোবাসার সূচনা তা আমি নিজেও জানি না। চারু কি জানে কবে থেকে সে অশ্রুনীলকে ভালোবাসে? জিজ্ঞেস করতেও বুক কাঁপছে। রুমালে যদি “অশ্রুনীল” লিখে সেলাই না করত তাহলে তো জানতেই পারতাম না যে, সে অশ্রুনীলকে ভালোবাসে। আমি নিজেও জানি না আমি কী করব। চারু আর আমার বিয়ের সম্বন্ধ আসে। আমরা মাত্র দেড় মাসের ছোট বড়। চারু বড় আমার চেয়ে। তাই বাবা চারুকে বিয়ে দিয়ে তবেই আমাকে বিয়ে দেবেন।
কলেজে ভর্তি হবার পর থেকে মাঝে মাঝে আমাকে আর চারুকে ম্যাথ দেখিয়ে দিতে আসত অশ্রুনীল। সে এসেছে এই খবর পেয়েই চারু সাজতে বসে যেত। বেশ সেজেগুজে সে অশ্রুনীলের সামনা-সামনি বসে অংক করত। আর আমি তো চিরকালের নিরামিষ। সাজগোজ আমার আসে না। তখনও বুঝতে পারিনি চারুর এই সাজের কারণ। আমি বরাবর মাথা নিচু করেই অংক করে গেছি। এতটাই লজ্জা পেতাম যে, অংক না বুঝলেও অশ্রুনীলকে জিজ্ঞেস করতে পারতাম না। কিন্তু সে খুঁটে খুঁটে আমাকেই ধরত। যেটুকু পারতাম নার্ভাস হয়ে সেটুকুও ভুলে যেতাম। সে ধৈর্য্য ধরে আবার বুঝিয়ে দিত। না বুঝলেও মাথা ঝাঁকিয়ে বুঝাতাম, বুঝেছি। কিন্তু চারু ছিল আমার উল্টা। বুঝার পরেও বারবার বুঝিয়ে নিত সে। অশ্রুনীলের সাথে কথা বলার বাহানা ছিল যে এসব তা তখন বুঝতে পারিনি। আজ যখন সব পরিষ্কার তখন কী বা করার আছে আমার? কিন্তু আমি যে বড় মনের পরিচয় দিয়ে নিজের ভালোবাসাকে বলি দিতে পারছি না।
গত একটা সপ্তাহ ধরে আমি ঘুমাই না। তন্দ্রা ভাব এলেও চমকে উঠে ঘুম ভেঙে যায়। কবে যে ভালোবাসা এত গভীর হলো তা নিজেও জানি না। সকালে বাবা অশ্রুনীলের সাথে চারুর বিয়ের কথা বলছিলেন। আমি সরে যাবার স্থান না পেয়ে ভার্সিটিতে চলে এসেছি। একটাও ক্লাস করিনি। সকাল থেকেই ক্যাম্পাসের কোণের পুকুর পাড়ে বসে আছি। বিকেল গড়িয়ে যাচ্ছে, আমার বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করছে না। হঠাৎ ফোন বেজে উঠলো। মা কল করেছে।
কল রিসিভ করতে মায়ের উৎকন্ঠিত কন্ঠস্বর, তুই কোথায় নীরা?
__ক্যাম্পাসে।
__সন্ধ্যে হতে চলল, এতক্ষণ ক্যাম্পাসে কী করছিস?
আমি চুপ করে রইলাম। মা বললেন, বাড়ি ফিরে আয় তাড়াতাড়ি !
__হুঁ
ইচ্ছে থাকলেও বাড়ির এই কোলাহল থেকে দূরে থাকতে পারি না। এ কেমন আবদ্ধ জীবন?
বাড়ি ফিরে ঘর অন্ধকার করে শুয়ে রইলাম। চারু আর মা বেশ কয়েকবার খাওয়ার জন্য ডেকে গিয়েছে, আমি যাইনি। আমার সাথেই এক বিছানাতেই ঘুমায় চারু। আজকাল তাকে আমার সহ্য হয় না। অথচ সে আমার সবচেয়ে প্রিয় বান্ধবী।
__তোর কী হয়েছে নীরা?
ক্ষীণ স্বরে জবাব দিলাম, কিছু না তো।
__আজকাল আমার সাথে কথা বলিস না দেখছি।
__শরীরটা ভালো নেই। ঘুমাতে দে।
আমি পাশ ফিরে শুলাম। সে আমার মাথায় হাত রেখে বলল, কাল পহেলা ফাল্গুন। শাড়ি পরবি না?
__না।
__কেন?
__আমাকে কবে শাড়ি পরতে দেখেছিস? আর কবেই বা তোর মতো আমাকে সাজতে দেখেছিস?
__এবছর না হয় প্রথম পরবি।
আমি ভীষণ বিরক্ত হয়ে বললাম, চুপ কর না চারু! এসব ভাবা বাদ দিয়ে নিজের বিয়ে নিয়ে ভাব আর আমাকে ঘুমাতে দে।
চারু আর কিছু বলল না।
সকালে ফ্রেশ হয়ে ড্রয়িংরুমে গিয়ে দেখি অশ্রুনীল বসে আছে। বাবা তার সাথে কথা বলছেন। চারু লাজুক মুখে এককোণে দাঁড়িয়ে আছে। কী সুন্দর সেজে আছে সে, যেন তাকে পাত্র দেখতে এসেছে। অশ্রুনীল যে চারুকে পছন্দ করবে সেটা আমি জানি। অমন চঞ্চল চপলাকে কোন ছেলেই বা অপছন্দ করবে?
আমি সেখান থেকে সরে যেতেই অশ্রুনীল আমাকে পেছন থেকে ডাকল, নীরা।
আমার বুকের ভেতরটা ধপ করে উঠে চেপে এলো। আমি মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে গেলাম। পিছু ফিরে তার দিকে তাকানোর ক্ষমতা আমার নেই। এমনিতেই আমি তাকে লজ্জা পাই, এখন আবার সে আত্মীয় হতে চলেছে। আর কয়েকদিন পরে তাকে আমার দুলাভাই বলে ডাকতে হবে। শালি দুলাভাইয়ের যে মধুর সম্পর্কটা থাকে তা হয়তো অশ্রুনীলের সাথে আমার কখনও হবে না। কিন্তু চারুর এই বিয়েটা চোখের সামনে সহ্য করব কী করে সেটাই ভাবছি।
সে আবার ডাকলো আমায়।
__নীরা এদিকে এসো।
আমি অনেক কষ্টে মুখটাকে ঘুরাতে পারলেও চোখ তুলে তার দিকে তাকাতে পারলাম না। সে উঠে এসে আমার হাতে একটা শপিং ব্যাগ ধরিয়ে দিয়ে বলল, বাসন্তী উপহার তোমার জন্য।
হঠাৎ বাবা বলে উঠলেন, চারুরটা কই? আসলে আমি তো কখনও একজনকে কিছু কিনে দিই না। যখন যা কিনি দু’জনের জন্যই কিনি।
অশ্রুনীল ম্লান হেসে বলল, ভালোবাসার উপহার তো একজনকেই দিতে হয়, যাকে ভালোবাসা যায়।
বাবা অবাক হয়ে বললেন, মানে? বুঝলাম না।
অশ্রুনীল খুব দৃঢ় স্বরে বলল, আমি নীরাকে ভালোবাসি।
বাবা হতবাক হয়ে তার দিকে তাকালেন। তার চেয়ে বেশি হতবাক হলাম আমি। আর চারু?
বাবা বললেন, কিন্তু আমরা তো চারুর সাথে….
চারুর চোখদুটো জলে ভিজে একাকার হয়ে গিয়েছে। আমি তার দিকে তাকিয়ে আছি।
অশ্রুনীল বলল, আঙ্কেল, আমি অনেক বছর ধরেই নীরাকে ভালোবাসি। তার লেখাপড়ার ক্ষতি হবে বলে আমি কখনও এসব তাকে বুঝতে দিইনি। আমার বাড়িতে সবাইকে নীরার ব্যাপারে বলা আছে। কাল যখন আপনি বাবাকে চারুর সাথে আমার বিয়ের কথা বলেছিলেন তখন মনে হলো, এখন না বললে বড্ড দেরি হয়ে যাবে। আমার পক্ষে চারুকে বিয়ে করা সম্ভব নয়। আমি কখনও তাকে অন্য দৃষ্টিতে দেখিনি।
বাবা আর কিছু বললেন না। আমরা সবাই স্তব্ধ হয়ে গেলাম। অশ্রুনীল কিছুক্ষণ চুপ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে বলল, বিকেলে আমি আসব তোমায় নিয়ে ঘুরতে যাব। ব্যাগে শাড়ি চুড়ি আছে, তুমি শাড়ি পরে রেডি থেকো।
আমি কিছু বললাম না। এমন কী মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতিও দিলাম না। অশ্রুনীল চলে গেল। আমি নিজের ঘরে এলাম। চারু ঘরে এলো না। এমনকি সারাটা দিনেও সে একবারও ঘরে আসেনি। এতে আমার একটুও খারাপ লাগেনি। আমার ভেতরে অচেনা এক অনুভূতি কাজ করছে। যা আমি বর্ণনা করতে পারছি না।
আমি আর অশ্রুনীল রিকশায় বসে আছি পাশাপাশি। কারও মুখে কোনো কথা নেই। আমি লজ্জায় তার দিকে তাকাতেও পারছি না। চারু এখন কী করছে তা আমি জানি না। জানতেও চাই না। মানুষ মাঝে মাঝে খুব স্বার্থপর হয়ে যায়। বাবা-মা, বিছানা এবং নিজের জামা কাপড় যার সাথে ভাগ করেছি তার সাথে প্রেম ভাগ করা যায়নি। শুনেছি যুদ্ধে আর প্রেমে ভুল বা অন্যায় বলে কিছু নেই। আমিও অন্যায় করিনি। নীরবতা ভেঙে হঠাৎ অশ্রুনীল বলল, চোখ বন্ধ করো, নীরা।
আমি কিছু না বলেই চোখ বন্ধ করলাম। সে আমার খোপায় কাঠগোলাপ গুজে দিলো। বসন্তের রঙে রঙিন হলাম আমি। ছড়িয়ে দিলো সে ভালোবাসার পরাগ। আমার বন্ধ চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে অবিরাম….
“অশ্রু সুখে অশ্রুনীল”
Written by- Sazia Afrin Sapna