জামদানী পর্ব ১
তেত্রিশ শো টাকা দিয়ে কেনা একটা জামদানী পরে রতন মামার টংয়ের দোকানে বসে আছি। টেনশনে বারবার আমার নাক ঘামছে। হাতের টিস্যুটা দিয়ে হালকা করে ঘাম মুছে ফেললাম, জোরে ঘষা দিলাম না, যদি আবার মেকাপ উঠে যায়!
প্রায় একঘন্টা হল আমি এই দোকানে বসা। হাতে থাকা চায়ের কাপে সর পরে গেছে এরমধ্যে, চুমুক দেওয়া হয়নি। আসলে ভেতরে ভেতরে চিন্তা হচ্ছে খুব। ও আসবে তো এখানে? যদি না আসে!
সোহেল আর আমি ক্লাসমেট। আমি এখানে সোহেলের জন্যই অপেক্ষা করছি। খুব সম্ভবত আজ আমরা বিয়ে করব। সম্ভবত বলছি কারন সোহেলের না আসার সম্ভাবনা প্রবল, সে না আসলে বিয়ে হবে না।
মাস্টার্সের থিসিস শেষ করতে না করতেই আমি বেশ কয়েকটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করার জন্য এপ্লাই করেছিলাম। এর মধ্যে দুটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডাক এসেছে। একটা কানাডা আর আরেকটা কাছে পিঠের দেশ জাপান হতে। আমি অনেক ভেবে চিন্তে কি মনে করে নাক বোচা পরিশ্রমী জাতির দেশটাই বেছে নিলাম। আর আগামীকাল রাতে আমার ফ্লাইট। অবশ্য আমার চেহারাতে চাইনিজ, জাপানিজ ভাব প্রবল। জাপান বেছে নেবার এটাও একটা অন্তর্নিহিত কারণ হতে পারে,সেটা নিয়ে ভাবিনি।
তবে এইযে ঠিক ফ্লাইটের আগের দিন বিয়ে করছি, জিনিসটা হয়তো বোকামি হচ্ছে। হয়তো না আসলেই বোকামি হচ্ছে। কিন্তু সেইটা যে বোকামি এটা মেনে নেবার মত মানসিক অবস্থায় আমি নেই।
জীবনের কিছু কিছু সময় মানুষ বুদ্ধির চেয়ে আবেগ দিয়ে বেশি কাজ করে, আমি এখন সেই অবস্থায় আছি। মহা আবেগী। আমার শুধু মনে হচ্ছে, যে কোন মূল্যে সোহেলকে আমি চাই, সোহেল আমার। আমি ছাড়া অন্য কেউ সোহেলের বুকে মাথা রাখবে এটা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারব না।
অথচ সোহেলের সাথে যে আমার খুব প্রেম ব্যাপারটা কিন্তু তাও না। ভার্সিটিতে প্রায় পাঁচ বছর একসাথে আছি, কখনও খুব বেশি আলাপ হয়নি। বন্ধু বান্ধবের যে কোন আড্ডা, প্রোগ্রামে বেশিরভাগ ভাগ সময়ে সে থাকতো অনুপস্থিত। সকালে আলুথালু হয়ে ক্লাসে আসতো। কোনরকম ক্লাস শেষ করেই বেড়িয়ে পড়তো। শুনেছিলাম বেশ কয়েকটা টিউশনি করে সে, এজন্যই ব্যস্ততা। ক্লাস ছাড়া বাকি সময়টা আমরা আমাদের মতো হই হুল্লোড়, আড্ডা দিয়েই সময় পার করছিলাম।
তবু এরমধ্যেই সোহেলের সাথে কথা হল একদিন। ব্যাপারটা ঠিক কাকতালীয় বলা যাবে না, অনেকটা ইচ্ছাকৃতই বলতে হবে।
ততোদিনে আমরা থার্ড ইয়ারে উঠি গেছি। ক্লাস শেষে মাঝে মাঝেই সোহেলকে মিরপুরের দিকে বাসে উঠতে দেখি। বেশ কয়েকবার তাকে কন্টাকটরের মতো ঘেমে নেয়ে বাসের হ্যান্ডেল ধরে ঝুলতেও দেখেছি। ভীষণ মন খারাপ হয়েছিল আমার। বুঝতে পারতাম জীবন যুদ্ধে অংশ নিতে নিতে বেচারা ক্লান্ত তবু হাল ছাড়তে রাজি নয়। কি জানি অদ্ভুত কোন কারণে আমার ব্যাপক মায়া লাগতো। যদিও সেটা প্রকাশ তো করতামই না, বরং দেখা হলেই এমন ভাব করতাম, যেন ওকে দেখে খুব মজা পাচ্ছি। একবার তো ওর বাসের ঠিক পাশেই আমার গাড়ি জ্যামে আটকে গেল। আমি জানালা দিয়ে মাথা বের করে তাচ্ছিল্য মার্কা একটা হাসি দিয়েছিলাম, লজ্জায় একদম কুঁকড়ে গিয়েছিল বেচারা।
সেদিনও ওকে বাসের জন্য অপেক্ষা করতে দেখে গাড়ি দাঁড়াতে বললাম। আমার লেটেস্ট মডেলের ঝকঝকে গাড়িটা ওর গা ঘেঁষে থামতেই চমকে উঠল সোহেল।
: গাড়িতে ওঠো, তোমাকে লিফট দেই।
আমি ভেবেছিলাম সোহেল আসবে না। কারন এ ধরনের মানুষের আর যা কিছু থাকুক বা না থাকুক, আত্মসম্মান বোধ থাকে টনটনা। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে বিনা বাক্য ব্যয়ে সোহেল গাড়িতে উঠে এলো। এমন ভাবে বসল যেন এটাই স্বাভাবিক, আমি আসব আর ওকে গাড়িতে তুলে নেব।
ঐদিনই প্রথম সোহেলের সাথে কথা হল। সে টিউশনিতে যাচ্ছে। পরপর চারটা টিউশনি করে একবারে রাতে হলে ফিরবে।
: দুপুরে খাবে কোথায়?
: এই খেয়ে নেব কোথাও।
বলে উড়িয়ে দিল আমার কথা। আমি স্পষ্ট বুঝলাম সে খাবে না। হয়তো টিউশনিতে যে নাশতা দেবে সেটা দিয়েই দুপুরের খাবার শেষ করবে।
: ড্রাইভার চাচা, গাড়ি রাখেন তো সাইড করে, রেখে এই দোকান থেকে দুটো বার্গার নিয়ে আসেন, অনেক দিন এই বার্গার খাই না।
ড্রাইভার চাচা বার্গার এনে হাতে দিতেই কোন লাজ লজ্জার ধার না ধরে গপাগপ খাওয়া শেষ করল সোহেল। আমি তখনও খাবার হাতে নিয়ে বসে আছি আর ওর খাওয়া দেখছি।
: চাচা চলেন, আমাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে তারপর আপনার এই স্যারকে নামাবেন।
: আমার দেরি হয়ে যাবে রূপু।
: রুপু কে! আমার নাম রূপকথা, নিজের ক্লাসমেটের নামটাও জানো না অথচ তার গাড়িতে এসে উঠেছো, আশ্চর্য তো।
সোহেল অপ্রস্তুত হয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল, বাকি পথটায় আর তেমন কোন কথা হলো না আমাদের।
বাসায় গাড়ি ঢুকতেই সোহেলের চোখ মোটামুটি কপালে উঠে গেল। অবশ্য এমনই হবে আশা করেছিলাম। আমাদের বাড়িটা একদম হুলস্থুল ধরনের। বিশাল বাড়ি, সাথে অনেক বড় বাগান। সচরাচর ঢাকা শহরে এইরকম বাড়ি আর খুব একটা দেখা যায়না। তাই যেই দেখে বেশ অবাক হয়।
: এটা তোমাদের বাড়ি!
: হুম, ভেতরে আসবে?
: না থাক।
এটাই সোহেলের আমাদের বাসায় প্রথম আর শেষ আসা। সোহেল গাড়ি নিয়ে চোখের আড়ালে যেতেই কি জানি কি অদ্ভুত কারণে চোখ ভিজে উঠল আমার। আমি কেমন করে সেদিন নিজের রুমে গিয়েছিলাম নিজেও বলতে পারি না।
পরের দিন ক্লাস শেষ হতেই সোহেলকে ডাকলাম।
: চল, নামিয়ে দেই।
সোহেল আজও বিনা বাক্য ব্যয়ে উঠে এল।
: নাও খাও, আম্মু বাচ্চাদের মত আমাকে টিফিন বানিয়ে দেয়, আমার খুব বিরক্ত লাগে, এটা তুমি খাও প্লিজ, না হলে ব্ক্স দেখে আম্মু মন খারাপ করবে।
সোহেল রহস্যময় একটা হাসি দিয়ে খাওয়া শুরু করলে আমি যেন মরমে মরতে শুরু করলাম। বারবার মনে হচ্ছিল, আমি যে ওর জন্যই খাবার এনেছি সেটা বুঝে যায়নি তো!
বাসায় পৌঁছানোর আগেই সোহেল গাড়ি থামাতে বলল।
: আমি এখানেই নেমে যাব।
আমি ভেতরে ভেতরে অবাক হলাম তবু কিছু জিজ্ঞেস করলাম না। বরং এমন ভাব দেখালাম যে সে যেখানে খুশি নামুক তাতে আমার কি!
এরপর থেকে প্রায়ই সোহেল কে ক্লাস শেষে আমার সাথে অর্ধেক পথ লিফট নিতো। বাসার কাছাকাছি আসতেই নেমে যেতো। অনেকটা অলিখিত একটা নিয়মে পরিনত হল যেন ব্যাপারটা। একদিন ক্লাস শেষে বারান্দা দিয়ে হেঁটে পার্কিংয়ের দিকে এগোচ্ছিলাম। দূর থেকে একদল ছেলে আমাদের দেখেই শীষ দিয়ে হাসাহাসি শুরু করল। আমি পাত্তা দিলাম না। না শোনার ভান করে গটগট করে হেঁটে গাড়ির সামনে চলে এলাম।
: রূপু, তুমি চলে যাও।
: কেন!
: ছেলেরা আজেবাজে কথা বলছে, আমার জন্য তোমাকে কেউ বাজে কথা বলুক এটা আমি চাইনা।
: ওদের কথায় আমার কিছু যায় আসে না, চল।
: আমার আসে, তুমি যাও।
এই বলে সোহেল হাঁটা দিল। আমি অসম্ভব মন খারাপ করলাম কিন্তু আর ডাকলাম না। কি দরকার জোর করার!
গাড়িতে উঠে ড্রাইভার চাচা কে বললাম কিছুক্ষণ এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করতে। এতো তাড়াতাড়ি বাসায় যেতে ইচ্ছে করছিল না। অনেকক্ষণ ঘুরেফিরে কলাভবনের সামনে আসতেই দেখলাম, আমগাছের বাধাই করা শানের ওপর বসে একমনে সিগারেট টানছে সোহেল, আকাশের দিকে তার মুখ।
বুকে কেমন ধাক্কার মত লাগল সেদিন। ছেলেটা এতো উদাস হয়ে আছে কেন! ওরও কি চাপা কষ্ট হচ্ছে আমার মত অথচ কিছু বলতে পারছে না? কি জানি!
সম্পূর্ণ গল্পের লিংক