“অমর সঙ্গী”
লাবনীকে যখন বিয়ে করি ও তখন ক্লাশ নাইনের ছাত্রী।পরীর মত দেখতে এতিম মেয়েটি আমার বউ হয়েই বুঝে গেছে, রায়হান নামের ইমোশনাল ও গুছানো মানুষটি খুব একটা ‘সুবিধার’ হবেনা।
এই ধরনের মানুষ নিজের আবেগ আর মতামতকে সব সময় বড় করে দেখে।
লাবনীর ধারনা সঠিক না বেঠিক সে
বিচারের ভার পাঠকের হাতেই ন্যস্ত রইল।
১৯৮৮ সালের ১৬ই ডিসেম্বর আমাদের বিয়ে হয়।শীতের রাত।কাগজের ফুলে সাজানো বিয়ের গাড়ী করে আমি,লাবনী
ছোট বোন আর ভাগ্নি ফিরছি।
ওর গায়ের সাথে গা লাগছে আমার!
আমি চমকে উঠি;মেয়েদের গা এত গরম হয়?
___________________________
বাসায় সাজানো খাটে ‘বউ দেখা’পর্ব হবে,সারা পাড়া ভেঙ্গে পড়েছে বউ দেখবে-রায়হানের বউ।
বেচারী লাবনীর গায়ে হলুদের দিন থেকেই জ্বর।বিয়ের দিন সারাদিন জ্বরে ও কিছুই মুখে দিতে পারেনি;তবু ওকে বউ সেজে থাকতে হয়েছে।
আমাদের আমলে বিয়ের কনেদের স্টেজে কোনঠাসা হয়ে বসে থাকতে হত।
ওই সময় ক্ষুধার্ত কনেটি বলতেও পারত না তার খিদে পেয়েছে।
-খিদে পেয়েছে?ওমা এ কেমন মেয়ে গো শুধু খাই খাই করে!এমন হাজারো কটু কথা মেয়েরাই মেয়েদের শোনাত।
দিন বদলেছে,এখনকার বিয়ের স্টেজে বর কনে কি সুন্দর হিন্দি গানের সুরে সুরে নাচে,গায়,ফটোসেশন করে!আমি অবাক হয়ে দেখি আর দীর্ঘশ্বাস ছাড়ি।
লাবনীর কোন বড় ভাবি কিংবা দস্যি বোন ছিলনা যে এক ফাঁকে ওকে জোর করে খাওয়াবে।আমি বর,আমারও কনের কাছে যাওয়া বারন।সারাটা দিন আমার লাবনী না খেয়ে বউ সেজে বসে রইল।
আমাদের বাড়ি এসেও সেই বসে থাকা।
আমি যে একটু বলব-সারাটা দিন লাবনী কিছু খায়নি;ওকে একটু খেতে দেয়া হোক
বলতে পারছিনা।
কত টিপ্পনী শুনতে হয় কে জানে।
‘বউ দেখা’পর্ব শেষে গভীর রজনীতে ওকে যখন আমার ঘরে দেয়া হয়;জ্বরে তখন ওর গা পুড়ে যাচ্ছে।
আমি একটু জোর জোর করে ওকে কয়েক লোকমা পোলাও,আর সামান্য রোস্ট মাংস মুখে তুলে দিলাম।
দু’টো প্যারা পাইরল বড়ি খাইয়ে দিলাম।
মিনিট পনের পরেই লাবনী হড়হড় করে বমি করে বিছানা ভাসিয়ে দিল।
তেত্রিশ বছর আগের সে রাতে লাবনীর বমি কেচে দিয়ে বিছানা পরিষ্কার করেছি।
মাথায় জলপট্টি দিয়ে চিন্তিত মুখে বারান্দায় বসে বসে সিগারেট ফুঁকেছি।
কঠিন মমতায় নির্ঘুম রাত কাটিয়েছি।
শিকেয় তুলে রাখতে হল আমার
বাসর রাতের মিষ্টি মধুর আলাপন!
আজ এতগুলো বছর পর লাবনীর অভিযোগ-‘তুমি একটা পাষান!
বাসর রাতে আমারে একা ফেলে বারান্দায় বসে বসে তামাক খাইছ’!
যার জন্য করলাম চুরি সেই কয় চোর-হাঃহাঃহা!সাধে কি আর শাস্ত্র বলে ‘নারীর মন দেবা না জানন্তি’!
আমার বড় দুই খালাত ভাই রাশেদ আর
আবুসিদ্দিক ভাই তাদের ইয়াসিকা আর জেনিথ ক্যামেরায় আগফা কালার ফিল্ম ভরে বিয়ের ফটো শ্যুট করেছেন।
সেই থার্টি ফাইভ এমএম এর এক রোল ফিল্মে সাধারনত ছত্রিশ থেকে আটত্রিশটা ছবি উঠত।কপাল ভাল হলে চল্লিশটা।
ছোট্ট একটা সরকারি চাকরি করি;
মাস শেষে মাইনে দেড় হাজার টাকা!
নূন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা।
দুই রোল ফিল্ম খালাত দুই ভাই ডেভেলপ করে দিলেন;টাকার অভাবে ছবি আর প্রিন্ট করাতে পারিনা।ফুজি কালার ল্যাব মাত্র দেশে এসেছে।থ্রি আর সাইজ এক কপি ছবি প্রিন্ট করাতে স্থান ভেদে পনের থেকে বিশ টাকা লাগে।
দুই রোল ছবি প্রিন্ট করাতে আমার এক মাসের মাইনেতেও কুলাবে না!এমনিতেই বিয়ে উপলক্ষে অনেক ঋন হয়ে গেছে-যা প্রায় সবটাই আমার কাঁধে চেপেছে।
আমি লাবনীকে বলি-
-প্রতি মাসে পাঁচ কপি করে প্রিন্ট করালে কেমন হয়?
-না বিয়ের ছবি একসাথে প্রিন্ট না করালে মজা থাকে না!
-তথাস্তু।
আমি আর ছবি প্রিন্ট করার কথা মুখেও আনিনা।শুধু শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন ডেভেলপ করা ফিল্মগুলো রোদে শুকাই যেন ফাঙ্গাস পড়ে ফিল্মগুলো নষ্ট না হয়।
শুকানোর পর পলি কাভারে থাকা ফিল্মগুলোরে রোদের দিকে উঁচু করে ধরি আর চোখ সরু করে দেখি-এইটা আমি,এইটা লাবনী,ওইটা আব্বা,ওই যে ওইটা মামা!
অনেক মন খারাপ করে ফিল্মগুলো আবার সযতনে তুলে রাখি।
মনেরে প্রবোধ দেই-ভবে চিরকাল কারো সমান নাহি যায়।আমার দিনও ফিরবে ইনশাল্লাহ।
১৯৯৪ সাল!
মরার উপর খাঁড়ার ঘা আর কাকে বলে!
সম্ভবত নভেম্বরের শেষের দিকে এক সকালে বলা নেই কওয়া নেই আমার এপেন্ডিসাইটিসের ব্যথা উঠল।
ব্যথার তীব্রতায় বিছানায় গড়াগড়ি খাচ্ছি।এদিকে বিভিন্ন দাবী দাওয়া নিয়ে ডাক্তার ধর্মঘট চলছে।সরকারকে আল্টিমেটাম দেয়া হয়েছে।
এর মধ্যেই সরকার দাবী না মানলে ডাক্তাররা প্রাইভেট প্র্যাকটিসও বন্ধ করে দেবে বলে সরকারকে হুঁশিয়ারি দিয়েছে।
মাসের এই সময় হাতে টাকা পয়সা নাই;
বেতনও হয়নি।আমার কোন সেভিংসও নাই!সংসার শুরুই তো করেছি ঋন মাথায় নিয়ে! বাড়ির কাছাকাছি একটা ক্লিনিক আছে ওরা বারো হাজার টাকা চাইল।
লাবনী আর আম্মা মিলে কিভাবে যেন টাকা জোগাড় করে আমাকে মাহফুজ ক্লিনিকে ভর্তি করে দিলেন।
অস্ত্রোপচার শেষে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে আমি আরো বারো হাজার টাকা ঋনের বোঝা মাথায় নিয়ে নিয়ে ঘুরি।
এমনি ঘুরাঘুরি করতে করতে একদিন বন্ধু মুস্তাকীমের সাথে দেখা।
-বন্ধু একি চেহারা হয়েছে তোমার?
-আর বলোনা বন্ধু অশেষ ঝামেলায় আছি।
মুস্তাকীম আমার বেশ বিশ্বস্ত বন্ধু।
সব কিছু শুনে ওর আলিকো এজেন্সির ভিজিটিং কার্ড ধরিয়ে দিল হাতে।
সন্ধ্যায় ওর অফিসে যাই,প্রতিদিনই যাই।
সংক্ষিপ্ত ট্রেনিং শেষে আমার চাকরির পাশাপাশি পার্টটাইম আলিকোতে বীমা প্রতিনিধি হিসাবে কাজ শুরু করি।
প্রচুর কমিশন পাই আলিকোতে।
দিনরাত পরিশ্রম করি।পলিসির পিছনে হাঁটি,হাঁটতে হাঁটতে পায়ে ‘কড়া’ পড়ে গেল।সেই কড়া অপারেশন করাই!
আবার হাঁটি…আবার।
কিচ্ছু করার নাই পায়ের উপরেই যে রুজী আমার।
অবস্থা এমন হয়েছে কিছু আত্মীয় আড়ালে আবডালে আর বন্ধুরা প্রকাশ্যে বীমার দালাল বলে বিদ্রুপ করতে লাগল।
এমনও পরিস্থিতিতে পড়েছি দীর্ঘ দিনের পরিচিত বন্ধু,ওর অফিসে গেছি-এক কাপ চা ও খেতে বলেনি!আমাকে দেখে মিটিং আছে বলে ফাঁকি দিয়ে চলে গেছে।
___________________________
সবাই ছেড়ে গেলেও আমার লাবনী,
আমার অমর সঙ্গী আমায় ছেড়ে যায়নি।
আমার হাতে এখন বেশ টাকা।
স্ত্রী লাবনীকে নিয়ে শপিংয়ে যাই,
এটা সেটা কিনি সবই সংসারের ব্যবহার্য জিনিস।আমার অপারেশনের সময় লাবনী তার সোনার চেইন বিক্রি করেছিল-একদিন ঠিক তেমনই একটা চেইন ওকে কিনে এনে দেই!
লাবনী বিস্ময়াভিভূত!আমি তৃপ্ত নয়নে ওকে দেখি…ও আমার অমর সঙ্গী।
১৯৯৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমাদের ৬ষ্ঠ বিবাহ বার্ষিকীর দিনে ওর জন্য একটা চমৎকার মিরপুরের সবুজ বেনারশী শাড়ি কিনে আনি!
-বউরে এটা পর!আমি তোরে দেখি।
আর চোখ বন্ধ কর তোর জন্য আরো সারপ্রাইজ আছে।
লাবনী চোখ খুলে দেখে ঢাউস সাইজের একটা ফটো এলবাম বিছানায় পড়ে আছে।এলবামের ফ্রন্ট কভারের নিচে একটা চাবি…চাবি ঘুরিয়ে দিয়ে এলবাম দেখতে বললাম ওকে।
আমাদের বিয়ের ছবি প্রিন্ট করে এনেছি অবশেষে!অনেকদিন ফিল্ম ঘরে পড়ে থাকায় ছবির রঙ চটে গেছে……কেমন ঘোলাটে ঘোলাটে হয়ে গেছে।
লাবনী ছবি দেখে আর কাঁদে!
ছবিগুলো এমন ঝাপসা দেখাচ্ছে কেন?
নাকি ওর চোখই ঝাপসা হয়ে আছে?
লাবনী আর আমি দু’জন গলাগলি করে ছবির এলবাম দেখছি!এলবামের পিয়ানো মিউজিক টুংটাং করে বেজেই চলেছে…’চিরদিনই তুমি যে আমার…সুখে দুঃখে আমি তোমারি…আমরা অমর…সঙ্গী……’!
টপটপ করে এলবামের উপর দু’ফোটা চোখের জল গড়িয়ে পড়ল।এ জল আমার না লাবনীর তা বুঝা গেলনা!
শেষ
#সাইফুল আলম