#পর্বসংখ্যা_১৭.
#ফাবিয়াহ্_মমো.
মেহনূরের মাথায় জট পাকিয়ে আপনমনে চললো মাহতিম। মাথার মধ্যে একটাই চিন্তা, একটাই পরিকল্পনা, মেহনূরকে এবার কঠিনভাবে জব্দ করে ছাড়বে। মেহনূর পিটপিট করে তাকিয়ে রইলো, কিন্তু ওর মাথার মধ্যে কিছুই ঢুকলো না। মাহতিম আর পিছু তাকিয়ে দেখার ইচ্ছা পোষণ করলো না।সোজা পা চালিয়ে বাড়িতে ঢুকে হান্নান শেখের রুমে আসলো। রুমের ভেতর পা রাখতেই চরম আশ্চর্য হয়ে কপাল কুঁচকে ফেললো। ভেতরে সৌভিক-নীতিরা কেমন উৎসুক দৃষ্টিতে বসে আছে। হান্নান শেখের সাথে কি নিয়ে যেনো আলাপ করছে। মাহতিমকে ঢুকতে দেখেই হান্নান শেখ একপ্রস্থ হাসি দিলেন। ইশারায় কাছে ডেকে বাকিদের সাথে বসতে বললেন। মাহতিম ওদের ভাব-গতি দেখে কিছুই বুঝতে পারছিলোনা, চুপচাপ ধীরগতিতে পা চালিয়ে বেতের মোড়া টেনে বসলো। হান্নান শেখ মাহতিমের দিকে সরল দৃষ্টিতে তাকালেন। হালকা কেশে বললেন,
– নানু, তোমার ভাইবোন আর বন্ধুগুলো বাইরে ঘুরাঘুরি করতে চাচ্ছে বুঝলে? এখন তারা আমার কাছে অনুমতি হিসেবে আমার নাতনীগুলাকে সঙ্গে নিতে চাইছে। কিন্তু নানুভাই, আমি আমার নাতনীগুলোকে বাড়ির বাইরে কখনো দূরে পাঠাইনি। এখন তুমি বলো নানুভাই, আমার এই মূহুর্তে কি করা উচিত? তুমি তো ওদের চেয়ে বড়, ওদের চেয়ে ভালো বুঝো। ওদের দিকটার পাশাপাশি আমার দিকটাও একটু চিন্তাভাবনা করে বলো।
মাহতিম এতোক্ষনে পুরো ব্যাপারটা বুঝতে পারলো। খাটাশ-খবিশ-বজ্জাতগুলা ইচ্ছে করে ঘুরার প্ল্যান বানিয়েছে। ওদের মূল টার্গেট যে কি, সেটা মাহতিম ভালো করে বুঝে গেছে। কিন্তু হান্নান শেখের কথাটা যখন খেয়াল করলো, তখন একটা জিনিস বুঝতে পারলো, এ বাড়ির মেয়েগুলো এখন পযর্ন্ত বাইরের পরিবেশ দেখেনি। সুন্দর-সুন্দর প্রাকৃতিক জায়গাগুলো ওদের দেখার সৌভাগ্য হয়নি। যদি এই উছিলায় ওরা চারবোন একটু ঘুরেও আসে, তাতে কোনো আপত্তি নেই। মাহতিম ওর ভাই এবং বন্ধুগুলোর চরিত্র জানে, ওরা কখনো দূর্ঘটনা ঘটানোর মতো ব্যক্তি না, তাই নিশ্চিন্তে হান্নান শেখের জন্য মাহতিম প্রস্তাব রাখলো,
– দেখুন নানা, আমি আসলে ঘুরাঘুরির ব্যাপারটা মাত্র জানতে পারলাম। ওরা আমাকে এ বিষয়ে আগে থেকে কিছুই জানায়নি। কিন্তু এখন যেহেতু সব পরিকল্পনা হয়েই গেছে, তাই একটাই অনুরোধ করবো শানাজরাও আমাদের সঙ্গে আসুক। আমি ওদের নিরাপত্তার জন্য সম্পূর্ণ দায়ভার নিচ্ছি। আমাদের সঙ্গে এলে ওদের কোনো ধরনের সমস্যা হবেনা এটুকু নিশ্চয়তা দিচ্ছি। এখন বাকিটা আপনার উপর ছেড়ে দিলাম, আপনি যে সিদ্ধান্ত নিবেন আমি সেটা মানতে বাধ্য হবো।
হান্নান শেখ প্রস্তাবটা শুনে কিছুক্ষণ মৌন অবস্থা পালন করলেন। সবকিছু চিন্তা ভাবনা করে শেষে মাহতিমের উদ্দেশ্যে বললেন,
– তোমরা কি দূরে কোথাও যাবে? নাকি কাছাকাছি এলাকা?
এবার মাহতিম উত্তরের জন্য সৌভিকদের দিকে তাকালো। সৌভিক মিনমিন কন্ঠে হাসি দিয়ে বললো,
– মানে একটু দূরে যেতে চাচ্ছিলাম আরকি। গুগলে দেখলাম গ্রামের বাইরে একটা সুন্দর রের্সোট আছে। রের্সোটাও মারাত্মক সুন্দর, নতুন সম্ভবত ওপেন করেছে। আমরা চাচ্ছি সবাই সেখানে তিনদিনের জন্য ট্যূর হিসেবে যাই। আমরাতো সাজেক, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ট্যূর দিয়েছি, তাই একটু গ্রামাঞ্চল জায়গায় ট্যূর দিতে চাচ্ছি।
হান্নান শেখ এ কথা শুনে আবারও নিরব হয়ে গেলেন। নাতনীদের কখনো ত্রিসীমানার বাইরে যেতে দেননি, অথচ আজ যাওয়ার জন্য অনুমতি চাচ্ছে। সুরাইয়ার মতো উড়নচণ্ডী মেয়েকে ওরা সামলাতে পারবে কিনা, এটা নিয়েও চিন্তা করা লাগছে। হান্নান শেখকে চিন্তিত দেখে মাহতিম নিরস্ত করার জন্য বললো,
– আপনি যদি সিদ্ধান্ত নিতে সমস্যায় ভুগেন, তাহলে আপনার নাতনীদের ডেকে জিজ্ঞাসা করতে পারেন। ওরা যদি যেতে চায়, তাহলে আপনি কোনো আপত্তি করবেন না। আর যদি না চায়, তাহলে আর কথা বাড়াবো না।
হান্নান শেখ কথাটা শুনেই শানাজদের ডাকলেন। চারবোন যখন একত্রে হাজির হলো, তখন পুরো ঘটনা বলে তাদের মতামত জানতে চাইলেন। মেহনূর বাদে সবাই তখন একলাফে রাজি হয়ে গেলো। শুধু মেহনূর চুপ করে মাথা নিচু করে ছিলো। হান্নান শেখ আর কথা বাড়ালেন না, ওদের সাথে যাওয়ার জন্য অনুমতি দিয়ে দিলেন। হান্নান শেখ কোনো একটা কাজে রুমের বাইরে চলে গেলে সবাই হৈ-হুল্লোড় করে ফূর্তি সুরে চিল্লাতে থাকলো। সবাই যখন খুশীর আমোদে টইটুম্বুর, তখন মেহনূর শুধু আড়চোখে মাহতিমের দিকে তাকাচ্ছিলো। মাহতিম ওই সময় রের্সোট বুকের জন্য ওনারের নাম্বারে কথা বলছিলো। চারদিনের সময় ধরিয়ে লোকটা কেমন ঢপ মারলো? ইচ্ছে করে মেহনূরকে জ্বালানোর জন্যই ঘুরার প্ল্যান বানালো। এদিকে মনে-মনে সুরাইয়া এতো খুশি যে, ও আর দেরি না করে কাপড় গুছাতে চলে গেলো। মাহতিম রিজার্ভেশান নিয়ে আলোচনা শেষ করে সবার উদ্দেশ্যে বললো,
– সবাই একটু শোনো, আমরা ভোর পাচঁটায় রওনা দিবো। সবাই একটু তাড়াতাড়ি করে গোছগাছ শেষ করো। সঙ্গে খাবার পানি এবং কিছু শুকনো খাবার রাখতে পারো। কারণ আমাদের ট্রাভেল করতে চার-পাঁচ ঘন্টা সময় লাগবে। আর রাস্তা যদি বেশি খারাপ হয় তাহলে ড্রাইভিং করতেও প্রচুর টাইম যাবে। এছাড়া থাকা-খাওয়ার জন্য সব ওখানেই বন্দোবস্ত করা আছে, তোমরা চাইলে কাপড়-চোপড় বেশি নিতে পারো। কারো কোনো কোয়েশ্চ্যান আছে এ ব্যাপারে?
কথাটা শুনে সাথে-সাথে শানাজ প্রশ্ন করলো,
– ওখানে গোসলের জন্য কি ভালো ব্যবস্থা আছে?
মাহতিম চিন্তিত মুখে মোবাইলটা নিয়ে আরো একবার ডিটেইলস চেক দিলো। সেখানকার সব ডিটেলস দেখে বলো,
– সব আছে। ওখানে একটা গ্রাম্য স্টাইলের পরিস্কার পুকুর আছে। একটা সুইমিংপুলও এরিয়ার ভেতর পাবে, ইভেন আমরা যেখানে যাচ্ছি সেখান থেকে পাঁচ মিনিটের দূরত্বে যমুনা নদী। সব সিস্টেমই দেখি ফুলপ্রুফ করা, আই থিংক মেয়েদের জন্য কোনো প্রবলম হবেনা। আর কোনো প্রশ্ন?
সবাই একসঙ্গে মাথা নাড়িয়ে না বুঝালো। মাহতিম সকলের দিকে হাসি দিয়ে ট্যূরের জন্য প্রস্তুত হতে বললো। সবাই নিজ-নিজ রুমে গিয়ে আলমারি খুলে পছন্দসই পোশাক-আশাক বের করলো। সুজলা, মাহমুদা এমন সিদ্ধান্ত শুনে প্রথমে ভড়কে গেলেও শেষে মেয়েদের খুশি বিবেচনা করে আনন্দমেলায় শামিল হলেন। শেফালী কিছুক্ষণ অমত ভাব দেখিয়ে নিরাপত্তার কথা বললেন, কিন্তু পরক্ষণে নিজেই আবার মেয়ের ব্যাগ গুছাতে ব্যস্ত হলেন। রাতের খাবার খেয়ে সবাই যখন ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলো, তখন হঠাৎ মাহতিমের রুমে হান্নান শেখ আসলেন। মাহতিম বালিশ ঠিক করা বাদ দিয়ে হান্নান শেখকে ভেতরে আসতে বললো। হান্নান শেখ সুক্ষ্ম চিন্তার রেশ ফুটিয়ে মাহতিমের প্রশস্ত কাধে হাত রেখে বললেন,
– তোমরা তাহলে ভোরের দিকে যাচ্ছো তাইনা?
মাহতিম ‘ হ্যাঁ ‘ সুচকে মাথা দুলিয়ে বললো,
– জ্বী নানা। পাঁচটায় বের হলে নয়টা বা সাড়ে নয়টার দিকে পৌঁছে যাবো।
হান্নান ব্যকুল চিন্তায় দৃষ্টি নত করলেন। মাহতিম উনার মনের অবস্থা বুঝতে পারলো। বুড়ো মানুষটা এতোদিন যাবৎ নাতনীদের সাথেই কাটিয়েছেন। ঘুম থেকে উঠেই নাতনীদের হাসিমাখা মুখ দেখেছেন, আবার রাতে শোয়ার আগেও একবার করে দেখে আসেন। সেই মানুষটা যখন তিনটা দিনের জন্য কোমল চারটে মুখের দেখা পাবেনা, সেটা নিয়েই বুকটা কেমন হু হু করে উঠে। মাহতিম হান্নান শেখের মলিন মুখটা দেখে বললো,
– আপনি যদি চান, তাহলে আমি আপনাকে সঙ্গে নিতে পারি নানা। আমাদের কিন্তু এক্সট্রা রুম আছে। আর যদি রুম শট পরে, তাতেও সমস্যা নেই। আপনি আমার রুমেই নাহয় থাকলেন। কি বলেন? আমাদের সাথে যাবেন?
মাহতিমের ইচ্ছাকৃত প্রস্তাব শুনে খুশী মৃদ্যু হাসলেন তিনি। কিন্তু খুশীর প্রকাশ তেমন করলেন না। মাহতিমের কাধে চাপড় মেরে বললেন,
– আমার আর বয়স কই? একসময় প্রচুর ঘুরাঘুরি করেছি। আমার আব্বা একজন মাওলানা মানুষ ছিলো। হায়রে কি বকা! আমি তবুও দোস্তদের সাথে ঘুরাঘুরি করতে যেতাম। তারপর তোমার নানীর সাথে বিয়ে হলো। বিয়ের একবছরের মাথায় তোমার বড় মামা আসলো। এরপর আর ঘুরাঘুরির শখ ছিলোনা। কিন্তু শেষ বয়সে একটা ইচ্ছা ছিলো, আমার নাতনীগুলোকে চিনামাটির পাহাড় দেখিয়ে আনবো। ওখানে তো যাওয়ার শরীর নেই, কিন্তু কালকের উছিলায় ওরা একটু বাইরের দুনিয়া দেখে আসুক। তোমার জায়গায় অন্য কোনো ছেলে হলে আমি জীবনেও রাজি হতাম না নানুভাই। কিন্তু আমি আমার মারজার ছেলেকে চিনি, এজন্য নাতনীগুলার জন্য ভরসা করতে পারি। তা নানু, তুমি নিজের দিকেও খেয়াল রেখো। কোনো সমস্যা হলে খবর দিও কেমন?
মাহতিম সরল ভঙ্গিতে হাসি দিয়ে হান্নান শেখের হাতটা ধরলো। দুহাতের মধ্যে বৃদ্ধের চামড়া কুচঁকানো হাতটা ধরে সম্মতি বুঝিয়ে দিলো। হান্নান শেখ আর বাক্য খরচ করলেন না, চুপচাপ নিজের মনে রুমে চলে গেলেন। এদিকে মাহতিম যখন ঘুমিয়ে পরলো, অন্যদিকে সকলের অগোচরে গোল-বৈঠক বসলো। এবারের বৈঠকটা মাহদি-সহ করা হচ্ছে, তাও আবার ফারিনের রুমে। ফারিনের রুমটা এখন বদল হয়ে সাবার রুমে এসেছে। আজ সাবা শানাজের সাথে ঘুমাবে, তাই ফারিনও খুব চালাকি করে সবার শোওয়ার পরই বৈঠক ডেকেছে। একসঙ্গে নয় মাথা একত্র হয়ে বসেছে, রুমের লাইট নিভিয়ে বৈঠকের মাঝখানে ফোনের ফ্ল্যাশ জ্বালানো হয়েছে। প্রীতি সবার প্রথম ফিসফিসিয়ে বললো,
– কাল যেভাবেই হোক, মেহনূরকে ভাইয়ার জিপেই বসাতে হবে। ও যেনো ভুলেও আমাদের জিপে না বসে।
প্রীতির কথায় সায় দিয়ে সৌভিক বললো,
– কথা তো ঠিক বলছিস। কিন্তু বাকিদের কিভাবে হ্যান্ডেল করি? সুরাইয়া তো পারলে মাহতিমের কোলে চড়ে বসবো।
সুরাইয়ার টপিক আসতেই সবাই চিন্তায় পরে গেলো। মেহনূরকে আবোলতাবোল বুঝিয়ে জিপে বসালে, সেখানে যদি সুরাইয়া এসে পল্টি খায়? কেউ কোনো সূত্র ধরে আগাতে পারলো না। কিন্তু মাহদি ঠিকই একটা সুরাহা খুজেঁ সবাইকে চমকে দিয়ে বললো,
– আমার কাছে একটা প্ল্যান আছে শুনবা?
কেউ ওর কথায় গুরুত্ব দিলোনা। সবাই আগের মতো চিন্তায় ডুবে গেলো। কিন্তু নীতি তখন কি মনে করে মাহদিকে বলার সুযোগ দিলো, মাহদি তখন খুশি হয়ে সবার দিকে তাকিয়ে বললো,
– আমি এদিকে মেহনূর আপুকে ইচ্ছামতো দেরি করিয়ে দিবো। আর ওদিকে তোমরা মাইক্রোতে সব সিট দখল করে বসে পরবা। যখন আপু এসে দেখবে গাড়িতে আর জায়গা নেই, তখন বাধ্য হয়েই ভাইয়ার জিপে বসে পরবে।
কথা শেষ হতেই মাথার পেছনে দারুণ থাবড়া গেলো মাহদি। ব্যথায় আর্তনাদ করতেই তৌফ ওর মুখ চেপে শব্দ আঁটকালো। অন্যদিকে সামিক ওর পানে তাকিয়ে বললো,
– আরে বলদের বস্তা, প্রবলেম তো সিট নিয়ে না। প্রবলেম তো সুরাইয়া নিয়ে।
মাহদি ঝটকা মেরে মুখের উপর থেকে হাত সরিয়ে দিলো। মাথার পেছনে ব্যথাতুর ভঙ্গিতে হাত বুলাতেই বললো,
– আমি কি সেটা জানিনা? তোমরা তো আমার কথায় পাত্তাই দিচ্ছো না। আমি কি বলছি সেটাতো একবার ভালো করে শুনবা? গাড়িতে যে দশটা সিট আছে সেটা কি ভুলে গেছো। আর ঠাসাঠাসি করে না বসলে মেহনূর আপু কি ভাইয়ার জিপে উঠতে যাবে?
তৌফ সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললো,
– তো ঠাসাঠাসি করে কিভাবে বসবো? আমি তো মোটা না।
মাহদি এবার মুখ ভেঙচি করে বললো,
– মাথায় নাই ঘিলু, আবার আসছে প্ল্যান বানাতে। আমাদের যেই মালপত্র পেছনের ডেকিতে তুলবে, সেখানে পানি ঢেলে দিও। তাহলে ওই মালপত্র সব লাস্টের সিটে বোঝাই করতে পারবে। আর সিট কমে গেলে বসা নিয়েও ঠাসাঠাসি হবে। প্লাস, মেহনূর আপুও বাধ্য হয়ে ভাইয়ার জিপে চড়বে। সুরাইয়া আপু যেহেতু বেশি লাফাচ্ছে, তাকে নীতি আপু আর ফারিন আপুর মাঝখানে কয়েদি বানিয়ে বসাবে। ঘটনা শেষ।
সবাই বিষ্ময়ে হা করে নিজেদের দিকে তাকালো লাগলো। মাহদির মতো পুচকে ছেলে দূর্দান্ত একটা বুদ্ধি দিলো। সবাই খুশীতে আটখানা হয়ে পিঠ চাপড়াতে লাগলো ওর। মাহদি যেনো ফুলে-ফুলে আরো এটিটিউট দেখাতে শার্টের কলারটা টেনে নিলো। গোল-বৈঠক শেষ হতেই সবাই ঘুমানোর জন্য চলে গেলো।
আকাশ এখনো কালো কুচকুচে হয়ে আছে। রাত্রিকালীন শেষ মূহুর্ত চলছে। একটু পরে আযান দিলেই ভোরের আলো ফুটতে শুরু করবে। শানাজ সবার আগে উঠে তিন বোনকে ডেকে তুললো। সুজলা, মাহমুদা, শেফালী সবার জন্য শুকনো খাবারের ব্যবস্থা গেলো। ঘড়িতে বাজে সাড়ে চারটা। শানাজ হাত-মুখ ধুয়ে এসে দাদাকে একবার দেখে এলো। হান্নান শেখ ঘুমাচ্ছেন বলে উনাকে আর ডাকলো না। শানাজ আজ সবুজ রঙের শাড়ি বের করেছে, আচঁলটা কালো, তবে ব্লাউজটা লাল রঙের। সাবাও নিজের জন্য গাঢ় নীলের তাঁতের শাড়ি বের করেছে, ব্লাউজ যে কোনটা পরবে সেটার জন্য সাদা ও নীল রঙ নিয়ে চিন্তায় বসে আছে। সুরাইয়ার জন্য শেফালী এসে লাল রঙের শাড়ি রেখে গেছে। শাড়ির অবস্থা দেখে সাবা ও শানাজ আড়ালে কিছুক্ষণ হাসাহাসি করে নিজেদের কাজে মনোযোগ দিলো। সবার চেয়ে দেরিতে উঠেছে মেহনূর, এদিকে হাতে আছে পচিঁশ মিনিটের মতো সময়। হাতমুখ ধুতে তাড়াতাড়ি নিচে নেমে কলপাড়ের দিকে দৌড় লাগালো। হাপাঁতে-হাপাঁতে কলপাড়ের দরজা টেনে ভেতরে ঢুকতেই থম মেরে দাড়িয়ে গেলো। মাহতিম বালতি থেকে মগে নিয়ে মুখ ধুচ্ছে। মাহতিম দরজার দিকে একদম নজর না দিয়ে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়েই বললো,
– কলপাড় বা বাথরুমে আসার আগে যে নক করে ঢুকতে হয়, সেটা কি জানো না? দরজা তো চাপানো ছিলো, তবুও এই সেন্সটুকু নেই?
মেহনূর তখন রাগ দেখিয়ে বললো,
– আপনি কিন্তু সেদিন রুমে —
কথা শেষ করতে দিলো না ওর। মাহতিম ওকে থামিয়ে দিয়ে ভেজা হাতে চুলের মধ্যে ব্রাশ করতেই বললো,
– তোমার রুমে কোনো দরজা চাপানো ছিলো না। আর যদি দরজা চাপানো থাকতো, তাহলে আমি নক করেই ঢুকতাম। নাহয় ঢুকতামই না। অযথা কারনে এখন গলা চড়াতে আসবেনা। রেডি হও, হাতে বেশি সময় নেই।
মাহতিম ওকে ইশারা দিয়ে রাস্তা থেকে সরতে বললো। মেহনূর ওর ইশারা দেখে মাথা নিচু করে সরে দাড়ালো। মাহতিম ওর পাশ দিয়ে চলে গেলে কলপাড়ে ঢুকে গেলো মেহনূর। চাপকলে চাপ দিতেই দেখলো আবারও কলটা ঘ্যাড়ঘ্যাড় শব্দ করছে, অথচ কোনো পানি দিচ্ছেনা। আরো কয়েকবার জোরে চাপ দিলো ঠিকই, পানি আর পরলো না। হঠাৎ পেছন থেকে কেউ বলে উঠলো,
– বালতি ভরেই রেখেছি। চোখ যদি আল্লাহ দিয়ে থাকেন, তাহলে বালতিটা দেখে সেখান থেকে পানি নাও। পানিটা পুকুরের।
মেহনূর আশ্চর্য হয়ে সাথে-সাথে পিছু তাকালো। কিন্তু মাহতিমের মুখ আর দেখতে পেলো না। আশ্চর্য হয়ে বালতির দিকে মুখ ফিরিয়ে মগের জন্য ধীরগতিতে হাত বাড়ালো। সকালবেলা কল একটু সমস্যা করে, প্রথম-প্রথম একটু চাপাচাপি করা লাগে। কিন্তু মাহতিম কি করে জানলো সবার শেষে মেহনূর কলপাড়ে আসবে? আর পানি পাবেনা জন্যই কি পুকুর থেকে বালতি ভরে রেখেছে? মেহনূর ছোট্ট করে নিশ্বাস ছাড়লো। এই লোকটা যে কেমন ধা-ন্দাবাজ সেটাই ভেবে আপনমনে হাসলো।
সবাই রেডি হয়ে ব্যাগপত্র নিয়ে উঠানে এসে হাজির। সামিক, সৌভিক গাড়ির লাস্ট সিটে ব্যাগ ঠেসে রাখছে। গাড়ির ডেকিতে খুব আগেই তিন লিটার পানি ঢালা হয়েছে, ভালোমতো ভিজিয়ে মাহতিমের কাছে কৈফিয়ত দিয়েছে, বৃষ্টির পানিতে ডেকি খুব বাজেভাবে ভিজে গেছে। সেখানে কোনো ব্যাগ-জিনিস রাখা যাবেনা। মাহতিম এ ব্যাপারে সন্দেহ করলেও সেটা নিয়ে মাথা ঘামায়না। এদিকে সুরাইয়া, সাবা, শানাজ উঠানে এসে উপস্থিত হলে তৌফ দ্রুত সৌভিকের বুকে কনুই মারে। সৌভিক কপাল কুঁচকে ওর দিকে তাকালে তৌফ নিচু স্বরে বলে,
– দোস্ত, সুরাইয়ার অবস্থা দেখ। মনেহয় বিয়ের শাড়ি পরে আসছে। ভাইরে ভাই আমারে বুঝা তুই, ট্যূরে কেউ এ গেটাপে বের হয়?
সৌভিক একপলক সুরাইয়ার দিকে তাকালো। কটকটে লাল রঙের শাড়ি পরেছে সুরাইয়া, যার পাড়টা সোনালী। মুখে বেইজ মেকআপ জাতীয় কিছু করেছে, যার জন্য ব্রাইডাল লুক বুঝা যাচ্ছে। সৌভিক এটুকু বুঝতে পারলো সে যদি আর কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থাকে তাহলে অট্টহাসিতে মারা যাবে। তাড়াতাড়ি সেখান থেকে চোখ সরিয়ে মাথা নিচু করে বললো,
– বন্ধু, মাহতিম যদি এইটারে এখন ইজ্জত দেয় তাহলে কেমন লাগবো ভাব তো?
তৌফ নিজের জম্পেশ উত্তরটা দিবে ওমনেই দরজা দিয়ে দ্রুতগতিতে বের হলো মাহতিম। পকেট থেকে জিপের চাবি বের করতেই সুরাইয়ার অবস্থা দেখে পা থামিয়ে দাড়ালো। সুরাইয়ার দিকে যখন আপাদমস্তক তাকাচ্ছিলো, তখন সুরাইয়া সেটা আড়চোখে দেখে মনে-মনে খুশিতে গদগদ হয়ে যাচ্ছিলো। এদিকে মাহতিম পাল্টা কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে চুপচাপ জিপে উঠে বসলো। কি-সিস্টেমে চাবি ঢুকাতেই শেফালী এসে হৈচৈ সুরে বললো,
– আচ্ছা, এত্তাগুলা মানুষ যাবো। এত্তাগুলা জিনিস যাবো, গাড়ি কেন একটা যাবো? এক গাড়িতে ঠাসাঠাসি করিয়া বসবার মানে আছে? ও সুরাইয়া, তুই গাড়ি থিন নামতো। জিপগাড়িতে উঠিয়া বস।
এ কথা শুনে মাহতিম চাবি মুচড়ানো থামিয়ে শেফালীর দিকে ভ্রুঁ কুঁচকে তাকালো। শেফালীর দৃষ্টি আর্কষণ করে বললো,
– জিপ কি আপনি চালাবেন মেজো মামী? কাকে অর্ডার দিচ্ছেন? আমিতো আমার জিপে আর কাউকে বসাবো না।
মাহতিমের অবস্থা দেখে নীতিরাও কিছু বললো না। সৌভিক শুধু ঠোঁটের উপর তর্জনী দিয়ে চুপ থাকার ইশারা করলো। পেছন থেকে সুজলা, মাহমুদা, মারজা ও হান্নান শেখ এসে জড়ো হয়েছে সেটার জন্য বাধা দিলো। শেফালী প্রচণ্ড ক্ষেপে গিয়ে বললো,
– দেহো, মাহতিম! তুমি কলাম ভালা কাজ করতেছো না। গাড়িতে ঠাসাঠাসি কইরা বসলে কেউ কি শান্তিমতো যাবার পাবো? তোমার জিপ তো পুরাই খালি। সুরাইয়ারে এট্টু বসবার জায়গা দিলে তো ক্ষতি হবো না।
মাহতিম এবার ভ্রু উঁচিয়ে ড্রাইভের হুইলের উপর দুহাত রেখে তাকালো। রাগত স্বরে সংযত ভঙ্গিতে বললো,
– আপনার মেয়ে কি খুবই ভালো মনে করেন? একটার-পর-একটা রঙ তামাশা যে করছে, সেটা কি ভুলে গেছেন? সুরাইয়া যদি আমার বোন হতো থাপড়িয়ে ওর সাহস বের করে দিতাম। আমার একটা বোন আজ পযর্ন্ত কুপথে যায়নি। আমাকে না-জানিয়ে, পরিবারকে না-বলে কোত্থাও বের হয়নি। সেই মেয়েকে আমার পাশে কেনো, আমার আশেপাশেও রাখবো না। আপনার যদি একান্ত সমস্যা হয়, ওকে ওই গাড়ি থেকে নামিয়ে নিন।
মাহতিমের কথা শুনে মারজা তেড়ে আসলেন। ওর পাশে দাড়িয়ে কপাল কুঁচকে শাসন ভঙ্গিতে বললেন,
– এগুলো কেমন আচরণ? তোকে বারবার কেনো বলতে হয় মেজো ভাবীর সাথে ভালোভাবে কথা বলবি? তুই বাবামশাইয়ের সামনে এরকম আচরণ করছিস?
মাহতিম মায়ের দিকে একপলক তাকিয়ে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে শেফালীর দিকে তাকালো। শেফালীও দারুণ ক্ষেপেছে দেখে সেখান থেকে দৃষ্টি সরিয়ে মায়ের উদ্দেশ্যে বললো,
– তোমার বাবামশাইয়ের কোনো সমস্যা হলে এতোক্ষনে ঠিকই আওয়াজ তুলতো, উনি যেহেতু চুপ করে আছেন তুমি আর কথা বলো না মা। আমি ওই সুরাইয়াকে আমার জিপে তুলবো না।
মারজা কঠিন কিছু বলতে যেয়ে থেমে গেলেন। মাথা ঘুরিয়ে সুজলা ও মাহমুদার দিকে তাকিয়ে নিজের অসহায়ত্ব বুঝালেন। সুজলা চোখ দিয়ে ইশারা করে সেখান থেকে সরে আসতে বললো। আর কোনো কথা না বাড়িয়ে মারজা যখন চলে এলো, তখন মাহদির হাত ধরে মেহনূর বের হলো। সবার শেষে, সবার দেরিতে মেহনূর এসে উপস্থিত হলো। এবার শেফালী দারুণ একটা কোপ বুঝে ঘোড়া এগিয়ে বললেন,
– তা বাবা, এখন কি করবা শুনি? মেহনূর যে এখন বসবার জায়গা পাবো না। ওর জন্যে কি জিপে ব্যবস্থা করবা?
মাহতিম শক্তমুখে তাকিয়ে রইলো। অন্যদিকে মেহনূর অবুঝের মতো ঘটনা বুঝার চেষ্টা করতে লাগলো। মাহদি এখন কি করবে সেটা বুঝতে না পেরে মেহনূরের হাত ছেড়ে মাইক্রোর দিকে দৌড় লাগালো। সামিক ওকে আসতে দেখে হাত বাড়িয়ে নিজের কোলে বসার জন্য ইঙ্গিত দিলো। মাহদি ছুটে এসে গাড়িতে চড়ে সামিকের কোলে উঠে বসলো। কিন্তু মেহনূর কি করবে বুঝে উঠতে পারছেনা। গাড়িতে যেহেতু জায়গা নেই, তাই সে ঠিক করলো ওদের সঙ্গে যাবেনা। শেফালীর চটান-চটান কথাও যেনো বন্ধ হতে চাইছেনা। প্রীতি দ্রুত একটা সিদ্ধান্তে আসার জন্য সিয়ামের ফোনে টেক্সট পাঠালো। সৌভিক ড্রাইভিং সিটে বসা ছিলো, সিয়াম তার পাশেই বসা। টেক্সটের টিউন বেজে উঠতেই সিয়াম পকেট থেকে ফোন নিয়ে দেখলো প্রীতির মেসেজ। প্রীতি সেখানে লিখেছে, ‘ Bro do something. This Shefali is just irritating. Please try to convince Mahtim vaiya. ‘ প্রীতির মেসেজ দেখে সিয়াম সেটা সৌভিককেও দেখালো। সৌভিক চিন্তিত মুখে সিয়ামের দিকে তাকিয়ে রইলো। হান্নান শেখ বলে দিলেন, যদি একজন নাতনী না যেতে পারে, তাহলে চারজনই বাদ যাবে। কারোর যাওয়ার দরকার নেই। সুজলাও বলে দিলেন, মেয়েরা বাড়িতে থাকুক, বাকিরা ঘুরে আসুক। ট্যূরের রাস্তা যখন সবাই বন্ধ দেখলো, তখনই মাহতিম থমথমে অবস্থায় নিরবতার চ্ছিন্ন করে বললো,
– মেজো মামী, ছোটবেলায় টস খেলছেন না? সুরাইয়া এবং মেহনূর এ দুজনের নামেই দুটো চিরকুট লিখবো, আপনাকে যেকোনো একটা চিরকুট শুধুমাত্র একবার উঠাতে বলবো। চিরকুটে যেই নাম আসবে সেই ব্যক্তি আমার জিপে বসবে। আর যে বাদ যাবে সে নীতি ও ফারিনের সাথে বসবে। ওই মাইক্রোতে একটা সিট খালি, এই জিপেও একটা সিট খালি। বাকিটা বুঝছেন তো?
চিরকুটের কথা শুনে সবাই ‘ আল্লাহ্ আল্লাহ্ ‘ করতে লাগলো। চিরকুটের নামটা যেনো মেহনূরই হয়, আর মেহনূরই যেনো মাহতিমের পাশে বসে আসতে পারে। সবাই একমনে জিকিরের তুফান লাগিয়ে দিলো, অন্যদিকে পকেট থেকে ছোট কাগজ বের করে দুটুকরো করে নিলো মাহতিম। চিরকুটে নাম বসিয়ে সুন্দর করে ভাঁজ করলো। দুহাতের মুঠোয় একবার ঝাঁকি মেরে শেফালীকে তুলতে বললো। শেফালী অনেক চিন্তা করে দুমিনিট সময় নষ্ট করে একটা চিরকুট বাছাই করলো। সেই বাছাইকৃত চিরকুট খুলেই দেখতে পেলো সেখানে চারটা অক্ষরে ‘ মেহনূর ‘ লিখা। শেফালীর মুখে এক ডলা কালি মাখার মতো কালো হয়ে গেলো, অপরদিকে গাড়ির ভেতরে সবাই চাপা খুশিতে আবেগ আটকে রাখলো। মাইক্রোর দরজা টান দিয়ে আঁটকানো হলো, আর শেফালীর সামনে দিয়েই মাহতিমের পাশে এসে মেহনূর দাড়ালো। জিপে উঠার জন্য কোনো প্যাডেল না থাকায় উঠতে সমস্যা হচ্ছিলো মেহনূরের। সেটা দেখে মাহতিম ওর দিকে হাত বাড়িয়ে দিলে মেহনূর সেটা ধরলো না। মাহমুদাকে ডেকে মায়ের হাত ধরে জিপে উঠে বসলো মেহনূর। সবাইকে বিদায় জানিয়ে মাইক্রোটা আগে ছুটলো, এরপর শান বাজিয়ে ধূলো উড়িয়ে মাহতিমের জিপ চললো। শত গালি, শত ধিক্কার, শত ভৎসনা করে উঠানেই দাড়িয়ে শেফালী। কঠোর চোখে রাগী দৃষ্টিতে ছাড়খার করে গালাগাল করতে লাগলো মেহনূরকে। উনার মেয়ে সুরাইয়ার জন্য গলার কাটা হিসেবে এই মেহনূর যেনো পয়দা হয়েছে। সবাই বাড়ির ভেতরে চলে গেলে মুষ্টিবদ্ধ করে থাকা শেফালী মাটির দিকে তাকালো। মাটিতে দুটো চিরকুট দেখে দুহাতে দুটো উঠিয়ে নিলো। একটা খোলা চিরকুট, অপরটা বন্ধ। শেফালী বন্ধ চিরকুটটা খুলে স্থির হয়ে গেলো। রাগে সমস্ত শরীর দপদপ করে জ্বলে উঠলো। দুটো চিরকুটেই একই অক্ষর, একই বর্ণ, একই শব্দ যেনো লেখা। চারটা গোটা গোটা অক্ষরে ‘ মেহনূর ‘ শব্দ লেখা।
– চলবে
#FABIYAH_MOMO
মন বাড়িয়ে ছুঁই গল্পের লিংক kobitor (all part)
( #নোটবার্তা : এতো বড় পর্বের পরও আমার জন্য আর বড় করা সম্ভব না। ফেসবুক অথোরিটি সেটার জন্য ওয়ার্ণিং দিয়ে থাকেন এবং আপনারাও তখন পড়তে পারবেন না। ভালোবাসা-কৃতজ্ঞতা।)