লেখক:হৃদয় আহমেদ
পর্ব ৩
ধপধপ আওয়াজ করে হাটছিলাম। দোরের সামনে চিকন পিনপিনে সিঁড়িতে পা লেগে উষ্টা খেয়ে পড়ে যাচ্ছিলা। চোখমুখ খিচে বন্ধ করে নিলাম। কেউ সর্বস্ব দিয়ে আঁকড়ে নিলো আমায়। ব্যাথা না লাগায় কৃতজ্ঞতা দৃষ্টিতে তাকালাম তার দিকে। সিয়াম ভাইয়া বাহুডোরে আমি। কালো ঘন পাপড়ি যুক্ত ছোট ছোট চোখদুটি অকপটে আমার দিকেই তাকিয়ে। শুকনো ডোগ গিললাম। প্রথম কোন পরুষের স্পর্শে, কলিজা শুকিয়ে কাঠ! পায়ের তলায় মাটি নেই যেন আমার।
‘ আ’ম সিওর তুই জানিস এখান থেকে পড়ে গেলে কি হতো? ‘
তড়িৎ গতিতে সরে আসতে গিয়ে আবারো পড়ে যাচ্ছিলাম, কোনমতে সামলে শক্ত হয়ে দাড়ালাম আমি। সুট,বুট,টাই,ব্লেজার পড়ে দাড়িয়ে সিয়াম ভাইয়া। কালো ব্লেজার সাদা শার্টে অপুর্ব লাগছে ওনাকে। প্রথম এতটা কাছ থেকে দেখলাম আমি তাকে। বুক ধুকপুক করছে! ওনার বলা কথাগুলো কান অব্ধি পৌছায়নি আমার। আমার দৃষ্টিতে মুগ্ধতা!
‘ কি বললাম শুনেছিস? ‘
চমকে উঠলাম। সকাল থেকে এত কেন দেখছি তাকে আমি? তার দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হওয়ার কি আছে? আমার চেনা আমি এমন পাল্টাচ্ছি কেন? শপথ তো এমন ছিলো না? কেন ওনাতে দুর্বল হয়ে পড়ছি? অন্যদিক ফিরে অস্ফুটস্বরে বললাম,
‘ আমি খেয়াল করিনি। ‘
‘ ইডিয়ট! একটা থ্যাংসও বললো না। ‘
সাথেসাথে রক্ত গরম হয়ে উঠলো আমার। তিক্ষ্ম চোখে তাকালাম। মুখ বাকিয়ে হাসছেন উনি। কর্কষ কন্ঠে বললাম,
‘ কি বললেন আপনি? ‘
‘ ওকে ফাইন, তুই অকৃতজ্ঞ। ‘
হনহন করে চলে গেলো সিয়াম ভাইয়া। অপমানে মুখ থমথমে হয়ে রইলো আমার। আজকাল একটু অপমানই কাটার মতো বিঁধে শরীরে।
চিঠিটার কথা নিচে আসতেই মনে পড়েছিলো। ড্রইংরুমের সোফায় মামাসহ আরও বৃদ্ধ কয়েকজন বসে ছিলো। সবাইকে উপেক্ষা করে ছুটে গেছিলাম চিঠিটা খুজতে। বাইটে গিয়ে রজদ কাকার থেকে জানলাম গাড়িটা নাকি নেই। খুব ভোরে সায়েম বেড়িয়েছে গাড়ি নিয়ে। সে দৌড়াতে গেছে। তখনি মনটা বিষন্নে ভরে উঠলো। আর সেই সময়েই ঘটলো এই অঘটন। ধুরু৷ ভালো লাগে না। জুবুথুবু হয়ে সোফায় বসলাম। ইডিয়ট, অকৃতজ্ঞ শব্দু দুটি জ্বালাচ্ছে খুব। তখন থেকে ভুলতে গিয়েও ভুলতে পারছি না। গেঁথে বসেছে মাথায়।
‘ আজ নাকি তোর রেজাল্ট বেরোবে সিয়া? ‘
একহাতে মগ নিয়ে আসতে আসতে বললেন মামী। আমি একটু হেঁসে উঠে দাড়ালাম। ধোঁয়া ওড়া মগটা আমার হাতে গুজে মামী সোফায় বসে পড়লো। খুব আস্তেধীরে আমিও বসলাম।
‘ তো আজ কলেজে যা। আবার কবে ভর্তি, সেটাও জেনে আয়। ‘
চোখ ছলছল করে উঠলো। বিয়ের পরের দিন সাধারণত বউরা বাড়ি থেকে বেরোতে পারে না। সেখানে আমি কলেজ যেতে পারব? ভাবতেই বুকে দামামার সৃষ্টি হচ্ছিলো। কফির দিকে আর খেয়াল নেই। আমি ভাবছিই।
‘ কফিটা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে তো সিয়া। খেয়ে নে। ‘
মামীর কথায় সজ্ঞানে ফিরলাম। ওষ্ঠদ্বয় প্রসারিত করে হাসলাম আমি। মামীও কিঞ্চিৎ হাসলো। একসাথে বসে কফিটা শেষ করলাম। উপরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিবো,মামী পিছু ডাকলেন,
‘ আনন্দে আবার এখনি রেডি হস না। ব্রেকফাস্ট করে তবেই বাড়ির বাইরে পা রাখবি। বুঝলি? ‘
রিনরিনে কন্ঠে হেঁসে উঠলাম। মাথা দুলিয়ে সম্মতি নিয়ে ছুটে গেলাম রুমে। আমি পড়ার জন্য এটুকু তো করতেই পারি। ঘরটা কালকে যা দেখেছি তার থেকেও সুন্দর। সাদা, সোনালি রঙের দেয়াল। দেয়ালে দেয়ালে বাল্ব লাগানো। আসবাবপত্র গুলো অনেক সুন্দর। বড়বড় ফুলদানি। কিন্তু এত বড় সুবিশাল রুমটায় আমার চোখ যা খুজছে তা তো নেই! একটা পড়ার টেবিল নেই? তাহলে পড়বো কোথায় আমি? বিরক্ত হয়ে বিছানায় বসলাম। শুনেছি সিয়াম ভাইয়া খুব ব্রিলিয়ান্ট! তাহলে তার রুমে একটি টেবিল থাকবে না এটা তো অস্বাভাবিক! মুখে আধার নেমে এলো। বিছানায় বসে পড়তে পারি না আমি।
কিছুক্ষণ ঠায় বসে ছিলাম। একটু হায় হায় না করলে আমার নিজের’ই ভালো লাগবে না। এরপর ফ্রেশ হওয়ার জন্য ওয়াশরুমে চলে গেলাম।
____
রিকশায় বসে উশখুশ করছি। তন্নি,প্রিয়,সামি,তিশা সবাই আসছে। কাল থেকে আজকে একটু বেশিই খুশি অনুভব করছি। তবে বিরক্ত একটু খানি তো আছেই। সামি আসছে! খুব জ্বালাবে ছেলেটা।
রিকশা থেমে গেলো কলেজের সামনে। ভারা মিটিয়ে ডুকে পড়লাম। এত আনন্দ হচ্ছে বলে বোঝাতে পারবো না। সবাই নিশ্চই পশ্চিম দিকটায় আছে। হাঁটতে লাগলাম পশ্চিম দিকে। বিরাট জাম গাছটার নিচে ওরা বসেছে। সকালের তুখোড় রোদে হালকা কুয়াশা শুকিয়ে গেছে। একটু ছায়া প্রয়োজন। রুমাল বিছিয়ে তারা বসে। আমি আসতেই তিশা বলে উঠলো,
‘ ফার্স্টবেঞ্চার হাজির হয়েছে। দেখ,দেখ তোরা। ‘
সকলে হেঁসে তাকালো আমার দিকে। তিশা একটু ফাজিল। কিন্তু ওর মনটা খুব সুন্দর। ওর পদ্ম ফুলের পাপড়ির মতো ঠোঁট দুটি দিয়ে হো হো করে হাসছে। কেউ তার জোক্স পছন্দ করুক বা না করুক, নিজের কথায় সে নিজেই হাসে।
‘ আয় সুন্দরী আমার পাশে বস। ‘ বললো সামি। আমি ইচ্ছে করেই তন্নির পাশে বসলাম। আগে হলে হয়তো বসতাম,কিন্তু এখন বসতে মন চাইছে না। দ্বীধা হচ্ছে। মনে হচ্ছে এখন ওর পাশে বসলে ঘোর পাপ হবে। তাই তন্নির সাথে বসলাম। সামিরের সাথে না বসায় ও ব্যাঙ্গ করে বললো,
‘ সুন্দরীর দেমাগ দেখলে? আমার মতো হ্যান্ডসামকে কেমন অবহেলা করছে। তোরা দেখলি? ‘
সামির অভিমানি স্বরে হাসির রোল পড়ে গেলো। সকলে হাসলাম। হঠাৎ প্রিয়ো বললো,
‘ রেজাল্ট দুপুরে বের হবে। চল গিয়ে প্রিন্সিপাল স্যারের কাছ থেকে শুনে আসি ভর্তি সম্পর্কে। ‘
প্রিয়োর এক কথায় সবাই রাজি। ছেলেটা চুপচাপ, তেমন কথা বলে না। আমরা চেষ্টা করি ওর কথা রাখার। নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতেই পছন্দ করে ও। শুধু নামটা নিয়েই একটু মজা করে সবাই। পরাশোনায় বেশ ভালো। মাঝেমাঝে ইচ্ছে হয় ওর মতো হতে, কিন্তু বাকিগুলোর জন্য আর হয়ে ওঠে না। সবাইতো আর এক হয় না। কেউ কেউ চেয়েও হতে পারে না।
সকলে উঠতেই তন্নি বিরোধিতা করে বলে ওঠে, ‘ ওই রাগচটা লোকটার কাছে যাস না। দেখবি কেমন দেমাগ! তারথেকে আজাদ স্যারের কাছে গেলে হয় না? ‘
তিশা কটাক্ষ করে বললো,
‘ উনি কি আমাদের স্যার? ইন্টারে পড়ায়। ‘
তন্নি একটু লজ্জা পেলো। সে আজাদ স্যারের উপর ক্রাসড। সকলে অফিস রুমে গেলাম। পার্মিশন নিয়ে ভর্তি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতেই প্রিন্সিপাল স্যার গম্ভীর গলায় বলে উঠলেন,
‘ আগে পাশ করো, তারপর তো ভর্তি! ‘
তন্নি এখনি বিরোধিতা করে কিছু বলতে যাচ্ছিলো। হাত ধরে থামিয়ে দিলাম। স্যার দুদীন পর আসতে বললো আমাদের। আমরা সকলে বের হয়ে আসলাম। তন্নির কথা না শোনায় সবাইকে ঝাড়লো ও। কানফাটা গলায় চিৎকার করতে করতে মাথা ঝালাপালা করে দিলো একদম। কলেজ থেকে বেরোতেই অবাক হয়ে গেলাম আমি। একপায়ে গাড়িতে ভর করে সিয়াম ভাইয়া দাড়িয়ে। চোখে রোদচশমা! উনি আমার কলেজ চিনলেন কিভাবে? জানলেন কিভাবে আমি কলেজে এসেছি? আমাকে প্রস্থান হতে দেখেই হিরো স্টাইলে হেঁটে এলেন উনি। বললেন,
‘ চল সিয়া! ‘
‘ ওয়েট! আপনি কে? এটা কে রে সিয়া? ‘
বললো সামি। শ্বাসরুদ্ধ কন্ঠ ওর। সিয়াম ভাইয়া আরেকটু এগোলেন আমার দিকে। সবাই ভুত দেখার মতো তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। সিয়াম ভাইয়া সকলের দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘ তোমাদের দুলাভাই আমি। আরেকদিন দেখা হবে। লেট’স গো সিয়া। ‘
হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো সিয়াম ভাইয়া। সবার চোখ কোটর থেকে বেড়িয়ে আসার উপক্রম। সামির মুখে তৎক্ষনাৎ আধার নেমে আসে। বুক মুচরে ওঠে। সূক্ষ্ম ভেজা দৃষ্টিতে তাকায় আমার দিকে। ওর বুকে যে আম্ফান বইছে বোঝলাম আমি। সিয়াম ভাইয়া পাশে বসালেন আমায়। গাড়ি চলতে আরম্ভ করে।
#চলবে…
আমার সংসার গল্পের লিংক (all part) kobitor.com
এখনো ব্যাথা হাতে। ভুল ত্রুটি সুন্দর চোখে দেখবেন।