#ফাবিয়াহ্_মমো .
বন্দুকটার দিকে আশ্চর্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেহনূর। চোখের সামনে এমন অস্ত্র দেখে হতভম্ব হয়ে আছে সে। নীতির মুখ থেকে ওমন বিবরণ শুনে মনের মধ্যে তীব্র ভয় কাজ করছে। যে মাহতিমকে এতোদিন দেখে এসেছে, সেই মাহতিম কিনা বন্দুক চালাতে দক্ষ! মেহনূর কোনোভাবেই বন্দুকটার সাথে মাহতিমকে মেলাতে পারছেনা। যতোবার ভাবছে মাহতিম একজন প্রোফেশনাল শ্যুটার, ততবারই চোখের সামনে কঠিন মূর্তির চেহারা ভাসছে। সেই কঠিন মূর্তির চেহারার সাথে কোনোভাবেই মাহতিমের হাসিখুশী মুখটা মানানসই না। নীতি কোনোরকমে নিজের হাসি আঁটকে আস্তে-আস্তে রুম থেকে চলে গেলো। মেহনূরকে একটুও বুঝতে না দিয়ে রুম থেকে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেলো। হতবাক মেহনূর তখনো সেই বন্দুকটার দিকে চিন্তার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, মাহতিমকে নিয়ে যতো কল্পনা-জল্পনা ছিলো সবকিছু গুলিয়ে ফেলছে। মেহনূর কৌতুহলের বশে বন্দুকটার দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়, দেয়ালে সেঁটে রাখা বন্দুকটার উপর আঙ্গুল দিয়ে স্পর্শ করে। ওমনেই সে টের পায়, শরীরের উপর দিয়ে শীতল হাওয়া বয়ে যাচ্ছে, অদ্ভুত এক শিরশিরে ভাব সমস্ত শরীরে ভর করেছে। এটা যদি সাধারণ বন্দুক হতো, তবে অশান্ত মনকে হাবিজাবি বুঝিয়ে শান্ত করা যেতো। কিন্তু না, এটা মোটেই সাধারণ বন্দুকের কাতারে পরেনা, যেখানে পুরো বন্দুকটা দামী মেটাল দিয়ে তৈরি করা, সেখানে নানা প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও অশান্ত মনকে উলটাসিধা বুঝানো যায় না। মেহনূর থম মারা ভঙ্গিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো, কালো রঙের বন্দুক থেকে ধীরে-ধীরে হাত নামিয়ে ফেললো। বুকভর্তি লম্বা নিশ্বাস টেনে নিজেকে শান্ত করার চিন্তা করলো। চোখদুটো বন্ধ করে ধীরেসুস্থে লম্বা শ্বাসটা টেনে নিচ্ছিলো মেহনূর, কিন্তু আকস্মিকভাবে যা হলো, তাতে প্রচণ্ড চমকে গিয়ে চোখ খুলে তাকালো মেহনূর। চোখের কোটর বিশাল বড় করে তৎক্ষণাৎ মাথা নিচু করে পেটের দিকে তাকালো। গাঢ় বেগুনি রঙের হাতাটা কনুইয়ের উপর ভাঁজযুক্ত থাকার জন্য বলিষ্ঠ হাতদুটো দেখা যাচ্ছে। সেই পেশিবহুল হাতদুটো পেছন থেকে আষ্টেপৃষ্টে ধরে রেখেছে মেহনূরকে, বাঁহাতের উপর বড় ডায়ালে ঘড়িটা ষ্পষ্ট দেখতে পেলো মেহনূর। ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকতেই পেটের উপর থেকে একটা হাত সরে গেলো। পেছন থেকে মাহতিমের উপস্থিতি পেয়ে নির্বাক হয়ে আছে মেহনূর, এই মূহুর্তে একটা কথাও মুখ ভেদ করে আসছেনা। মাহতিম সুকৌশলে মেহনূরের কাধ থেকে কেশগুচ্ছ সরিয়ে দিলো, ডান কাধটা আয়ত্ত করার জন্য চুলগুলো বাঁ-কাধের দিকে ঠেলে দিলো। উন্মুক্ত ডানকাধের দিকে চোখ বন্ধ করে থুতনি রেখে দিলো মাহতিম, আবারও হাতদুটো কোমরের কাছে এনে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো মেহনূরকে। এদিকে মাহতিমের এমন আকস্মিক কাজের জন্য মেহনূরের অবস্থা কাহিল হয়ে গেছে, গলায় যে ছাপ বসিয়ে দিয়েছে সেটাই এখনো মিটেনি। এখন যদি কিছু করে ফেলে লজ্জায় আর টেকা যাবে না। মেহনূর চুপ মেরে কাঠ হয়ে থাকলে মাহতিম তখন শান্ত কন্ঠে বললো,
– মাকে অনেক বুঝালাম মেহনূর, কিন্তু সে রাজি হলো না। তোমাকে আঠারোর আগে ছোঁবো না জেনেও মা তোমাকে আলাদা রাখতে চাচ্ছে। ভেবেছিলাম হাতে থাকা এই দুদিন তোমাকে আগলে-আগলে রাখবো। কিন্তু এবারের জন্য সম্ভব হচ্ছে না, আমি বোধহয় ছয় থেকে সাত মাসের জন্য ফিল্ডে থাকবো। হতে পারে আরো দেরিতে আসতে পারি। তোমাকে একা-একা সবকিছু সামলাতে হবে মেহনূর, আমাদের সংসার সাজানোর দায়িত্ব সম্পূর্ণই তোমার।
মাহতিমের কথাগুলো শুনতে-শুনতে স্বাভাবিক হচ্ছিলো মেহনূর। মনের মধ্যে যে সংকোচগুলো মাথানাড়া দিয়ে উঠেছিলো, সেগুলো ধীরে-ধীরে কমতে লাগলো ওর। অনেকটা ধাতস্ত সুরে মাহতিমের উদ্দেশ্যে ছোট্ট একটা প্রশ্ন করলো,
– কবে আসবেন?
অত্যাশিত কিছু শোনার মতো চোখ খুলে তাকালো মাহতিম। সাথে-সাথে পেটের উপর থেকে হাতজোড়া সরিয়ে ফেললো। মেহনূরকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে তৎক্ষণাৎ শক্ত করে ওর দুকাধ ধরলো। আশ্চর্য দৃষ্টিতে হাসি দিয়ে বললো,
– আমি জলদি ফিরলে তুমি খুশী?
মাহতিমের উৎসুক চাহনির মাঝে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলো মেহনূর। প্রশ্নের জন্য একদম মুখ খুললো না সে। মাহতিম কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে শেষমেশ কাধ থেকে হাত সরিয়ে ফেলে। মেহনূরের মুখটা দুহাতের মাঝে আবদ্ধ করে মুখটা ধীরে-ধীরে উঁচু করে তোলে। মেহনূরের উজবুক চাহনির মাঝে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকতেই স্বর নামালো মাহতিম, ঠোঁটে প্রাণখোলা হাসি ফুটিয়ে নম্র সুরে বললো সে,
– জলদি ফিরবো মেহনূর আফরিন। হাতে প্রচুর সময় নিয়ে আসবো। আমাকে যেভাবে পাগল বানিয়ে দিচ্ছো, সেটা শোধ তুলতে হবেনা?
মেহনূর এমন কথার প্রেক্ষিতে লজ্জায় চোখ নামিয়ে ফেললো। লোকটা এতোই খারাপ, এতোই অসভ্য, একটা সভ্য কথাকে ইচ্ছে করে অসভ্য বানিয়ে ছাড়লো।
.
মাহতিমের হাতে আর একদিন মাত্র সময় আছে। এবার যেভাবে ছুটি কাটালো, সেভাবে আগে কখনো কাটিয়েছে কিনা সন্দেহ। প্রতিবার চারদিনের মতো সময় নিয়ে বাড়ি ফিরে, সেই চারদিন বাড়ির বাইরে কাটিয়ে পুনরায় ফিল্ডে চলে যায়। এবার যেহেতু বেশিদিন কাটিয়েছে, সেক্ষেত্রে আগামী ছয়মাস পযর্ন্ত ছুটি আবদার করা যাবে না। মাহতিম পড়নের পোশাক পালটে হাত-মুখ ধুয়ে বিছানায় এসে বসলো। বিছানার মধ্যখান থেকে ফোন তুলে ফ্লাইটের জন্য টিকিট করছিলো। টিকিটের জন্য ওয়েবসাইটে ঢুকতেই দরজা খুলে চোরের মতো উঁকি মারলো তৌফ। মাহতিম সেদিকে একপলক তাকালো ঠিকই, কিন্তু বিশেষ দৃষ্টি প্রদান করলো না। চোখ যেভাবে চোখ তুলেছিলো, ঠিক সেভাবে চোখ নামিয়ে পুনরায় ফোন দেখতে লাগলো। তৌফ ব্যাপারটা স্বাভাবিক ভাবে নিলেও ফোনের প্রতি মনোযোগ দেখে কিছুটা খটকা লাগলো। দরজাটা চাপাতে-চাপাতে কৌতুহল সুরে বললো,
– ও বন্ধু? এ্যানি সমস্যা? ইউ নিড হেল্প? তোমার মুরগী তো দেখি ছাদের রুমে শিফট হইছে।
মাহতিম সেদিকে তাকালো না, উত্তর পযর্ন্ত দিলো না। তৌফের কথা শুনে মন চাচ্ছে, কষিয়ে এক চড় লাগাতে! কিন্তু সেটা দমিয়ে রেখে শান্তভাবে বসে রইলো মাহতিম। তৌফ হেলেদুলে হেঁটে এসে মাহতিমের পাশে এসে বসলো। মাহতিম কি করছে সেদিকে দৃষ্টি ছুড়তেই কপাল কুঁচকে ফেললো। একবার মোবাইলের দিকে তাকালো, আরেকবার মাহতিমের দিকে তাকালো তৌফ। চোখের সামনে অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যাপার দেখে অনেকটা চিল্লিয়ে উঠলো তখন,
– দোস্ত, তুই মেহনূরের কথা চিন্তা করলি না? কনফার্ম দিলি ক্যান? কি করলি দোস্ত এটা?
তৌফের চেঁচানো সুর শুনে সশব্দে নিশ্বাস ছাড়লো মাহতিম। ফোনটা অফ করে চুপ করে বসে রইলো সে। তৌফ তখন নির্বিকার ভঙ্গিতে মাহতিমের পানে তাকিয়ে আছে, কি বললে ব্যাপারটা অনুকূলে ফিরবে সে সম্পর্কে কিচ্ছু জানা নেই ওর। মাহতিমকে চুপচাপ দেখে তৌফ যেনো শান্ত হলো। জোরে একটা নিশ্বাস ছেড়ে মাহতিমের হাত থেকে ফোন কেড়ে নিলো। বন্ধ ফোনটা বিছানায় রেখে স্বাভাবিক সুরে বললো,
– মেহনূর ফ্রি হয়নি, ঠিক না?
প্রশ্নটার শব্দতরঙ্গ স্বল্প হলেও মাহতিমের নিকট তীব্রভাবে ঠেকলো। মাহতিম সাথে-সাথে দুচোখ বন্ধ করে মাথা নুয়ে ফেললো। ফ্লোরের দিকে মাথা ঝুঁকিয়ে নিচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরলো। তৌফ ওর অবস্থা দেখে কেমন প্রতিক্রিয়া দিবে, ভাবতে পারছিলো না। মৃদ্যুভঙ্গিতে নিশ্বাস ছেড়ে মাহতিমের প্রশস্ত পিঠটার উপর হাত উঠালো তৌফ। অনেকটা কোমল সুরে সরল কন্ঠে বললো,
– মাহতিম? তুইতো সবসময় বলোস, Every situation has a meaningful thing. তোর কি মনে হয়না সবকিছু সময়ের উপর ছাড়া উচিত? তাছাড়া ও তো মেয়ে মানুষ, ওর নিজেরও একটা থিন লাইন আছে। ওরে ওর মতো —
কথাটুকু শেষ না করতেই মাহতিম ওকে থামিয়ে দিলো। ঝুঁকানো মাথাটা স্বাভাবিক করে তৌফের দিকে তীক্ষ্ণ নজরে তাকালো। চুলগুলো পাঁচ আঙ্গুলে পেছনে ঠেলে চোখ বন্ধ করে বললো,
– ওর সম্পর্কে কি জানিস তুই? তুই নিজেই আমাকে বল, এতোদিন যে থাকলি, ওর ব্যাপারে কি কি জানলি?
মাহতিমের এমন উদ্ভট প্রশ্নে সরুচোখে তাকালো তৌফ। চোখে ভীষণ কৌতুহল ফুটিয়ে আশ্চর্য কন্ঠে বললো,
– মানে? শালা এমন গাজাখুরি প্রশ্ন করোস ক্যান? ও তো সাদামাটা মেয়ে। গ্রামের সাধারণ পরিবার থেকে বিলং করে। ওর দাদাটা আবার চাল্লু চিজ, চুল পাকছে ঠিকই, রাগের তেজ কমেনাই। এখনো লুঙ্গি কাছা দিয়া চোর খেদাইতে পারবো।
তৌফের আবোলতাবোল যুক্তি শুনে বিরক্ত হলো মাহতিম। বিরক্তি ভাবটা সাইডে ফেলে আপাতত মোদ্দাকথায় আসলো,
– ওর ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড সম্পর্কে তোরা কেউ জানিস না। ওর দাদা, হান্নান মোল্লা সলিড একটা মানুষ। উনার মতো নির্ভেজাল মানুষ, তুই হাজার খুঁজলেও পাবি না। উনি যে শেফালীর মতো ধুরন্ধর মহিলাকে এখনো থাকতে দিয়েছে, এটা ওই মহিলার ভাগ্য বলা চলে। ওই মহিলা যা যা করেছে, ওই তথ্য যদি শুনতে পারিস, তাহলে থুথু করবি। আমি যদি হান্নান নানার জায়গায় থাকতাম, ওই মহিলার যা দশা করতাম পুরো গ্রাম সাক্ষী থাকতো। আমিযে কতোটা ধৈর্য্য নিয়ে চুপ ছিলাম, এটা জাস্ট আল্লাহ্ জানে। খালি মেহনূরের কথা চিন্তা করে এতোদিন শান্ত ছিলাম। পরশু যেহেতু চলেই যাচ্ছি, যাওয়ার আগে ওই মহিলার কাহিনী রফাদফা করে যাবো।
মাহতিমের কথা শুনে তৌফ কিছুক্ষণ চুপ মেরে রইলো। মেহনূরের পরিবার সম্বন্ধে কি এমন জানতে পেরেছে সেটা জানার জন্য আকুপাকু করছিলো। সেই আকুপাকুর রেশ দীর্ঘ না হতেই মাহতিম তখন উঠে দাঁড়ালো। ট্রাউজারের পকেটে দুহাত গুঁজে ডানদিকের খোলা জানালার কাছে যেতে লাগলো। হালকে নীলের কার্টেনগুলো বাইরের হাওয়ায় উড়ছে, মাহতিম সেখানে দাড়ানোর সাথে-সাথে কার্টেনগুলো দুধারে ঠেলে দিলো। পূর্ণচন্দ্রের আকাশে দৃষ্টি রেখে কঠোর ভঙ্গিতে বললো,
– শেফালীর পুরো নাম, হামিদা বিনতে শেফালী। এই মহিলার মা নেই, বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করে বউ নিয়ে সংসার করছে। ওই বউয়ের চরিত্র খারাপ, একসময় আক্কাস চেয়ারম্যানের সাথে গভীর সম্পর্ক ছিলো। শেফালী ওর দূর-সম্পর্কীয় খালা জমিলার কাছে বড় হয়েছে। ওই খালাও আহামরি সচ্চরিত্র মহিলা না। লোকেমুখে শোনা যায়, এই জমিলা রাতের বেলায় বাড়ি থাকতো না, কোথায় যেতো ওই তথ্য তোর জানার দরকার নেই। হান্নান নানার মেজো ছেলে কোনো মাস্টার-ফাস্টার না, ওইটা এক নাম্বার নেশাখোর। একসময় জুয়ারিদের সাথে চব্বিশ কাটতো, ওই নেখাখোর এখন রাঙ্গামাটিতে আছে। ওখানে টুকটাক স্মাগলারের কাজ করে। হান্নান নানা নিজের মেজো ছেলেকে ত্যাজ্যপুত্র বলে দিয়েছে, এর জন্য ভুলেও শেফালীর সাথে দেখা করতে পারেনা। শেফালীর সাথে প্রেমের সম্পর্ক ছিলো, আর শেফালীই নিজের কুকীর্তি ঢেকে মোল্লা বাড়ির বউ হয়েছিলো। শেফালীর একটাই উদ্দেশ্য ছিলো, ওটা ছিলো সম্পত্তির লোভ। তার উপর মেহনূরের দাদী খুব বড়লোক পরিবার থেকে এসেছিলো। ওর দাদীর যতো সম্পত্তি ছিলো সবই নানার নামে, আর নানার নামে মানে ইন-ফিউচারে সেটা তিন ছেলের নামে। এই খবর যখন জানতে পারে, তখন শেফালী কাদা খেয়ে হলেও মেজো ছেলেকে ফাঁসায়, বিয়ে করে, আরো নানা কাহিনী করে, সেগুলো জেনে লাভ নেই। মেহনূর যখন চারমাসের ছিলো, তখন এই মহিলার কোলে তখন ছয়মাসের সুরাইয়া। মেহনূর এই বংশের সবচেয়ে সুন্দরী বাচ্চা ছিলো, সবাই বলতো ও নাকি মরহুম দাদীর রূপ নিয়ে এসেছে। শেফালী এটা সহ্য করতে পারেনি, হিংসার জ্বালায় মেহনূরকে পানিভর্তি বড় বোলের মধ্যে শুইয়ে দিয়েছিলো। কিন্তু মেহনূরের নসিব ভালো ছিলো, ও বেঁচে যায়। আর হাস্যকর ব্যাপার হলো, এতোকিছু হওয়ার পরও হান্নান নানা ওই মহিলাকে মাফ করে দেয়। কাহিনি এখানেই শেষ না, আরো কাহিনী আছে। এই বংশের বড় ছেলে কে জানিস? সুজলা মামীর ছেলে হচ্ছে বড় ছেলে, ওর নাম শাওন। শাওন, শানাজ, সাবা এরা সহোদর ভাইবোন, বাট ইন্সিডেন্টলি শাওন বর্তমানে কানাডাবাসী। আর শেফালীর যে একটা ছেলে আছে ওটা জানতিস?
প্রশ্নটা করে জানালা থেকে ঘুরলো মাহতিম। জানালার দিকে পিঠ দিয়ে পকেট থেকে দুহাত বের করলো, বুকের উপর হাতদুটো ভাঁজ করে একপেশে হাসি দিয়ে বললো,
– ওর নাম সিফাত, ওটাও আরেকটা লম্পট। ওটাকে গা ঢাকা দিয়ে বাচানোর জন্য মিশরে পাঠিয়ে দিয়েছে।এখন মেবি গভমেন্ট হাসপাতালের সুইপার, আগে প্রাইমারি স্কুলের সুইপার ছিলো। আরো শুনবি?
তৌফ বিশাল বড় ঢোক গিলে হতভাগা দৃষ্টিতে বললো,
– তুই এগ্লা কবে করলি দোস্ত? মানে, এই কাজটা যদি সরকারের লিগা করতি, কি পরিমাণে ইনকাম করতি চিন্তা আছে?
এবার মাহতিম ফিক করে হেসে দিলো। হাসতে-হাসতে বললো,
– বারোটা মাসের মধ্যে দশটা মাস বাইরেই থাকি, আমার কন্ট্রিবিউশনটা জায়গামতো ঠিকই আছে। দেশেরটা দেশের জন্য, নিজেরটা নিজের জন্য।
তৌফ ওর কথার হেয়াঁলিটা বুঝতে পারলো না। ভ্রুঁদুটো ভীষণ কুঁচকে প্রশ্ন গলায় বললো,
– বুঝিনাই, আবার বল।
মাহতিম হাসি থামিয়ে আগের মতো স্বাভাবিক হলো। কিন্তু কথার মাঝে আবারও হাসতে-হাসতে বলতে লাগলো,
– শেফালীর ভাষ্যমতে, মেহনূরের কপালে কোনোদিন বিয়ের ভাগ্য জুটবে না। যদি কখনো হয়েও যায়, সে বিয়ে নাকি ভেঙ্গে যাবে। আমি কথাটা শুনলাম, প্রচুর হাসলাম, এরপর ডিসাইড করলাম, দরকার পরলে হাত-পা বেধেঁ হলেও মেহনূরকে তুলে আনবো। তবুও ওই শেফালীর সামনে ওকে রাখবো না। কিন্তু ওই মহিলা আমার সাথে পল্টি মারতে গিয়ে উলটো নিজের ফাঁদে ধরা খায়। সুরাইয়ার সাথে কথা উঠানো তো দূর, আমি আরো সুন্দর মতো একচান্সে মেহনূরকে পেয়ে গেলাম।
খুব কষ্টে কথাগুলো শেষ করলো মাহতিম। আঁটকে রাখা হাসিটা পুরো রুমের মধ্যে ছড়িয়ে পরলো। মাহতিমকে ওরকম ভাবে হাসতে দেখে তৌফ যেনো মলিন চাহনিতে তাকালো। এক বন্ধু প্রিয়তমাকে অর্জন করে আত্ম খুশীতে হাসছে, আরেক বন্ধু আকাঙ্ক্ষীত প্রিয়দর্শনীকে দূরে রেখে বদ্ধ রুমে কষ্ট পাচ্ছে। দুজনের কতো মিল, তবুও সেই মিলের মধ্যে আকাশ-পাতাল অমিল।
– ‘ চলবে ‘
#FABIYAH_MOMO
( নোটবার্তা : আমি আপনাদের কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। নিজের ব্যক্তিগত সমস্যার জন্য গল্প দিতে দেরি করেছি। তন্মধ্যে বোর্ড পরীক্ষার জন্য অনিয়মিত হলেও চেষ্টা করবো পরীক্ষা শেষে আবার নিয়মিত হওয়ার। সবাইকে আমার তরফ থেকে সামাহীন, অজস্র ভালোবাসা। )
#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই
#পর্বসংখ্যা_৩১.
#ফাবিয়াহ্_মমো .
অংশ ০২.
পুরো বাড়ির মধ্যে শব্দহীন অবস্থা বিরাজ করছে। দূর থেকে অস্পষ্ট সুরে ব্যাঙের ডাক ভেসে আসছে। রাতের সময়গুলো হুবহু গ্রামের মতো না লাগলেও সাদৃশ্য ব্যাপার দেখা যাচ্ছে। কোলাহলযুক্ত ব্যস্ত শহরটা ঘুমের চাদরে ঢেকে আছে এখন। আকাশে দেখা যাচ্ছে ঝাপসা-ঝাপসা ধোয়া, সেই ধোয়া কি শীতের সূচনা, সে সম্পর্কে বলতে পারছেনা মেহনূর। ছাদের রেলিংয়ে দুহাত রেখে রাতের আকাশে তাকিয়ে আছে সে। দীঘল চুলগুলো আজ কেউ বেধেঁ দেয়নি, একদিনের এই তারতম্য দেখে নিজের প্রতি ভালোই অযত্ন কাজ করছে। ছাদের ডানদিকটা এখন শয়নকক্ষ হিসেবে নির্বাচন করা হয়েছে, সেই নির্বাচনের পুরো কার্যাদি মাহতিম নিজে করেছে। মারজার একটা সিদ্ধান্তের উপর মাহতিম এখনো রেগে আছে, সেই রাগ কোনোভাবেই মায়ের সামনে দেখিয়ে বেড়ায়নি। নিজের সদ্য বিবাহিত বউকে আলাদা রাখার মতামতে গম্ভীর মুখে সায় দিয়েছে মাহতিম। মা-ছেলের এমন অদৃশ্য রেষারেষিতে বিচ্ছিন্ন ভাবে ছাদের রুমটায় থাকতে হচ্ছে মেহনূরের। এ নিয়ে বিন্দুমাত্র আক্ষেপ নেই তার, মলিন মুখটা নিয়ে সবসময়ের মতো আজও মাথানিচু করে রেখেছে সে। বিশাল ছাদটার ডানদিকে বড় একটা রুম আছে, রুমটা মাহতিমের একান্ত রুম হিসেবে বিবেচ্য হলেও বর্তমানে সেটা মেহনূরের জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে। মারজা এ নিয়ে প্রচুর বিরোধিতা করলেও একটুও লাভ হয়নি। মাহতিমের কথার উপর দু’কথা ফলাতে পারেননি তিনি। মাহতিমও কাট-কাট গলায় ঠাট বজায় রেখে বলে দিয়েছে, যে পযর্ন্ত মেহনূরের উপযুক্ত বয়স হবেনা, সে পযর্ন্ত ছাদের রুমটাই ওর আসল রুম। সেখানেই ও থাকবে-খাবে-সব করবে, কিন্তু অন্য রুমে শিফট হতে পারবেনা। যদি শিফট করাই লাগে তাহলে মাহতিমের রুমেই ফিরে আসুক। মারজা এমন কথা শুনে কিছুটা ক্রোধগ্রস্থ থাকলে পরক্ষণে শান্ত হয়ে যান। ছেলের উপর থেকে রাগ সরিয়ে শান্তভাবে বুঝান, পরিস্থিতির দিকে চিন্তা করে মাহতিমকে ব্যাপারটা খুটিনাটি দেখিয়ে দেন। মাহতিম সব শোনার পর আর কোনো কথা বলেনি। চুপচাপ রাতের খাবার খেয়ে ঘুমাতে চলে গিয়েছে, এদিকে সবার সঙ্গে খেতে বসা মেহনূর প্রচণ্ড অস্বস্তি নিয়ে খাওয়া শেষ করেছে। সবাই যখন যার-যার রুমে ঘুমের রাজ্যে মগ্ন, তখন মেহনূরের চোখে ঘুম নেই। রুমটা যতোই বিলাসবহুল হোক না কেনো, মন পরে আছে গ্রামের ভিটেতে। সেই ছোট্ট রুম, ছোট্ট জগতের মাঝে। মেহনূর ছাদের রেলিং থেকে হাত সরিয়ে ধীরে-ধীরে পিছাতে থাকে, আকাশের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ছাদের মেঝেতে নিবদ্ধ করে। রুমের দিকে যাওয়ার জন্য সম্পূর্ণরূপে ঘুরে দাড়ায়, সেদিকে এগুতে-এগুতে একপর্যায়ের রুমের সামনে চলে আসে। স্বচ্ছ কাঁচের দরজাটা থাইগ্লাসের মতো ডানে টেনে ভেতরে ঢুকে। নিরবে হেঁটে এসে আয়নার সামনে দাড়ায় মেহনূর, নত করে রাখা দৃষ্টিদুটো আস্তে-আস্তে উপরে তুলে তাকায়। নতুনের মতো চকচকে আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে পেয়ে গুমর ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকে। সারাদিন সবার সাথে শান্তভাবে চললেও রাতের এমন নিরিবিলি মূহুর্তে প্রচণ্ড অসহায় লাগছে। মনের মধ্যে আছড়ে পরছে একের-পর-এক ঝড়, সেই ঝড়ের ঝাপটায় নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে মনের ছোট্ট পরিধিটা। মেহনূর কোনোভাবেই নিজেকে আর সামলাতে পারলো না, ওই আয়নার সামনে তাকিয়ে থেকে ঝরঝর করে চোখের অশ্রুধারা ছেড়ে দিলো। শান্ত নেত্রদুটো অশ্রুবন্যায় টলটল করে উঠলো তখন, গালের নরম পরিখা বেয়ে অশ্রু পরতে লাগলো তার। নিঃসঙ্গ সময়গুলো ভীষণ যন্ত্রণা দিচ্ছে ওকে, যন্ত্রনা অনুভবের জায়গাটা চ্ছিন্ন-বিন্ন হয়ে যাচ্ছে মেহনূরের। অবধারায় পরতে থাকা অশ্রুগুলো দারুণ তেজে ঝরতে লাগলো, এবার নিস্তব্ধ রুমটা ফিসফিস শব্দে মুখর হলো। সেই ফিসফিস আওয়াজটা রুমের বাইরে যেতে পারলো না, শহরের বুকে ছুটে চলা বাতাসটা মিলিয়ে দিলো সেই শব্দগুলো। দোতলার রুমের শুয়ে থাকা মাহতিম কোনোক্রমেই সেই শব্দগু লো আচঁ করতে পারলো না। মেহনূরের কন্ঠনালী থেকে নিঃসৃত প্রতিটি চাপাকষ্ট দেয়ালের শক্ত জমিনে ধাক্কা খাচ্ছে, ধাক্কা খেয়ে প্রতিফলিত হয়ে রুমের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে। মেহনূর অশ্রুপূর্ণ চোখ খুলে আবার আয়নার দিকে তাকালো, তেজালো কান্নার গতিটা কমতে-কমতে হেচকির তালে এসে ঠেকলো। অনবরত হেচকি তুলার জন্য কেঁপে-কেঁপে উঠছে মেহনূর, চোখের অবস্থা শান্তরূপ ছেড়ে অশান্ত আকার ধারণ করেছে এখন। আয়নার দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে শাড়ির আচঁলটা মুঠোবন্দি করলো তখন, আবদ্ধ আচঁলটুকু উপরে উঠিয়ে কম্পমান হাতে চোখের সিক্তভাব মুছলো। দু’চোখ থেকে অশ্রুর শেষ অস্তিত্বটুকু মুছে চুপচাপ ভঙ্গিতে বিছানায় উঠে বসলো। থাই গ্লাসের দরজাটা ওভাবেই খুলে রেখে বালিশে মাথা রাখলো, দরজা দিয়ে প্রচুর বাতাস ঢুকছে। দরজায় ঝুলানো হালকা নীলের পর্দাটা থাইগ্লাসে বারি খাচ্ছে। মেহনূর সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকতেই বৃথা চেষ্টা হিসেবে চোখের পাতা বুজলো। বিছানায় টান হয়ে শুতেই পেটের উপর হাতদুটো রেখে দিলো। মাথার উপর চলতে থাকা ফ্যান, সেই সঙ্গে বাইরের হিম হাওয়া এসে তন্দ্রাচ্ছন্ন করে দিলো ওকে। মেহনূর হালকা মতোন ঘুমের ঘোরে ডুব দিলে হঠাৎ থাইগ্লাসের দরজা খোলার শব্দ হয়। শব্দটা এমনভাবে হচ্ছে, যেনো কেউ সর্তকভাবে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকার চিন্তা করছে। মেহনূর ঘুমের ঘোরে বদ্ধচোখে কপাল কুঁচকে ফেলেছে, ব্যাপারটা বাস্তব না-অবাস্তব সে বিষয়ে বুঝার চেষ্টা করছে। কিন্তু বুঝার সাপেক্ষ বেশি না হতেই চোখের পাতা খুলে তাকালো। ওমনেই ধড়পড় করে শোয়া থেকে উঠতে নিলো মেহনূর, কিন্তু অর্ধেক মতোন উঠতেই কারো আজ্ঞাদেশ এসে পরলো। মেহনূর ছোট্ট একটা ঢোক গিলে পিটপিট তাকিয়ে থাকতেই তৎক্ষণাৎ বিছানায় দ্বিতীয় ভর এসে যুক্ত হলো। মেহনূর কনুইয়ে ভর দিয়ে শোয়া থেকে উঠতে নিয়েছিলো, আজ্ঞাদেশ শুনতেই ওইভঙ্গিতে কনুইয়ে ভর রেখে মাহতিমের তাকিয়ে রইলো। মাহতিম ওর অবস্থ দেখে হাসি দিয়ে বললো,
– কনুই ব্যথা হয়ে যাবে, শুয়ে পরো।
‘ হ্যাঁ ‘ সূচকে মাথা দুলালো মেহনূর। পুনরায় বালিশে মাথা ঠেকিয়ে শুলো। মাহতিম ওর দিকে একধাপ এগিয়ে ডানহাতটা পাশে থাকা টেবিলল্যাম্পের দিকে বাড়িয়ে দিলো, স্বাভাবিক কপালটা ক্রমান্বয়ে চিন্তাযুক্ত হতে-হতেই চট করে টেবিলল্যাম্পটা সাদা বাতিতে জ্বলে উঠলো। ঠিক তখনই মাহতিমের চোখের সামনে মেহনূরের মুখটা পরিষ্কার হয়ে উঠলো, মাহতিম যেভাবে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে, সেটা একদমই সাধারণ ভঙ্গির তাকানো না। ওই চোখের চাহনি বারবার ঘুরছে, সুক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করছে, সরু দৃষ্টিতে কপাল কুঁচকাচ্ছে আরো। মেহনূর ভয়ে জড়সড় হয়ে গুটিয়ে গেলে মাহতিম টেবিলল্যাম্পের ওখান থেকে হাত সরিয়ে ফেলে। মেহনূরের দিকে মুখ নামিয়ে মেহনূরের বাদিকে হাত রাখে। বালিশের উপর বাহাতের ভর রেখে শুয়ে থাকা মেহনূরের মুখোমুখি হয়। সেই সন্দেহপ্রবণ দৃষ্টিটা ছুড়ে দিয়ে মেহনূরের গালটায় ডানহাতটা রাখে। গালের উপর মাহতিমের ঠান্ডা হাতের স্পর্শ পেয়ে আকস্মিকভাবে চোখ বন্ধ করে মেহনূর, সেকেন্ডের মধ্যে আবার চোখ খুলে তাকায়। মাহতিমের তীক্ষ্ণ চাহনিটা ধীরে-ধীরে নরম হচ্ছে, সেই নরম ভাব যতো তীব্র হচ্ছে, মেহনূরের জমাটবদ্ধ কান্নাটা বাইরে প্রকাশের জন্য নিংড়ে আসছে যেনো। মাহতিম অনেকক্ষণ চুপ করে ছিলো ঠিকই, এবার যেনো সুরটাও কোমল করে বললো,
– হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে?
সেই কোমল সুরটুকু কানে যেতেই ভেতরের সমস্ত জড়তা ধূলোয় উড়িয়ে দিলো। চোখ ছাপিয়ে মাহতিমের সামনেই অশ্রুক্লিষ্টে নত হলো মেহনূর, ঠোঁটদুটো ভেতরে গুটিয়ে দুপাটি দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরলো তখন। নাক ফুলিয়ে কান্না করতেই পুরো মুখ লালচে হয়ে উঠলো ওর, নাকের ডগাটা আবার লালবর্ণে গাঢ় হলো। মেহনূরের কান্নারত মুখটার দিকে তাকিয়ে থেকে ওষ্ঠযুগল এগিয়ে নিলো মাহতিম, চোখবন্ধ করে নাকের লালচে অংশটুকুতে স্পর্শ বসিয়ে গাঢ় চুমু খেলো। মেহনূরের গালটা ছেড়ে দিয়ে ওর ডানহাতটা ধরলো, হাতটা টেনে এনে নিজের ঘাড়ের উপর রাখলো মাহতিম। তখন স্পর্শমুক্ত করলো মেহনূরকে, সুকৌশলে বামহাতটাও একইভাবে ঘাড়ে টেনে আনলো। মেহনূর কিছু টের পাওয়ার ভঙ্গিতে তৎক্ষণাৎ অশ্রুজড়িত চাহনিতে তাকালো। তাকাতে দেরি, ওমনেই একজোড়া পেশীয় হাত এসে মেহনূরকে শূন্য তুলে নিলো, ঘটনার প্রেক্ষিতে মেহনূর ভয়ংকর ভাবে চমকে উঠবে, সেই সুযোগের পূর্বেই মাহতিম চলতে শুরু করলো। মাহতিমের দিকে ঠিক তাকাতেই গলা ভিজিয়ে প্রশ্ন করলো মেহনূর। প্রচণ্ড উদ্বিগ্ন হয়ে চাপা ভাবেই বললো,
– কোথায় যাচ্ছেন?
মাহতিম এমন উদ্ভট প্রশ্ন শুনে ফিক করে হাসলো। মেহনূরের দিকে দুষ্টু হাসিতে তাকিয়ে জবাব দিলো,
– বুঝো না কোথায় যাচ্ছি?
মেহনূর সাথে-সাথে কান্না ভুলে চকিত দৃষ্টিতে তাকালো। আবারও সেই ভয়মিশ্রিত গলায় বললো,
– আপনি দয়াকরে আমাকে নামিয়ে দিন। আপনার রুমে নিয়ে যাবেন না। মা দেখতে পেলে খুব কষ্ট পাবেন, আপনি দয়াকরে আমাকে নামান।
মাহতিম এতোক্ষন হাসির ছলে সবকিছু নিলেও এবার মেহনূরের কথা শুনে শক্ত চাহনিতে তাকালো। সিড়ির মাথায় হাঁটা নামিয়ে কাঠিন্য সুরে বললো,
– ‘ আপনার রুম ‘ আবার কি? ওটা তোমার রুম, অবশ্যই আমাদের রুম। ফার্দার যদি তোমার মুখ থেকে ‘ আপনার ‘ শব্দ শুনি, তোমার খবর আছে।
মাহতিমের শাসানো বাণী শুনে চুপটি মেরে গেলো মেহনূর। আর কোনো শব্দ উচ্চারণ করলো না সে, মাহতিম ওর দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে হাঁটা দিলো গন্তব্যের দিকে। সিড়ির প্রতিটি ধাপ অতিক্রম করে নিচে নামলো মাহতিম, নিজের রুমের দিকে নিয়ে চললো মেহনূরকে। রাত জেগে সিওসি খেলে হাই তুলতে-তুলতে দরজা খুললো মাহদি। ঘুমে ঢুলু চোখে সামিকের ফোনটা ফেরত দিতে বেরুলো, বড় হাইটা হাতের উলটোপিঠে চাপা দিতে তুলবে ঠিক তখনই চোখের সামনে মাহতিমের অবস্থা দেখতে পেলো। মেহনূরকে চেপেচুপে কোলে নেওয়ার দৃশ্য দেখে চমকানো দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো, হাইয়ের জন্য আর হাত চাপা দিতে মনে থাকলো না। বড় ভাইয়ের এমন কাণ্ডকারখানা দেখে আশ্চর্য ভঙ্গিতে বলতে লাগলো মাহদি,
– আবার বাটপারি! দাড়াও মায়ের কাছে লাগাচ্ছি। তখন তোমার ফোন চেয়েছিলাম, তুমি দাওনি না? এবার দেখো কি করি!
মাহদি কটমট রাগে যেই গলা ছেড়ে চেঁচাবে, তখনই পেছন থেকে মুখ চেপে ধরলো তৌফ। মাহদি গোঙানির মতো শব্দ করতে থাকলে তৌফ তাড়াতাড়ি ওকে টেনে এনে রুমের ভেতরে ঢুকালো। দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে মাহদিকে বিছানার উপর ছেড়ে দিলো, মাহদি হাপড়ের মতো নিশ্বাস নিতেই তৌফের দিকে তাকালো। স্বল্প সময়ের মধ্যে দুজনই বেশ হয়রান হয়ে গিয়েছে, মাহদিকে টেনে আনতে গিয়ে প্রচুর ক্লান্ত লাগছে তৌফের। তৌফ কোমরে দুহাত রেখে জোরে-জোরে নিশ্বাস নিতেই ভ্রুঁ কুঁচকে ক্রুদ্ধভাবে বললো,
– তোরে কি গুড়া কৃমি কামড়ানি দিছিলো? পেটের মধ্যে নাড়াচাড়া দেয়? কি কাহিনী করতে নিছিলি? তোরে তো বাথরুমের ফ্লাশে চুবানো দরকার ফাজিল কোথাকার!
তৌফের কথা শুনে দারুণভাবে ক্ষেপে উঠলো মাহদি। বিছানা থেকে নেমে সোজাসুজি দাঁড়িয়ে পরলো সে। তৌফের দিকে চোখ রাঙিয়ে বেশ কাট-কাট ভাবে জবাব দিলো,
– মা আমাকে বড় একটা রিসপন্সসিটি দিয়েছে, মা বলেছে ভাইয়া যেনো কোনোভাবেই আমার বউয়ের রুমে না যায়। যদি যায়, তাহলে তাড়াতাড়ি খবর দিয়ে দিতে।
মাহদির বড়-বড় কথা শুনে তৌফ বাঁ ভ্রুটা উঁচিয়ে তাকালো। মুখের ভাবটা তৎক্ষণাৎ তিরিক্ষি করে গমগম কন্ঠে বললো,
– ওই দাড়া, দাড়া এক মিনিট! তুই আগে রিসপন্সলিবিটি বানান কর! এখুনি কইরা দেখাবি, না পারলে এমন এক থাপ্পর মারুম, গালে হাত দিয়া দুইরাত কাঁদবি।
তৌফের কথায় নাক ফুলিয়ে তাকালো মাহদি। দু’পা এগিয়ে এসে বেশ ভাব নিয়ে বললো,
– তুমি যে ভাইয়ার পাসপোর্ট হারিয়ে ফেলেছো, আমি কিন্তু এটা জেনে গিয়েছি। যদি এটা ভাইয়ার কানে লাগাই তো —
কথাটুকু বলে বদমাইশি হাসি দিয়ে থেমে গেলো মাহদি। সেই হাসিটুকু প্রসার করে ভ্রুঁ নাচাতে থাকলো। তৌফ ওর অবস্থা দেখে ভয়ে জমে গেলো, এতো বড় গোপন তথ্য কিভাবে জেনে গেলো সে ব্যাপারে একদমই চিন্তা করতে পারছেনা সে। তৌফের শুষ্ক মুখটা দেখে মাহদি আরো একগাল হাসলো, হাসতে-হাসতে তর্জনী তুলে রাস্তা থেকে সরে যেতে ইশারা করলো। তৌফ রেগেমেগে বিরক্ত নিয়ে তাকালে মাহদি আবার হাসি দিয়ে বিনা শব্দে ঠোঁট নাড়িয়ে বললো, ‘ পা-স-পো-র্ট ‘। তৌফ বাধ্য হয়ে রাস্তা থেকে সরে গেলে মাহদি হেঁটে-হেঁটে দরজার দিকে চললো। তৌফ রাগত ভঙ্গিতে ওর পশ্চাৎদেশ বরাবর লাত্থিসূচকে পা তুললে, ঠিক তখনই মাহদি পিছু ফিরে তাকালো। ধরা পরার ভয়ে তাড়াতাড়ি নিজেকে পরিস্কার করতে পায়ের ব্যায়াম দেখিয়ে বললো,
– তাকাস ক্যান? ব্যায়াম করি। পা-টা যে কি ব্যথা গো বাবা! মুভটা দিয়ে মালিশ করা দরকার।
তৌফের মিথ্যা কথাটা ঠিকই ধরলো মাহদি। কিন্তু মুখে সেটা ভাইয়ের মতো স্পষ্ট করে বললো না। মাহতিমের প্রতিরূপ আচরণ দেখিয়ে শান্ত পায়ে বেরিয়ে গেলো। কিন্তু আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো, মারজার রুমে সে গেলো না। নিজের রুম থেকে বের হয়ে সামিকের রুমে গেলো, কিন্তু সেখানেও কিছু বললো না। তৌফ সবটা ব্যাপার হতভাগার মতো পর্যবেক্ষণ করতেই নিজের মনে উচ্চারণ করতে লাগলো,
– যেমন ইলিশ, তেমনি দুই জাটকা। কেউ কারোর চেয়ে এক ইন্ঞ্চি কম না। কিন্তু আর যাই কর্, মাহতিমের ব্যাপারে কিচ্ছু বলিস না ব্যাটা। ভুলেও আপাতত কিচ্ছু বলিস না।
– ‘ চলবে ‘
#ফাবিয়াহ্_মমো .
#FABIYAH_MOMO .
( নোটবার্তা : খাপছাড়া পর্ব দেওয়ার জন্য দুঃখিত )
#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই
#পর্বসংখ্যা_৩১.
#ফাবিয়াহ্_মমো .
শেষ অংশ .
মেহনূর সংকীর্ণ মনে কুঁকড়ে আছে। মাহতিমের দিকে চোখটা পর্যন্ত স্বাভাবিক ভাবে তুলতে পারছেনা। মাহতিম ওকে কোলে নিয়ে নিজের রুমে ঢুকে গেলো। দরজাটা চাপানোর জন্য পা দিয়ে হালকা একটা ধাক্কা দিলো দরজাটায়। দরজাটা মৃদ্যু ক্রিয়া পেয়ে বন্ধ হতেই বিছানার দিকে এগিয়ে গেলো মাহতিম। বিছানার কাছ ঘেঁষে চুপচাপ দাড়িয়ে পরলে এবার কাঙ্ক্ষিত মুখটার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। মেহনূরের নত করা চাহনিটুকু অনিমেষ নেত্রে অবলোকন করে ছোট্ট একটা নিশ্বাস ছাড়লো। ওই মুখটার উপর স্থির দৃষ্টি রেখে বিছানার উপর ডানহাঁটুটা তুলে দিলো মাহতিম। হাটুতে ভর দিয়ে হাতদুটো বিছানার দিকে নামাতে-নামাতে মেহনূরকে বালিশ বরাবর শুইয়ে দিলো। জীর্ণ অবস্থায় গুটিয়ে থাকা মেহনূর প্রচণ্ড জড়তায় নেত্রজোড়া বুজে ফেললো। ওমন আকষ্মিক মূহুর্তে কি করে নিজেকে স্বাভাবিক রাখবে, সেটা নিয়ে ভাববার অবকাশ ছিলোনা। খুব কাছ থেকে অনুভব করতে পারছিলো মাহতিমের সঙ্গটা। মাহতিম যে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, সেই দৃষ্টির মাঝে চোখ মেলে তাকালে যে কত বড় সর্বনাশ হয়ে যাবে, সে সম্পর্কে মেহনূর একটু হলেও অবগত ছিলো। মেহনূরের অপ্রস্তুত মুখটা দেখে মাহতিম কিছুসময় নিরব রইলো, সেই নিরবতার মাঝে ধীরে-ধীরে হাতটা এগিয়ে দিলো তখন। মেহনূরের কোমল গালের উপর আঙ্গুল ছুঁয়ে-ছুঁয়ে বলতে লাগলো মাহতিম,
– তোমাকে আমি কিছুই করবো না মেহনূর। শুধু এটাই চাই তুমি যেনো একটু ইজি ফিল করো। জানি তোমার প্রচুর সমস্যা হচ্ছে, সবকিছুই এলোমেলো লাগছে। আমাকে দেখেও তুমি স্বস্তি অনুভব করছো না। ওভাবে একা-একা কাঁদার চাইতে তুমি আমার সঙ্গেই থাকো। মা-কে এ বিষয়ে বলবো না, মা জানবেও না। তুমি ঘুমাও।
কথাটুকুর ইতি টেনে মাহতিম হাতটা সরিয়ে নিলো। মেহনূরের কাছ থেকে সরে গিয়ে জানালার পর্দাটা টেনে দিলো। নিরুত্তর মেহনূর নির্বোধের মতো তাকিয়ে থাকলে মাহতিম সেদিকে ধ্যান দিলো না। চুপচাপ রুমটা অন্ধকার করে মেহনূরের পাশে চলে আসলো। মেহনূরের দিকে পিঠ দিয়ে ওপাশ ফিরে শুলো। মেহনূর ওই অন্ধকার রুমে কিছুই স্পষ্ট দেখতে পেলো না, তবুও মনে-মনে অনুভব করতে পারছিলো, মাহতিম নামক মানুষটা বেশ দূরত্ব রেখে শুয়ে পরেছে, যতোটা দূরত্ব রাখলে মেহনূর কোনো ভয় ছাড়াই ঘুমাতে পারবে। মেহনূর কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো, সময়ের কাটাটা হুরহুর করে পেরিয়ে ষাটটা মিনিট অতিক্রম করলো। মেহনূর সময়ের হিসাব না জানলেও কানে তখন তিনটা বাজার ঘন্টা বাজলো। ঘুটঘুটে অন্ধকার রুমে আগে কখনো থাকেনি মেহনূর। গ্রামে সবসময় জানালা খুলে ঘুমাতো বলে এমন নিকষ অন্ধকারে পরতে হয়নি। এতোক্ষন কোনো সমস্যা না হলেও এখন ঠিকই বিপাকে পরতে হলো। রুমটা চরম অন্ধকার হওয়ার ফলে মেহনূর একটু হলেও ভীত হতে লাগলো। কোনো সাড়া নেই, শব্দ নেই, দূর থেকে নেড়ি কুকুরের ঘেউ ঘেউ শোনা যাচ্ছে। কুকুরের ডাকটা স্বাভাবিক হলেও পারতো, কিন্তু সে ডাক যে নিশাচর দেখলে শোনা যায় সে সম্পর্কেও জানতো মেহনূর। মূল ভয়টা তখনই আঁকড়ে ধরলো, যখন অশরীরীর ব্যাপার নিয়ে খুব ভয়ঙ্কর একটা কল্পনা করে ফেললো সে। মেহনূর তাড়াতাড়ি দুটো ঢোক গিলে ডানদিকে তাকালো। তাকিয়ে কোনো লাভ হলোনা, কিচ্ছু তখন দেখা যাচ্ছে না, এতো অন্ধকার দেখে গা ছমছম করছে ওর। একদিকে মনের ভয়, অপর দিকে নতুন পরিবেশ, এ দুটো মিলে তছনছ অবস্থা হচ্ছে মেহনূরের। মেহনূর তখন না পারতে মাহতিমের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো, ভয়ে হাতটা ঠান্ডার মতো জমে গেছে, থরথর করে অনবরত কাঁপছে, তবুও শক্ত অবলম্বন খোঁজার জন্য মাহতিমের দেহটাকে খুঁজছে তখন। হাতটা প্রথমে পাতলা কম্বলের পশমী আস্তরণটা টের পেলো, মাহতিম যে গায়ে কম্বল টেনে ঘুমিয়েছে সেটাও মানসপটে চিন্তা করে ফেললো। এদিকে কম্বলের স্তরটা যখন পার হয়ে গেলো, তখন বিদ্যুতের মতো চমকে উঠলো মেহনূর! শিরশির করে উঠলো মেহনূরের ছোট্ট দেহের কাঠামোটা! শরীরের সমস্ত লোমকূপ কাঁটা দিয়ে উঠলো তার! ঠান্ডা হাতটা উষ্ণ দেহের অস্তিত্ব পেলেও ভেতরে-ভেতরে ঝড় তুলে ফেলেছে ওর। মেহনূর চোখ-মুখ কুঁচকে মাহতিমের উন্মুক্ত পিঠটায় কাঁপা-কাঁপা হাত রেখে দিয়েছে। মাহতিম যে শোয়ার পূর্বে টিশার্ট খুলে শুয়েছে সেটা সম্ভবত অন্ধকারের জন্য টের পায়নি। মেহনূর এমন অবস্থায় ফেঁসে যাবে সেটা চিন্তাও করতে পারেনি, তন্মধ্যে ঠান্ডা হাতের পরশ পেয়ে তড়িঘড়ি করে জেগে গেলো মাহতিম। পরিস্থিতি তখন কি হচ্ছে সেটা বুঝার জন্য তাড়াতাড়ি মাথাটা মেহনূরের দিকে ঘুরালো, গা থেকে কম্বল নামিয়ে মেহনূরের হাতটা পিঠ থেকে সরালো ঠিকই, কিন্তু নরম হাতটা মুঠোবন্দি করে ধরলো। ওর দিকে সম্পূর্ণ ঘুরে প্রসন্ন কন্ঠে বললো,
– হাত ঠান্ডা কেনো? কি হয়েছে তোমার?
মাহতিমের প্রশ্ন শুনে লজ্জায়-শঙ্কায়-জড়তায় কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে মেহনূরের, মাহতিম এমন উটকো ঘটনা দেখে কি ভাববে সেটা নিয়ে চিন্তা করলেই নিজের উপর ধিক্কার হচ্ছে। মাহতিম কোনো প্রশ্নাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখালো না, মেহনূরের হাতটা নিঃশব্দে ছেড়ে দিয়ে শান্তসুরে বললো,
– কালকের মতো ওপাশ ফিরো মেহনূর।
মেহনূর কথাটা শুনে কুঁচকানো চোখটা খুললো। অন্ধকার হলেও মাহতিমের দিকে একপলক তাকিয়ে থেকে ধীরে-ধীরে ওপাশ ফিরে শুলো। উত্থাল-পাত্থাল চিন্তাগুলোধীরে-ধীরে সবর থেকে নিরব হতে থাকলে পেছন থেকে পেশীবহুল হাতটা গলার কাছে আঁকড়ে ধরলো। পিঠের উপর থেকে এলোমেলো চুল সরে বালিশের উপর স্থান পেতে থাকলো। চট করে আকস্মিকভাবে উন্মুক্ত বুকের উষ্ণতা দিয়ে জড়িয়ে ধরলো মাহতিম। গলার কাছে রাখা হাতটা দিয়ে মেহনূরকে শক্ত করে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে ধরলো। মাথার কাছে চুলের উপর থুতনির কর্তৃত্ব টের পেলো মেহনূর। সেই থুতনিটা যখন কয়েক সেকেন্ডের জন্য স্থানচ্যুত হলো, তখন ওষ্ঠজোড়ার কঠিন চাপ অনুভব করলো মেহনূর। চোখদুটো অজানা আন্তঃক্রিয়ায় বুজে ফেললো সে, ভেতর থেকে সমস্ত জড়তা ঝেড়ে-কেশে স্বস্তির নিশ্বাস বেরিয়ে এলো। এতোক্ষন কত শত চিন্তা, কত শত ভয়, কত রকমের জড়তা নিয়ে ক্লিষ্ট ছিলো মন, কিন্তু পরিশেষে এবং নির্বিশেষে শান্ত হলো মন। মেহনূর ঠোঁট ভেদ করে নিশ্বাস ছাড়ছিলো, সেই নিশ্বাসের স্পর্শগুলো মাহতিমের হাতের উপর ছড়িয়ে পরছিলো। মাহতিম নিরবে সবটা টের পেয়ে নিচু গলায় বললো,
– সময় হোক মেহনূর আফরিন , যেদিন তোমার সম্মতিটা পাবো সেদিন তোমার মুখটা বুকে চেপে রাখতে দেরি করবো না।
প্রচণ্ড লজ্জায় খিঁচে গেলো মেহনূর। গলার নিচে থাকা মাহতিমের হাতটা দুহাতে খামচে ধরলো তখন। মেহনূরের লজ্জা-করুণ অবস্থাটা টের পেয়ে পেছন থেকে হেসে উঠলো মাহতিম। সেই হাসিতে চোখদুটো ঘুমের জন্য বন্ধ করে ফেললো।
.
দিনের আলো ছড়িয়ে পরলে জেগে উঠলো শহর। নিরব-নিরব রাস্তাগুলো সরব হলো তখন। বাড়ির পরিবেশ জাঁকজমক ভাবে মুখর হয়ে উঠলো, একে-একে সবাই তখন নাস্তার টেবিলে আসতে থাকলো। বাড়ির নতুন বউ হিসেবে আজ মেহনূরের রান্না করার কথা, কিন্তু সেই রেওয়াজে পানি ঢেলে মারজা নিজেই সবকিছু প্রস্তুত করলেন। মেহনূরকে সাজিয়ে-গুছিয়ে পরিপাটি করে নিজের পাশে এনে রাখলেন। মাহতিম যে চালাকি করে ভোর বেলায় উঠেছে, সেই চালাকিটা জায়গামতো ফলিয়ে মেহনূরকে রুমে রেখে এসেছে। মারজা ব্যাপারটা না জানলেও তৌফের খাতিরে বাকি সবাই সেটা জেনে ফেলেছে। মাহদি কাল রাতের কথাটা পেটে চেপে রাখলেও তৌফ কথাটা পেটে রাখেনি, এমন পেট পাতলা ব্যক্তিদের দুচোখে সহ্য করতে পারেনা মাহদি। এখন তো ইচ্ছে করছে তৌফকে কড়া ভাষায় দুটো কথা শোনাতে, ভাইয়ার ব্যাপারে যখন জেনেই গিয়েছো তাহলে সেটা নিয়ে ঢোল পেটানোর মানে কি? মাহদি চুপচাপ কঠোর মুখে শুকনো রুটিতে কামড় দিলো। পাশে বসা ফারিন মাহদির গম্ভীর মুখটা দেখে খটকা মনে সবার অগোচরে বললো,
– কিরে বিট্টু, তোর মুখের এই অবস্থা কেন? সবজি থাকতে ছাগলের মতো খালি রুটি চাবাচ্ছিস কি জন্যে?
মাহদি এতোক্ষন শান্ত ভাবে রুটি চিবাচ্ছিলো, কিন্তু ফারিনের এমন হস্তক্ষেপ ওর মোটেই সহ্য হলো না। মুখটা বিরক্তিতে চুবিয়ে ফারিনের দিকে তাকালো, শুকনো রুটিটায় আরেক কামড় দিয়ে স্থিরদৃষ্টিতে বলতে লাগলো,
– তৌফ ভাইয়া কাজটা ভালো করেনি। গবেটের মতো কাজটা করেছে। সেটার জন্য আমার মুড খারাপ।
মাহদির মুখে বড় বড় ভঙ্গির কথা শুনে অবাক হয়ে তাকালো। চোখের কোটর বড় করে বিষ্ময় সুরে বললো,
– তোর মুখ যে কটকট করে চলে সেটা জানিস? ভাইয়া তো শুধু শুধু তোকে নিয়ে টেনশন করেনা। এইটুকুনি বাচ্চা তুই, যেখানে মুড শব্দটাই স্পেলিং করতে পারবি কিনা সন্দেহ, তার উপর এতো বড় কথা বলিস কিভাবে?
মাহদি এবার তিরিক্ষি মেজাজে তাকালো। হাতের রুটিটায় হিংস্র ভাবে কামড় দিয়ে স্বর নামিয়ে বললো,
– শোনো ফারিন আপু, তৌফ ভাইয়ার উচিত ছিলো চুপ থাকা। ভাইয়া গাধার মতো মাহতিম ভাইয়ার কথাটা তোমাদের জানিয়েছে। সব কথা সবাইকে বলা যায় না। আর তুমি হয়তো ভুলে গিয়েছো আমি ইংলিশ মিডিয়ামের স্টুডেন্ট। তুমি যেই ওয়ার্ডগুলো তুমি এখন চিনছো, সেগুলো আমি বাবু থাকতেই ঠোটস্থ করে ফেলেছি। আমাকে ‘ ছোট ছোট ‘ বলে কাহিনী করো না। নিজের চরকায় ডিজেল দাও।
মাহদি একদমে কথাগুলো শুনিয়ে পুনরায় খাওয়া শুরু করলো। এবার ঠিকই রুটির সাথে সবজি দিয়ে খেলো। হতভম্ব ফারিন দু’কানের মধ্যে যা শুনলো তাতেই স্তব্ধ হয়ে মাহদির দিকে তাকিয়ে আছে। সেই দৃষ্টিতে নির্বাক হয়ে টেবিল থেকে গ্লাস তুলে নিলো, ঢকঢক করে পানি খেতেই পুচকে ছেলের কথাগুলো স্মরন করতে লাগলো। এদিকে মারজার ডান পাশটায় মেহনূর বসে আছে। সবার খাওয়া-দাওয়া এবং আড্ডা পর্ব যতো দ্রুতগতিতে হচ্ছে মেহনূর ততই শান্ত ভাবে চালাচ্ছে। সবাই গপাগপ খেয়ে চললেও মেহনূর একটা রুটি নিয়ে পরে আছে অনেকক্ষন ধরে। মারজা বারবার তাড়া দিচ্ছেন বেশি বেশি খাওয়ার জন্য কিন্তু মেহনূর পারছিলো না। ঠিক তখনই রুম থেকে পরিপাটি হয়ে বেরুলো মাহতিম। কোমরের কাছে ইন করা গ্রে কালারে শার্ট, কালো বেল্টের সাথে কালো প্যান্ট, হাতে ডার্ক ব্রাউন রঙের ঘড়িটা পরতে-পরতে টেবিলের দিকে আসছিলো মাহতিম। মারজা ছেলের জন্য চেয়ার ছেড়ে উঠতে নিলে মাহতিম ইশারায় মা’কে থামিয়ে ফেলে। মারজা ইশারা পেয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে গেলো, দাঁড়ানো অবস্থায় ভ্রু কুঁচকে বললো,
– তুই বাইরে যাচ্ছিস?
মাহতিম টেবিলের কাছে আসতে-আসতেই জবাব দিলো,
– হ্যাঁ।
জবাবের পাটটা চুকাতেই মেহনূরের দিকে তাকালো। কোনো বিশেষ প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে চট করে নীতির দিকে দৃষ্টি ছুঁড়লো। মেহনূরের পাশের সিটটা দখল করার উদ্দেশ্যে নীতিকে ছোট্ট একটা ইঙ্গিত বুঝালো। ভাই-বোনের ইশারাগুলো একটুও বুঝলো না মেহনূর, ওর কিছু বোধগম্য হওয়ার পূর্বেই নীতি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো, হাসিমুখে সাবিরের পাশে চলে গেলো। খালি হওয়ার সাথে-সাথে সিট আয়ত্ত করে ফেললো মাহতিম। টেবিলের উপর থেকে উল্টানো প্লেটটা একহাতে স্বাভাবিক করে রাখতেই অন্য হাতটা রুটির বোলে চালান দিলো। মেহনূরের প্লেটটার দিকে কয়েক সেকেন্ডের জন্য তাকালো মাহতিম, এরপর আর কোনো কথা না বলে সোজা মেহনূরের প্লেটে একটা রুটি রাখলো। প্লেটের উপর রুটির আগমন দেখে তৎক্ষণাৎ শিউরে উঠলো মেহনূর, তাড়াতাড়ি বামে তাকিয়ে মাহতিমের দিকে দৃষ্টি রাখলো। মাহতিম এমন ভঙ্গিতে খেতে শুরু করেছে যেনো সে কিছুই জানে না, কিছুই করেনি। মেহনূর চুপ মেরে তাকিয়ে থাকলেও ইতিমধ্যে হাসিপর্ব শুরু হয়ে গেছে। সিয়াম মুখে পানি নিয়ে বহু কষ্টে হাসি আটকে রেখেছে, যদি বায় চান্স আরেকটা দৃশ্য দেখে ফেলে ওমনেই ছলাৎ-ছলাৎ ঝর্ণার মতো মুখ বর্ষণ করে ফেলবে। সৌভিক হাসি আঁটকাতে না পেরে খুক খুক করে কেশে উঠছে, সেই কাশি থামানোর জন্য পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে তৌফ। তৌফ হাসি আটঁকানোর পলিসি হিসেবে মুখে ইচ্ছামতো রুটি পুড়ে নিয়েছে। আরেকদিকে নীতি তখন ঠোঁট কামড়ে প্লেটের দিকে ঝুঁকে খাচ্ছে। মারজা ব্যাপারটা উপেক্ষার নজরে রাখলেও শেষমেশ মেহনূরের পক্ষ নিয়ে বললো,
– ও যে খেতে পারছে না দেখতে পারছিস? জোর করে যে খাওয়াতে নেই সেটা জানিস না? এক্ষুনি রুটিটা সরা মাহতিম। ওর উপর জুলুম করতে যাবি না।
মায়ের কথাটা ভালোমতো শুনলো মাহতিম, কিন্তু সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ না করে নিজের ভঙ্গিতে বললো,
– একই নৌকার যাত্রী পেয়ে মজাই লাগছে, ঠিক না মা?
মারজা খুব শান্ত ভঙ্গিতে পানি খেতে নিয়েছিলো, কিন্তু ছেলের মুখে খোঁচা শুনে পানি আর গলা দিয়ে নামলো না। দ্রুত গ্লাসটা টেবিলে নামিয়ে জোরে-জোরে কেশে উঠলো মারজা। মেহনূর দ্রুত শ্বাশুড়ির কাশি দেখে পিঠে হাত বুলাতে থাকলো, এদিকে মারজা একটু শান্ত হয়ে মাহতিমের দিকে চোখ রাঙিয়ে বললো,
– তোকে এইসব কথা বলতে না করেছি না? আমাকে দেখলে কোন্ দিক দিয়ে তোর না-খাওয়া লাগে?
মাহতিম মায়ের দিকে তাকিয়ে খেতে-খেতেই বললো,
– খবরদার মা, চুপ কর। তুমি ফ্যাটি হয়ে যাচ্ছো, মোটু হয়ে গেছো, ভূড়ি বেড়ে গেছে এসব হেনতেন কথা যেনো না শুনি। তোমার ওই প্রতিবেশীদের টিটকারি যদি শুনি, তোমার কিন্তু খবর আছে মা। আমি কিন্তু তোমাকে আগেও বলেছি, আবারও বলছি, তুমি যথেষ্ট সিক। তোমার রোগটা কি সেটা তুমি নিজেও জানো। তাই বলে যদি খাওয়া কমিয়ে দিবে, না খেয়ে থাকবে তাহলে সেটাতো চলবে না। আমি ইনকাম করছি তোমাদের জন্য, নিশ্চয়ই বাবা বেঁচে থাকলে এটা সহ্য করতেন না। তাছাড়া ওইসব প্রতিবেশীদের কাছে তোমার না যাওয়াই ভালো, ওদের একটারও মেন্টালিটি আমার পছন্দ হয়নি। এতোদিন তুমি ‘ বউ বউ ‘ করেছো, এখন বউ এনে দিয়েছি, দয়াকরে ওকে নিয়ে সময় কাটাও। শেষ কথা এটাই বলবো, যদি সুন্দরের কথা বলতে হয়, তুমি যেমনি হও আমার চোখে তুমি মেহনূরের চেয়েও সুন্দর। গলা বাজিয়ে যদি বলা লাগে তাও আমি স্বীকার করবো, আমার মা, মারজা বিনতে ফেরদৌসী যথেষ্ট সুন্দরী।
মাহতিম কাটকাট সুরে কথাগুলো বলে খাওয়ার দিকে পূর্ণ মনোযোগ দিলো। যেই মিচকি-মিচকি হাসির রোল চলছিলো, এখন সেটা পিনপতন নিরবতায় ছেয়ে গেছে। মাহতিমের ঠাঁট ধ্বনি শুনে সবাই নির্বাক-হতবাক হয়ে আছে। সবচেয়ে বেশি আশ্চর্য হয়ে আছে মেহনূর। এই অসভ্য উপাধি পাওয়া লোকটার ভেতর নতুন রূপ দেখে আশ্চর্য হওয়া ছাড়া উপায় নেই। এতোদিন যাকে মায়ের সাথে ঠাট্টা-মষ্কারি করতে দেখা যেতো, আজ হঠাৎ করে তার মধ্যে জেদের বিষ্ফোরণও দেখা গেলো। সবাই চুপচাপ চোখ নামিয়ে ফেললো। মেহনূর ওভাবে ড্যাবড্যাবে তাকিয়ে থাকলে কয়েক মূহুর্ত্তের জন্য খাওয়া থামালো মাহতিম। মেহনূরের দিকে তাকানোর পূর্বে সবার দিকে একপলক তাকিয়ে নিলো, সবাইকে নিজ-নিজ কাজে ব্যস্ত দেখে এবার মেহনূরের দিকে তাকালো। গলার স্বরটা যথাসম্ভব নিচু করে জোর খাটিয়ে বললো,
– যদি প্লেটের খাবার শেষ না দেখি তোমাকে আমি ছাড়বো না।
মাহতিমের কথা ও চেহারার অবস্থা দেখে ভীত হলো মেহনূর। সরল চাহনিজুড়ে সঙ্গে-সঙ্গেৎ ভয়ের বিস্তার হলো। মেহনূরকে ইচ্ছে করে ভয় দেখানোর জন্যে মাহতিম কড়া দৃষ্টিতে তাকালো। গলার দিকে তাকিয়ে পুনরায় চোখে-চোখ রেখে বললো,
– গলায় কি যেনো করেছিলাম মনে আছে?
বলতে দেরি, ওমনেই গলার সেই কামড়জনিত জায়গাটায় হাত রাখলো মেহনূর। এবার মারাত্মক ভয়ে জবুথবু হয়ে মাহতিমের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। মাহতিম আর বাক্য উচ্চারণ না করে টেবিল ছেড়ে উঠে গেলো। যাওয়ার পূর্বে নীতির কাছে গিয়ে কিছু বলেও আসলো। নিরুপায় মেহনূর সম্পূর্ণ বিষয়টা তখন ধরতে পারলো যখন সবাই খাওয়া শেষ করে চলে গেছে, কিন্তু নীতি তখনও মেহনূরের দিকে নজরদারি করার জন্য বসে আছে। মাহতিম জিপের চাবি তর্জনী আঙ্গুলে ঘুরাতে-ঘুরাতে চোখের সামনে দিয়ে চলে গেলো, কিন্তু মেহনূরকে আর উঠে যেতে বললো না।
.
ঠিক সন্ধ্যায় সময় চলছে। পাখ-পাখালির কলরবে ছাদের জায়গাটা রোমান্ঞ্চকর লাগছে। বাতাসও বইছে ঠান্ডা-ঠান্ডা, মনের উঠোনে মৃদ্যু-মৃদ্যু অনুভূতি জাগানোর মতো শীতল মূহুর্ত এখন। মেহনূর কালো শাড়িটার আঁচল টেনে পিঠ ঢেকে নিলো। লম্বা চুলগুলো এখন আর খোলা নেই, মারজার নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় সেগুলো এখন বেণীর আদলে রূপ নিয়েছে। মেহনূর ছাদে দাঁড়িয়ে দূরের বিল্ডিংগুলো দেখছিলো, নিবিষ্ট মনে ভাবছিলো এতোদিনের মূহুর্ত্তগুলো। চোখ বন্ধ করলেই এখন একটা মানুষের চেহারা ভাসে, বিভিন্ন সময়ে তার বিভিন্ন রূপের ধারণাতীত দেখা মিলেছে। তার সাথে জীবনের প্রতিটি স্তুর মিলাতে এখনো যেনো সময় লাগবে, সেই সময়টা কবে আসবে তার জন্য দৃঢ় প্রতীক্ষায় আছে মেহনূর। উপন্যাসের পাতায় পড়েছিলো, প্রিয়তম মানুষটাকে দেখার জন্য, ছোঁয়ার জন্য বুকের ভেতর যে ছটফটানি হয়, যে যন্ত্রণা হয়, তাকে একটাবার দেখার জন্য যে বিষাদময় কষ্ট, ঠিক কতটা দহনে দগ্ধ হয় অন্দর, ঠিক কতটা মরিয়া হলে মানুষটার জন্য অম্লান বদনে সিক্ত হয় হৃদয়, এসব অনুভূতি ব্যক্ত করা যায় না কখনো। যেদিন শিরায়-শিরায় প্রবাহ হবে অনুভূতির জোয়ার, সেদিনটা হবে অনুভূতির দিন, আকাঙ্ক্ষার দিন, অন্তরে-অন্তর প্রকাশের দিন। সে দিন কি কালিক পরিবর্তন হলেও স্মৃতির পাতায় রক্ষিত থাকবে আমৃত্যু অবধি। মেহনূর চোখ বন্ধ করে রেলিংয়ের দিকে মুখ করেছিলো, আশেপাশের কোনো পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে পারলো না, বুঝতে পারলো না, টেরও পেলো না মাহতিম একটু আগে বাসায় ফিরে এসেছে। মেহনূর বড় একটা নিশ্বাস ছেড়ে চোখ খুলে তাকালো, তখনই ওর মনে হলো কাল ২২ তারিখ। তারিখটার কথা মনে পড়ার পর যেই মনটা এতোক্ষন ভালো লাগায় আচ্ছন্ন ছিলো, সেই মনটা এখন অদ্ভুতভাবে কুঁকড়ে যাচ্ছে। কেনো যাচ্ছে জানা নেই। শুধু মনে হচ্ছিলো, রাতের অন্ধকারে যখন শক্ত অবলম্বন খুঁজবে হয়তো সেই অন্ধকারে কাউকে খুজেঁ পাবে না।
– মন খারাপ?
কথা-কন্ঠ-সুর শুনে চমকে উঠলো মেহনূর। ওমনেই রেলিং থেকে দৃষ্টি সরিয়ে পিছু ফিরে তাকালো। পকেটে দুহাত গুঁজে উত্তরের জন্য তাকিয়ে আছে মাহতিম। গায়ে নেভি ব্লু রঙের টিশার্ট পরা। বুকের কাছে ইংরেজি বর্ণে সাদা কালিতে লিখা
বুকের কাছে ইংরেজি বর্ণে সাদা কালিতে লিখা, ‘ GUCCI ‘. মেহনূর লেখাটা থেকে চোখ সরিয়ে সরল গলায় বললো,
– আপনি কখন এসেছেন? আপনাকে যে আসতে দেখিনি।
মাহতিম ঠোঁটে হাসি এনে মেহনূরের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। রাতের আধারে ছেয়ে যাওয়া আকাশে দৃষ্টি রেখে বললো,
– যেখানে দাড়িয়ে আছো সেখান থেকে সবার আসা-যাওয়া দেখতে পাওয়ার কথা। অথচ তুমি আমায় দেখোনি।
মাহতিমের কথা শুনে বিমূঢ় হয়ে গেলো মেহনূর। এটা সত্য যে ছাদ থেকে নিচের সবকিছু দেখা যায়, কিন্তু এটাও সত্য যে মাহতিমকে নিয়েই বিভোর ছিলো সে। মাহতিম তখন উত্তরের অপেক্ষা না করে পকেট থেকে ডানহাতটা বের করলো। সেটা রেলিংয়ের উপর রেখে মেহনূরের দিকে এগিয়ে দিলো। মেহনূর মুখ থেকে দৃষ্টি নামিয়ে রেলিংয়ের দিকে তাকাতেই কপাল কুঁচকে ফেললো। মেহনূরের কৌতুহলী মুখটা দেখে ওর দিকে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
– আমার রুমের চাবি। এটা তোমার কাছে রেখে দিও। কাল তো চলে যাচ্ছি, সম্ভবত ছয় মাসের ভেতর ফিরবো না। যদি ইচ্ছে হয় রুমে যেও, নয়তো তালাবন্দি করে দিও।
কথাগুলো শেষ করে চলে গেলো মাহতিম। পিছু ফিরে তাকিয়েও দেখলো না তার কথাগুলো শোনার পর আর স্বাভাবিক থাকতে নেই মেহনূর। যে চাহনি দিয়ে চাবির দিকে তাকিয়ে ছিলো সেই চাহনি ঝাপসা হয়ে অশ্রু ঝরছে। মেহনূর শব্দ আঁটকানোর জন্য ঠোঁট কামড়ে ফেললো, চোখের করুণ অবস্থা ঢাকার জন্য আচঁলটা দুচোখে চেপে ধরলো। আচঁলটা আর শুকনো রইলো না। মাহতিম ভোরের জন্য মাত্র লাগেজ ধরেছে, তখনই রুমে হাঁপাতে হাঁপাতে প্রবেশ করলো মাহদি। একদৌড়ে রুমে ঢুকে মাহতিমের হাতটা টাইট করে ধরলো, হাঁপানোর সুরেই টানতে-টানতে বললো,
– তুমি আমার বউকে কি বলেছো? ওকে তাড়াতাড়ি থামাও ভাইয়া! মা দেখতে পেলে খুব ঝামেলা করবে, তুমি প্লিজ তাড়াতাড়ি এসো। তাড়াতাড়ি চলো! দেরি করো না ভাইয়া, মা জানলে প্রচুর কাহিনী করবে!
মাহতিম তখন কিছুই বুঝতে পারলো না। এমন একটা পরিস্থিতিতে পরলো, তখন মাহদিকে জেরা করার মতো সুযোগ পেলো না। যেই লাগেজটা মনোযোগের সাথে রেডি করছিলো সেটা ওভাবেই ফেলে রেখে ছাদের দিকে দৌড় লাগালো। পিছু-পিছু দৌড় লাগালো মাহদিও, কিন্তু সে ছাদে আর ঢুকলো না। চুপচাপ হাসি দিয়ে ছাদের দরজাটা বাইরে থেকে লাগিয়ে দিলো। হাতদুটো ময়লা ঝাড়ার মতো ঝেড়ে থ্রি-কোয়াটার প্যান্টের দু’পকেটে হাত গুঁজে দিলো। ঠোঁটটা গোল করে বেসুরো ধ্বনিতে শিষ বাজাতে-বাজাতে নিচে নামতে লাগলো।
– চলবে
#FABIYAH_MOMO .
( #নোটবার্তা : আমার পরীক্ষা এখনো চল মান। তাই সবার কাছে বিশেষ বিশেষ দুয়া চাচ্ছি। আজকের পর্বটা বেশ খাপছাড়া হয়ে গিয়েছে, তার জন্য আন্তরিক মনে ক্ষমা চাচ্ছি। তবে সবার প্রতিক্রিয়ার জন্য সত্যিই আমি অপেক্ষায় রইলাম। )
মন বাড়িয়ে ছুঁই গল্পের লিংক kobitor (all part)