#ফাবিয়াহ্_মমো .
অংশ সংখ্যা ০১.
আবহাত্তয়ার পৈশাচিক চিৎকারে বারবার দালান শুদ্ধো কেঁপে উঠছে। কানে হাত চাপা দেওয়ার মতো বিকট শব্দ হচ্ছে। একটু পরপর হুঙ্কার দিচ্ছে জোরালেভাবে, তীব্র সুরে, ভয়ঙ্কর কাঁপুনিতে। প্রকৃতির এমন বিধ্বংসী রূপ দেখে মারজার মনটা কেনো যেনো কু ডেকে উঠলো। তিনি কোনোভাবেই শান্ত থাকতে পারলেন না, এরই মধ্যে ছুটে এসেছে মেহনূর। সদর দরজায় দাঁড়িয়ে অনুমতির জন্য শ্বাশুড়ির দিকে তাকিয়ে আছে, দৌঁড়ে আসাতে সামান্য হাঁপাচ্ছে সে। বিছানায় জবুথবু হয়ে বসেছিলো মারজা, দরজায় হাঁপাতে থাকা মেহনূরের ক্লান্ত মুখ দেখে মায়াসূচকে হাসি দিলেন। মাথাটা একটুখানি ‘ হ্যাঁ ‘ সূচকে দুলিয়ে ভেতরে আসার ইশারা দিলেন, মেহনূর ঠোঁট প্রসার করে হাসি দিতেই ধীরপায়ে বিছানার কাছে এগিয়ে গেলো। মারজা মুগ্ধ হয়ে তার বউমার দিকে তাকিয়ে রইলেন, আপাদমস্তক পুলকিত ভঙ্গিতে তাকিয়ে দেখলেন। মেহনূরের একটা হাত টেনে নিয়ে তার পাশে বসালেন মারজা। শ্বাশুড়ির সৌহে কিছুক্ষণ কাটানোর জন্য মেহনূর পা তুলে মারজার মতোই বিছানায় আসন করে বসলো। মারজার চোখের দিকে তাকাতেই তাঁকে প্রচণ্ড বিমর্ষ এবং বিষণ্ণ দেখালো, কেনো এই বিষণ্ণতা সেটা বুঝার জন্য গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেহনূর। অবচেতন মন কেনো জানি বলছে, কিছু তো অঘটন ঘটতে যাচ্ছে। সেটার ফল যে কোনোভাবে সুমিষ্ট, শুভ হবে না সেটা পুরোপুরি নিশ্চিত। মারজা শুষ্ক ঠোঁটে জিভ বুলিয়ে ইতস্তত ভঙ্গিতে বলতে লাগলেন,
– তোকে অসময়ে বিরক্ত করছি মা। একা থাকি তো, কথা বলার মানুষ না পেলে খারাপ লাগে। তুই কিছু মনে করিসনি তো? রাগ করেছিস?
দ্রুত শ্বাশুড়িকে বিচিত্র চিন্তা থেকে ইস্তফা দেওয়ার জন্য তাঁর হাতদুটো ধরলো মেহনূর। রেশমী চুড়ির রিনরিন শব্দটা মৃদ্যুতালে হতেই মারজার হাতদুটো মেহনূরের মুঠোয় ভরসা পেলো। মেহনূর সদাসর্বদার মতোই নিচু গলায় শান্তভঙ্গিতে বললো,
– আমাকে এসব বলে কষ্ট দিবেন না মা। আপনার উপর কেনো রাগ করবো? আমারই ভুল হয়েছে। আপনি যে একা আছেন সেটা ভুলে গিয়ে উনার রুমে বসে ছিলাম। আমাকে মাফ করুন।
মারজা সঙ্গে-সঙ্গে জিভ কেটে ভ্রুঁ কুঁচকে তাকালেন। একটা হাত মুক্ত করে মেহনূরের দিকে মারের ভঙ্গিতে শূন্যে উঠালেন। খানিকটা রাগ দেখিয়ে বললেন,
– খালি ‘ মাফ করুন, মাফ করুন ‘ বলতে থাকিস। ভুল হলেও বলিস ‘ মাফ করুন ‘, নাহলেও বলিস ‘ মাফ করুন ‘। বাবামশাইকে এ ব্যাপারে বিচার লাগাবো? কানটা মুচড়ে দেবো?
এমন প্রসঙ্গ শোনার পর মেহনূরের জায়গায় যদি অন্য কেউ হতো তাহলে হো-হো করে রুম কাঁপিয়ে হেসে দিতো, হাসতে-হাসতে লুটোপুটি খেতেও কার্পণ্য করতো না। কিন্তু এসবের কিছুই না করে মেহনূর কিয়দংশ পরিমাণে হেসে দিয়ে আবারও নিচু গলায় বললো,
– দাদাভাইকে বলতে না হবে মা। আমি খেয়াল রাখবো।
মারজা তবুও আদুরে ভঙ্গির রাগটা কায়েম রাখলেন, চোখের উপরে থাকা ভ্রুঁদুটো কুঁচকে রেখেই গম্ভীর হওয়ার চেষ্টা করলেন, কিন্তু রীতিমতো তিনি ব্যর্থ। মেহনূর ফের হেসে দেওয়ার চিন্তা করতেই আকস্মিকভাবে এমন অবস্থা হলো সে আর হাসতে পারলো না। ওইসময় দারুণ শব্দ করে রূহ কাঁপিয়ে প্রচণ্ড হুঙ্কারে বাজ পরলো। মেহনূর অকস্মাৎ এমন শব্দ শুনে এতোটাই আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে যায়, সে দিশেহারা পথিকের মতো ভয় পেয়ে মারজার দেহটায় তৎক্ষণাৎ ঝাঁপিয়ে পরলো। মারজার কাধে থুতনি রেখে চোখদুটো খিঁচুনি দিয়ে বন্ধ করলো। আর কোনো হুঁশজ্ঞান নেই মেহনূরের, ভয়ের চোটে শুধু মারজাকে কঠিনভাবে আঁকড়ে ধরে আছে। পিঠে হাতের স্পর্শ লাগিয়ে শান্ত হতে বললেন মারজা। ‘ কিচ্ছু হয়নি, এটুকু শব্দে কেউ ভয় পায়? ‘ বলেই তিনি মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকলেন। ভয়ের মাত্রাটা একটু কেটে গেলে বুক ধড়ফড় করা অবস্থায় চোখ খুললো মেহনূর, মারজাকে ছেড়ে দিতে-দিতেই জানালার বাইরে উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
– এমন ঝড়ো অবস্থা দেখলে ভয় পাই মা। এমন অবস্থা দেখলে শুধু সমুদ্রের উত্থাল-পাত্থাল অবস্থার কথা মনে হয়। দাদাভাই সমুদ্র দেখতে গিয়ে যেই ঝড়ের মুখোমুখি হয়েছিলেন এখনো সেই গল্প তিনি শুনান। গা ছমছম করে উঠে ওই গল্প শুনলে। আমি এমন দিনে একা থাকতে পারিনা। সবসময় বুবু বা মা আমার কাছে থাকতো।
মেহনূরের উদ্বিগ্ন দৃষ্টি লক্ষ্য করে মারজাও জানালার বাইরে দৃষ্টি দিলেন। আকাশের ফেঁটে যাওয়া দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে হালকা স্বরে বললেন,
– সমুদ্রের কথা যদি জানতে চাস, সেটা তোর স্বামী এলেই শুনে নিস। এসব ব্যাপারে ও-ই ভালো খবর দিতে পারবে।
ইঙ্গিতটা মাহতিমের দিকে নির্দেশ করলে মারজার দিকে চকিত ভঙ্গিতে তাকালো মেহনূর। মারজা তখনও আকাশের দিকে মন ভোলানো দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। মেহনূর বিষয়টা পরিষ্কার ভাবে বোঝার জন্য কৌতুহল গলায় প্রশ্ন করলো,
– আমি আপনার কথা বুঝিনি মা। ঝড়ের সাথে উনার কি সম্পর্ক?
মারজা একই অবস্থাতে স্থির রইলেন, জানালা থেকে দৃষ্টি না সরিয়ে হাসিসূচকে বললেন,
– ঝড়ের কাছে হার মানলে সাক্ষাৎ মৃতুর দর্শন। একটু যদি এদিক-সেদিক করে তাহলে মনে কর্ মাহতিম আর ফিরবে না। তবে এখনো এই কাজে আছে কিনা জানিনা। মাহতিম সবসময় বলে, প্রাকৃতিক দূর্যোগ যতোটা সহজে মোকাবিলা করা যায়, মানুষের ধূর্ত চাল মোকাবিলা ততটাই কঠিন। প্রকৃতির হালচাল দ্রুত ধরা যায়, মানুষেরটা ধরা যায় না।
মারজা হুট করে চাপা ব্যথার মতো শ্বাস ছাড়লেন। জানালার বাইরে দৃষ্টিলব্ধ চোখদুটো চট করে বন্ধ করলেন। মেহনূর আনমনে আকাশের দিকে তাকালো। বড় বড় চোখদুটো অজানা ব্যথায় কাতর হয়ে আছে। পুরো মুখটাই স্বহাস্য রূপ পালটে মলিন অবস্থা ধারণ করেছে। বুকের ভেতরটা টাইফুনের মতো হুলস্থুল করছে, অসহ্য অপরাধে মুষড়ে আসছে সরল-কোমল মনটা। মাহতিম তো ওর জন্যই গাড়ি ঘুরিয়ে এসেছিলো। হাতে সময় নেই জেনেও সে বিদায় জানাতে দেরি করেনি। মাহদির ছোট্ট একটা কল শুনেই মেহনূরকে বিদায় জানাতে ছুটে আসে মাহতিম। সেই মানুষটা মেহনূরের কঠিন-কঠিন কথা শুনে নিশ্চয়ই অভিমান করেছে, রেগে গেছে। ক্ষোভে হয়তো মনের মধ্যেই বিক্ষোভ করে বেড়াচ্ছে, সে প্রকাশ করছে না কিছুই। হঠাৎ ভাবনার রাজ্যে ছেদন করে হাসি দিয়ে বললেন মারজা,
– আগে এই বাড়িটা এমন খাঁ খাঁ করতো না। বাপ-বেটা দুজন মিলে পুরো বাড়ি মাতিয়ে রাখতো। দুটো মানুষ দুশো মানুষের সমান হৈ-হুল্লোড় করতো। ওর বাবা ছুটি কাটাতে এলেই মাহতিম আর স্থির থাকতে পারতো না, সোজা বাবার কাধে চড়ে ফূর্তি করতো। আমাকে কতোভাবে যে জ্বালিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই রে মা। একবার কলেজে থাকাকালীন কি করেছে শোন। মাহতিম তখন বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আবদুর রউফে পড়তো। বাসা থেকে ওর কলেজ দূর বলে ওর বাবা কর্তৃপক্ষকে বলে-টলে থাকার ব্যবস্থা করে দেয়। ঈদের ছুটি পেয়ে ও বাড়িতে আসে, এসেই বাপের সাথে এক সপ্তাহ বন্দুকের টিপ শিখলো। ওইযে শিখলো, মনে কর্ আমাকে ছাড়েনা। আপেল,পেয়ারা, তরমুজ যেটাই পায় সেটাই আমার মাথায় রেখে টার্গেট করে। আমিতো ভয়ে শেষ! এদিকে ওর বাপও কম ইতর ছিলো না। আগেরদিন রাতে কি নিয়ে যেনো মন খারাপ করেছিলাম সেটার শোধ তুলতে গিয়ে মাহতিমকে আরো লেলিয়ে দেয়। এইযে আমি বুঝাচ্ছি, ‘ থাম বাবা, আমি মরে যাবো, তোর নিশানা ভুল হলেই আমাকে আর পাবি না। ‘ এদিকে কে শোনে কার কথা? বদমাইশটা সত্যি-সত্যিই আমার দিকে ওর বাবার বন্দুক তাক করলো, ট্রিগারে আঙ্গুল রেখে নিশান ঠিক করলো। আমিও আজীবনের জন্য তওবা করে একনিশ্বাসে ‘ লা ইলাহা ইলাল্লাহু, আল্লাহ মাফ করো। ‘ বলে ফেললাম। এরপর বিশ্বাস কর্, আমার কলিজাটা স্বাভাবিক হতে প্রায় আধা ঘন্টা লেগেছে, এমন ভয়ঙ্কর শব্দ! বাড়ির সবক’টা চাকর কানে আঙ্গুল ঢুকিয়ে খিঁচে আছে। আরেকটু যদি অস্থির হতাম তাহলে হার্ট এ্যাটাক করে সেদিনই ম’রতাম। এরপর থেকে ওর বাবার মুখে একটা কথা খুব গর্ব করে বলতে শুনতাম। তার ছেলে নাকি তার সাথে ভালোই পাল্লা দিতে পারে। পুরো ট্রেনিং সেন্টারে নাকি ওর মতো চতুর বন্দুকবাজ কেউ ছিলো না। মাথার খুলি নাকি এমনভাবেই উড়াতে পারতো, বাস্তবে নাকি সেটাও এক বীভৎস দৃশ্য। সেটা হাতে গুণে দশের মধ্যে একজন করতে পারে। এখনো ওর টিপ নিয়ে ওর বাবার কলিগরা প্রশংসা করে। আজ যদি ওর বাবা বেঁচে থাকতো, তাহলে হয়তো জানতে পারতো আজ সেই হাসিখুশি ছেলেটা খুব উচ্চপদে চলে গেছে। সে দেখেও যেতে পারেনি মেহনূর, আমার জীবনে এটা সবচেয়ে বড় আফসোস। যেই ছেলেকে উনি কাছেপিঠে মানুষ করলেন, ছেলে আজ বাপকেও ছাড়িয়ে গেছে, অথচ বাপ তার একবিন্দু দেখতে পারলোনা। জানিস….
মারজার কথা আর শুনতে পেলো না মেহনূর। জানালার দিকে মুখ করে ক্রমাগত বলেই যাচ্ছিলেন মারজা, তিনি আর বউয়ের দিকে খেয়াল দিতে পারলেন না। ঠোঁটদুটো ফাঁক করে নিশ্বাস ছাড়ছিলো মেহনূর, ওই অবস্থাতেই চোখদুটো বন্ধ করে মাথা নিচু করলো। মাহতিমের কথা শুনলে এখন প্রচণ্ড অস্থির লাগে, মন আনচান হয়, মানসিক অবস্থা প্রকটরূপে বেচইন হয়ে উঠে। কোলে রাখা হাতটা আচঁলের কাপড়টুকু কঠিনভাবে খামচে ধরলো, ওমনেই কয়েক মিনিটের মধ্যে একটার-পর-একটা স্মৃতির পৃষ্ঠা উলটাতে লাগলো মেহনূর। কালো শার্টপ্যান্ট পরা সাহেবী বেশভূষার লোক, যার মেজাজটা অস্বাভাবিক খারাপ ছিলো, বাড়িতে অতিথি হিসেবে পরিবার নিয়ে ঢুকলো, সবাই তাদের নিয়ে ব্যস্ত হলো, সুরাইয়া তাকে নিয়ে কুমতলব ঠাওরাতে লাগলো, গোসল শেষে পেটের কাছে কুচিগুলো ঠিক করছিলো মেহনূর, আয়নায় তাকাতেই কোনো পুরুষের সামনে ওমন অপ্রত্যাশিত দর্শন, ভয়ে-আতঙ্কে জ্বরে ভুগে সে, পরদিন সকালে দাদাভাইয়ের লাইব্রেরীতে আবারও লোমহর্ষক ভঙ্গিতে সাক্ষাৎ হয়, শেল্ফের সাথে ধাক্কা খেয়ে কোমরে সূচালো তারকাটা বিদ্ধ হয়। গাঢ় করে ক্ষত হয় জায়গাটা, গলগল করে রক্ত পরতে থাকে। সেই কাটা জায়গায় ওই মানুষটার প্রথম স্পর্শ টের পায় মেহনূর। সুদেহী মানুষটা নিজের বাহুদ্বয়ের মধ্যে প্রথমবারের মতো কোলে তুলে, একদিন রাতে কিসের শোধবোধ করার জন্য তার হাতটা টেনে গাঢ় করে চুমু খায়। জঙ্গলে ছ্যাঙ্গাজাতীয় কীট থেকে রক্ষা, শেফালী মেজোমার অত্যাচার থেকে বাঁচানো, সুরাইয়াকে ঠান্ডা মস্তিষ্কে মোকাবিলা করা, সবই যেনো তার অনন্য ঘটনার অংশ। মেহনূর চোখ বন্ধ করেই রাখলো, পাঁচ আঙ্গুলের ফাঁকে-ফাঁকে কোলে থাকা আচঁলটা আরো দলা পাকাতে থাকলো, স্মৃতির পৃষ্ঠা যতো সামনের দিকে উলটাচ্ছে বুকের ভেতরটা অশান্ত ঝড়ের মতো ধড়াস-ধড়াস করে উঠছে। ভাগ্য যেনো টেনে-হিঁচড়ে বারবার তার সামনে দাঁড় করাতে ব্যস্ত। তরুণের কাছ থেকে ধাওয়া খেয়ে আবারও সেই মানুষটার মুখোমুখি! ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত-ভঙ্গুর দেহটা আবারও তার বলপূর্ণ হাতদুটোর মাঝে স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লো। কেনো এই স্বস্তি, কেনো এমন শঙ্কাহীন, মন যেনো এসবের উত্তর বানাতে ত্রস্ত। এবার রেসোর্টের নিরব পরিবেশে শুধু মুখোমুখি নয়, অদৃশ্য কোনো বন্ধন যেনো সংষর্ষ লাগাতে ব্যস্ত। সেই পড়ন্ত বিকেলটা সন্ধ্যার সাজে পসরা সাজিয়েছিলো, আবারও কালো পোশাকে তার আর্কষণীয় ব্যক্তিত্বটা চোখ ধাঁধিয়ে দিলো। রোমন্থন করা মূহুর্তগুলো তার ঠোঁটের হাসি দিয়ে সিক্ত করছিলো তখন, গিটারের তারে আঙ্গুলের অগ্রভাগ সুরের মূর্ছনায় ডুবে ছিলো সন্ধ্যাটা। বাতাসে তালে-তালে কোমল ধ্বনি উঠেছিলো, ‘ তাকে অল্প কাছে ডাকছি, আর আগলে-আগলে রাখছি, অল্পেই হারাচ্ছি আবার। ‘ তার চোখের হাসি-হাসি দৃষ্টি জুড়ে শুধু মেহনূর ছিলো, ঠোঁটের প্রাণখোলা হাসিটা তার সান্নিধ্য পেয়ে আশেপাশের কোনো বাধ মানেনি। গিটারের তারে আঙ্গুল কাটলেও মেহনূরের উপর থেকে দৃষ্টি সরায়নি। সেই রাতে যখন জঘন্য ঘটনা…. আর ভাবতে পারলো না মেহনূর। বন্ধ চোখের দু’কোল থেকে তরল ফোঁটা গড়াতে লাগলো, খামচে ধরা হাতের উপর টপটপ করে পরতে থাকলো, মারজার দিকে দৃষ্টি তুলে ভেজা কন্ঠে বলতে ইচ্ছে করলো,
– মা আমার খারাপ লাগছে। আমার খুব খারাপ লাগছে।
ইচ্ছাটা কাগজের মোয়ার মতো গুটিয়ে গেলো। মারজাকে একটুও মুখ ফুটে বলতে পারলো না। মারজা তখনও অন্যমনষ্ক ভঙ্গিতে অতীতে দিনগুলো বলেই যাচ্ছেন, মেহনূরের দিকে অজান্তেই বেখেয়ালী হয়ে গেছেন। মেহনূর তাড়াতাড়ি চোখের সিক্ততা ঢাকার জন্য মাথা আরো নিচু করলো, দলা পাকানো আচঁলটা চোখে তুলে দ্রুতগতিতে চোখজোড়ার অবস্থা শুষ্ক করলো। আকাশের কারসাজি যেনো থামার ইচ্ছাতে ছিলো না, হুঙ্কারে দ্বিগ্বিদিক ফেটে পরছিলো তখন। এমনই সময় খবর এলো বাড়িতে অতিথি এসেছে। কে এসেছে সেটা জানার জন্য মারজা প্রশ্ন ছুড়লে, তড়িৎগতিতে উত্তর পায় রজনী ভাবীর ভাতিজি। চাপা আক্রোশে মারজার স্বাচ্ছন্দ্য মুখটা আকাশের মতোই কালো হয়ে যায়, হাসিটা কোথায় মিলিয়ে যায় সেটা খোঁজা মুশকিল। মারজার দেহটা বিছানা থেকে নামাতে ইচ্ছে করছিলো না, তবুও মনের উপর বেহিসেব ভর জুগিয়ে স্বাগত জানাতে নামলেন । মেহনূরকে কি উত্তর দিবেন এটা নিয়ে আপাতত মাথাব্যথা নেই। মেহনূর অন্যান্য মেয়েদের মতো পরিস্থিতির মারপ্যাঁচ ধরতে পারবেনা। একদিক দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে তিনি মেহনূরকে পরিচয় করানোর জন্য সেদিকে নিয়ে গেলেন। মেহনূরও আগত মেহমানের প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করে শ্বাশুড়ির সাথেই পা বাড়ালো। প্রশস্ত ড্রয়িংরুমের আভিজাত্য সোফার দিকে দৃষ্টি আঁটকালো মেহনূরের, শ্বাশুড়ির পিছু-পিছু পা বাড়িয়ে এগুতে থাকলে ‘ ভাতিজি ‘ বলা মেয়েটার উপর আশ্চর্য হয়ে তাকালো। মেয়েটার পড়নে এ কি ধরনের পোশাক? শার্ট রঙের টপ পরেছে মেয়েটা। টপসের কাধদুটো নেই, হাতদুটোও খালি। বুক থেকে পেট পযর্ন্ত ঢাকা ওইটুকু পোশাক কি করে শালীন পোশাক হতে পারে? টপের উপর পাতলা ফিনফিন ধরনের কটি পরেছে। ওই কটি পোশাকটা পরা যা, না পরাও তা। কালো রঙের জিন্স পরা, দামী ব্রান্ডের হিল বুট দেখা যাচ্ছে। পায়ের উপর পা তুলে বাঁ পা-টা ক্রমাগত নাচাচ্ছে। মেয়েটার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই সে ফোন টেপা বাদ দিয়ে মুখ তুলে তাকালো। মারজার দিকে চোখ পরতেই দ্রুত উঠে দাঁড়ালো, অনেকটা আমোদিত ভাবসাব দেখিয়ে মারজার সাথে কুশল বিনিময় করলো। মারজা এবার পরিচয় করাতে মেয়েটার হাত ধরে মেহনূরের মুখোমুখি করালো। মেহনূর সহজ চাহনিতে মেয়েটার দিকে তাকালেও মেয়েটার চাহনিতে বিষভরা ক্রোধ ছিলো। মেহনূরের দিকে তাকিয়ে মারজা প্রস্তুত গলায় বললেন,
– মেহনূর এই দ্যাখ, ও হচ্ছে রজনী ভাবীর একমাত্র ভাতিজি। আগে তো আমাদের বাসাতেই থাকতো, এখন অবশ্য বিদেশ থাকে। ওর বাবা খুব ভালো মানুষ, একদিন উনার সাথেও দেখা করাবো।
মারজার পরিচয় পর্ব শেষ হতেই মেয়েটা নিজ উদ্যোগে হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত এগিয়ে দিলো, কৃত্রিম হাসি দিয়ে বললো,
– কেমন আছো মেহনূর? আমি অনামিকা। ছোট করে অনা ডাকলেই হবে। তুমিতো দেখছি আমায় জুনিয়র। নেভার মাইন্ড, কিসে পড়াশোনা করছো এবার?
মেহনূর ছোট্ট একটা ঢোক গিলে ডানহাতটা বাড়িয়ে বললো,
– মাধ্যমিক।
অবাকে হা করে তাকালো অনামিকা। মেহনূরের হাতটা আর হ্যান্ডেশেকের জন্য ধরলো না। আশ্চর্য মুখভঙ্গি নিয়ে চট করে মারজার দিকে তাকালো, বিষ্ময়াভূত দৃষ্টি দিয়ে তাকাতেই মেহনূরের দিকে তর্জনী তাক করে বললো,
– ওকে বিয়ে করেছে? সত্যি? আমি কি কানে ঠিক শুনছি মারু আন্টি?
মারজা এমন প্রশ্ন শুনে বিপাকে পরলেন। অপ্রস্তুত হাসি দিয়ে একবার অনামিকার দিকে তাকালেন, আরেকবার থতমত দৃষ্টিতে মেহনূরের দিকে তাকালেন। মেহনূর ইতিমধ্যে তার দিকে প্রশ্নসূচকে তাকিয়ে আছে। মারজা চটজলদি পরিস্থিতিটা অনুকূল করার জন্য প্রসন্ন হাসি দিয়ে বললেন,
– মাহতিমের ব্যক্তিগত পছন্দের উপর আমি কখনো বাধা দেইনি। তাছাড়া ও আমার দূর সম্পর্কীয় ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের নাতনী। এবার যখন ওদের বাড়িতে দীর্ঘদিনের ছুটিতে গেলাম, তখন ওকে ভালো লাগে। তাই ওদের দুছনকে সেখানেই বিয়ে করিয়ে দেই।
অনামিকা উত্তর শুনে জোরপূর্বক হাসি দিয়ে আঙ্গুল নামিয়ে নিলো। মারজা সামনে না থাকলে আসলেই মেহনূরকে কঠিন কিছু বলে ফেলতো! মিথ্যা অভিনয় চলমান রেখে দুজনের সাথেই ভালো ব্যবহার করলো অনামিকা। এর মধ্যে মারজার গুরুত্বপূর্ণ কল আসলে মারজা সেদিকে ছুটে যায়, সুযোগ বুঝে মেহনূরের কাছে ফলের জুস খাওয়ার বায়না করে সে। মেহনূর অতিথি আপ্যয়নের জন্য রান্নাঘরের দিকে যেতে থাকলে ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে অনামিকা। চোখদুটো দুষ্কর্ম করার জন্য যেনো জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। জিন্সের ডান পকেটে হাত ঢুকিয়ে ফোন বের করে, কিছু একটা টাইপ করতেই কানে ঠেকালো আধা-খাওয়া আপেলের ছোট্ট ছাপবিশিষ্ট দামী ফোন। কলের বিপরীতে কথা শুরু করতেই ঠোঁটের হাসিটুকু পালটে গিয়ে ক্রুদ্ধ আভা ফুটলো। গলায় তেজ মিশিয়ে চাপাসুরে বললো,
– গেঁয়ো মেয়ে এটা। এটাকে টাইট দেওয়া আহামরি কিছু না। আমি জানিনা রজনী ফুপি কেনো এটাকে আরামে থাকতে দিচ্ছে। সে কি আমার প্রতিটা ম্যাটার ভুলে গেছে? উহু, আমিতো চুপ করে থাকার জন্য এখানে আসিনি। কক্ষনোই না। এই মেয়ের চামড়ায় যদি এসিড ঘঁষে দিতে হয়, তাও আমি করবো। আমার চামড়ার কথা কিন্তু ভুলিনি। যেই দাগ আমার শরীরে বসিয়েছিলো আমি এর চেয়ে তিনগুণ ডাবল চিহ্ন করে ছাড়বো। মাহতিমের দেওয়া প্রত্যেকটা পেইন আমি হিসেব করে রেখেছি, এখন শুধু দাবার গুটির মতো চাল দিতে থাকবো। আমি মেহনূরকে ছাড়বো না।
.
বিলাসবহুল কোয়ার্টারের সামনে বিশেষ গাড়িটা থামলো। গাড়িটার পেছনে আরো তিনটি সিকিউরিটি গাড়ি থেমেছে। সিকিউরিটি গাড়ি থেকে আর্মিদের বেশভূষার দু’দল বেরিয়ে এলো, বিশেষ গাড়িটার কাছে দাঁড়াতেই গাড়ির ড্রাইভার সিটের দরজাটা ভেতর থেকে খুললো। ড্রাইভার লোকটা বেরিয়ে পেছনের সিটের দরজা খুলতেই সিকিউরিটি দল থেকে ক’জন সদস্য কোয়ার্টারের প্রবেশপথে এগিয়ে গেলো। সেখানেও একইভাবে কিছু নিরাপত্তাকর্মী পাহারা দিচ্ছে, তাদের প্রত্যেকের হাতে লম্বা-লম্বা বন্দুক। সিকিউরিটি টিমের সদস্যরা তাদের দিকে এগিয়ে যেতেই গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করলো,
– উনি ভেতরে আছেন? আপনারা খবর পাঠান ল্যাফটেন্যান্ট জাফর হাবিব এসেছেন।
সিকিউরিটি টিমের একজন উত্তর দিলো,
– জ্বী আছেন। আপনারা ভেতরে যেতে পারেন। আপনাদের আসার ব্যাপারে আগেই আমাদের কাছে ইনর্ফম করা হয়েছে।
প্রত্যুত্তরে ‘ হ্যাঁ ‘ সূচকে মাথা নাড়ালো, অপেক্ষা না করে জাফর হাবিব তার দলবল নিয়েই ভেতরে প্রবেশ করলেন। উনার পিছু গোটা সিকিউরিটি টিম আসতে থাকলে উনি হাতের ইশারায় একজনকে সামনে আসতে বললেন। পিছন থেকে একজন সেই ইশারা পেয়ে চট করে জাফর হাবিবের ডানপাশে এসে হাঁটতে লাগলো। জাফর হাবিব যথেষ্ট রসিকপ্রিয় মানুষ, মাঝে-মাঝে কথা বলার সঙ্গী হিসেবে মাইনুদ্দীনকে পছন্দ করে। লিফটে ঢুকে থার্ড নাম্বারে ক্লিক করতেই মাইনুদ্দীনের উদ্দেশ্যে তিনি বললেন,
– বুঝলে মাইনু, লাইফে আজীবন লেগে থাকতে হয়। লাইফ যে কোন্ পথে টান মারবে কেউ আন্দাজও করতে পারবেনা। এই ডিপার্টমেন্টে কখনো পা দিয়েছো?
মাইনুদ্দীন একটু ইতস্তত করতে লাগলো। হাতে যদি বন্দুক না থাকতো তাহলে মাথাটা একটু চুলকে নিতো। তবুও ইতস্তত গলায় সে বললো,
– না, স্যার।
লিফট উপরে উঠতে-উঠতেই জাফর হাবিব প্রাণখোলা হাসি দিয়ে বললেন,
– না জানার তো কথা না। নৌবাহিনীর বিশেষ সদস্যরা এখানে থাকছে। এই ডিপার্টমেন্টে অবশ্য তোমাকে নিয়ে আসিনি।
ছোট্ট একটা শব্দ করে সিলভারের দু’দ্বার দুদিকে সরে গেলো, ওমনেই চোখের সামনে কাঙ্ক্ষিত ফ্লোর দেখতে পেলেন জাফর হাবিব। লিফট থেকে বেরিয়ে স্মৃতির পাতা নাড়াতে-নাড়াতে আসল ফ্ল্যাটের কাছে চলে এলেন তিনি। সিকিউরিটি টিমকে বাইরে থাকতে বলে দিলেন তখন। হালকা অফ হোয়াইট দরজাটা নতুনের মতো চকচক করছে, বন্ধ দরজার এক জায়গায় কালো ক্যাপিটাল লেটারে লিখা, ‘ M. ANSARI ‘ . জাফর হাবিব হাত উঠিয়ে ডানদিকে থাকা কলিংবেলটার বোতামে তর্জনী চাপ দিলেন, সাথে-সাথেই বেলের শব্দ হয়ে থেমে গেলো। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই গোলগাল নব্ এবং কিছু সিকিউরিটি সিস্টেম সম্পণ্ণ হয়ে দরজা খুললো, পাশে থাকা মাইনুউদ্দীন আশ্চর্যভাবে এসব কীর্তিকাণ্ড দেখছে। তখনই ভেতর থেকে কাটকাট গলার আওয়াজ এলো,
– কাম ইন। আনসারী হেয়ার।
– চলমান .
#FABIYAH_MOMO
#নোটবার্তা : প্রত্যেকটা পাঠককে মনের সুগভীর স্থান থেকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা জানাই। আপনাদের প্রত্যেকের অফুরন্ত ভালোবাসা পেয়ে আমি আনন্দিত। আজ ছোটোখাটো প্রতিক্রিয়া এবং মন্তব্য পেতে চাই, সবার জন্য দুয়া রইলো।
#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই
#পর্বসংখ্যা_৩৭.
#ফাবিয়াহ্_মমো .
(যাদের লিংকে ঢুকতে অসুবিধা হচ্ছিলো, এটা তাদের জন্য।)
অংশ সংখ্যা ০২.
আজ মস্ত আকাশের উপর বৃষ্টির গুরুভার পরেছে। সেই গুরুভারটা গুরুত্বের সাথেই থেমে-থেমে পালন করছে কালোমেঘের আকাশ। বৃষ্টির প্রবল ধারায় শহরের আনাচে-কানাচে করুণ-বেহাল দশা এখন, পা ফেলতেও মানুষ দ্বিধাবোধ করছে আজ। বৃষ্টি তখনও থেমে যায়নি, কালো মেঘে পুন্ঞ্জীভূত হয়ে বারবার আকাশ ফেটে স্ফূলিঙ্গ দেখা দিচ্ছিলো। মেহনূর ফ্রিজ থেকে দুটো কমলা বের করে সমানতালে ছিলে যাচ্ছে, তার অন্যমনষ্ক দৃষ্টি এখন জানালার বাইরে আকাশের দিকে স্থির। মান-অভিমানের গোলকধাঁধায় আজ মেহনূর যথেষ্ট ক্লান্ত অনুভব করছে, এই ক্লান্তি সমস্ত দেহে বিষাদের মতো আঘাত করছে। আঘাতে নিরবে-নিরবে ক্ষত হচ্ছে ভেতরের ছোট্ট মনটা। মেহনূর কমলার গা থেকে শেষ খোসাটা ছিলে নিতেই গায়ের সাথে ঘেঁষে দাঁড়ালো কেউ। অন্য কারোর উপস্থিতি টের পেতেই খানিকটা চমকে উঠে সৎবিৎ ফিরে পাশে তাকালো মেহনূর, ডানে তাকিয়ে দেখলো মাহদি পাশে দাঁড়িয়ে আছে। বৃত্তের মতো গোল কমলাটা তার দু’হাতের মুঠোয় দু’ভাগ হয়ে আছে, সেখান থেকে কমলার প্রতিটি অংশ আলাদা করে কাঁচের পিরিচ সাজাচ্ছে মাহদি। এটুকুনি দেবরের কার্যকলাপ দেখে আশ্চর্য হতে গিয়ে অকস্মাৎ হেসে দিলো মেহনূর। মাহদির পিঠে হালকা মতোন চাপড় মারতে গিয়ে সেটা আর করলো না, হাতটা মাহদির মাথায় রেখে পরমস্নেহে চুলের ফাঁকে-ফাঁকে বুলিয়ে দিতে থাকলো। মাহদি এমন ভঙ্গিতে কাজ করতে লাগলো, যেনো সে এসবে পুরোনো দিনের দক্ষ কারিগর। মাহদির চুলের চামড়ায় আঙ্গুলের ডগা দিয়ে বুলিয়ে দিতেই প্রসন্ন হাসিতে বললো মেহনূর,
– তুমি এখানে কেনো পুচকে দেবর? তোমার কি মোবাইলে খেলা নেই? আমাকে সাহায্য করতে হবে না। তোমার কিছু লাগলে বলো আমি করে দেই।
মাহদি বড়দের মতো গলাটা একটু খুকখুক করে কেশে নিলো, কথা বলার জন্য গলাটা পরিষ্কার করতেই মেহনূরের হাত থেকে অন্য কমলাটা নিতে-নিতে বললো,
– আমি আমার বউকে সাহায্য করছি। বউকে টুকটাক কাজে হেল্প করাই যায়। তাছাড়া অনা-মনার কাছ থেকে দূরে থাকো, পারলে তোমার প্রিসিয়াস আইটেমগুলো লুকিয়ে রাখো। ঘর থেকে কিছু উধাও হলে সেই জিনিস আর ফিরে পাবেনা।
মাহদির কথায় ভ্রুঁদুটো কুঁচকে কপালে অসংখ্য ভাঁজ পরলো। বাড়ির নতুন অতিথি নিয়ে কেমন ইশারা দিলো? অনামিকা কি চোর নাকি চোরাই স্বভাবের অন্য কেউ? মেহনূরের মুখটা আড়চোখে দেখতে পেলো মাহদি। সাথে-সাথে চোখ বুজে নিজেকে অনেকগুলো গা’লি দিলো, পরিস্থিতিটা তাড়াতাড়ি স্বাভাবিক করার জন্য তাড়াহুড়ো করে অন্য প্রসঙ্গ টেনে বললো,
– কমলা সব সাজিয়ে দিয়েছি। তুমি কি এগুলোর জুস করবে? করলে তুমি সাবু খালাকে বলে দাও। খালা চমৎকার করে জুস বানিয়ে দিবে।
মেহনূর মৃদ্যু করে হেসে দিয়ে মাথাটা একটু নিচে ঝুঁকালো। মাহদির মাথায় ছোট্ট একটা চুমু দিয়ে তাকে চলে যেতে বললো। মাহদি আরো কিছুক্ষণ থাকতে চাইলো কিন্তু মেহনূরের কথা শুনে আর সেখানে থাকলো না। মেহনূর আধুনিক যুগের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে জানেনা, গ্রামের সহজাত জিনিস দিয়েই শরবত বানানো শিখেছে। বড় মার কাছ থেকে শরবত বানানোর যেসব কৌশল রপ্ত করেছিলো, সেগুলো একে-একে ফলাতে থাকলে রান্নাঘরের দরজার আড়াল থেকে সবকিছু দেখতে লাগলো মাহদি। চোখদুটো সর্বক্ষণ মেহনূরের উপরেই আঁটকে আছে, বাড়িতে যেদুটো ডা’ইনীর আগমন হয়েছে, তাদের আসাটা এই মূহুর্তে ঘোর অমঙ্গল। দরজার বাইরে থেকে উঁকি দিয়ে তাকিয়ে থাকলে হঠাৎ হাতে হেঁচকা টান খায় মাহদি, ভয়ের চোটে গলা ফাটিয়ে ‘ আম্মু ‘ বলে চিৎকার দিবে সেটারও সুযোগ আর রইলো না। মুখের উপর কঠিনভাবে হাত চেপে ধরলো কেউ, তারহাতদুটো পিছমোড়া করে শক্তভাবে ধরে আছে, চোখ খুলে ঠিকঠাক মতো অজ্ঞাত ব্যক্তিকে দেখবে সেটারও কোনো ব্যবস্থা নেই। বুকটা ঢিপঢিপ করে কাঁপতেই সেকেন্ডের ভেতর ঘেমে উঠলো মাহদি। হাত-মুখ-চোখ সাময়িকভাবে বন্ধ করে দিলেও নাকের ইন্দ্রিয়শক্তি তখনও সচলভাবে কাজ করছে। নাকে যে মিষ্টি পারফিউমের সুভাস পাচ্ছে সেটা ঠিকমতো আন্দাজ করতেই পুরো দেহ যেনো শিরশির করে কেঁপে উঠলো। তীব্র আতঙ্কে কিচ্ছু বললো না মাহদি, শুধু চুপ করে অপেক্ষা করতে লাগলো। মাহদিকে স্বল্প সময়ের ভেতর টেনে এনে রুমের দরজার সাথে ঠেসে ধরলো, ছোট্ট মুখটার দু’গালে বাঘের থাবার মতো শক্ত করে চেপে ধরলে ঠোঁট ধীরে-ধীরে উঁচুতে উঠে গেলো। মাহদির দিকে কড়া দৃষ্টি ছুঁড়ে হুঙ্কার দিয়ে বললো,
– চোখ খোল্।
কন্ঠের তীব্রতায় আরেকবার শিউরে উঠলো মাহদি। পিটপিট করে চোখ খুলে তাকাতেই চোখভর্তি পানিগুলো টলমল করে উঠলো ওর। মনে-মনে যে ব্যক্তিকে নিয়ে ছক কষেছিলো, সেটা পুরোপুরি খাপে-খাপ মিলে গেছে। গালটা যেভাবে চেপে ধরেছে মাহদি গোঙানো সুরেও আওয়াজ করতে পারছিলো না, সেই কড়া চাহনিটা ওর মুখের কাছে এসে আবারও নিচু সুরে বললো,
– তুই ওখানে দাঁড়িয়ে কি করছিলি? কোনো মিথ্যা বলতে যাবিনা। আমার চোখ ফাঁকি দিয়ে নজরদারি করবি সেটা ভুলে যা মাহদির বাচ্চা। তোর ভাই যে নেই, এইবার তোকে, আর তোর বউকে কে রক্ষা করবে? নীতিরাও নেই, সৌভিকরাও বাড়ি ফিরেছে, তোর বোকামার্কা মা থাকার চেয়ে না-থাকাও ভালো। সে আমার কোনোকিছুই করতে পারবে না। তুই সাবধানে থাকিস। তোর ভাই আমার সাথে যা করেছিলো, সেটা যদি একটুখানি জায়গামতো পৌঁছে দেই তাহলে ওই গেঁয়োর অবস্থা কেমন হবে সেটা ভালোমতো চিন্তা করে নিস। আমাকে রাগাতে যাস না। তোর ভাইকে বলিস অনামিকা এখানে শান্তিমতো থাকতে এসেছে। আমার সাথে যদি তামাশা করার চেষ্টা করে, ক্ষতিটা ওর কলিজার উপর টেনে-খুবলে করবো।
টলমলানি অশ্রুগুলো এক-এক করে গাল বেয়ে নামতে লাগলো। মাহদি কাঠ-কাঠ ভঙ্গিতে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। চোখ থেকে যে অশ্রুগুলো পরছিলো তাও অবিরামভাবে পরছে, তাতে কোনোপ্রকার হেলদোল নেই। অনামিকা গালটা ছেড়ে দিতেই সোজা হয়ে দাঁড়ালো। ছেড়ে রাখা সিল্কি চুলগুলো উঁচু করে ঝুটি করলো। মাহদি শুষ্ক-রুক্ষ গলায় ঢোক গিলে কাঁপা-কাঁপা সুরে বললো,
– যা-যাই?
অনামিকা হাসিহীন মুখে দাম্ভিকতার ভঙ্গিতে মাথাটা ‘ হ্যাঁ ‘ করে নাড়ালো। ডানহাতের তর্জনী তুলে বেরিয়ে যাওয়ার ইশারা করলো। মাহদি ভয়ে-ভয়ে চোখ নত করে নব্ ঘুরিয়ে দরজা খুললো, বাইরে পা দিতেই অনামিকার কন্ঠটা ফের বেজে উঠলো,
– তোর মা’কে কিছু বলতে যাস না মাহদি। এবার কিন্তু টর্চার তোর উপর করবো না, তোর ‘ বউ, বউ ‘ করা মেহনূরের উপর চালাতে থাকবো। মুখটা একদম স্কচট্যাপের মতো বন্ধ করে রাখবি, নাহলে এটার পরিণাম মোটেও ভালো হবেনা।
দরজার নব্ ধরে থম মেরে দাঁড়িয়ে আছে মাহদি। রাগে শরীরের প্রতিটি কোষ যেনো বিক্ষোভ করে উঠছে, আজ যদি তার ক্ষমতা থাকতো, তাহলে মাহতিমকে ডেকে এনে একেবারে ওর শিরায়-শিরায় শিক্ষা ঢুকিয়ে ছাড়তো। মাহদি মাথাটা পিছু না ঘুরিয়ে ছোট্ট করে বললো,
– ঠিক আছে, বলবো না।
নব্ ছেড়ে দরজার বাইরে পা বাড়ালো মাহদি, হাতের উলটোপিঠে চোখদুটো ভালো করে মুছলো। নিজের রুমের দিকে যেতে-যেতেই অনেক কিছু ভাবতে লাগলো। তার একটু আগের ভয়ার্ত মুখটা এখন যেনো আকাশের মতো কঠোর হয়ে আছে। যে চোখে ভয় গ্রাস করেছিলো সেটা আকস্মিকভাবে বদলে গেছে, বুকের ভেতর তরতাজা রক্তগুলো রাগে-ক্ষোভে উত্থাল করছে এখন, কিছুতেই শান্ত হতে চাচ্ছেনা ক্ষুদ্ধ-বিক্ষুদ্ধ মন।
.
সাদা পরিষ্কার ডিভানে বসে আছেন জাফর হাবিব। পায়ের উপর পা তুলে রেখেছে সে। ঠিক সামনের টেবিলে পেটমোটা ধরনের দামী একটা বোতল সাজানো আছে। তিনি বোতলটার দিকে তীক্ষ্মদৃষ্টি ছুঁড়ে দেখতে লাগলেন, ইংরেজি এ্যালফাবেটে গভীর মনোযোগ ঢেলে দিয়ে হঠাৎ মনে-মনে উচ্চারণ করে উঠলেন, ‘ বিদেশী মাল, উফ! ‘। ভদ্রলোকের মুখোমুখি সোফায় সাধারণ কায়দায় বসে আছে মাহতিম। জাফর হাবিবের তৃষ্ণার্ত মুখটা দেখতে পেয়ে ঠোঁটে তার বাঁকা হাসি দেখা দিলো। টেবিলটার দিকে হাত বাড়িয়ে পেটমোটা বোতলটা হাতে নিলো, প্রোফেশনাল স্টাইলে ছিপি খুলতেই জাফর হাবিব চোখ ছোট করে বললেন,
– ইজ দিজ ট্রু ইয়াং বয়? তুমি কি ওগুলো চেখে দেখো? সবই তো দেখছি এ্যাব্রড কান্ট্রির হাইপ মাল।
ঠোঁটের হাসিটা আর বাঁকাভাবে রইলো না, এবার যেনো চওড়া করে হেসে দিলো। ছ্যাৎ করে শব্দ হতেই বোতল থেকে ফেনা মতো কিছু পানীয় মাহতৈমের হাত গড়িয়ে পরতে থাকলো, এরপর কাঁচের গ্লাসের কাছে মুখ ঠেকিয়ে ঢকঢক করে সামান্য পানীয় ঢেলে নিলো। আধাভর্তি গ্লাসটার নিচে থাকা চিকন দন্ডটা দু’আঙ্গুলের ফাঁকে চেপে ধরলো, এরপর তরল পানীয় দ্বারা পরিপূর্ণ গ্লাসটা এগিয়ে দিলো। স্বাভাবিক ভঙ্গিতে প্রসন্ন হাসিতে বললো,
– আপনাদের জন্য কালেকশন রেখেছি স্যার, এসব আমার জন্য না।
মাহতিমের হাত থেকে সেও একই ভাবে দু’আঙ্গুলের ফাঁকে নিলো গ্লাসটা। ঠোঁটের কাছে গ্লাস ঠেকিয়ে ছোট্ট একটা চুমুক দিলো, তৃপ্তিতে চোখমুখ বুজে এলো তার। মাহতিম এটা ভালো করেই জানে, তার থেকে উর্ধ্বতন পদের মানুষদের কিভাবে হ্যান্ডেল করা লাগে। মাহতিম একপেশে হাসি দিয়ে নিজেও পায়ের উপর পা তুলে নিলো, সোফায় আয়েশী ভঙ্গিতে বসতেই বাঁ কনুইটা সোফার হ্যান্ডেলে ঠেকিয়ে দিলো। জাফর হাবিব তৃপ্তিজনক সুখ থেকে বিচ্যূত হয়ে আবার চোখ খুলে তাকালেন, মাহতিমকে চতুর চাহনিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে হাসি দিয়ে বললেন,
– শুনলাম নতুন বিয়ে করেছো, কথাটা কি সত্যি না গুজব? তোমার বিয়ে নিয়ে যেই গুজব রটে মাই গড! বিশ্বাস করতে গিয়েও ভড়কে যাই।
মাহতিম ওইভঙ্গিতেই জবাব দিলো,
– না, এবার সত্যি শুনেছেন। বিয়ে করেছি।
জাফর হাবিব কেবল আরেক চুমুক দিতে যাচ্ছিলেন, পথিমধ্যে এমন কথা শুনে বিষ্ময় দৃষ্টিতে বললেন,
– কে সেই ভাগ্যবতী মেয়ে? আমি কি তাহলে ফাইনালি এম. আনসারীর বিয়ের সংবাদ শুনলাম? আমিতো ভেবেছি চিরকুমার থাকার প্রতিজ্ঞা করে বসে আছো।
মাহতিম ‘ চিরকুমার ‘ শব্দটা শুনেই ফিক করে হেসে দিলো। জাফর হাবিবের দিকে সদ্য খোলা বোতলটা আবার এগিয়ে দিতেই গ্লাস ভর্তি করে দিলো। পুনরায় আগের মতো বসলে পরিষ্কার হাসিতে বললো মাহতিম,
– বিয়ে করেছি এটা সত্য। ভাগ্যবতী না বলে ভাগ্যবান বলুন মেজর। ভাগ্যটা বলতে গেলে আমার। এমন সময়ে আমার লাইফে কেউ চলে আসবে এটা ধারণা করতে পারিনি। তবে এখন যেহেতু এসে গেছে, সেক্ষেত্রে আমার ভাগ্য বলা চলে।
মেজর জাফর হাবিব হাসতে-হাসতে হঠাৎ মলিন হয়ে গেলেন। হাতের গ্লাসটা ঠোঁটে না ঠেকিয়ে টেবিলে রেখে দিলেন। চোখদুটো কিছুক্ষণ বন্ধ করে চুপ করে বসে রইলেন, জোরে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে চোখ বন্ধ অবস্থায় বলতে লাগলেন,
– তোমার বাবার হাসি-হাসি মুখটা দেখতে পাচ্ছি মাহতিম। আমার দিকে সে হাসছে। আমি যদি এখন ওর দিকে এগিয়ে যাই তাহলে ও আমাকে জাপটে ধরে নাচবে। কি অমায়িক হাসি, এতো সুন্দর হাসিটা ওই শেষ সাক্ষাতে দেখেছিলাম। চোখের সামনে মৃত্যু দেখেও আমার দিকে হাসছিলো, হাত নাড়িয়ে টাটা দিতেই চোখের পলকে মিলিয়ে গেলো।
বৈদ্যুতিক শক খাওয়ার মতো তৎক্ষণাৎ চোখ বন্ধ করলো মাহতিম। নিশ্বাসটা আচানক আঁটকে গিয়ে কোথাও ছুড়ির মতো ঢুকে গেলো। বন্ধ চোখজোড়া কুঁচকে নিতেই ঠোঁট খুলে নিশ্বাস ছাড়তে লাগলো, চোখের কুঁচকে রাখা ভাবটা ধীরেসুস্থে স্বাভাবিক হয়ে পরিষ্কার দৃষ্টিতে তাকালো। জাফর হাবিব চোখের উপর রুমাল চেপে ধরে আছেন। ভদ্রলোক যে সহকারী বন্ধুর মৃ’ত্যুযন্ত্র’নায় ব্যথা অনুভব করছেন, সেটা পরিদৃষ্ট। মাহতিম গলা খাকাড়ি দিয়ে একটু কেশে নিলো, ইঙ্গিতে জাফর হাবিব শান্ত হয়ে আবার প্রাণোচ্ছল হাসিতে স্বাভাবিক হয়ে উঠলেন। হাসিটুকু ধরে রেখে গ্লাস তুলে বললেন,
– নাম কি? কোথাকার মেয়ে? শহরের তো?
মাহতিম সহজ ভঙ্গিতে বলে উঠলো,
– ম্যাডামের নাম মেহনূর। আমার মায়ের দূর-সম্পর্কীয় আত্মীয়, গ্রামে ওদের বসতবাড়ি আছে।
জাফর হাবিব উত্তর শুনে পানসে মুখে তাকালেন, কিছুটা কৌতুহল নিয়ে বললেন,
– মারজা ভাবীর ওই রিলেটিভ নাতো? তুমি কাকে বিয়ে করেছো?
মাহতিম সকল কৌতুহল ধূলিসাৎ করে গোড়া করে বলতে লাগলো,
– এবার যে অনেক দিনের ছুটি নিয়েছি তাতো আপনি জানেন। ছুটিটা মূলত ওদের বাড়িতে গিয়েই নেওয়া হয়েছে। মায়ের ফোর্স দেখে ডিপার্টমেন্ট থেকে প্ল্যান মোতাবেক চার দিনের ছুটি নিয়েছিলাম, মা বায়না ধরলো তার আত্মীয়ের বাড়ি যাবে। না করতে পারিনি। তার সঙ্গেই আমার ভাইবোনদের নিয়ে গেলাম। সেখানে সবকিছু নরমাল দেখা গেলেও কোনোকিছু এ্যাবনরমালের চেয়ে কম লাগেনি। আমি ছাড়া বিষয়টা কেউ ধরতে পারেনি, ইভেন মা’ও না। আমি যখন গেলাম সেদিন থেকেই ওই বাড়িতে অনেক কিছু টের পেয়েছি, সবচেয়ে বড় রহস্য হলো ওই প্রবীণ বয়সী হান্নান শেখ। যিনি কিনা মেহনূরের আপন দাদা। আপনি কি আমার পয়েন্ট ধরতে পেরেছেন মেজর?
মেজর হাবিব চোখ-কান সজাগ করে তাকালেন। এতোক্ষণ পর তার সবল মনটা মাহতিমের কথায় অন্যকিছুর আভাস টের পাচ্ছে। বিশাল বড় প্রশ্নটা ঘূর্ণিপাকের মতো ঘুরপাক খাচ্ছে। তিনি প্রশ্নটা না করে পারলেন না,
– তুমি কি মেহনূরকে অন্য উদ্দেশ্যে বিয়ে করেছো মাহতিম? তোমার ভেতরে কি চলছে খুলে বলোতো।
মাহতিম তৎক্ষণাৎ নিজের মতামতটা পরিষ্কার করে বললো,
– ওকে বিয়ে করার পেছনে কোনো মোটিভ রাখিনি মেজর। ও আমার একান্ত ব্যক্তিগত মানুষ। ওকে সম্পূর্ণরূপে মন থেকে চেয়েছি। ওই একমাত্র ব্যক্তি যার সামনে আমার মস্তিষ্ক কখনো কাজ করেনা।
মেজর আশ্চর্য হয়ে চোখদুটো বড় বড় করলেন, আশ্চর্যের সীমাটা এমনভাবে গলা উঁচিয়ে ফলালেন সেটা মাইনুদ্দীনের কান অবধি পৌঁছে গেলো। মাইনুদ্দীন বিষ্ময়ে চমকে গেলেও মাহতিম তখন মেজরের অবস্থা দেখে হাসি দিয়ে ফেললো। মেজর হাবিব তখন আহাম্মক হয়েই বলতে লাগলেন,
– কি তাজ্জব কারবার দেখি! এতো বছরেও যা শুনতে পারলাম না সেটা নাকি এখন শুনি। মাহতিম তোমার ওয়াইফ আসলেই সাইলেন্ট কি’লার। মেবি সে নিজেও জানেনা কাকে সে গুরুতর ভাবে ঘায়ে’ল করেছে।
মাহতিম হাসিটুকু কমাতে-কমাতে একপর্যায়ে গম্ভীর হয়ে গেলো। পিঠটা সোফায় ঠেকিয়ে কিছুটা চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো,
– ওর বয়সটা কম ছিলো বলে ফার্স্ট স্টেপে ভেবেছিলাম আংটি পরিয়ে রেখে যাই। কিন্তু মন সায় দেয়নি মেজর। মনে হচ্ছিলো ওকে রেখে গেলেই কিছু-না-কিছু একটা ঘটবে। হান্নান শেখকে দেখে প্রথম যেই খটকাটা লেগেছিলো, সেটার হিসাব কিছুদিন আগে মিলিয়েছি। আপনার কি অপারেশন ঝিলতলার কথা মনে আছে?
মেজর হাবিব কপাল কুঁচকে তাকালেন, ডানে তাকিয়ে খোলা জানালার বাইরে সর্তক দৃষ্টি দিয়ে আবার মাহতিমের দিকে ফিরলেন। দেয়ালের যদি কান না থাকে তবেই এখন ভালো। মেজর হাবিব একটু এগিয়ে এসে প্রশ্নাত্মক গলায় বললেন,
– যেই অভিযানটা তোমার আন্ডারে লিড হয়েছিলো সেটার কথা বলছো না?
মাহতিম ‘ হ্যাঁ ‘ ভঙ্গিতে মাথা নাড়িয়ে দিলো। মেজর হাবিব কপাল কুঁচকে কিছু একটা ঘোরতর ভাবে চিন্তা করতে লাগলেন। মাহতিম উনার চিন্তার জটটা আরেকটু খুলে দিতেই স্বর নামিয়ে সাবধানী কন্ঠে বললো,
– আপনাকে আমি এজন্যই ডেকেছি কারণ আপনাকে আমার দরকার। কালাম সরদার নামটা তো শুনেছেন নিশ্চয়ই? অপারেশন ঝিলতলা নামে যেই অভিযানটা করেছিলাম সেখানে সবগুলো আসামী ধরা পরলেও মূল আসামী পলাতক ছিলো।
জাফর হাবিব কপালে জমা বিন্দু-বিন্দু ঘামগুলো অশ্রু মুছা রুমালে মুছে নিলেন। তিনিও স্বর নামিয়ে সজাগ হয়ে বললেন,
– তুমি কাকে সন্দেহ করছো মাহতিম? মেহনূরের দাদাকে নাকি? তুমি কথা না প্যাঁচিয়ে সোজাসাপ্টা বলো।
মাহতিম স্থির হয়ে জাফর হাবিবের দিকে তাকিয়ে আছে। এদিকে উত্তর শোনার জন্য জাফর হাবিব প্রচণ্ড খচখচ অনুভব করছেন। তিনি সহ্য করতে না পেরে আরেকবার তাগাদা দিলেন, এবার মাহতিম নতমুখে নিশ্বাস ছাড়তে-ছাড়তে বললো,
– সাসপেক্ট পার্সন দুজন মেজর। এক. আমার শ্বশুড়মশাই, দুই. আমার দাদাশ্বশুড়।
বাকশূণ্য দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন জাফর হাবিব। মুখের ভাষাও যেনো হারিয়ে গেছে উনার। এতো বড় আসামীর সন্ধান কিনা অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে পাওয়া গেছে আজ। এতোদিন পরও মাহতিম সেই কেসটা সগোপনে চালিয়ে যাচ্ছে সেটা দেখে তিনি অবাক! ঠিক কিভাবে প্রতিক্রিয়া দিবেন বুঝতে পারছেন না, শুধু ভেতরে-ভেতরে বুঝে নিয়েছেন মাহতিম খুব ভয়াবহ ধরনের চিন্তা কষে রেখেছে। সেটা যে কতোটা ভয়াবহ হবে, তিনি আবারও চোখ বন্ধ করে দেখতে লাগলেন।
.
স্টাডি টেবিলের সামনে বসে পিসি অন করলো মাহদি। ছুটি কাটানোর পর অনেকদিন যাবৎ পিসিতে হাত দেওয়ার সুযোগ পায়নি। আজ অনেকটা বাধ্য হয়েই জে’দের ব্যতিরেকে পিসির সামনে চেয়ার টেনে বসলো, মাউসে ক্লিক করে কাঙ্ক্ষিত পাসওয়ার্ড দিয়ে পিসির সিকিউরিটি শেষ করলো। মাউস ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে কায়দামতো জিমেইলে এন্ট্রি করলো, টেবিলের নিচে হাত রেখে ড্রয়ারের মতো টান দিয়ে কির্বোড বের করলো। একনাগাড়ে ফুলস্পিডে বাংলা শব্দ টাইপ করতে থাকলো মাহদি। দক্ষ হাতে সম্পূর্ণ একটা জিমেইল সম্পন্ন করে অন্য জিমেইল এ্যাড্রেসে সাথে-সাথে সেন্ড করে দিলো। জিমেইলটা সেন্ড করতেই জোরে-জোরে দুটো নিশ্বাস ছেড়ে টেবিলেই মাথাটা নত করে রাখলো। চোখ বুজে অষ্ফুট সুরে বারবার বলতে লাগলো,
– তুমি চলে এসো ভাইয়া, চলে এসো, তুমি এবার চলে এসো প্লিজ।
গুণে-গুণে দশ মিনিট যেতেই মাহদির ডান থাইটা সুড়সুড় করে উঠলো। মাহদি তৎক্ষণাৎ বেজায় স্পিডে ট্রাউজারের ডান পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিলো, একটানে এন্ড্রয়েড ফোনটা বের করতেই স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে ‘ ইয়াহু ‘ বলে মৃদ্যু শব্দে চিল্লিয়ে উঠলো। তড়িঘড়ি করে চেয়ার থেকে উঠে রুমের দরজাটা লক করে বিছানায় উঠে বসলো। কলটা রিসিভ করে কানে ঠেকাতেই চটপট গলায় বললো,
– ভাইয়া তুমি কেমন আছো? তুমি মায়ের সাথে কথা বলো আর আমাকে কল দাওনা? আমাকে কি মনে পরেনা?
ওপাশ থেকে ব্যস্ত গলায় কিছু বলতে গিয়েও চুপ রইলো মাহতিম। দু’কানে ইয়ারপড ঢুকিয়ে সেও টেবিলে বসে পিসিতে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছে। মাহদি কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে ক্ষেপাটে ভঙ্গিতে বললো,
– আমার বউকে তুমি কি বলেছো হ্যাঁ? বিয়ে করেছো কি কাঁদানোর জন্য?
এবার কির্বোডের উপর হাত থেমে গেলো মাহতিমের। কিছুটা বিচলিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– আমিতো মা’কে ছাড়া আর কাউকে কল দেইনি। ও কাঁদবে কেনো?
মাহদি ঠোঁট ফুলিয়ে রাগ দেখিয়ে বললো,
– কল দেওয়া কি উচিত না? আমার বউ কি টেনশন করেনা? তুমি এতো খারাপ জানলে জীবনেও আমার বউকে বিয়ে করতে দিতাম না। দশ বছর পর আমিই ওকে বিয়ে করে আনতাম।
মাহতিম বিরক্ত হয়ে বললো,
– চড় খাবি? আমি আসলে কিন্তু কঠিন চড় লাগাবো। আমার বউকে তোর বউ বলা বন্ধ করিস। চড় কিন্তু একটাও মাটিতে পরবেনা ।
মাহদি নিজের চিকন-চিকন ভ্রুঁদুটো কুঁচকে ক্ষুদ্ধ কন্ঠে বললো,
– যেটা তোমার ওটা আমার। যেটা আমার ওটা আমারই।
বেখাপ্পা উত্তর শুনে বোকা বনে গেলো মাহতিম। এটুকুনি ব’দমাশের মাথায় কি জটিল-জটিল কথা ঢুকে গেছে। মাহতিমকে চুপ থাকতে মাহদি নিজেই বলে উঠলো,
– ভাইয়া শুনো আমাদের বউ ঠিকমতো নিজের খেয়াল রাখছেনা। কি করা উচিত বলো?
‘ আমাদের বউ ‘ শুনে আর নিজেকে থামাতে পারলোনা মাহতিম, ফিসফিস করে হেসে উঠলো পিসির সামনে। ফাজিলটাকে ধরে কঠিনভাবে কান মোচড়াতে ইচ্ছে করছে। শেষমেশ কিনা আমাদের বউ বলে আখ্যা? মাহতিম অনেক কষ্টে নিজের হাসি আটঁকে মাহদির উদ্দেশ্যে বললো,
– শোন্ ব্যাটা, ও আমার বউ। ওকে ভাবী ডাকতে শিখ। পারলে ভাবী আম্মা ডাকবি, ভাবী আম্মা। বুঝছিস?
মাহদি নাছোড়বান্দার মতো জবাব দিলো,
– না, ও আমার ভাবী টাবী না। ও আমার বউ। তোমার বউ মানে আমারও বউ। তুমি যখন বুড়ো হয়ে যাবে, তখন আমি ওকে বিয়ে করে ফেলবো।
মাহতিম হাঁফ ছেড়ে সশব্দে নিশ্বাস ছাড়তে লাগলো, এসব পাকনা পোলাপানদের সাথে যুক্তি লাগিয়ে পারা যাবেনা। মোদ্দাকথায় আসার জন্য জোর দিলে মাহদির কন্ঠটা বিমর্ষ আকার ধারণ করলো। যেই প্রফুল্ল স্বরটা এতোক্ষণ ছিলো সেটার পরিবর্তে একরাশ বিষণ্ণ সুর ভর করে বললো,
– তোমার রুমের ফ্লোরে বসে ও খুব কাঁদছিলো ভাইয়া। ও তোমার জন্য প্রতিদিন যেই ডায়েরীটা লিখতো ওটা বৃষ্টির পানিতে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। যেই হাতটায় নীতি আপু ব্যান্ডেজ করে দিয়েছিলো সেটা পরশুদিন মা খুলে দিয়েছে। ঘা শুকায়নি ভাইয়া। এখনতো ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করেনা। সকালে জোর-জবরদস্তি করে কয়েক লোকমা মা খাওয়ায়, এরপর যে তোমার রুমে ঢুকে সেখান থেকে সহজে বেরোয় না। আজ ওই অনামিকা এসেছে, এখনো ওর কানে কিছু ঢুকায়নি। আমি আশেপাশে ঘুরি দেখে আমাকে অনেক শাসিয়েছে ভাইয়া। তুমি প্লিজ প্লিজ চলে এসো।
কলের বিপরীতে স্তব্ধ হয়ে আছে মাহতিম। চোখের সামনে থাকা পিসিটা বিমূঢ় দৃষ্টিতে বন্ধ করে দিলো। সহসা কিছুক্ষণ নিরব থেকে কোমল গলায় বললো,
– তোকে কিছু করেছে?
মাহদি বিষণ্ন গলায় বললো,
– না ভাইয়া। শুধু গালটা —
কথা শেষ করার আগেই ফোনের ওপাশ থেকে বিকট শব্দ শুনলো মাহদি। আচমকা ভয় পেয়ে কান থেকে ফোন পরে গেলো ওর। দ্রুত ফোনটা তুলে আবার কানে ঠেকাতেই ‘ টুট টুট টুট ‘ শুনতে পেলো ।
রাতের খাবার শেষে কেবল বিছানায় এলেন মারজা। সঙ্গে করে তিনি মেহনূরকেও নিয়ে এসেছেন। আজ তিনি মেয়ে-সম বউমার সঙ্গে গল্প করতে-করতে ঘুমাবেন বলে চিন্তা করেছেন। পুরোনো দিনের আবদ্ধ স্মৃতির কারখানাটা খুলে দিবেন আজ, সেখান থেকে অসংখ্য মধুর স্মৃতি বের করে মেহনূরকে শোনাবেন। মেহনূর একটু একা থাকার সুযোগ খুজেঁ যাচ্ছিলো কিন্তু সুযোগটা সে পায়নি। মারজার উৎসুক মুখটা দেখে বলতেও পারেনি আজ তার মন খারাপ। ভীষণভাবে খারাপ। একাকিত্বের মাঝে অন্ধকার রুমে সময় কাটাতে ইচ্ছে করছে। কিভাবে মনের চূর্ণবিচূর্ণ অবস্থা সম্পর্কে মারজা বলবে? এমন কোনো সিস্টেম যদি থাকতো, যেখানে মনের সব কথা অটোমেটিক আশেপাশের মানুষগুলো বুঝে ফেলতো, তাহলে এমন অসহ্য যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতো মেহনূর। মারজা বিছানায় শুয়ে-শুয়ে অনায়াসে সকল কথা বলতে লাগলেন, একে-একে সব ঘটনা খুলে বলতেই কখন যে নিদ্রার রাজ্যে তলিয়ে গেলেন সেটা নিজেও ধরতে পারলেন না। পাশে থাকা মেহনূর টেবিল ল্যাম্পটা বন্ধ করে মারজা গায়ে পাতলা কম্বলটা টেনে দিলো। বিছানা থেকে নেমে চুপিচুপি সেখান থেকে বেরিয়ে এলো। আবছা অন্ধকারে পা চালাতে-চালাতে আচঁলটা চোখে ডলছিলো বারবার। বন্ধ রুমটার কাছে এসে ডানহাত বাড়িয়ে ধাক্কা দিলো, দরজাটা খুলে গেলে ভেতরে ঢুকলো মেহনূর। দরজাটা চাপিয়ে দিয়ে রুমের সুইচবোর্ড থেকে ড্রিম লাইটটা জ্বালিয়ে নিলো। শূন্য রুমের শূন্য বিছানায় পা উঠিয়ে বসলো। মাহতিমের একান্ত নিজস্ব বালিশটা টেনে এনে কোলের উপর রাখলো মেহনূর। বালিশটার দিকে দৃষ্টি দিয়ে তাকাতেই টপটপ করে গোল-গোল বিন্দু কণা বালিশের উপর পরতে লাগলো। কাঁপা-কাঁপা গলায় হালকা সুরে বলে উঠলো,
– আমাকে মাফ করতে চলে আসুন।
ঝরঝর করে চোখ থেকে ফোঁটায়-ফোঁটায় অশ্রু ঝরছে। রাত্রিকালীন নিরিবিলি সময়টা লুকিয়ে থাকা ব্যথাকে জাগিয়ে দিচ্ছে যেনো। ঘুমন্ত শহরটা নিদ্রামগ্নে ডুবে গেছে ভীষণভাবে, কোথাও কেউ জেগে নেই আজ। চারপাশটা এতো নিরব হয়ে উঠলো, শেষমেশ কেবল টিকটিক করে ঘড়ি চলার আওয়াজটা স্পষ্ট হতে লাগলো। মেহনূর ঢোক গিলে চোখ খুলে তাকাতেই বালিশটা জায়গামতো রেখে দিলো। মাহতিমের পাঠানো বইগুলো নেড়েচেড়ে দেখার জন্য উঠতে উদ্যত হলো মেহনূর, হঠাৎ নিরবতার সন্ধিক্ষণে ছেদন ঘটিয়ে বহুদিন পর টানা একসপ্তাহ একদিন শেষের রাত্রিরে ফোন বেজে উঠলো। নিরব রুমটায় বিকট আওয়াজের জন্য কেমন ভূতুড়ে-ভূতুড়ে ঠেকছে। মেহনূর প্রথমে অবিশ্বাস করলেও শেষে দেখলো ঠিকই ফোন বাজছে, সেটা বালিশের পাশ থেকে বেজেই চলছে। বুকভরা সাহস নিয়ে জোরে-জোরে দম নিতেই ফোনটার কাছে এগিয়ে গেলো মেহনূর, ঠান্ডা হয়ে আসা হাতটা আস্তে করে ফোনের নিচে ঢুকিয়ে সেটা মুঠোয় তুলে নিলো। স্ক্রিনের দিকে তাকাতেই আনন্দ-অশ্রু মিলিত চাহনিতে হু হু করে কেদেঁ উঠলো মেহনূর।
– চলমান
#FABIYAH_MOMO .
#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই
#পর্বসংখ্যা_৩৭.
#ফাবিয়াহ্_মমো .
( ব্রাউজার ঘটিত সমস্যার জন্য পুনরায় পোস্ট করা হলো।)
অংশ সংখ্যা ০৩.
চোখের সামনেই নতুন ফোনটা বাজতে-বাজতে কেটে গেলো। মেহনূর কান্না আঁটকানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পরলে এদিকে আর ফোন ধরতে পারলো না। কল কেটে গেলে মূঢ় দৃষ্টিতে ফোনের দিকে তাকিয়ে রইলো মেহনূর, এবার সবকিছু ভেঙ্গেচুরে কান্না ঠেলে আসছে তার। ফোনের ওপাশে থাকা মানুষটা এমনেই অভিমান-অপমান নিয়ে রেগে ছিলো, এখন যদি কল না ধরাকে একধাপ বেশি ভাবে তখন? মেহনূর আর ভাবতে পারলো না, ফোনটা কোলে ছেড়ে দিয়ে অশ্রুমাখা মুখটা দুহাতে ঢেকে ফেললো। হাতের শুকনো তালু দুটো আবারও সিক্তজলে ভিজে উঠলো। এবার মাহতিম জীবনেও ওকে কল করবেনা। ও যে ভুলবশত কলটা ধরতে পারেনি, কলটা যে আপনা-আপনি কেটে গেছে সেটা না জেনেই মাহতিম তিনগুণ বেশি ক্ষেপবে। এই ঘটনার পর থেকে আদৌ সে কল করবে? মেহনূর অসহ্য চিন্তা-ভাবনার ভেতর অস্থির হয়ে উঠলে কোলের উপর আলো জ্বেলে পুনরায় বস্তুটা বাজতে লাগলো, টিকটিক করা ঘড়ির আওয়াজকে টেক্কা দিয়ে পুরো রুমে তখন ফোনের রিংটোনটা ছড়িয়ে পরলো। মেহনূর হতবাক হয়ে মুখ থেকে হাতদুটো নামাতে লাগলো, দৃষ্টিনত করে কোলের দিকে চোখ পরতেই এবার ডানেবামে তাকালো না। খপ করে ফোনটা হাতে তুলে রিসিভ অপশনে বৃদ্ধাঙ্গুল রেখে আলতো চাপ দিলো, এবার কলটা রিসিভ! মেহনূর ভেজা-ভেজা দৃষ্টিতে স্ক্রিন থেকে চোখ সরিয়ে ফোনটা তখন কানে ঠেকালো, নির্বাক ভঙ্গিতে কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে হালকা সুরে বললো,
– হ্যালো,
উত্তরের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো মেহনূর, বুকটা প্রচুর ঢিপঢিপ করে শব্দ করছে। শুকিয়ে আসা গলাটা ছোট্ট ঢোক গিলে খানিকটা ভিজিয়ে নিলো, অপেক্ষায় থাকা উৎকন্ঠিত মনটা মাহতিমের কথা শোনার জন্য ছটফট করে চন্ঞ্চল হচ্ছে, আচঁলের নরম কাপড়টা বাঁহাতের তালুতে দলা পাকিয়ে মুচড়ে যাচ্ছে। আচ্ছা মাহতিম কি প্রচুর রাগারাগী করবে? ধমক দিবে? কড়া কথা শোনাবে? অসংখ্য-অসংখ্য প্রশ্ন যখন মেহনূরের চিন্তাকে হুরহুর করে বাড়িয়ে দিচ্ছিলো, তখনই কিলবিল করা প্রশ্নের মধ্যে দাঁড়ি বসিয়ে ওপাশ থেকে বলতে লাগলো মানুষটা। আজ তার কথার মধ্যে ঝাঁঝ ছিলো, তেজ ছিলো, প্রচণ্ড রাগের আভাস বোঝা যাচ্ছিলো।
– খুব খারাপ লাগছে? হাড়ে-হাড়ে টের পাওয়ার কথা। সেদিন তোমার সামনে দাঁড়িয়েছিলাম, গাড়ি ব্যাক ঘুরিয়ে কত বড় রিষ্ক নিয়েছিলাম তোমার ধারণাও বাইরে। আমার পজিশনের পাওয়ারটা কোনোদিন খাটাইনি, সেদিন ফ্লাইট মিস করবো জেনে এ্যাজেন্সীর মালিককে শ্যাডিউল পিছাতে বলি। তোমার জন্য ওই ফ্লাইটের সত্তর জন যাত্রীর ভোগান্তি সহ্য করা লাগে। বাড়ি থেকে যখন বেরিয়ে এলাম, তখন ইচ্ছা করছিলো সৌভিককে বলে তোমাকে গ্রামে পাঠিয়ে দেই। পুরোটা রাস্তা তোমার ওইসব কথাগুলো কানে বিধেঁছে। তোমার উপর কি পরিমাণ ক্ষোভ কাজ করছিলো, সেটা যদি এককোণা পরিমাণ প্রকাশ করি তুমি আমাকে সহ্য করতে পারবেনা মেহনূর। আমাকে মনের খুশীমতো কথা শোনাবে, ইচ্ছামতো এটা-ওটা করে ফেলবে, এদিকে আমিও চুপচাপ শুনে তোমাকে আদর করতে আসবো, তোমার কথা ভুলে পিছনে-পিছনে ঘুরঘুর করবো, এই চিন্তা মাথা থেকে সম্পূর্ণ ঝেড়ে ফেলো। আমাকে অন্যদের মতো ভাবতে যেও না। এই ভুলটা যদি না করো তাহলে তোমার জন্যই ভালো। তুমি আমার হাসিখুশি রূপ দেখে অভ্যস্ত মেহনূর, সেটা নিয়েই থাকার চেষ্টা করো। আমার আড়ালে থাকা রূপটা টেনে-হিঁচড়ে বের করার চেষ্টা করো না, জাস্ট এটুকুই সতর্ক করবো, তুমি আমাকে সহ্য করতে পারবে না।
কাট-কাট গলায় তেজালো সুর শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলো মেহনূর। মুখের ভাষা হারিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে রইলো। মাহতিমের সহজাত রূপটা পলকে-পলকে যেনো অন্যরূপে বদলে যাচ্ছে। যাকে চেনা যায় না, বুঝা যায় না, জানাও যায়না এমনই স্থিতিতে গুলিয়ে যাচ্ছে। মেহনূর স্থির দৃষ্টিতে বুক ফুলিয়ে দম নিলো, নিশ্বাসটা ছাড়তে-ছাড়তে আটদিন আগের ক্ষত হাতটা চোখের সামনে তুললো। এখনো ঘা-টা শুকোয়নি, চাপ লাগলে এখনো ভীষণ ব্যথা করে। ক্ষতটার দিকে নির্মল দৃষ্টি রেখে স্বচ্ছ গলায় বললো মেহনূর,
– আপনার হাত ভালো হয়েছে?
বিছানার হেডসাইডে পিঠ ঠেকিয়ে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বসে আছে মাহতিম। রুমের লাইট নেভানো বলে জানালা দিয়ে বাইরের আলো এসে চর্তুদিকে আবছা অন্ধকার করে দিচ্ছে। ঠান্ডা-ঠান্ডা বাতাস তখন খোলা জানালা দিয়ে পর্দা উড়িয়ে ঢুকছে। মাহতিম উড়ন্ত পর্দার দিকে দৃষ্টি রেখে তাচ্ছিল্যের হাসিতে বললো,
– মনের খোঁজ নেওয়াটা জরুরী। হাতের জন্য ডাক্তার আছে।
উত্তর শুনে ফিক করে হেসে দিলো মেহনূর। হাতটা চোখের সামনে থেকে নামিয়ে বাঁ-পাশ থেকে মাহতিমের বালিশটা টেনে নিলো। বিছানার হেডসাইডে সেও পিঠ ঠেকিয়ে কোলে বালিশ রেখে বসলো। এদিকে মাহতিমের মাথায় অতিথিদের নিয়ে টেনশন কাজ করছে। সবচেয়ে বেশি টেনশন হচ্ছে মেহনূরকে নিয়ে। এই মূহুর্তে যদি ওর কিছু হয়ে যায় তাহলে কিভাবে সবকিছু সামাল দিবে? মাহদিকে একা পেয়ে গাল চেপে ধরেছে, যদি মেহনূরকে সুযোগ মতো কিছু করে ফেলে? কোনোকিছুই ঠিকঠাক মতো ভাবতে পারছেনা মাহতিম। বাড়ি ফিরার জন্য মন ও মস্তিষ্ক ব্যকুলভাবে আনচান করছে। বিছানার ডানপাশ থেকে চারকোণা বস্তুটা হাতে তুলে নিলো মাহতিম। আবছা অন্ধকারের ভেতর সেই বস্তুটার দিকে একাগ্রমনে তাকিয়ে রইলো। কালো রঙের ফটো-ফ্রেমটা আজ সকালেই ডেলিভারি ম্যান দিয়ে গেছে। গোলাপি শাড়ি পড়ুয়া মানবী হাতে উপন্যাস নিয়ে ডুবে আছে, তার দীর্ঘকেশগুলো পিঠ ছাড়িয়ে মাটিতে পরে আছে। আনমনে নিজের ভুবনে থাকা নারীমূর্তির ছবিটা রেসোর্টে থাকার সময় মাহদি তুলেছিলো। ভাগ্যিস ফোনটা মাহতিমের ছিলো বলে আজ একটুকরো ভালোবাসা নিজের কাছে রাখতে পেরেছে। মাহতিম ছবিটার দিকে দৃষ্টি রেখে মেহনূরের উদ্দেশ্যে বললো,
– তোমার বইগুলো যেই ভাগ্য নিয়ে এসেছে, আমার নসিবে সেই ভাগ্যটুকু নেই। তোমার বইগুলো যখন-তখন তোমার কোমল-কোমল আঙ্গুলগুলোর ছোঁয়া পাচ্ছে, তোমার কোলটায় নিজেদের গুঁজে নিয়েছে, তোমার কাছে থাকার সুযোগ তারাই বেশি পায়। আমি ঠিক এতোটাই দূরে আছি যে, যদি তোমার কিছু হয়েও যায় তাও আমি আসতে পারবো না। নিজের দিকে খেয়াল রেখো মেহনূর। এবার ফিল্ড থেকে ফিরলে আমাকে একটু ……
চোখদুটো বন্ধ করে গভীরভাবে নিশ্বাস ছাড়লো মাহতিম। কান থেকে ফোন সরিয়ে কলটা কেটে দিলো। ফটোফ্রেমটা বিছানায় ফেলে ফ্লোরে পা রেখে দাঁড়ালো। খোলা জানালার দিকে উদাস দৃষ্টি রেখে ধীরপায়ে সেখানে গেলো। ট্রাউজারের দু’পকেটে হাত গুঁজে জানালা দিয়ে নিচে তাকালো মাহতিম। সুইমিংপুলের টলমল পানিতে আকাশের ছাপ পরে আছে এখন। বাতাসের জন্য পানির উপর মৃদ্যু স্রোত দেখা যাচ্ছে, স্রোতের প্রবাহে আকাশের প্রতিচ্ছবিটা নড়েচড়ে উঠছে। ডানপকেট থেকে হাত বের করলো মাহতিম। মুঠোবন্দি হাতটা কাছে এনে আঙ্গুলগুলো আলগা করে ফেললো, ওমনেই মুঠোয় থাকা পাসপোর্ট সাইজের ছোট্ট ছবিটার দিকে দৃষ্টি রাখলো। কিছু সময় নিরব থেকে একাকী রুমের ভেতর বলতে লাগলো মাহতিম,
– তোমার মিষ্টি মুখটায় অসংখ্য চুমু মেহনূর। যতো দূরেই থাকিনা কেনো তোমার কিচ্ছু হতে দিবো না। চাইলে এখুনি তোমার কাছে ফিরতে পারি, কিন্তু কাজ ফাঁকি দেওয়াটা আমার দ্বারা কোনোকালেই সম্ভব না।
.
আকস্মিকভাবে ফোন কেটে দেওয়াতে কিছুটা আশ্চর্য হয় মেহনূর। তাঁর রাগ কি এখনো কমেনি নাকি ক্ষোভটা এখনো দেখিয়ে যাচ্ছে? মেহনূর ফোন হাতে নিয়ে দশ মিনিটের মতো অপেক্ষা করলো, কিন্তু কল এলো না। এবার আর মন খারাপ হলো না, মনে-মনে ভেবে নিলো হয়তো কাজে ব্যস্ত হয়ে পরেছে। এখন আর রাতের সময়টুকু ঘুমায় না মেহনূর, গ্রামে যেভাবে বই নিয়ে সময় কাটাতো সেভাবেই বই নিয়ে বিছানায় শুয়ে পরলো। হাতে এখন ‘ সমুদ্রবিলাস ‘ নিয়ে মগ্ন হয়েছে, সময়ের প্রহর বাড়তে-বাড়তে রাতটা গভীরভাবে তলিয়ে যাচ্ছে। রাত্রি যখন দ্বিপ্রহরের ঘন্টা বেজে উঠলো তার কিছু মিনিট পরপরই রুমের দরজায় ঠকঠক করে উঠলো। মেহনূর বই থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ঘড়ির দিকে তাকালো, এতো রাতে এই রুমে কে নক করছে? মেহনূর বইটা বন্ধ করে পাশে রেখে শোয়া থেকে উঠে বসলো। দরজার দিকে দৃষ্টি রেখে প্রশ্নাত্মক গলায় জিজ্ঞেস করলো,
– কে?
‘ ক্যাচ ‘ করে শব্দ তুলে দরজা খুলতে লাগলো, দরজা একটু ফাঁক হয়ে গেলে রুমের ভেতরে পা রাখলো মাহদি। মেহনূরের দিকে চিলতেখানি হাসি দিয়ে দরজা চাপিয়ে কাছে এলো। বিছানার কাছে এসে পাশে বসতেই হাসি-হাসি গলায় বললো,
– আমার শত্রু ফোন দিয়েছিলো তাইনা? তোমাকে কাঁদালে আমার কাছে বিচার দিবে ঠিক আছে? আমি একেবারে ফাল্টি-ফাল্টি করে সাইজ করে দিবো।
মাহদির দুঃসাহসিক আচরণ দেখে খিলখিল করে হেসে উঠলো মেহনূর। মাহদিকে কাছে কোলে বসিয়ে নিলো, গালদুটো দুহাতে ধরে কপালে ছোট্ট চুমু দিতেই হাসিসূচকে বললো,
– তোমার কিচ্ছু করতে হবে না পুচকে দেবর। তুমি যে এতো রাতে না ঘুমিয়ে এখানে এসেছো, এটা কি ঠিক হলো? ঘুমাওনি কেনো? কিছু লাগবে?
মাহদি কোনোপ্রকার উত্তর না দিয়ে মেহনূরের গলা জড়িয়ে ধরলো। মেহনূরের কাধে গাল ঠেকিয়ে নিচু স্বরে বললো,
– আমি তোমার কাছে ঘুমাবো বউ। ভাইয়া তো এখন নেই, আমি তোমার কাছে একটু ঘুমাই?
মাহদির আকুতিসম্পণ্ণ কন্ঠ শুনে ‘ না ‘ করলো না মেহনূর। প্রসন্ন গলায় হাসি দিয়ে মাহদির পিঠ বুলিয়ে বললো,
– আমি কি কখনো না করেছি? করিনি তো। যখন ইচ্ছে তখন চলে এসো।
মাহদি দুপাটি দাঁত বের করে প্রফুল্ল হাসিতে মেতে উঠলো, মেহনূরকে ছেড়ে দিয়ে পাশে বালিশ টেনে শুলো। মেহনূর রুমের জানালায় পর্দা টেনে দিয়ে কম্বল বের করলো। কম্বলের ভাঁজটা খুলে দিয়ে মাহদির গা ঢেকে দিতেই নিজেও কম্বলের নিচে ঢুকে পরলো। ঘুমানোর জন্য মাহদির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকলে অন্যদিকে পকেট থেকে ফোন বের করলো মাহদি। মিচকি-মিচকি হাসিটা অনেক কষ্টে ভেতরে চেপে ছোট্ট একটা ম্যাসেজ টাইপ করলো,
– তোমার বিছানায় আমার বউ নিয়ে ঘুমাচ্ছি ভাইয়া। আমার বউ আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছে, ইয়াহু, ইয়াহু।
ম্যাসেজটা পাঠিয়ে বিশ্বজয়ীর হাসি দিয়ে মেহনূরের দিকে একপলক তাকালো। মেহনূরের দৃষ্টি তখন দেয়ালে আটঁকে থাকা বন্দুকটার দিকে স্থির হয়ে আছে। মাহদি সেটা দেখতে পেয়ে মেহনূরকে কিছু বললো না, চুপচাপ ঘুমের জন্য চোখ বন্ধ করে ফেললো।
.
রাতের আধার চিড়ে ধীরে-ধীরে ভোরের আলো ফুটে উঠলো। পূবদিকটা অরুণপ্রভায় রাঙা হয়ে দিনের আর্বতনে পরিবর্তন হলো। ভোরের আলো পেয়ে জাগ্রত হলো পাখিরা, মসজিদে-মসজিদে আযানের সুর শেষ হয়ে জামাতের সালাত শুরু হলো। পাখিরা কিচিরমিচির করতে-করতে জাগিয়ে দিলো গাছের সতেজতা। মৃদ্যু হাওয়ায় পর্দা উড়ে স্থানচ্যূত হলো, তখনই পূবের সোনালী আলো এসে মেহনূরের চোখদুটোতে ভর দিলো। আলোর তীব্রতায় ঘুমের ঘোরেই চোখ কুঁচকালো মেহনূর, সাথে-সাথে একটা হাত এনে চোখের উপর আড়াল করে ধরলো। চোখের পল্লবজোড়া আস্তে-আস্তে খুলে সকালের প্রথম প্রহরটা দেখতে পেলো, ওমনেই দেখতে পেলো মাহদি গুটিশুটি পাকিয়ে মাথা পযর্ন্ত কম্বল দিয়ে মুড়ে রেখেছে। মেহনূর ঈষৎ ভঙ্গিতে হেসে দিয়ে আস্তে করে মাহদির মাথা থেকে কম্বল সরিয়ে দিলো। যেটা ভেবেছিলো তাই দেখলো, মাথাটা ঘেমে উঠেছে। মেহনূর আচঁলটা টেনে মাহদির মাথা মুছে দিলো, এরপর শোয়া থেকে উঠে বসলো মেহনূর। ঘুমের আড়মোড়া ভাঙ্গার জন্য শরীরটা একটু টানা দিয়ে নিলো। চোখটা ডলতে-ডলতে বালিশের তলা থেকে ফোন বের করলো, সেটা অন করে অভ্যেস মতো দেখলো, আজও কি মানুষটা স্মরণ করেছে কিনা। ফোনের স্ক্রিনটা আজও খালি, না স্মরণ করেনি। মেহনূর ভারী একটা নিশ্বাস ছেড়ে বিছানা থেকে নেমে গেলো, হাত-মুখ ধুয়ে এসে দরজা খুলে বাইরে বেরুলো। উদ্দেশ্য এখন ছাদের রুমটার দিকে খেয়াল রেখে আসা। মেহনূর সিড়ি ধরে উপরে উঠে নিজের আসল রুমটার দরজা ঠেলে দিলো, হাই তুলে ভেতরে ঢুকতেই হাইটা সেখানেই ওইভঙ্গিতে আটঁকে গেলো। আশ্চর্য হয়ে রুমের ভেতরে ঢুকে আশে-পাশে তাকাতেই বুকটা নিংড়ে এলো মেহনূরের!
– চলমান .
#FABIYAH_MOMO .
#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই
#পর্বসংখ্যা_৩৭.
#ফাবিয়াহ্_মমো .
শেষ অংশসংখ্যা .
নিশ্বাসটা যেনো গলার মধ্যে আঁটকে গেছে, চোখদুটোর অবস্থা বিষ্ময়ে অভিভূত। মেহনূর বিধ্বস্ত রুমটার ভেতর একপা-একপা করে এগুচ্ছে, ওমনেই নিশ্বাসের প্রখর যেনো ছ্যাৎ ছ্যাৎ করে বুকের পিষ্টনে আঘাত করছে। বিছানার চাদরটা অস্বাভাবিক আকারে দলা পাকিয়ে আছে, যেনো টেনেটুনে ছিঁড়তে চাওয়ার বাসনা ছিলো। ফ্লোরের উপর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ছেঁড়া বালিশের তুলা, টেবিলের উপর যে গ্লাস দুটো রেখেছিলো সেগুলো এখন চূর্ণবিচূর্ণ। স্বাভাবিক কায়দায় রেখে যাওয়া রুমটা একরাতের ভেতর লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। কে করেছে, কেনো করেছে কিচ্ছু মাথায় ঢুকছেনা, কেনো এসব হলো? মেহনূর জড়সড় মন নিয়ে বিছানার কাছে এসে দাঁড়ালো, ভীতশঙ্কিত চাহনি নিয়ে ধীরে-ধীরে ধ্বংসাত্মক অবস্থা দেখতে লাগলো। দেখতে-দেখতে যেই ভীতিপ্রবণ চোখদুটো আলমারির দিকে আঁটকালো, তখনই বিস্ফোরণ চাহনিতে মুখের উপর হাত চাপা দিলো মেহনূর। উন্মাদের মতোই হোক, বা অস্থিরচিত্তের মতোই, মেহনূর ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র কাঁচকণাকে উপেক্ষা করে দৌড়ে সেদিকে পা বাড়ালো। পায়ের তলায় নরম চামড়া ভেদ করে ক্ষুদ্র ধারালো কাঁচ টুকরো ঢুকলো, ব্যথায় চোখ খিঁচে আসলেও নিচের ঠোঁটটা দাঁতে কামড়ে হজম করলো। হাতদুটো দিয়ে পাগলের মতো আলামারির ভেতরটা হাতাপিতা করতে লাগলো মেহনূর, প্রত্যেকটা হ্যাঙ্কার সরিয়ে-সরিয়ে বেঁচে যাওয়া শাড়ির খোঁজ করতে লাগলো। সতেরটা শাড়ির একটা শাড়িও অবশিষ্ট নেই, সবগুলো শাড়ি নৃশংসভাবে কেটে ফেলা হয়েছে। তবুও উন্মাদের মতো বারবার দেখতে লাগলো মেহনূর, পায়ের তলায় যে কঠিন ব্যথা হচ্ছিলো সেটা কোনোভাবেই তোয়াক্কা করলো না। গুণে-গুণে সতেরটা শাড়ি দিয়ে লাগেজভর্তি করে দিয়েছিলো মাহতিম। যাওয়ার আগে একটা কথাই বলেছিলো, বয়সটা যখন আঠারোয় এসে পৌছাবেতখন আঠারো নাম্বার শাড়িটা সে নিজে এসে কিনে দিবে। তদ্দিন পযর্ন্ত সতেরটা শাড়ির সঙ্গেই যেনো দিনগুলো কাটতে থাকুক, কিন্তু আজকের এই ঘটনা সমস্ত কিছু চুরমার করে দিয়েছে। মেহনূর নিরুপায় হয়ে নিস্তেজ ভঙ্গিতে থেমে যায়, নষ্ট করা শাড়িগুলো ওভাবেই রেখে আলামারি থেকে ঘুরে দাঁড়ায়। প্রত্যেকটা অবস্থা দেখে চিল্লিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। যেদিন থেকে মাহতিম বিদায় হলো সেদিন থেকেই মনের ভেতর ভীতি ঢুকে গেছে। এই ভীতিটা দিনকে-দিন ভয়ানক আকারে বাড়ছে, শুধু বাড়ছে। কমার অবস্থা একদম নেই। মেহনূর বিকারহীন ভঙ্গিতে থম মেরে ছিলো, আস্তে-আস্তে বাস্তবিক অবস্থায় ফিরে এলে পায়ের তলাটা যেনো বিষিয়ে উঠলো। ফ্লোরে ধপ করে বসতে পারলে শান্তি পেতো মেহনূর, কিন্তু কাঁচের টুকরো দিয়ে ঘরভর্তি ছড়িয়ে আছে তখন। শাড়ির কুচিগুলো ডানহাতে খাবলে একটু উঁচু করে তুললো শাড়িটা, অন্যহাত দিয়ে শাড়ির আচঁলটা মুঠো করে ধরে রইলো। ধীর কদমে এগুতে-এগুতে বহুকষ্টে ছাদের পরিখা পার করলো। এরপর সিড়ি ধরে নিচে নামতেই ব্যথাতুর কন্ঠে ‘ মা ‘ বলে ডেকে উঠলো মেহনূর। ডাকটা যে বেশিদূর যায়নি এবং কারোর কানেই পৌঁছনোর কথা না সেটা বুঝতে পারলো মেহনূর, কিন্তু গলা উঁচিয়ে যে কাউকে ডাকবে সেটাও তীব্র যন্ত্রণার কাছে পরাস্ত হয়ে যাচ্ছে। রজনীর রুম থেকে পরিষ্কারের কাজ শেষ করে সাবু খালা পান চিবাতে-চিবাতে বের হচ্ছিলো, জিহবা দিয়ে উপরপাটির দাঁতগুলো বুলিয়ে নিতেই সিড়ির দিকে দৃষ্টি পরলো। ভ্রুঁ খানিকটা কুঁচকে অনেকটা কৌতুহলের সাথেই সেদিকে এগিয়ে গেলো, মেহনূরের যন্ত্রণাকাতর মুখ দেখে ওর দিকে আপাদমস্তক তাকিয়ে বললো,
– ও বউ, তোমার মুখ এমুন লাল হইয়া আছে ক্যা? কুনোহানে বিষ-ব্যাথা করতাছে নি? তোমার অবস্থা যে আমার কাছে ভালা ঠেকতাছে না।
মেহনূর খিঁচুনি দেওয়া চোখদুটো পিটপিট করে খুললো, অনেক কষ্টে ঢোক গিলতেই আবারও চোখ খিঁচুনি দিয়ে মাথানত করে বললো,
– পায়ে কাঁচ ঢুকেছে খালা। আমি ঠিকমতো হাঁটতে পারছিনা, খুব জ্বলছে।
‘ হায়, হায় ‘ আর্তকন্ঠে চিল্লিয়ে উঠলো সাবু খালা। ঢলঢলে দেহটা নিয়ে দ্রুত সে মেহনূরের হাতটা শক্ত করে ধরলো। মেহনূরের একটা হাত নিজের কাধের উপর টেনে নিতেই চিন্তিত কন্ঠে বললো,
– বউ কামডা তুমি ঠিক করলা? এহন যদি আফায় আমারে ইচ্চামতু বকে তাইলে আমার কি হইবো কওতো দেহি? ইশশি রে, কাঁচ ঢুকলে যে কি ব্যথা! বউ একটু ধৈইর্য্য ধরো, আমি এহুনি তোমার ব্যথা কমায়া দিতাছি।
সাবু খালা কথায় যেমন চটপট, কাজের বেলাতেও পটুতা দেখিয়ে দিলো। মেহনূরের মতো পাতলা দেহী মানুষকে সে একাই ধরে-ধরে কোনো কষ্ট ছাড়া মাহতিমের নিয়ে গেলো। বিছানায় বসিয়ে দিতেই মাথায় রঙচটা আচঁলটা ঠিক করে ব্যান্ডেজের সরন্ঞ্জামাদি এনে মেহনূরের মুখোমুখি হয়ে বসলো। স্যাভলনের মুখটা তিন আঙ্গুলে ঘুরাতে-ঘুরাতেই বললো,
– পা দুইটা আস্তে কইরা কোলে তুলো বউ।
মেহনূর দাঁত-মুখ শক্ত করে পাদুটো সাবু খালার কোলের উপর তুললো। খুলে রাখা স্যাভলনের চ্যাপ্টা বোতলটা একপাশে রেখে ছিলো সাবু খালা, খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে পায়ের তালুটা দেখতেই ব্যথিত দৃষ্টিতে বলে উঠলো,
– বউ গো, যেই সর্বনাশ করছো এই সর্বনাশের কথা যুদি বড়বাবায় জানে, আমারে না ধুইয়া ফালাইবো! এইডা কি করলা কও দেহি? ক্যামনে তুমি সর্বনাশডা করলা?
মাহতিমের প্রসঙ্গ আসতেই খিঁচুনি দেওয়া চোখদুটো খুলে তাকালো মেহনূর, এদিকে পাকা হাতে তুলো ছিঁড়ে ঘা পরিষ্কার করছে সাবু খালা। ব্যথায় যেনো বিদ্যুতের মতো টনটন করে বাজছে মেহনূরের,হাঁটুর উপর খামচে রাখা হাতটা আরো শক্তভাবে খামচে নিয়ে রুষ্ট গলায় বললো সে,
– খালা, আপনার কাছে অনুরোধ, আপনি ভুলেও উনার কাছে কিছু বলবেন না। আমার কথাটুকু মান্য করুন, উনি শুনলে তুলকালাম কাণ্ড বাঁধিয়ে দিবেন।
কাঁচের ক্ষুদ্র কণাটা এইফাঁকে দু’আঙ্গুলের নখ দিয়ে টেনে বার করলো সাবু খালা, আচমকা ব্যথায় অস্ফুট সুরে শিউরে উঠলো মেহনূর। চোখদুটো বন্ধ করে ঠোঁট গোল করে সশব্দে নিশ্বাস ছাড়তেই সাবু খালা সেখানে তুলা চেপে বললো,
– তোমার এই অবস্থার কথা আমার কওন লাগতো না। তোমার দুই নাম্বার জামাই গিয়া আসল জায়গায় পাচার কইরা দিবো।
চট করে চোখ খুলে প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকালো মেহনূর। চিকন-চিকন ভ্রুঁদুটো কপালে ভাঁজ ফেলে দিলো। হাঁটুর উপর খামচে ধরা হাতটা ধীরে-ধীরে শিথিল হতে থাকলে সাবু খালা ওর দিকে দৃষ্টি তুলে বললো,
– ওই পাকনারে থামান যাইতো না বউ। বড়বাবার কাছে ঠিকই লাগায়া দিবো। তার চেয়ে তোমারে ভালা বুদ্ধি দেই শোনো, তুমি এহুনি বড়বাবারে ফুন দিয়া ঘটনাডা কইয়া দেও। তাইলে আর সমিস্যা হইবো না।
মেহনূর মুখ ফুটে কিছুই বললো না, ওইমূহুর্তে স্থির হয়ে চুপ থাকা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। এমনেতেই রুমের অবস্থা দেখে মাথাটা ভোঁ ভোঁ করছে, তার উপর দ্বিতীয় দুশ্চিন্তায় মগ্ন হলে সর্বনাশটা ঠিকই হবে। পাদুটো সাদা ব্যান্ডেজে ঢেকে দিয়ে রক্তাক্ত তুলাগুলো ডাস্টবিনে ফেললো সাবুখালা, ফিরে এসে মেহনূরের সামনে বসতেই একগাদা প্রশ্ন ছুঁড়ে বসলো। পড়নে বাটিকের সবুজ শাড়ি, সবুজের উপর কমলা রঙের গোল-গোল ছাপ, ব্লাউজটা বাহুদুটোর উপর টাইট ফিটিং হয়ে চিপসে আছে, পেটের ভূড়িটাও বেশ স্বচক্ষে বোঝা যায়। পানের রসে ঠোঁটদুটো টকটকে লাল, দাঁতও লালবর্ণে লেপ্টে আছে, ‘ আনসারী নিবাসে ‘ প্রায় পনেরো বছর যাবৎ বিশ্বস্ততার সাথে কাজ করছে, চালচলন এবং দেহের স্থূলতা দেখে বয়সের কোঠা অনুমানের বাইরে। মেহনূর অনেকক্ষণ যাবৎ চুপ থেকেও সাবু খালা খোচাখুচির প্রশ্ন থেকে রেহাই পেলো না, ভীতিকর পরিস্থিতিটা যথাসম্ভব সংক্ষেপেই বলে দিলো মেহনূর। সাবু খালা এতো বড় ঘটনা শুনে কোনো প্রতিক্রিয়াই দেখালো না, উলটো ঝিম মেরে কিছুক্ষণ অন্যমনষ্ক হয়ে বসে রইলো। মেহনূর ভেবেছিলো সাবু খালা এই ঘটনা শুনে এলাহীকাণ্ডের মতো বাড়ি মাতিয়ে তুলবে, নিজেই এদিক-ওদিক না তাকিয়ে মাহতিমকে ফোন করে বসবে। অথচ চরম আশ্চর্যের ব্যাপার, সে কিছুই করলো না। শান্ত-স্থির হাবভাব দেখে মেহনূরের মনটা খটমট করতে লাগলো, নিশ্চিতরূপে বলা যায় সাবু খালার নিঃশ্চুপের পেছনে বিরাট কোনো কারণ লুকিয়ে আছে। মেহনূর মারজার জন্য খোঁজ করলো, এদিকেও সে জানতে পারলো মারজা খুব সকালের দিকে ডাক্তারের কাছে চেক-আপ করতে গিয়েছে। মেহনূরকে তিনি সঙ্গে নিতে চেয়েছিলেন কিন্তু রজনীর জন্য নাকি নেননি। অন্যদিকে হাতমুখ ধুয়ে পরিপাটি হয়ে বড়ভাইয়ের রুমে আসে মাহদি। সবসময়ের মতো আজও সে মাহতিমের রুমে মেহনূরকে পেয়ে যায়, কিন্তু পায়ের দিকে দৃষ্টি যেতেই পুচকে দেবরের বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখীন হয় মেহনূর। অনেকটা নিরুপায় হয়েই মাহদির কাছে সব কথা বলে দেয়, এতেও মাহদির গভীর কৌতুহলের জায়গাটা তৃপ্তি পায়নি। মেহনূরের সরল মস্তিষ্ক যেখানে গোলকধাঁধার নিয়ম ধরতে পারতোনা, সেখানে বড়ভাই মাহতিমের সাথে উঠ-বস করতে-করতে মাহদি এসব নিয়ে যথেষ্ট তৎপর হয়েছে। আজও সে গোড়ার দিকটা ধরার জন্য মেহনূরকে নাস্তা খাওয়ার নাম করে রুম থেকে বেরিয়ে যায়, ট্রাউজারের ডান পকেটে হাত ঢুকিয়ে ফোনের অস্তিত্বটা দেখে নেয়, এরপর সোজা ছাদের রুমটায় চলে আসে মাহদি। দরজার পর্দাটা ডানহাতে সরিয়ে ভেতরে ঢুকতে নিলে চোখ ছানাবড়া অবস্থায় থমকে যায়, এক-এক করে সবক’টা জিনিসে চোখ বুলিয়ে তাড়াতাড়ি পকেট থেকে ফোন বের করে। আজ কোনোভাবেই অস্থির হলে চলবে না, যথাসম্ভব শান্ত থাকার চেষ্টায় মাহদি অনুভব করলো তার পাদুটো কাঁপছে। ঠিকমতো দাঁড়িয়ে থাকতে পারছেনা। তবুও মনের উপর সাংঘাতিক জোর খাটিয়ে কলটা ডায়ালে ফেললো মাহদি, কোমরে ডানহাত রেখে কানে ফোন ঠেকালো তখন। পরপর দুটো রিং যেতেই ওপাশ থেকে রিসিভ হলো কলটা, মাহদি তৎক্ষণাৎ ত্রস্তভঙ্গিতে বলতে শুরু করলো,
– আপু, ভাইয়া সবাই শোনো, প্লিজ শোনো, আজ বাড়িতে মা নেই। মা সম্ভবত ইকবাল আঙ্কেলের কাছে গিয়েছে। আমার বউয়ের রুমটা একদম তছনছ করা, আমি মাত্র দেখেছি। ওর পায়ে দেখলাম সাবু খালা ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে। আমি কি কর —
কথাটা বলতে যেয়ে আঁটকে গেলো মাহদি। ভয়টা যে ওকেও কঠিনভাবে কাবু করে ফেলেছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। মাহদি শুষ্ক ঠোঁটে জিভ বুলিয়ে লম্বা-লম্বা নিশ্বাস টানতে লাগলো, গলাটা ভেজানোর জন্য বরফ ঠান্ডা পানি দরকার। বরফ কুচি ছেড়ে দেওয়া পানি ঢকঢক করে গিললে হয়তো খরতপ্ত গলাটার তৃষ্ণা মিটবে। মাহদির কথা মাঝপথে থামার পর কলের ওপাশ থেকে একযোগে চিল্লিয়ে উঠলো আটজন,
– মাহদি তুই ঠিক আছিস?
আটটা গলা একসাথে চিল্লানোর জন্য চমকে উঠলো মাহদি, তাড়াতাড়ি কান থেকে ফোনটা একটু দূরে সরাতে বাধ্য হলো। কানটা আরেকটু হলে ঠিকই কালা বানিয়ে ছাড়তো ওরা, মাহদি সাথে-সাথে বিরক্তিতে মুখ ভার করে বললো,
– তোমাদের কতোবার বলবো এভাবে চিল্লাবে না? আমি ভয় পেয়ে যাই জানো না? আমি ঠিকই আছি, আমি মাত্র ঘুম থেকে উঠলাম। সাবু খালাকে রুম পরিষ্কার করতে বলে এলাম। আমি কি করবো বুঝতে পারছিনা, রজনী মামী অনাকে নিয়ে কালরাত থেকে ফুসুর-ফাসুর করছে। আমি দূর থেকে কিচ্ছু শুনতে পাইনা। আজ মা’ও নেই এখন কি করবো মাথায় ঢুকছেনা।
হোয়াটসঅ্যাপের গ্রুপ কলে একত্র হয়েছে সবাই। সৌভিক অফিসের মিটিং বাদ দিয়ে মাহদির কল ধরে আছে, তৌফ মুখে ব্রাশ ঢুকিয়ে কথা শুনছে, সিয়াম গাড়ি ড্রাইভ করতে-করতে কানে ফোন চেপে আছে, নীতি লেকচার এ্যাটেন্ড করা বাদ দিয়ে ক্লাস থেকে বেরিয়ে এসেছে, প্রীতি ক্যান্টিনে বসে আধা খাওয়া চা রেখে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে, সাবির শোয়া থেকে না উঠলেও সজাগ হয়ে গেছে, সামিক আপাতত কাজহীন তাই তার সমস্যা হয়নি, ফারিন ফোনের নেটওয়ার্কটা ঠিকঠাক পাওয়ার জন্য জানালার বাইরে ফোন ধরে আছে, ফোনের স্পিকারটা লাউডে দেওয়া। মাহদির বিরক্তি মেশানো কন্ঠ শুনে সবার আগে চেঁচিয়ে উঠলো তৌফ। ব্রাশটা মুখ থেকে বের করে চেঁচানো সুরেই বললো,
– তুই যে আমার বুকপিন্ডটা খত’ম করার তালে আছোস জানা আছে? তোর কল দেখলেই আমার কলিজা ভয়ে থপথপায়।
তৌফের কথা শুনে এবার ফারিন ভ্রুঁ কুঁচকালো। তৌফের অস্ফুট ভঙ্গির তোতলামি শুনে ফারিন স্পষ্ট গলায় বললো,
– তুমি এমন ‘ ওয়া ওয়া ‘ করে তোতলাচ্ছো কেনো? তোমার কি ভয়ের চোটে মৃগী ব্যারাম ধরলো? আর বুকপিন্ড কি শব্দ? কি আজেবাজে বকছো তুমি?
ফারিনের ত্যাড়ামো ধরনের প্রশ্ন শুনে ক্ষেপে উঠলো তৌফ। গলাটা হাই ভলিউমে উঁচু করে গজগজ সুরে বললো,
– মুখে ব্রাশ নিয়া তারপর কথা বলতাছি বুঝছোস? হাদা কোথাকার, মাথায় সামান্যতম বুদ্ধি নেই। সকালে মানুষ কি করে হ্যাঁ?
তৌফের ক্ষেপাটে ভঙ্গির সুর শুনে ওপাশ থেকে নিরব রইলো ফারিন। নিরব ছিলো সবাই, কারণ হঠাৎ ফোনের মধ্য থেকে ‘ গড়গড় ‘ জাতীয় শব্দ শোনা যাচ্ছে। ফারিন-সহ সবাই তখন কপাল কুঁচকে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবে, তার আগেই ফারিন হামেশার মতো আগ বাড়িয়ে বললো,
– এই শব্দ কি ফ্লাশের না? ছিঃ ছিঃ তৌফ ভাই তুমি হাই কমোডে —
ফারিনের কথা শেষ না হতেই ছোঁ মেরে কথা টান দিলো সৌভিক। যথেষ্ট সংযত গলায় স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললো,
– আমি জরুরী মিটিং ছেড়ে তোদের দুটোর বকবক শুনতে আসিনি। মাহদি চটপট বলতো আর কি কাহিনী হয়েছে? আমি কি ছুটি নিয়ে সেখানে আসবো? তোর কি খুব অসুবিধা হচ্ছে? তুই কি আর দুটো দিন ম্যানেজ করতে পারবি না?
এবার সৌভিকের কথার প্রেক্ষিতে মুখ খুললো মাহদি। যেই কথা বলতে নিবে ছাদের খোলা দরজার দিকে সর্তক দৃষ্টি চলে গেলো ওর। কিছু একটা তীক্ষ্মদৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখতেই তাড়াতাড়ি কল কেটে ফোন পকেটে ঢুকালো। আজ যেহেতু মা নেই, এই সুযোগটা কি হাতছাড়া করবে ওরা? আদৌ কি হাতছাড়া করার পরিকল্পনা করেছে? ছাদের দিকে কেউ যেনো এগিয়ে আসছে, এগিয়ে আসার জোরদার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। শব্দটা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে এখন। খোলা ছাদের উপর তখনই বয়ে চললো দমকা হাওয়া। বাতাসে মাহদির কমলা টিশার্টটা হালকা মতোন উড়লো, মাথার ঝিলমিল করা চুলগুলো বাতাসের দোলায় কপালের উপর আছড়ে পরলো। দুটো কুন্ঞ্চিত ভ্রু’র নিচে একজোড়া সর্তক চাহনি এমন কিছু দেখলো, ওই চোখদুটো রাগে জ্বলজ্বল করে উঠলো আবার।
.
শীতের খোলসে ঢাকা পরেছে প্রকৃতির নান্দনিক রূপ। গ্রামের আনাচে-কানাচে শীতের ভরা মৌসুম। পড়ন্ত বিকেলের সূর্যটা তেজ হারিয়ে পশ্চিমে হেলে পরেছে, অরুণশক্তি নিস্তেজ হয়ে শীতের প্রকোপ বাড়িয়ে দিচ্ছে। গ্রামের মানুষরা গায়ে চাদর জড়িয়ে নিত্যকর্মে নেমেছে। কেউ-কেউ অলসতাকে সাঙ্গ করে ঘুরে বেড়াচ্ছে বেকার। মোল্লাবাড়ির মুখরোচক ঘটনাটা এতোদিনে চাপা পরে গেছে, সবাই ব্যস্ত হয়ে পরেছে অন্য বাড়ির সমালোচনা নিয়ে। কাঠের ইজিচেয়ারে ক্যাচ ক্যাচ করে শব্দ হচ্ছে এখন, শব্দটা নিস্তব্ধ রুমটায় ভূতুড়ে কায়দায় ঘুরপাক খাচ্ছে। রুমে একটি মাত্র জানালা খোলা আছে, সেই জানালা দিয়ে যতটুকু আলো প্রবেশ করছে তা অন্ধকার হ্রাসের জন্য যৎসামান্য। চাপিয়ে রাখা দরজায় ঠকঠক করে শব্দ হলো, ইজিচেয়ারটা সহসা থমকে যেতেই ক্যাচক্যাচ শব্দটা আর হলো না। বাইরে থেকে আগত মানুষটা কান খাড়া রেখেছিলো, অবিরাম শব্দটা থেমে গেলে সে আধ-ভেজানো দরজা ঠেলে দিলো। দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিতেই আধো-আধো অন্ধকার ফুঁড়ে বাঁদিকে দৃষ্টি গেলো লোকটার, গলা খাকাড়ি দিয়ে ইঙ্গিত দিতেই গম্ভীর সুরে এবার ইজিচেয়ার থেকে উত্তর চলে এলো,
– ভেতরে আসো জহিরুল।
খুবই নিঃশব্দ কায়দা বজায় রেখে ভেতরে ঢুকলো জহিরুল। অনেকটা চোরের মতোই ভেতরে প্রবেশ করলো। কোনো বিশেষ আজ্ঞা না পেলেও নিজ দায়িত্বে দরজাটা ভেতর থেকে ছিটকিনি-বদ্ধ করে দিলো। ইজিচেয়ারে দুলতে থাকা মানুষটা ছিটকিনি লাগানোর আওয়াজ পেতেই চোখ কাঠিন্য করে তাকালো, ততক্ষণে জহিরুল সামনে এসে হাজির। ঘিয়ে রঙের পান্ঞ্জাবীটার ডানপকেটে হাত ঢুকালো সে, সঙ্গে-সঙ্গে দুটো খামে বদ্ধ চিঠি সামনে ধরলো হান্নান শেখের। কাঠিন্য দৃষ্টিদুটো বাড়িয়ে দেওয়া হাতের দিকে স্থির এখন। একবার খামদুটোর দিকে তাকালো হান্নান শেখ, আরেকবার দৃষ্টি তুলে জহিরুলের দিকে তাকালো। মার্জিত শব্দে কঠোর আভাসে জিজ্ঞেস করলো জহিরুলকে,
– চিঠি আসার কথা মাঝ রাতে। এখন এসেছে কেনো?
জহিরুল নতমুখে আমতা-আমতা করে বললো,
– চাচাহুজুর, এই ব্যাপারে আমিও কিছু কইতে পারিনা। শফিক্কা আমার হাতে দুইডা চিঠি গুইজা দিয়া কয়, তাত্তাড়ি আমনের হাতে দিতে।
প্রচণ্ড সংকীর্ণ মনে কপাল কুঁচকে গেলো হান্নান শেখের। তিনি নিজেই যেটা নিয়ে ভয়ে-ভয়ে ছিলেন সেটা সম্ভবত ফলতে শুরু করেছে। হান্নান শেখ খামদুটো হাতে নিয়ে উলটে-পালটে দেখতে লাগলেন, ছোট্ট একটা প্রশ্ন জুড়ে জহিরুলকে প্রশ্নবিদ্ধ করলেন,
– তোকে কেউ আসতে দেখেছে?
–
জহিরুল ‘ না ‘ ভঙ্গিতে মাথা নাড়িয়ে নিজের প্রস্তুত উত্তরটা জানিয়ে দিলো,
– না চাচাহুজুর, কেউ দেহে নাই। সুজলা ভাবী গোয়ালঘরে দুধ দুয়াইতাছে। বাকিরা যার যার রুমে কাম করতাছে। আমি চোখ ফাঁকি দিয়া ঢুইক্কা গেছি।
হান্নান শেখ জহিরুলকে বিদায় দিয়ে এবার খাম নিয়ে বসলেন। ইজিচেয়ারে পিঠ লাগিয়ে মৃদ্যুভঙ্গিতে দুলতে লাগলেন। একটা খামের উপর আরবী হরফে কিছু লিখা ছিলো, বিশেষ খামটা আগে ছিঁড়ে উপুড় করতেই ভেতর থেকে ফস করে কোলে পরলো চিঠিটা। চিঠিটার ভাঁজ খুলে চোখ বুলাতেই চোখের কোটর আশ্চর্যভাবে বড় বড় হয়ে গেলো, ইজিচেয়ারে দোল খাওয়াটা বন্ধ হয়ে গেলো হান্নান শেখের। ঠোঁট নাড়িয়ে চিঠির শব্দগুলো নিঃশব্দে পড়তেই বুকের রক্তস্রোত যেন টালমাটাল হচ্ছিলো। কিংকর্তব্যবিমূঢ় ভঙ্গিতে চিঠির পাতায় গোটা-গোটা শব্দগুলো আবার পড়তে লাগলেন, ফের পড়তে লাগলেন, বারবার পড়লেন, বহুবার পড়লেন। চিন্তায়-দুশ্চিন্তায় চোখ বুজে ফেললে তিনি মনে-মনে আওড়াতে লাগলেন চিঠিটা,
‘ মাহতিম আনসারী পিছু ছাড়েনি কালাম সরদার। ও সবার চোখে বাজেভাবে ভেলকি মে’রেছে। জীবিত থাকলে গুরুতর সমস্যায় পড়বেন। দ্রুত মৃ’ত্যু-সংবাদ ধার্য করুন। ‘
.
পিসিটা বহুক্ষণ যাবৎ অন করা, সেটা বন্ধ করার প্রয়োজন হয়নি। রুমের ভেতরটা নীলাভ আলোয় স্বল্পোজ্জ্বল হয়ে আছে, থাইগ্লাসটা খুলে রাখা। জানালার দুপাশে জড়ো করে রাখা পর্দাগুলো বাতাসে উড়ছে, সেই সঙ্গে অনুভব করিয়ে দিচ্ছে শীতের আগমনী বার্তা। কফি মেকার থেকে মোটা পেটের মগটায় ঢকঢক করে কফি ঢালছে নোমান, কফির অবস্থা দেখে মুখ কুঁচকে রেখেছে। কালো পানীয়টার মধ্যে চিলতেখানি চিনির কণা পরেনি, না পরেছে এক চামচ দুধ। মাঝারি সাইজের কফি মগটায় পাঁচ চামচ কফি পাউডার মেশানো হয়েছে, দ্রবণটা হয়েছে কুচকুচে কালো। গন্ধে এতো বেশি তিক্ততা ছড়াচ্ছিলো, না-জানি খেতে কেমন জ’ঘন্য হয়! তবুও নাকি জঘন্য পানীয়টা বসের জন্য তৈরি করাই লাগবে, নইলে কি অবস্থা করে দিবে কে জানে। ছোট্ট একটা আয়তাকার ট্রের উপর সদ্য বানানো কফিটা রাখলো, ট্রে’টা দুহাতে ধরে উক্ত রুমটার দিকে যেতে লাগলো নোমান। রুমের দরজাটা যদিও পুরোপুরি খোলা, তবুও সে সৌজন্যতা কায়েম করে দরজায় নক করলো। নীলাভ বাতিতে আলোকিত রুমটা দেখে কেমন জানি গা ছমছম করলো নোমানের। বাতাসের শোঁ শোঁ ধ্বনি অদ্ভুত ভাবে উত্থাল করছে, রুমের দিকে তাকালে মনেহয় মৃত্যুপুরীর রাজ্য, পিসিটা কেমন নির্বিকার ভাবে জ্বলে আছে, মনে হচ্ছে রুমটার সমস্ত অন্ধকার দেখে খুশীতে মত্ত। নোমান এবার খুব সাবধানী গলায় ডাক দিলো,
– স্যা-স্যার,
গলাটা যেনো কেঁপে উঠলো নোমানের, কেনো কেঁপে উঠলো সে জানে না। সে যথেষ্ট সাহসী ব্যক্তি, প্রচুর দুঃসাহসিক কর্মকাণ্ড করার রের্কডও তার আছে। এতোকিছুর পরও এই একটা ব্যক্তির কাছে আসলে তার সকল সাহস কোণঠাসা হতে বাধ্য। পিসির সামনে মুখোমুখি অবস্থায় থাকা রকিং চেয়ারটা নড়েচড়ে উঠলো। একনিমিষেই সেটা পিসির দিক থেকে মুখ সরিয়ে নোমানের দিকে ঘুরে গেলো, নোমান অবশ্য চমকালো না। গতরাতে এরকম দৃশ্যের অভিজ্ঞতা আরো একবার হয়েছে, তাই আজ সে উদ্যোগী ভঙ্গিমায় সচেতন। নোমান অবস্থা দেখে ব্যবস্থা নেওয়ার পূর্বে আরেকদফায় ডেকে উঠলো,
– স্যার? স্যার, আপনার কি মাথাব্যথা করছে?
প্রশ্ন করার পর কয়েক মিনিট নিরব রইলো, এর পরপরই নিরবতা চ্ছিন্ন করে ভারী গলায় বললো মাহতিম,
– মগটা টেবিলে রেখে বিদায় হও। লাইট জ্বালাতে যাবে না।
নোমান যথা আজ্ঞাসূচকে ভেতরে ঢুকলো, রকিং চেয়ারের পাশে এসে টেবিলে রাখলো মগটা। ঘাড়টা ডানে ঘুরিয়ে একপলক চেয়ারে হেলান দেওয়া ব্যক্তিটার দিকে তাকালো, সে চোখ বন্ধ করে একটা হাত ভাবুক স্টাইলে হ্যান্ডেল রেখে ঠোঁটের কাছে আঙ্গুল রেখে দিয়েছে। নোমান আবার প্রশ্ন করলো,
– স্যার রাগ না করলে একটা কথা বলি? আপনি একটু ঘুমোন স্যার। ছেঁচল্লিশ ঘন্টা ধরে আপনি কম্পিউটারের সামনে বসে আছেন। আপনার চোখ খুব লাল হয়ে গেছে।
কথাটুকু শেষ করে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো নোমান। ফ্লোরের দিকে দৃষ্টি রেখে চাপা হতাশার নিশ্বাস ছেড়ে দিলো। ঠোঁটের কাছ থেকে আঙ্গুল সরিয়ে স্বাভাবিক হলো মাহতিম। মগের হ্যান্ডেলটা দু’আঙ্গুলে পেঁচিয়ে টেবিল থেকে তুলে নিলো সেটা, নিচের ঠোঁটটার কাছে মগ এনে গভীর করে এক চুমুক দিলো। তিক্তস্বাদের আভাস কোনোভাবেই মুখের উপর প্রকাশ পেলো না, চোখ বন্ধ করে বহুক্ষণ পর জবাব দিলো মাহতিম,
– বাহাত্তর ঘন্টা খাটতেও সমস্যা নেই নোমান। অসুস্থ হবো না। শুধু মাথাটা একটু ঝিমঝিম করবে এর বেশি কিছু হবেনা। তোমার কাজ না থাকলে একটু পিসির সামনে বসো। আমি কফিটা ততক্ষণে শেষ করে নেই।
বলতে-বলতেই চেয়ার ছেড়ে উঠে গেলো মাহতিম। মাথাটা আসলেই যন্ত্রণা করছে। নির্ঘুম দশা যে কতটা অসহ্যকর সেটা ফিল্ডে ফিরলেই বুঝা যায়। মাহতিমের নির্দেশ মতো রকিংচেয়ারে বসলো নোমান। ইতিমধ্যে আন্দাজ করে ফেলেছে, নির্ঘাত কোনো গুরুত্বপূর্ণ নিউজের জন্য অপেক্ষা করছে তার বস। এতো খাটাখাটনির পেছনে যেই গূঢ় রহস্য লুকিয়ে আছে, সেটা কিছুক্ষণের মধ্যে বেঁফাস হতে বাকি নেই। মাহতিম ধীরগতিতে হাঁটতে-হাঁটতে জানালার কাছে এসে দাঁড়ালো, ট্রাউজারের লেফট পকেট থেকে ফোন বের করে কল বসালো, ধোয়া উঠা কফিতে চুমুক দিতেই বাঁকানে রিসিভ হওয়ার টিউন শুনতে পেলো। চুমুক শেষে মগ নামাতেই ঝারি লাগিয়ে বললো,
– কিরে ব্যাটা, রিসিভ করতে এতো টাইম লাগলো কেন? থাকিস কোথায়? তোর ভাবী আম্মার খবরটা চটপট দে। আবার যদি ‘ আমার বউ, আমার বউ ‘ করতে দেখি, থাপড়ে দাঁত তুলে আনবো।
ওপাশ থেকে গাঁইগুই করতে-করতে শেষে রাগ দেখিয়ে বললো,
– নিজে খেয়াল রাখতে জানো না? আমাকে শাষাচ্ছো কেনো? সারাদিন তো ঘুমিয়ে-ঘুমিয়ে সময় কাটাও আমার অবস্থা কি করে বুঝবে?
কফিতে চুমুক দিতে গেয়ে ফিক করে হেসে ফেললো মাহতিম। হাসতে-হাসতে আকাশের দিকে অন্যমনষ্ক হয়ে বললো,
– হ্যাঁ, ঠিকই বলেছিস। আমিতো ঘুমিয়ে-ঘুমিয়ে দিন কাটাই। খুব আরামে কাটছে।
মাহতিমের মুখটা না দেখেও কন্ঠের ধাত শুনে চুপসে গেলো মাহদি। কথাটা আসলেই এভাবে বলা ঠিক হয়নি। সে তো জানেই তার ভাই শুধু-শুধু দূরে গিয়ে থাকছেনা, বাধ্য না হলে কেউ দূরে থাকতে চায়? মাহদি গুমোট অবস্থার ভেতর সকালের ঘটনাটা ব্যক্ত করবে কিনা চিন্তায় পরে গেছে। ভাবতে-ভাবতে শেষে প্রচণ্ড দ্বিধা নিয়ে বলতে শুরু করলে হঠাৎ বিকট উল্লাসে ‘ স্যার এক্ষুনি আসুন ‘ বলে চেঁচিয়ে উঠলো নোমান। গরম কফিতে কেবল চুমুক দিতে নিয়েছিলো মাহতিম, ওমন ভড়কে দেওয়া চিৎকার শুনে কফির আগুনতুল্য তাপটা ঠোঁটে লেগে গেলো ওর। সাথে সাথে ঠোঁটটার জ্বলুনির কমানোর জন্য দুপাটি দাঁত দিয়ে চেপে ধরলো জায়গাটা। কলটা অজান্তেই কেটে দিলো মাহতিম। কি থেকে কি হলো সেটা বুঝার আগেই কঠিন মেজাজে পিছু ঘুরে তাকালো। নোমান এই প্রথম বসের রাগ উপেক্ষা করে আশ্চর্য কন্ঠে হড়বড় করে বলতে লাগলো,
– আপনার ইমেইল চলে এসেছে স্যার। জলদি এদিকে আসুন, এক্ষুনি এদিকে আসুন। দেখে যান আপনার ইমেইল কোত্থেকে এসেছে। স্যার আপনি প্রচণ্ড খুশী হয়ে যাবেন, আপনার এ্যাফ্রড ভেস্তে যায়নি।
– চলমান .
#FABIYAH_MOMO .
( #নোটবার্তা : সামনে কি হতে যাচ্ছে? )
মন বাড়িয়ে ছুঁই গল্পের লিংক kobitor (all part)