#ফাবিয়াহ্_মমো .
ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীটা বিছানায় শোয়া। কিভাবে ক্যান্সারের অনুজীব দেহের ভেতর ঢুকেছে,জানে না। সকলের অগোচরে দিনের-পর-দিন দেহের সবকিছু নিঃশেষ হয়ে গেছে। সে নিজেও বুঝতে পারেনি, তার নিজ দেহটা কঠিন অসুখে লিপ্ত। শরীরের সবটুকু শক্তি যেনো ফুড়িয়ে শেষ। হাতদুটো লকলকে লতার মতো শুকিয়ে গেছে। সামান্য শক্তিটুকু নেই। চোয়াল ভেঙ্গে গালের হাড় দেখা যায়। ঠোঁটদুটো রুক্ষ হয়ে চৌঁচির। দেহের হাড়গুলো আজ কঠিনভাবে দৃশ্যমান, যেনো বিছানায় একটা নারী কঙ্কাল পরে আছে। মাথার চুল এখন পাতলা। লম্বা কেশের গোছাটা আর নেই। চোখের কোটর যেনো অতল গহ্বরে ঢুকে গেছে। দু’কোণা থেকে নিরবে অশ্রু ঝরে। অন্যের দারস্থ হয়ে জীবনযাপন করাটা দুঃখদায়ক। পূবের খোলা জানালা দিয়ে প্রকৃতির হাওয়া ঢুকছে। নির্মল হাওয়ার সাথে বেলীফুলের মন মাতানো ঘ্রাণে অসুস্থ ঘরটা ম-ম করছে। সূর্যের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আলোয় চার দেয়ালের ঘরটা আলোকিত। নিরবচ্ছিন্ন ঘরটায় হঠাৎ মৃদ্যু আওয়াজ হলো। আওয়াজটা বাঁ-কানে শুনতে পেয়ে চোখ মেললো সে। চোখদুটো কি বিশ্রীভাবে জ্যোতি হারিয়ে ফেলেছে! রোগ হলে কি সব হারিয়ে যায়? দেহের যন্ত্রাংশগুলো ধীরে-ধীরে ক্ষয়ে যায়? এইযে চোখ মেলেও পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে না, এর চেয়ে যন্ত্রণার কিছু আছে? মরে যেতে ইচ্ছে করে। বেঁচে থেকেও যদি দুনিয়ার দৃশ্যটুকু না দেখতে পায়, তাহলে এর চেয়ে দুঃখের কিছু আছে? শ্রবণেন্দ্রীয়তে টের পাচ্ছে কেউ তার বিছানার দিকে এগুলো। সন্তপর্ণে বিছানায় বসে আস্তে করে ডাক ছাড়লো,
– ছোট বউ,
শব্দ উৎসের দিকে মুখ ফেরালো সে। ভেজা লোচনে মানুষটির দিকে দূর্বল চোখে তাকালো। কখনো মায়ের মতো, কখনো বোনের আগলে রেখেছে। এই অসুস্থ অবস্থায় দেখভাল করতে আজও কার্পণ্য করেনি। শুকনো কাঠির মতো হাতটা কাঁপাতে-কাঁপাতে সুজলার দিকে উঠালো। সুজলা সেটা দেখতে পেয়ে কাঁপুনি হাতটা দুহাতের মাঝে পুরলো। মুখটা নিচু করে আলতো গলায় বললো,
– কেমন লাগছে ছোট বউ? কোথাও ব্যথা হচ্ছে? কিছু খাবে? হালকা কিছু আনি?
অমন মোলায়েম কন্ঠ শুনে বুকটা শান্ত হয়ে যায়। দেহের অসুখটা যেনো ধাপ-ধাপ করে কমতে থাকে। বাঁচার জন্য মন-মস্তিষ্ক যুদ্ধ করে। বারবার ভেতর থেকে স্লোগান দেয়, ‘ তোমাকে বাঁচতে হবে। তোমাকে উঠতে হবে। হেরে যেও না বাছা। জীবনযুদ্ধে হেরে যেও না ‘। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতেই সুজলার নয়নদুটিতে চোখ পরলো। শান্ত অথচ তীক্ষ্ম চোখদুটো আজ চিন্তায় ডুবে আছে। যেনো বহু-বহু চিন্তার অংক মিলিয়ে ক্লান্ত হয়ে গেছে। গলাটা সামান্য ভিজিয়ে প্রশ্ন করলো মাহমুদা,
– কি হয়েছে ভা-ভা-ভাবী?
শেষ কথাটা বলতে গিয়ে জড়িয়ে ফেললো মাহমুদা। ‘ খুক, খুক ‘ করে একটুখানি কেশে ফেললো সে। মাহমুদার সামান্য শ্রম দেখে সুজলার মনটা গুমরে উঠলো। মুখে ‘ ছোট বউ ‘ বললেও সবসময় ‘ ছোট বোন ‘ হিসেবে দেখেছেন। কখনো জায়ের মতো সম্পর্ক খাটাতে পারেননি। ভালো মানুষটার জীবনে কেনো দুঃখের ঘানি জুটলো, সেই হিসাবটা মেলাতে পারেন না সুজলা। অশ্রুমিশ্রিত ধাক্কাটা ভেতরে গুটিয়ে শান্তস্বরে বললেন,
– ছোট্ট ছোট্ট আঘাত খেয়ে মেয়েটা বদলে গেছে ছোট বউ। কি পরিমাণ দুঃখ পেলে মানুষ হুট করে বদলে যায়, তাই দিন-দিন দেখছি। চেয়ারম্যানের ছেলেকে মাথা ফাটিয়ে এসেছে। আরেকটাকে জুতিয়ে-জুতিয়ে পিটিয়েছে, ব্যাপারটা তোমার কাছে সহজ লাগে?
চোখ স্থির করলো মাহমুদা। পলকহীন দৃষ্টিতে আরেকবার ঢোক গিলে নিলো। রুক্ষ খসখসে ঠোঁটদুটো ফাঁক করে শব্দ ছুঁড়ে বললো,
– আমা-মা-মা-র মেহনূর?
নির্বিকার ভঙ্গিতে মাথাটা দুবার উপর-নিচ করলেন সুজলা। নিজের দুহাতের ভেতর শুকনো হাতটা উষ্ণতায় চেপে বললেন,
– তোমার মেয়ে যে মাহতিম ছাড়া কিচ্ছু বুঝেনা, সে খবর রাখো? গতকাল যা করেছে, তা যদি মাহতিম শুনতো! কলেজ থেকে আসতেই এক ছেলে গায়ে হাত দিয়েছিলো। সহ্য করতে পারেনি। অটো থেকে এমন ধাক্কা দিয়েছে, ওই ছেলে এখন হাসপাতালে ভর্তি। আরেকজন এখনো বেঁহুশ হয়ে আছে। চেয়ারম্যান এখন বিচারের জন্য ডাক পাঠিয়েছে। যাওয়ার আগে তোমাকে বলে গেলাম। সকালের খাবারটা ঝুটা কোরো না ছোট বউ। কষ্ট হলেও খেয়ে নিও। শেফালি খাবার গরম দিচ্ছে। আমি এসেই দুপুরের খাবার রেঁধে দেবো। এখন ঘুমোও। আমি যতদিন আছি, কিচ্ছু হতে দেবো না। আমার মেয়ে চারটা ছিলো, চারটাই থাকবে। আমি চারটাকে একচোখেই দেখবো। আমার জন্য আপন-পর বলে কিছু নেই। ঘুমোও ছোট বউ। আসছি তাহলে, থাকো।
মাহমুদা নিরবে তাকিয়ে রইলো। সাড়াশব্দ কিছু করলো না। যেভাবে সুজলা বিছানায় এসে বসেছিলো, সেভাবেই উঠে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। সবটুকু নিরবতা ফেলে একাকিত্বের মাঝে রুগ্ন মাহমুদাকে ছেড়ে গেলো। শূন্য দরজার দিকে একদৃষ্টিতে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলো মাহমুদা। বালিশের ওয়্যারটা ছোট-ছোট গোলাকার বিন্দুতে ভিজতে লাগলো। হায়, মানুষ কত অসহায়! এ কথা যদি তারা বুঝতো!
.
উপস্থিত সভার ভেতর তুমুল ভীড়। উঠানে বিন্দুমাত্র জায়গা নেই। ঝাঁকে-ঝাঁকে মানুষ হাজির হচ্ছে। সবার মূখ্য চিন্তা একটাই, আজকের বৈঠকে কি বিচার হবে। মানুষ উৎসুক দৃষ্টিতে তামাশা দেখার জন্য ভীষণ ছটফট করছে। সবাই শুনতে পেয়েছে, নিকটবর্তী গ্রামের হর্তাকর্তা সুজলা বিচারের জন্য ডাক পেয়েছে। মুখে আঁচল টেনে গেরস্থ মহিলারা তাই নিয়ে কানাঘুসায় লিপ্ত। মুরুব্বি সদস্যরা ধি:ক্কারে-ধি:ক্কারে না:রীজাতিকে ‘ ছিঃ ছিঃ ‘ করছে। মাথার উপর সৌরপিণ্ডটা তীব্র উত্তাপে টগবগ করছে। গরমের বিভীষিকায় উত্তপ্ত উঠোনে দাঁড়ানো যাচ্ছে না। শরীর ঘেমে দরদর করে ঘাম ছুটছে মেহনূরের, আকাশী রঙের কামিজটা পুরোপুরি ভিজে শেষ। খুব সাবধানে বাটিকের নীলচে ওড়নাটা মাথায় টেনে নিলো, পুরো পিঠ ঢেকে যতটুকু সম্ভব শরীর আবরণ করলো। ঠিক ডানেই জবুথবু হয়ে সুরাইয়া দাঁড়িয়ে আছে, মুখের অবস্থা ঘেমে একাকার। সাবা যদিও বাঁয়ে দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু ভয়ে অবস্থা নাজেহাল। মেহনূরের বাঁ কবজিটা শক্ত করে ধরে আছে সাবা। ভয়ের কারণ একটাই, চেয়ারম্যান লোকটা ভালো না। এই মূহুর্তে সেই লোকটা ওদের সামনে বসে আছে। মুখের অবস্থা রাগের জন্য রক্তিম হয়ে গেছে। পারলে এখুনি হিংস্র হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পরতো। খুলে-খাবলে খাওয়ার জন্য প্রচণ্ড হাহাকার করতো। গায়ে ধবধবে সাদা পাণ্ঞ্জাবী, নিচের অংশে লুঙ্গি পরা। মাথায় সাফ শুভ্র টুপি দেওয়া, কিন্তু চোখের চাহনি বড্ড বিশ্রী। সুরাইয়া আড়চোখে লোকটার দিকে একপলক দেখলো। ওমনেই কিড়মিড় রাগে নিচুস্বরে বললো,
– দেখতেই হা:রামির মতো দেখা যায়। কিভাবে তাকায় আছে দেখছোস? মনটা চাচ্ছে জুতাটা খুলে মুখের মধ্যে ফিক্কা মা:রি! মেহনূর? খবরদার এই নির্লজ্জের সামনে ক্ষমা চাইবি না। এই লোক আস্ত খাটাশ!
সুরাইয়ার চিবানো কথাগুলো শুনতে পেলো মেহনূর। খুব কষ্ট করে নিজের রাগটা ধামাচাপা দিলো। মাটি থেকে দৃষ্টি তুলে উপরে তাকালো সে। এই শয়তান লোকের সামনে ভয় পাবে না মেহনূর। মাফ চাওয়ার তো প্রশ্নেই উঠেনা! একটু সামনেই আর-এফ-এলের নীল চেয়ারে সুজলা বসেছিলেন।খানিকক্ষণ নিরব থেকে গম্ভীর আওয়াজ তুললেন,
– চেয়ারম্যান সাব, আমার জানামতে, আমার মেয়েরা কুশিক্ষা পায়নি। পথেঘাঁটে মারপিট করার মতো শিক্ষা দেওয়া হয়নি। মাথা নিচু করে কলেজ গিয়েছে, মাথা নিচু করেই কলেজ থেকে ফিরেছে। আজ অবধি উত্যক্তের স্বীকার হয়নি। কালই কেনো উত্যক্তের স্বীকার হলো, সেটাই আপনার কাছ থেকে জানতে চাচ্ছি। উত্তরটা যথাযথ দিবেন।
হান্নান মোল্লার ছেলেবউ হিসেবে সবাই সুজলাকে চেনে। চেনে না এমন গাঁ-গণ্ঞ্জে ব্যক্তি নেই। সুজলার তেজীয়ান রূপ, বলিষ্ঠ আচরণ, সত্যের প্রতি একাগ্রতা নিয়ে এখনো মানুষ প্রশংসা করে। সেই মহিলাকে বিচার শুনাতে ডাকা হয়েছে, এটা যেনো চাঁদ পাওয়ার মতো ঘটনা! চেয়ারম্যান সাথে-সাথে উদ্ধত আচরণ করলেন না। কাঠের নকশাকার চেয়ারে বসে একপলক সুজলার দিকে তাকালেন। মহিলার বয়স হয়েছে, কিন্তু চামড়ায় ভাঁজ নেই। মুখটা ক্লান্ত, কিন্তু শোভা কমেনি। এবার চোখ ঘুরিয়ে আসল ব্যক্তির দিকে তাকালো। তাকাতেই ‘ টন ‘ করে বাজলো। পরিস্ফুটিত পুষ্প যখন পত্র মেলে ফুটে, চারিদিকে সুঘ্রাণ ছড়িয়ে লোভনীয় আকৃতিতে পৌঁছে, তখন আকৃষ্টসুলভ ভ্রমর তার কাঙ্ক্ষিত পুষ্পের প্রতি মাতাল হয়ে যায়। গন্ধ-স্পর্শ-মায়ার জন্য বারবার ছুটে আসে। ঠিক তেমনি সদ্য ফোঁটা পুষ্পটি সবটুকু যৌবনশ্রী নিয়ে নীল পোশাকে দাঁড়িয়ে আছে। মুখটা পূর্ণমায়ায় কোমল, যেনো সুগঠিত ছাঁচে ফেলে খুব যত্নের সাথে গড়া হয়েছে। পাতলা শরীরটা তারুণ্যের শোভায় লালায়িত। চোখের দৃষ্টি এমন মনোহর, যেনো গভীর মায়ায় আবিষ্ট করার ক্ষমতা রাখে। এই মেয়েকে হান্নান মোল্লার হাত ধরে ঘুরতে দেখেছে। তখন বয়স অল্প ছিলো, দৈহিকভাবে শ্রী-সৌর্ন্দয্য এতোটা ভয়ংকরভাবে ধরা পরেনি। কিন্তু এখন এই অবস্থায় ঘুরাঘেরা করছে? এর তো কপাল ভালো, কোনো পুরুষের চোখে গভীরভাবে ধরা পরেনি। নাহলে গ্রামাঞ্চলে টিকতে পারতো? এই মেয়ের না বিয়ে হয়েছে? স্বামী কোথায়? টগবগে যুবতী বউকে গ্রামের মাটিতে ফেলে রেখেছে? চেয়ারম্যান খুবই কুৎসিত ভঙ্গিতে নিচের ঠোঁটটা ভিজালো। লালসামিশ্রিত দৃষ্টিতে ঢোক গিললো। দফায়-দফায় আপাদমস্তক চোখ বুলাতে-বুলাতে বললো,
– খাসা জিনিস খুইলা রাখছেন ক্যান আফা? এইসব জিনিস দেখলে মাথা ঠিক থাকবো? আমার পুলার তো দেহি দোষ নাই। বিয়াশাদি দিছেন, নাকি এখনো জায়গা ফাঁক আছে?
পায়ের নখ থেকে মাথার তালু পযর্ন্ত শীতল স্রোত ছুটলো! রাগে ঝাঁজালো দৃষ্টিতে তাকালো মেহনূর! চোয়াল শক্ত করে যেই কিছু বলতে যাবে, বাঁ কবজিতে কঠিনভাবে চাপ খেলো! চমকে গিয়ে বাঁয়ে তাকালো মেহনূর। সাবার এখনো নতদৃষ্টিতে শক্ত হয়ে আছে। চেয়ারম্যানের কথাটা সহ্য করার ইঙ্গিত দিতেই সামনে থেকে সুজলা চেঁচিয়ে উঠলেন,
– মুখ সামলান চেয়ারম্যান সাব! ঘাঁটের বাইরে একটা কথাও বলতে যাবেন না! আপনি এখানে বিচার করতে বসেছেন, ভদ্রলোকের মতো সেটাই করুন। নিজের বংশপরিচয় দিতে আসবেন না! নাহলে আমারটাও ভালো করে চাউর করতে পারি।
সুজলার বজ্রকন্ঠে ভেতরবাড়ি থেকে দুজন ব্যক্তি ছুটে এলো। প্রচণ্ড বিষ্ময় ও আশ্চর্য নিয়ে চেয়ারম্যানের পিছনে দাঁড়ালো। এই পাড়ায় আজ পযর্ন্ত নারীকন্ঠ উঁচু উঠেনি! কোনো মহিলারই ওইটুকু সাহস দেখানোর স্পর্ধা হয়নি। সুজলার তেজী মুখ দেখে চোখ শক্ত করলো তানভীর। নাক ফুলিয়ে রাগী বায়ুটা উত্তাপের সঙ্গে ছাড়লো। যতো সমস্যার গোঁড়া এই মহিলাকে নিয়ে হয়। এই মহিলার জন্য কোনোদিকেই এগুতে পারছেনা তানভীর। নাহলে এতোদিনে হাড়ে-হাড়ে আসল মর্মটা বুঝিয়ে দিতো। তানভীরের পাশেই চেয়ারম্যানের স্ত্রী দাঁড়ানো। মুখে আঁচল টেনে কপাল কুঁচকে ভৎসর্নার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মেহনূর ধীরে-ধীরে মাথাটা নুইয়ে ফেললো। দুচোখ বন্ধ করে উত্থাল ঝড়টা আঁটকানো চেষ্টা করছে। চোখের সামনে বড়মার অপমান সহ্য করা যাচ্ছে না। লোকটার কথাগুলো কানের ছিদ্রপথে যেনো শূল বিঁধিয়ে দিচ্ছে। কাল যদি সুরাইয়ার সাথে জিদ না দেখাতো, তাহলে এই দশা দেখতে হতো না। রসায়ন দ্বিতীয় পত্র বইয়ের ফাঁকে ছোট্ট চিরকুট রেখেছিলো মেহনূর। কলেজের সবাই যখন ব্রেকটাইমে মাঠে চলে যেতো, তখন শূন্য রুমটায় পরে থাকতো সে। চুপচাপ বই খুলে সেই ছোট্ট চিরকুটটা ছুঁয়ে-ছুঁয়ে দেখতো। হলুদ রঙের চিরকুটটা মাহতিমের দেওয়া শেষ রত্ন ছিলো। ‘ I’m SORRY, yours Ansari . ‘ কতবার, সহস্রবার, অগণিত বার এই চিরকুটটা পড়েছে, হিসেব নেই। চিরকুটের অক্ষরে-অক্ষরে আঙ্গুল বুলিয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। সেই ছোট্ট চিরকুটটা যখন সুরাইয়ার ভুলের জন্য পানিতে ভিজে যায়, তখন রাগ কমাতে পারেনি। অকল্পনীয় রাগে ফেটে পরে মেহনূর। সামান্য চিরকুটের জন্য মেহনূরের উতলা অবস্থা দেখে অবাক হয়েছিলো সুরাইয়া। পরক্ষণে যখন আসল ব্যাপারটা বুঝতে পারলো, ততক্ষণে মেহনূর চুপ হয়ে গেছে। অটোতে ইচ্ছে করে সাবা বা সুরাইয়ার পাশে বসেনি মেহনূর। রাগ দেখিয়ে অটোর উলটো সীটে বসতেই ছেলেদুটোর আগমন হয়। যখন আকারে-ইঙ্গিতে বাজে স্পর্শ করে, তখনই সমস্ত রাগ উজাড় করে ধাক্কা মা:রে। কোনো ছাড় দেয়নি মেহনূর, নিজের সাথে অ:শ্লীলপনা সহ্য করেনি সে! যার ফলস্বরূপ আজ বিচারের কাঠগড়ায় আসতে হয়েছে। চেয়ারম্যান তখন থামলো না। নারী কন্ঠের গ:রজ দেখে অশালীন ভাষায় বললো,
– আমার এলাকারে ন:ষ্টাপাড়া ভাইবেন না আফা। খুবই খারাপ হইবো বলতাছি! বিয়াত্তা ছেড়ি রাস্তায়-রাস্তায় তামশা মা:রায়া চলে, আর এইহানে আপনে দেমা:ক মা:রান? আমারে মগা পাইছেন আপনে?
তপ্ত চোখে তাকালেন সুজলা। চেয়ার থেকে চট করে দাঁড়িয়ে পরলেন তিনি। মাথার ঘোমটাটা ঠিকঠাক মতো টেনে দাপটের সাথে বললেন,
– এই এলাকারে আমি থু মা:রি! যেখানে বেহায়া জাতের চেয়ারম্যান থাকে, ওই এলাকায় কিসের বিচার? ওই বিচারের উপর ধি:ক্কার দেই! মূ:র্খের কাছে বিচার চাওয়া, আর দেয়াল মাথা বা:রি মা:রা একই কাজ। মেহনূর? এ্যাই মেহনূর?
এক ডাকে সচকিত হয় মেহনূর। চোখ খুলে তৎক্ষণাৎ মুখ তুলে তাকায়। সুজলার মুখ দেখে আরো ভীতু হয় সে। বুঝতে পারে পরিস্থিতিটা খারাপ হতে চলেছে। বাঁ হাতটা জোঁকের মতো খামচে ধরেছে সাবা। ভয়ে আরো গুটিয়ে যাচ্ছে সে। সুরাইয়া চোখ তুলে তাকিয়ে আছে ঠিকই, কিন্তু পরিস্থিতির বাজে দিকটা আঁচ করতে পেরেছে। চেয়ারম্যানের সাঙ্গুরা ইতিমধ্যে হৈহৈ বাঁধিয়ে দিয়েছে। একদল লোকেরা লাঠি নিয়ে পথ আঁটকে দাঁড়ালো। তাদের মধ্য থেকে সবচেয়ে তরুণ ছেলেটা চিৎকার দিয়ে উঠলো,
– আমগোর সামনে চেয়ারম্যানরে থুকবি, আর আমরা ছাইড়া দিমু ভাবছোস? পা ধর্! পা ধইরা মাফ চাইবি! কিরে ছেড়ি? আগাইতে মন চায় না? লাঠির বারি খাইয়া আগাইবি?
ইঙ্গিতটা মেহনূরের জন্য ছিলো। মাথা পিছু না ঘুরিয়েও ইঙ্গিতটা বুঝতে পারলো। মুখ তুলে সুজলার দিকে তাকাতেই সুজলা ‘ না ‘ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ালেন। ঠোঁট নাড়িয়ে নির্বিকার চিত্তে বললেন,
– মাফ চাইবি না মেহনূর। আমিও দেখতে চাই, কে তোর গায়ে হাত তোলে।
চেয়ারম্যান চোখের ইশারা দিয়ে সত্যি-সত্যিই বাঁশ আনতে বুঝিয়ে দিলেন। পাঁচ-ছয়জন ছেলে এরই মধ্যে স্ত্রস্তভঙ্গিতে ছুটে গেলো। সুজলা ঘোরতর বিপদের আশঙ্কা পেলেও মনে-মনে ‘ আল্লাহু আকবর ‘ জপে যাচ্ছেন। তিন-তিনটি মেয়ে নিয়ে আজ সত্যিই বিপদে পরেছেন। তবুও সংযত মনে শেষপর্যন্ত এর বিহিত দেখতে চাচ্ছেন। আজ ভয় পাবেন না তিনি। মেহনূর শক্ত মুখে দাঁড়িয়ে থাকলেও বুকটা ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে। এতো এতো মানুষের ভীড়ে প্রচণ্ড অসহায় লাগছে। কেউ এগিয়ে আসছেনা! সবাই দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে পরিহাস দেখতে মত্ত। চোখ খিঁচুনি দিয়ে ওড়না খামচালো মেহনূর। ভেতরটা ক্ষোভের অনলে দাউদাউ করলেও চোখ ভিজে আসছে। কোন্ ভুলের খেসারত দিচ্ছে? কোন্ ভুলের জন্য সবাই তাদের কথা শুনাচ্ছে? কিসের জন্য? পরিস্থিতি বিগড়াতে দেখে ভীড় ঠেলে একজন বেরিয়ে গেলো। এক দৌঁড় দিয়ে উঠোন পেরিয়ে কাঁচা রাস্তায় ছুটলো। রাস্তার ডানপাশে নারিকেল গাছটার আড়ালে পৌঁছলো। তাড়াতাড়ি ডানে-বায়ে চেক দিলো। না, কেউ নেই। ওমনেই পকেট থেকে ফোন বের করলো, ডায়ালে কল বসাতেই চোরা ফোনটা কানে চাপলো। বাঁ-কানে ফোন চেপে তখনও ডানে-বাঁয়ে কেউ আছে কিনা দেখছে। কলটা ‘ টুট টুট ‘ করে বাজতেই ওপাশ থেকে রিসিভ হলো। ওমনেই দেরি না করে অস্থির গলায় বললো,
– স্যার, স্যার ক্ষেপে গেছে! চেয়ারম্যান প্রচুর মিসবিহেব করছে! আপনি এখুনি এ্যাকশন নিন। এখুনি নিন। দেরি করবেন না স্যার। ওরা —
কথার মাঝপথে ‘ খট ‘ করে কলটা কেটে গেলো। তার মানে কাজ শেষ। এবার লঙ্কাকাণ্ড ঘটবে! ‘ এবার দ্যাখ শা:লা! তোর কোন্ জায়গায় ছক্কা লাগে দেখিস। ‘ গুপ্তচর লোকটা হাসতে-হাসতে চুপচাপ আগের মতো ফিরে গেলো। একদম সাধারণ ভঙ্গিতে নাটকের জন্য প্রস্তুত হলো। চেয়ারম্যান খ্যাঁক করে চেঁচিয়ে উঠলো,
– মা:গীর দেমাক দেখছোনি? পিছা দিয়া বাই:ড়ায়া তোর দে:মাক ছুটা:মু! আহোস না ক্যা? পা ধর। ন্যাকামি মা:রাবি, থাপ্প:ড়ায়া তোর জামাইর নাম ভু:লামু। আমার লগে ঢঙ মা:রাস, না? খুব মজা লাগে?
দাঁত শক্ত করে চোখ তুললো মেহনূর। চোখের সাদা অংশের চিকন শিরাগুলো লাল হয়ে গেছে। অশ্রুতে টলমল করলেও ক্রোধাবিষ্ট চাহনিতে তাকিয়ে আছে। হুঙ্কার দিয়ে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে, ‘ উনার নামটা একবার বা:জেভাবে নিয়ে দ্যাখ, তোকে ছাড়বো না হা:রাম:জাদা! ‘। তুমুল উত্তেজনার ভেতর উন্মুখ হতেই হঠাৎ তপ্ত পরিবেশটা ভূতুড়ে ভেলকির মতো থমকে গেলো! চর্তুদিকে একদম পিনপতন নিরবতা! বাড়ির ভেতর থেকে হাঁপাতে-হাঁপাতে ডানহাত গোছের চামচাটা ছুটে এলো। চেয়ারম্যানের হাতে ফোন দিয়ে নিশ্বাস নিতে-নিতে বললো,
– ওস্তাদ? এমপি সাব, এমপি সাবে ফোন দিছে।
– কি!
কথাটা যেনো ছিটকে এলো চেয়ারম্যানের মুখ থেকে। ‘ এমপি ‘ নামটা শুনেই ঝড়ের গতিতে ফোন হাতে নিলো। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই বিনয়ী হাসিতে বললো,
– আসসসা-সা-সা-সা-লামুয়ালাইকুম, কি খবর স্যার? হঠাৎ এই অভাগারে স্মরণ করলেন…
ফোনের ওপাশে কি কথা বলছে, কিচ্ছু বুঝা যাচ্ছে না। সবাই উজবুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেই চেয়ারম্যানের দূর্দশা দেখতে পেলো। ভয়ে চোখজোড়া বড়-বড় করে স্থির হয়ে গেছে। অনবরত ঢোকের-পর-ঢোক গিলেই যাচ্ছে। হাতের উলটা পিঠে বারবার কপালের ঘাম মুছছে। থেমে-থেমে অবাধ্য চাকরের মতো বলছে, ‘ আচ্ছা, ঠিক আছে। আচ্ছা, ঠিক আছে ‘। হুট করে কি নিয়ে ভয় পেলো, সেটা বুঝার আগেই কান থেকে ফোন নামালো চেয়ারম্যান। ফোন ধরা হাতটা শীতের কাঁপুনির মতো থরথরিয়ে কাঁপছে। থতমত ভঙ্গিতে ফোনের স্ক্রিনে ডান তর্জনী ছোঁয়ালো। ওমনেই কলটা লাউড স্পিকারে ডাইভার্ট হলো। ওপাশের ‘ এমপি ‘ সম্বোধন ব্যক্তিটার উদ্দেশ্যে বললো,
– জ-জ-জ্বী, স্যার। করছি।
এবার ‘ এমপি ‘ সম্বোধিত ব্যক্তিটা আদেশের সুরে বললো,
– যেই মেয়েটারে হেন:স্তা করছো, ওর পা ধরে মাফ চাও।
আকাশচুম্বী আশ্চর্য নিয়ে তাজ্জব হলেন সুজলা!অজান্তেই তাঁর মুখটা ‘ হা ‘ গেলো। সাবা আকস্মিকভাবে এমন আদেশ শুনে মেহনূরের হাত ছেড়ে তাকালো। সুরাইয়া তো বোবার মতো মূঢ় হয়ে গেছে। তানভীর চরম বিষ্ময় নিয়ে ভ্রুঁ কুঁচকে ফেলেছে। কি হচ্ছে কি? একবার কাঁচুমাচু করা মামার দিকে তাকালো, আরেকবার তাকালো সরাসরি মেহনূরের দিকে। মেহনূরও প্রশ্নাত্মক দৃষ্টি তুলে কপাল কুঁচকে ফেলেছে। তানভীর তার মামার কাধে হাত রাখবে, তার আগেই ধপ করে মাটিতে পরলো চেয়ারম্যান। মেহনূরের পায়ের কাছে দুহাত রাখতে নিলে চমকে পিছিয়ে গেলো মেহনূর। মাটিতে কদমবুসি করে ফড়ফড় করে বললো চেয়ারম্যান,
– আমারে মাফ কইরা দেও। ভুলে বইলা ফেলাইছি। সব দোষ আমার। সব আমার পুলার দোষ। ওরে আজকাই পুলিশে দিতাছি। তুমি আমারে মাফ কইরা দেও। দিয়া তাড়াতাড়ি বাড়ি যাও গা। আমি কিচ্ছু কইতাম না। এই দেহো, গালে ঠাস কইরা মা:রছি। আর কইতাম না। সব ভুল আমার। তোমাগোর কোনো দোষ নাই।
কারো মুখে শব্দ নেই। কোনোপ্রকার আওয়াজ নেই। পুরো সভাটা যেনো নিরব হয়ে গেছে। সবার চোখে-মুখে বিষ্ময়ের ঘোর গভীরভাবে এঁটেছে। স্বয়ং এমপি কিনা চেয়ারম্যানকে বাঘের মতো ধরলো। কিন্তু কি করে খবরটা শুনতে পেলো? কেউ তো এতো দয়ালু নয়। তাছাড়া, এমপির কানে খবর দেওয়ার মতো কর্মটা সাধারণ কারোর হবে না। তাহলে কে দিলো? পুরো ভীড়ের মাঝে একজন ব্যক্তি নিরবে-নিভৃতে সটকে গেলো। কাজ সমাপ্ত করে আবারও ডায়ালে টিপলো। কানে ফোন চাপতেই ওপাশ থেকে সেকেন্ডের ভেতর রিসিভ! এবার চুপ না থেকে গম্ভীর গলাটা ধীরাজ ভাবে বললো,
– কেঁদেছে?
প্রত্যুত্তরে হাসি দিয়ে বললো,
– হ্যাঁ, স্যার।
কলের ওপাশ থেকে দীর্ঘশ্বাসের শব্দ হলো। কয়েক সেকেন্ড পর ঠান্ডা গলায় বললো,
– তানভীরের উপর নজর রাখো।
#FABIYAH_MOMO .
মন বাড়িয়ে ছুঁই গল্পের লিংক kobitor (all part)