একুশ বছর আগে মেডিক্যালে ফিফথ ইয়ারে মাত্র তিন মাসের সম্পর্কে আমি কল্লোলকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছিলাম।
কল্লোল খুব মনোযোগ দিয়ে আমার কথা শুনছে। আমি বলছি,
— আব্বা আমার বিয়ে ঠিক করেছেন। ছেলে বুয়েটের শিক্ষক।
কল্লোল কোন মন্তব্য করলো না। রাতে ফোন করে বললো,
— শীলু, আগামীকাল সকালে কি একটু দেখা করতে পারবে?
জিগাতলার যে জায়গাটাতে ও আমাকে যেতে বললো সেখানে যেয়ে দেখি ও ওর তিনজন বন্ধু নিয়ে অপেক্ষা করছে। সামনেই কাজী অফিস। ও বললো ও আমাকে হারাতে চায় না তাই এখনি বিয়ে করবে।
আমি কোন ভাবেই রাজী হলাম না। আমি বললাম,
— আমি তোমাকেই বিয়ে করবো তবে আব্বা আম্মাকে রাজী করিয়ে করবো।
আমি প্রায় জোর করেই বাসায় চলে এলাম। পরের দিন সকালে ওর এক বন্ধু আমাকে ফোন করে জানালো কল্লোল হাসপাতালে। আমি যেন দ্রুত আসি।
হাসপাতালে এসে দেখি কল্লোল গত রাতে ছুরি দিয়ে নিজের হাত কেটে ফেলেছে। হাত কাটার আগে সিগারেট দিয়ে দুই হাতের বিভিন্ন জায়গায় ছ্যাকা দিয়েছে।
আমি ওকে দেখে কেঁদে ফেললাম। ওর বন্ধুরা এ ঘটনার জন্য আমাকে দায়ী করলো। কল্লোল বললো,
— তুমি যদি আমাকে এখন বিয়ে না করো তাহলে আমি নিজেকে শেষ করে দিবো।
আমার সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেলো। আমি বিয়ে করতে রাজী হয়ে গেলাম। জিগাতলা কাজী অফিসে আমরা দুজন বিয়ে করলাম।
যদিও ভেবেছিলাম আমরা আমাদের বিয়ের কথাটা গোপন রাখবো কিন্তু বাস্তবে তা হলো না। বিষয়টা বাসায় জানাজানি হয়ে গেলো। আব্বা এই বিয়েটা মেনে নিলেন না। তিনি বলে দিলেন আমি যেন আর বাড়ীতে না যাই।
আমি আপার বাসায় থেকে পড়া শেষ করলাম। আমি এবং কল্লোল দুজনই ঢাকার দুটি প্রাইভেট হাসপাতালে চাকরী নিলাম এবং ছোট একটি বাসা নিয়ে সংসার শুরু করলাম।
অল্প কয়েকটা মাস সুখেই কাটলো তারপরেই আমি আশ্চর্য হলাম কল্লোলের আচরণের পরিবর্তন দেখে। বিয়ের শুরু থেকেই বুঝতে পারছিলাম ওর মধ্যে কিছু possessiveness আছে। আমি ভেবেছিলাম হয়তো আমার প্রতি অতিরিক্ত ভালোবাসার কারণে এমন হতে পারে। কিন্তু এটা এক সময় মাত্রা ছাড়িয়ে গেলো।
আমার কোন কিছুতেই কোন স্বাধীনতা নেই। যে কোন কাজে ওর অনুমতি নিতে হবে। যেটা ওর পছন্দ না হবে সেটা খুব বিশ্রীভাবে বলবে,
— তুমি এটা করতে পারবে না।
আমি যদি জানতে চাই,
— কেন?
ও রাগত স্বরে বলবে,
— I said no. It is no.
— আমার কি কোন মতামত নেই?
— না, তুমি চলবে আমার কথা মতো।
ওর ভয়ংকর রাগকে আমি ভীষণ ভয় পাই। ওর সব কথাই আমি মানতে বাধ্য হই। একদিন বললো,
— তুমি নাইট ডিউটি করতে পারবে না।
আমি অবাক হয়ে বললাম,
— কি বলছো তুমি? আমি একজন ডাক্তার হয়ে হাসপাতালে নাইট ডিউটি করবো না?
— না করবে না।
— সরি, আমার পক্ষে তোমার এ সিদ্ধান্ত মানা সম্ভব নয়।
এ কথার পরে আমার সাথে কথা বন্ধ করে দিলো। ঐ দিন আমি নাইট ডিউটিতে চলে গেলাম। সকালে বাসায় এসে দেখি সিগারেট দিয়ে নিজের দুই হাত ক্ষত বিক্ষত করে ফেলেছে। আমি আমার সংসারের শান্তি রক্ষার্থে নাইট ডিউটি বন্ধ করে দিলাম।
আমার নাইট ডিউটি বন্ধের পরে নতুন বায়না শুরু হলো, বুয়ার হাতের রান্না খেতে পারছে না। প্রতিবেলা গরম খাবার নিজ হাতে ওকে রান্না করে দিতে হবে।
আমি ভোর পাঁচায় ঘুম থেকে উঠে সকালের নাস্তা, দুপুরের খাবার রান্না করি। ওর টিফিন গুছিয়ে দিয়ে সাড়ে সাতটার মধ্যে বাসে ঝুলে ঝুলে হাসপাতালে যাই। রাতে এসে আবার রাতের খাবার তৈরী করি। যেহেতু আমি নাইট ডিউটি করি না সেহেতু দিনে প্রায়ই আমাকে দুই শিফট করতে হয়। এটাও কল্লোলের পছন্দ না। ও বিরক্ত হয়ে বলে,
— বিকালে বাসায় এসে আরাম করে এক কাপ চা খাবো সে উপায় কি আছে?
আমি সব সহ্য করি আর নিরবে চোখের পানি ফেলি। কিন্তু কাউকে কিছু বুঝতে দিই না। কালে ভদ্রে আপার সাথে দেখা হলে ‘আমি ভালো আছি’ এই অভিনয় করি।
কল্লোল ভোলার উপকূলীয় এলাকার হাসপাতালে একটা চাকরী পেলো। বেতন ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা বেশ ভালো। আমি বললাম,
— তুমি যাও। আমি আপার বাসায় থাকি। প্রতি মাসে যাওয়া আসা করবো।
কল্লোল অনেক আজেবাজে কথাবার্তা বলতে লাগলো। আমি বাধ্য হলাম চাকরী ছেড়ে দিয়ে ওর সাথে ভোলা চলে যেতে।
ভোলায় আমার সম্পূর্ণ বন্দী জীবন। সারাদিন ঘরকন্নার কাজ করা ছাড়া আমার আর কোন কাজ ছিলো না। এরমধ্যে আমি কনসিভ করলাম। এক বছরের মাথায় আমাদের প্রথম মেয়ে নদীর জন্ম হলো।
নদীর জন্মের কিছুদিনের মধ্যে ইরানের একটা হাসপাতালে আমাদের দুজনের চাকরীর আবেদন কনফার্ম হলো। ভোলার পাট চুকিয়ে আমরা চলে গেলাম ইরানে।
ইরানের হাসপাতালে আরো কয়েকজন বাংলাদেশী ডাক্তার এবং নার্স কাজ করছিলো। আমি আবার কাজ শুরু করতে পেরে খুব খুশী। তবে কল্লোল বেশী খুশী হতে পারেনি। প্রথম দিকে কিছু না বললেও এক বছর যেতেই বলতে শুরু করলো,
— নদী খুব একা। ওর একটা ভাই বা বোন হলে ভালো হয়।
আমি ভীষণ অসহায় বোধ করলাম। আমার এখন আরো একটি সন্তানের কোন ইচ্ছা নেই। আমি এখন মনোযোগ দিয়ে চাকরী করতে চাই। আরো পড়ালেখা করতে চাই। চিরকালের এই ভীতু আমি জোড় করে বলতে পারলাম না, “আমার শরীর, আমার সিদ্ধান্ত।”
আমি আবার কনসিভ করলাম। পর পর তিন বার কনসিভ করলাম এবং তিনবারই মিসক্যারেজ হয়ে গেলো।
প্রতিবার মিসক্যারেজ হয় আর কল্লোল অকথ্য ভাষায় আমাকে গালিগালাজ করে। মিসক্যারেজের জন্য নাকি আমি দায়ী। আমি বাচ্চা চাইনি তাই মিসক্যারেজ হচ্ছে। আমি সর্বংসহা, চিরকালের দূর্বল শীলু শুধু চোখের পানি ফেলি। নদী আমার কোলে বসে জিজ্ঞাসা করে,
— আম্মু, তুমি কাঁদছো কেন? তোমাকে কে মেরেছে?
আমি চতুর্থবার কনসিভ করলাম। এবার মিসক্যারেজ হলোনা । তবে প্রায় সারা বছর বেড রেস্টে থাকতে হলো। সারাক্ষণই শরীর খারাপ থাকতো কিন্তু কল্লোলের কাছ থেকে কোন সহানুভূতি পেতাম না। প্রায়ই বলতো,
— ভোলাতে কত মহিলাকে দেখেছি সারাদিন ভারী ভারী কাজ কর্ম করে এসে বিকালে বাচ্চা ডেলিভারী করেছে। তোমার যত সমস্যা।
আমি চোখের পানি লুকাই। আস্তে করে বলি,
— তুমি একজন ডাক্তার হয়ে এমন কথা বলছো? সবার সব ক্ষেত্রে একরকম সমস্যা হয় না।
— রাখ, রাখ আমাকে জ্ঞান দিতে এসো না।
আমার দ্বিতীয় মেয়ে বৃষ্টির জন্ম হলো সিজার করে। ছোট বাচ্চা দেখাশুনা করার জন্য দেশ থেকে আমার শ্বাশুড়ীকে আনতে চাইলাম। আবার মেয়ে হয়েছে বলে কল্লোলের মুখ কালো। তাই শ্বাশুড়ীকে আনতে রাজী হলো না।আমি পেটে সেলাই নিয়েই বাচ্চার দেখাশুনা করি।
আমার মেটারনিটি লিভ শেষ করে হাসপাতালে যোগদান করলাম। হাসপাতালে যোগদান করে কলিগদের কেমন যেন আচরণ লক্ষ্য করলাম। বাঙ্গালী কলিগরা সবাই আমাকে এড়িয়ে চলছে। আমি বিষয়টা বুঝতে পারছি কিন্তু এটা নিয়ে কারো সাথে বসে কথা বলার সুযোগ পাচ্ছি না। হাসপাতালের কাজের মাঝে একবার বাসায় এসে বৃষ্টিকে বুকের দুধ খাইয়ে যাই। কাজ শেষে দ্রুত বাসায় আসি। তারপরেও কয়েকদিনের মধ্যে কিছু কিছু কানাঘুষা আমার কানে আসলো।
একদিন ডাঃ লুবনাকে জিজ্ঞাসা করলাম। উনি বললো,
— কি বলবো আপা? আপনার জন্য আমরা সবাই কষ্ট পাচ্ছি। আমার হ্যাজবেন্ড কল্লোল ভাইকে সরাসরি চার্জ করেছিলো। কল্লোল ভাই ওকে খুব অপমান করে বলেছে, এটা আমার ব্যক্তিগত বিষয়। আপনি কথা বলার কে?
আমি ঝরঝর করে কাঁদতে লাগলাম। এই প্রথম আমি কারো সামনে নিজের জীবনের পরাজয়ের জন্য কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম। লুবনা আমাকে সান্ত্বনা দিলো,
— আমরা সবাই আপনার পাশে আছি।
আমি বাসায় এসে দেখি কল্লোল হাসপাতালে যাওয়ার জন্য রেডী হয়েছে। আমি ঘরে ঢুকে বললাম,
— একটু বসো তোমার সাথে আমার কথা আছে।
কেমন যেন একটা ফুরফুরে মেজাজে আছে। সেই রকম ফুরফুরা ভাব নিয়ে বললো,
— এখনতো বসতে পারবো না। তোমার কথাগুলি রেডী রাখো আমি রাতে এসে শুনবো। রাতে বাসায় খাবোনা, ফিরতে দেরী হবে।
আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেলো। আমি বললাম,
— গাইনি ওয়ার্ডের নার্স সাবিনার সাথে তোমার কি সম্পর্ক?
সঙ্গে সঙ্গে কল্লোলের চেহারাটা বদলে গেলো। কর্কশভাবে বললো,
— এসব কথা তোমাকে কে বলেছে?
— কে বলেনি সেটা জিজ্ঞাসা করো। হাসপাতালের কারো কি জানতে বাকী আছে?
আমি চিৎকার করে কাঁদতে লাগলাম আর বলতে লাগলাম,
— তুমি একটা চরিত্রহীন লম্পট। ঘরে বৌ বাচ্চা রেখে হাসপাতালের নার্সের সঙ্গে কুকীর্তি করছো।
কল্লোল আচমকা আমার গালে একটা চড় মারলো। আমি টাল সামলাতে না পেরে মাটিতে পড়ে গেলাম। মাটিতে পড়ে আমি জ্ঞান হারালাম।
কতক্ষণ এভাবে পড়েছিলাম আমি জানিনা। যখন জ্ঞান ফিরলো দেখি কেউ একজন আমার মুখে পানির ছিটা দিচ্ছে। নদী আমাকে জড়িয়ে ধরে আছে। বৃষ্টি বেবী কটে ক্ষুধায় হাত পা ছুড়ে কাঁদছে। ইরানী ক্লিনার মেয়েটা আমার মুখে পানির ছিটা দিচ্ছে আর বলছে,
— তোমার কি হয়েছে? সামনের দরজা খোলা পেয়ে আমি ভিতরে ঢুকে তোমার এই অবস্হা দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।
আমি নদীকে জিজ্ঞাসা করলাম,
— তোমার আব্বু কোথায়?
ও ভয়ে ভয়ে বললো,
— তোমাকে মেরেই আব্বু চলে গেছে।
আমার মুখে কল্লোলের পাঁচটা আঙ্গুলের দাগ বসে গেছে। আমার আর বাঁচতে ইচ্ছা করছে না। শুধু মেয়ে দুটির মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে শক্ত করলাম। কল্লোল রাতে বাসায় ফিরলো না। আমি সকালে হাসপাতালে সিক রিপোর্ট করলাম।
চলবে…. (গল্পটি দুই পর্বে শেষ হবে)
গল্পঃ একটু সুখের জন্য (১ম পর্ব)
লেখকঃ কাজী তাসমীন আরা আজমিরী
বনানী, ঢাকা।
দুপুরে ডিউটি শেষ করে লুবনা এলো আমাকে দেখতে। ওর কাছ থেকে সব জানলাম। কল্লোল আর সাবিনার সম্পর্কের বিষয়টা গত কয়েকমাস ধরে সবাই জানতে পেরেছে। কারণ তখন থেকেই ওরা দুজন বেশ বেপরোয়া চলাফেরা করে। তবে লুবনা ধারণা করছে হয়তো সম্পর্কের শুরু হয়েছে আরো কয়েকমাস আগে।
আমি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানালাম এবং এর সুরাহা চাইলাম। ওরা প্রথমে বিষয়টি ‘ব্যক্তিগত’ হিসেবে আমলে নিতে চাচ্ছিলো না। আমার জোড়াজোড়ির জন্য ওরা বললো, ওরা বিষয়টা দেখবে।
কল্লোল ঐ দিনের ঘটনার পরের দিন থেকে স্বাভাবিকভাবে বাসায় আসছে। তবে আমার সাথে কথা বন্ধ।
যেদিন হাসপাতালকে বিষয়টা জানালাম তার কয়েকদিন পরে ওরা আমাকে ফোন করে বললো,
— ডাঃ শিউলি, তোমার স্বামী এবং নার্স সাবিনা বিবাহিত। গত মাসে ওরা বিয়ে করেছে। ওদের বিয়ের সার্টিফিকেট আমাদের দেখিয়েছে।অতএব আমাদের আর কিছু করার নেই।
ফোনটা রেখে আমি পাথর হয়ে বসে আছি। এমন সময় কল্লোল বাসায় এলো। এসে আমার চুলের মুঠিটা ধরে বললো,
— তুই হাসপাতালের কাছে আমার নামে নালিশ করছিস। তুই পাইছিস কি? আমি তোরে মজা দেখাবো। তোরে আমি ডিভোর্স দিয়ে দেশে পাঠিয়ে দিবো। আমার বাচ্চারা আমার কাছে থাকবে।
আমি কোন কথা বললাম না। আমার জীবনে কষ্টের কোন শেষ নেই। আমি সব সহ্য করছি কিন্তু আমার সন্তানদের হারানোর কষ্ট আমি সহ্য করতে পারবো না।
এর ঠিক এক সপ্তাহ পরে আমি আমার দুই মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে চলে আসলাম। ঢাকায় এসে আপার বাসায় উঠলাম। তারপর একটা বাসা ভাড়া করে সেখানে থাকতে শুরু করলাম। তবে সত্যিটা কাউকেউ কিছু বললাম না। আপার অনেক প্রশ্নের জবাবে বললাম,
— আমার চাকরীর মেয়াদ শেষ তাই চলে এসেছি। কল্লোলের মেয়াদ আরো আছে। ওরটা শেষ হলে ও আসবে।
আপা সরল মনে আমার কথা বিশ্বাস করলো।
আমি একটা চাকরীতে যোগ দিলাম। নদীকে স্কুলে ভর্তি করলাম। বৃষ্টির দেখভালের জন্য একটা বুয়া রাখলাম। শুরু হলো আমার নতুন জীবন সংগ্রাম।
দেশে সবাই জানে আমার স্বামী ইরানে চাকরী করে, প্রতিদিন ফোন করে, মাসে মাসে টাকা পাঠায়। কিন্তু বাস্তবে কখনো সে ফোন করে না এবং কখনো টাকাও পাঠায় না।
আমার জীবন কেটে যাচ্ছে দুই মেয়ে আর চাকরী নিয়ে। বছর পার হয়ে গেছে কিন্তু কল্লোল ঢাকা আসে না। আপা একদিন আমাকে খুব শক্ত করে ধরলো,
— সত্যি করে বলতো তোদের কি হয়েছে?
আমি আমার পরাজয়ের কথা মুখ ফুটে বলতে পারলাম না। আমি শুধু বললাম,
— আপা, আমাদের সম্পর্কে সুর কেটে গেছে অনেক আগেই। এখন শুধু মেয়ে দুটির কথা ভাবি। এরচেয়ে বেশী কিছু জানতে চেও না। সময় হলে আমি তোমাদের বলবো।
আম্মার সাথে ফোনে আমার যোগাযোগ হয় কিন্তু আব্বা এখনো আমার বিয়েটা মেনে নেননি। আমার বাড়ীতে যাওয়ার অনুমতি নেই। এর মধ্যে খবর পেলাম, আব্বা খুব অসুস্হ। মেসিভ হার্ট এটাক করে হাসপাতালে ভর্তি।
আমরা সবাই ছুটলাম আব্বার কাছে। আমরা পৌঁছানোর আগেই সব শেষ।
আব্বার সেই গম্ভীর মুখটা দেখলাম, কেমন কালো হয়ে গেছে। মুখটার মধ্যে নেই কোন রাগ বা ক্ষোভ, সারা মুখটা জুড়ে আছে একটা প্রশান্তি। মনে হচ্ছে যেন বলছেন,
— মা, তুই এসেছিস?
আব্বার নিথর পা দুটি জড়িয়ে ধরলাম।
— আব্বাগো তুমি আমাকে মাফ করে দাও। তোমাকে কষ্ট দেয়ার শাস্তি আমি হাড়ে হাড়ে পাচ্ছি।
আব্বা মারা যাওয়ার ঠিক চারদিনের মাথায় আমাদের বাড়ীতে কল্লোল এসে হাজির। আমি অবাক হয়ে গেলাম ও কিভাবে জানলো! কিন্তু কাউকেই কিছু বুঝতে দিলাম না। ওকে দেখে আত্মীয় স্বজনরা সবাই খুশী।
একটা সংসার, একটু সুখ, সবার কাছে আমাদের সন্মান এই আশায় আমার মনের মধ্যে কেমন যেন একটা আশা জেগে উঠলো – কল্লোল ইরানে সবকিছু শেষ করে দিয়ে আমার কাছে ফিরে এসেছে। আমি এ কথাটা ওর মুখ থেকে শুনার জন্য মনে মনে অপেক্ষা করছি।
আব্বার মিলাদ শেষে একটা মাইক্রোবাসে আমরা সবাই ঢাকায় ফিরছি। আপা কল্লোলকে জিজ্ঞাসা করলো,
— তুমি খবর পেলে কিভাবে?
— ফেসবুকে।
বুঝতে পারলাম কল্লোল আমার কাজিনদের পোস্ট দেখেছে।
আপা বললো,
— কতদিন থাকবে?
— মাত্র সাতদিনের ছুটি নিয়ে এসেছি। এর মধ্যে তিনদিনতো চলে গেলো।
আমার ভগ্ন হৃদয়টা আরো একবার ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেলো।
আপা আলাপ করেই যাচ্ছে।
— অনেকদিনতো হলো। ওরা ঢাকায় একা থাকে। মেয়েরা বড় হচ্ছে। তুমি এখন ঢাকায় চলে আসো।
— দেখি কি করা যায়।
দুপুরে বাসায় পৌঁছে আমি হাসপাতালে কাজ আছে বলে বাসা থেকে বের হয়ে গেলাম। সন্ধ্যায় নদী আমাকে ফোন করে বললো,
— আম্মু, আব্বু এখন দাদা বাড়ী যাচ্ছে। তোমার সাথে কথা বলতে চায়।
নদী ফোনটা কল্লোলকে দিলো।
— আমি আমার মেয়েদের আমার সঙ্গে ওদের দাদা বাড়ী নিয়ে যাবো।
আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। আমি শক্তভাবে বললাম,
— আজ ওদের স্কুল থেকে আমাকে ফোন করেছিলো। আগামীকাল স্কুলে না গেলে ওদের আর স্কুলে রাখবে না। তাছাড়া দুদিন বাদেই ওদের পরীক্ষা শুরু।
ফোনটা রেখে দিয়ে আমি দ্রুত বাসায় চলে এলাম। মেয়েরা মুখ অন্ধকার করে বসে আছে। কল্লোল ভাত খাচ্ছে। নদী আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিস ফিস করে বললো,
— আম্মু, আমরা আব্বুর সাথে কোথাও যাবো না।
বৃষ্টির স্মৃতিতে বাবার কথা না থাকলেও নদীর স্মৃতিতে আছে। আমি কখনো নদীকে তার বাবার কথা বলতে শুনিনি। বরং বাবার বিষয়ে আমি ওর চোখে দেখেছি এক তীব্র ঘৃনা।
কল্লোল ওর গ্রামের বাড়ী চলে গেলো। ওখান থেকে আমাদের এখানে ফিরলো না। সরাসরি চলে গেলো ইরানে।
কল্লোল ফিরে যাওয়ার কয়েক মাস পরেই ওর মেসেন্জার থেকে সাবিনা আমার চাচাতো বোন নীনাকে ফোন করে ওর আর কল্লোলের বিষয়টা জানালো। ওদের একটা ছেলে আছে সেটাও জানালো।
আমার পরিবারের কাছে সাবিনার বিষয়টা আমি এতদিন গোপন রেখেছিলাম। এখন সব জানাজানি হয়ে গেলো। সবাই আমাকে কল্লোলকে ডিভোর্স করার কথা বললো। আমি রাজী হলাম না। আমি শুধু মাত্র আমার মেয়েদের সামাজিক অবস্হানের কথাটা চিন্তা করে এই সিদ্ধান্তে অটল থাকলাম।
আমাদের দিন চলে যাচ্ছে। আম্মা এখন ঢাকায় আমাদের সাথে থাকেন। নদী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে, বৃষ্টি ক্লাস টেনে পড়ে। আমি ফরিদপুরে একটা হাসপাতালে চাকরী নিয়ে এসেছি।
বেশ কয়েক বছর কল্লোলের সাথে কোন যোগাযোগ নেই। এরমধ্যে একদিন হঠাৎ কল্লোল এসে উপস্হিত। নদী ফোনে জানালো,
— আব্বু এসেছে। আব্বু বলছে উনি এখন থেকে এখানেই থাকবে।
রাতে আপা, নীনা, ছোট খালা আমাকে ফোন করলো। সাবিনা মেসেন্জারে এদের সবাইকে ফোন করে জানিয়েছে কল্লোল ওদের কিছু না জানিয়ে চলে এসেছে। কল্লোল ওকে খুব মারতো এ কারণে ও থানায় জিডি করেছিলো। তাছাড়া কল্লোল অনেক লোকের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে ফেরত দেয়নি। হাতপাতালেও রোগীদের সাথে দুর্ব্যবহার করতো ফলে সেখানেও ওর বিরুদ্ধে নানা কথা উঠেছে।
সাবিনা আমার আত্মীয় স্বজন সবাইকে ফোন করে অনুরোধ করছে আমরা যেন কল্লোলকে ইরানে পাঠিয়ে দিই। তা না হলে ও আর ওর ছেলে খুব বিপদে পড়বে। কারণ কল্লোল অনেক আগেই সাবিনার চাকরী ছাড়িয়ে দিয়েছে। দুই/তিন দিনের মধ্যে সাবিনা সবাইকে ফোন করে বিরক্ত করে ফেললো।
আমি বা আমার মেয়েরাও এখন আর চাই না কল্লোল আমাদের সাথে থাকুক। তাই আপা কল্লোলকে ডেকে বলে দিলো,
— আমরা এতদিন তোমাকে কিছু বলিনি কিন্তু তারমানে এই নয় যে আমরা তোমার যথেচ্ছাচারিতাকে মেনে নিয়েছি। তাছাড়া সাবিনার বিরক্ত আমাদের ভালো লাগছে না। শীলু বা তোমার মেয়েরাও তোমাকে আর চায় না। তুমি চলে যাও।
কল্লোল ওর গ্রামের বাড়ীতে চলে গেলো। দুদিন পরে আমি ওকে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিলাম।
যেদিন এই বিবাহ বিচ্ছেদ পত্রে স্বাক্ষর করি আমার মনে এক ধরনের সুখের অনুভূতি হচ্ছিলো। এত গুলি বছর বন্ধহীন এক বন্ধনের মধ্যে কাটিয়ে দিলাম! আজ যেন আমার মুক্তি! কিন্তু মুক্তি কি আমার মিললো? একটু সুখের জন্য আমার প্রতিক্ষার অবসান কি হলো?
ফরিদপুরে আমার সহকর্মী সৈকত আমার ভালো বন্ধু হয়ে গিয়েছিলো। সৈকতের বৌ ওকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলো। ওদের বহু বছর কোন ছেলেমেয়ে হয়নি। আমরা দুজনই খুব দুঃখী। হয়তো
সে কারণেই দুজনের সখ্যতা হয়েছিলো। আমি বুঝতাম ও আমার প্রতি দুর্বল ছিলো কিন্তু আমি বিবাহিত থাকার কারণে কখনো কিছু বলার চেষ্টা করেনি। আমিও মেয়েদের কথা চিন্তা করে ওর এই বিষয়টাকে সাবধানে এড়িয়ে গেছি।
কল্লোলের সাথে ডিভোর্সের পরে একদিন চা খেতে খেতে সৈকত বললো,
— I want to grow old with you.
আমার ইচ্ছা হলো আমিও বলি,
— Let’s go.
কিন্তু আমি নদী আর বৃষ্টির মা। শুধু ওদের কথা ভেবেই আমি এতদিন একা রইলাম। এখন ওদের সাথে কথা না বলে কি করে এই সিদ্ধান্ত নিই!
নদী আর বৃষ্টি মনোযোগ দিয়ে সব শুনলো। আমি সৈকতের সাথে ওদের পরিচয় করিয়ে দিলাম। তারপর একদিন নদী বললো,
— আম্মু, আমাদের কোন আপত্তি নেই।
বৃষ্টিও ওর কথায় সায় দিলো।
আমি আর সৈকত বিয়ে করলাম। দুটি মেয়ে পেয়ে সৈকতও খুব খুশী। আমার ঘরে এই প্রথম যেন একটা সুখের বাতাস বয়ে গেলো। আমরা চারজন একসাথে কক্সবাজারে বেড়াতে গেলাম।
কক্সবাজার থেকে ঢাকায় আসার পর থেকে মেয়েরা কেমন যেন একটু চুপচাপ। আজই প্রথম সৈকত আমার বাসায় থাকবে। আমি ঢাকায় থাকলে বৃষ্টি আমার সাথে ঘুমায়। ও সন্ধ্যাবেলা যথারীতি আমার বিছানায় এসে ঘুমিয়ে পড়লো। আম্মা এসে ওকে ডেকে উনার কাছে নিয়ে গেলো। বৃষ্টি যেতে চাচ্ছিলো না, আম্মা জোড় করে নিয়ে গেলো। সকালে আম্মা বললো, বৃষ্টি নাকি অনেক রাতে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদেছে।
আমার মনটা খারাপ হয়ে গেলো। আম্মা এবং আপা আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললো,
— প্রথম প্রথম এমন হবে। পরে সব ঠিক হয়ে যাবে।
চির অভাগী এই আমি, আমার কপালে মনে হয় সুখ লিখা নাই। দিন গেলো, মাস গেলো, বছর গেলো কিন্তু কিছুই ঠিক হলো না। নদী এবং বৃষ্টি এখন আমার সাথে কথা বলাই বন্ধ করে দিয়েছে। আম্মা বা অন্য কারো সাথেও প্রয়োজন ছাড়া কথা বলে না। আমি ফরিদপুর থেকে বাসায় এলে দুজনই দরজা বন্ধ করে রাখে। ফোন করলে নির্লিপ্ত গলায় বলবে,
— বলো কি বলবে।
গত এক বছরে আমি ‘আম্মু’ ডাকটি শুনিনি। শুধুমাত্র যে ডাকটির জন্য আমি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়টা একা কাটিয়েছি। আমি জানতে চেয়েছি কেন এমন করছে। ওদের উত্তর খুব সংক্ষিপ্ত,
— আমাদের কথা বলতে ভালো লাগে না।
— আমি সৈকতকে ছেড়ে আসলে কি তোমাদের ভালো লাগবে?
— জানি না।
আমিও জানিনা আমি এখন কি করবো। মাঝে মাঝে মনে হয় সব ছেড়ে দিয়ে দূরে কোথাও চলে যাই। তখন মনে হয় যেখানেই যাই আমার কপালটাতো আমার সঙ্গেই যাবে।
সৈকতও খুব কষ্ট পাচ্ছে। মাঝে মাঝে বলে,
— আমি তোমার জীবনে নতুন কষ্ট যোগ করলাম।
আমি কিছু বলিনা। আমার চোখ দিয়ে পানি পড়তে থাকে। সৈকত সেই পানি মুছিয়ে দেয়। আমার হাতটা শক্ত করে ধরে বলে,
— আমি তোমার পাশে আছি। তুমি আমাকে কখনো ছেড়ে যেও না।
গল্পঃ একটু সুখের জন্য (পর্ব-২/ শেষ পর্ব)
লেখিকাঃ কাজী তাসমীন আরা আজমিরী
ভালো লাগলে অবশ্যই আমার বাকি গল্পগুলো পড়বেন।
আপনারাই আমার লেখার অনুপ্রেরণা