আম্মার বারংবার ফোন এবং কান্নাকাটির জন্য বাড়ি আসতে বাধ্য হলাম। আমি মন খারাপ করে বললাম,
— অনেক তো চেষ্টা করলে। হিসেব করে দেখো কতগুলি পাত্র দেখালে, কেউ তো আমাকে পছন্দ করলো না। এবারও করবে না।
— তোর রোকন মামা বলেছে এবারের ছেলেটাকে আগে থেকেই সব বলা হয়েছে। তোর ছবিও দেখানো হয়েছে। ছবি দেখে ওরা তোকে পছন্দ করেই দেখতে আসতে চেয়েছে। সামনাসামনি পছন্দ হলে আংটি পরিয়ে দিবে।
আব্বা মারা গেছে আজ তিন বছর। বড় আপার বিয়ে আব্বাই দিয়ে গেছেন। দুলাভাই একটা এনজিওতে চাকরী করে। আমার ছোট আরো তিন বোন। আমাদের কোন ভাই নেই।
আমরা সব বোনেরাই পড়ালেখায় ভালো। আপাও ভালো ছাত্রী ছিলো। কিন্তু আব্বা তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দিলেন। আব্বার ইচ্ছা ছিলো রিটায়ারমেন্টের আগে সব মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিবেন। কিন্তু সে সুযোগ তিনি পেলেন না।প্রতিদিন ত্রিশ কিলোমিটার রাস্তা বাসে করে যাওয়া আসা করে আব্বা অফিস করতেন। একদিন দুটো বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে স্পটেই মারা গেলেন।
অভাবের সংসার আমাদের। আব্বার অল্প কিছু পেনশনের টাকা ছাড়া আর কোন আয় আমাদের নেই। আমি টিউশনি করে নিজের খরচ চালাই। মাঝে মাঝে মামাদের কাছ থেকে কিছু টাকা চেয়ে নিই। দুলাভাই ছোট চাকরী করে, অল্প বেতন। তারপক্ষে কিছু দেয়া সম্ভব হয় না। প্রতি বছর আত্মীয় স্বজন তাদের যাকাতের টাকা থেকে বেশ কিছু আমাদের দেয়। সেই টাকা জমিয়ে রেখে আম্মা সারা বছর চলে।
আমাদের পাঁচ বোনেরই গায়ের রঙ কালো। আমার আব্বা বলতেন,
— আমার মেয়েরা আমার মত দেখতে হয়েছে।
আব্বা খুশী হয়ে বলতেন নাকি দুঃখ করে বলতেন সেটা বুঝতাম না। তবে আম্মা যে কষ্ট পায় তা বুঝি। আম্মা সব সময় বলেন,
— একটা মেয়েও আমার মত গায়ের রঙ পেলো না।
আমার আম্মার আরো কষ্ট আছে। আম্মার ধারণা আমাদের যদি একটা বড় ভাই থাকতো তাহলে এতো কষ্ট থাকতো না।
আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজকল্যাণে অনার্স ফাইনাল ইয়ারে পড়ি। থাকি বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হলে। আব্বা মারা যাওয়ার পর থেকে আমাকে বিয়ে দেয়ার অনেক চেষ্টা করা হচ্ছে। বাবা হারা এতিম মেয়ে, গরীব পরিবার, কোন ভাই নেই, গায়ের রঙ কালো ইত্যাদি নানা কারণে সব প্রস্তাবই না হয়ে গেছে। তবে সবচেয়ে প্রধান কারণ মনে হয় মেয়ের গায়ের রঙ কালো। আমি মাঝে মাঝে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভাবি, আমাদের গায়ের রঙটা কি একটু ফর্সা হতে পারতো না? তাহলে আমাদের দ্রুত বিয়ে দেয়া যেতো, আমার আম্মার একটু শান্তি হতো!
আত্মীয় স্বজনরা আমাদের প্রতি সহানুভূতিশীল। তবে এর মধ্যে কেউ কেউ আমাদের অসহায়ত্বের সুযোগ নেয়। একজন দূর সম্পর্কীয় আত্মীয় মাঝে মাঝে আমাদের বাসায় আসে। রাতে থাকে। প্রতিবারই একটা/দুটো বায়োডাটা নিয়ে আসে। আম্মাকে অনেক আশ্বাস দেয়। আমার আম্মাও ডুবন্ত মানুষের মত এসব খড়কুটা আঁকড়ে ধরেন। উনার জন্য মুরগী রান্না করেন, পায়েস রান্না করেন। আমরা সেই পায়েসের দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি। সারা বছরে আম্মা আমাদের জন্য পায়েস রান্না করতে পারেন না। মাসে একবার বা দু’বার মুরগী রান্না হয়। আমরা প্রায় সারা মাসই নিরামিষ, ছোট মাছ চচ্চরি, আলু ভর্তা খেয়ে থাকি।
আমাদের সেই আত্মীয় থলথলে বিরাট ভুড়ি নিয়ে বিছানায় বসে পেট পুরে মুরগীর রান, থান, বুকের মাংস দিয়ে ভাত খায়, ডালের বাটি ধরে চুমুক দিয়ে খায়, পায়েসের বাটির সবটুকু পায়েস চেটে পুটে খায়। গলায় ঝুলানো রুপার খিলাল দিয়ে দাঁত খিলাল করে ময়লাগুলি সামনের প্লেটে ফেলতে ফেলতে বলে,
— ভাবী, চিন্তা করবেন না। এবার যে বায়োডাটাটা এনেছি এই ছেলের বাবার সাথে আমার কথা হয়েছে। শ্বেতা মার ছবি দেখে ওরা পছন্দ করেছে। আমি কথা চালিয়ে যাচ্ছি।
আম্মা দু’চোখ ভরা আশা নিয়ে ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর ভদ্রলোক ঢেকুর তুলতে তুলতে নিজের ঘরে যেয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে মিষ্টি করে বলে,
— শ্বেতা মা, আমার এই কাপড়টা ধুয়ে ফ্যানের নীচে শুকাতে দাও। আমি সকালে এটা পরে বের হবো।
এ কথা বলে উনি আমার হাতে উনার ব্যবহারিত আন্ডার ওয়ারটা ধরিয়ে দেন। আমার কান্না আসতে থাকে। আম্মা ছো মেরে ওটা আমার হাত থেকে নিয়ে সাবান দিয়ে ধুয়ে ফ্যানের নীচে শুকাতে দেন।
আমি আম্মাকে অনেক বার বলেছি,
— উনি যখন কোন কাজে এখানে আসে তখন থাকা খাওয়ার জন্য আমাদের বাসায় আসে। বায়োডাটাগুলি সব ভুয়া।
আম্মা আমার কথা মানতে চান না। উনি বলেন,
— মা গো গরীবের এত বুঝের দরকার নাই। কার উসিলায় আমাদের ভাগ্য খুলবে তা আমরা কেউ জানিনা।
কারো উসিলায়ই আসলে আমাদের ভাগ্য খুলে না। আমি আম্মাকে বুঝাতে চেষ্টা করি আমাকে আর কয়েকটা বছর সময় দাও আমি নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই। আম্মা কোন কথা মানতে রাজী না। তার শুধু চিন্তা চার মেয়ের বিয়ে উনি কিভাবে দিবেন! এবার আম্মার সেকি উচ্ছ্বাস,
— ছেলে দেখতে একদম রাজপুত্রের মত। রোকন বলেছে ছবির চেয়ে বাস্তবে আরো সুন্দর।
আমি উদাস গলায় বলি,
— তোমার কথা কি শেষ হয়েছে?
— কথা তো শেষ হয়নি। ওরা ১০ জনের মত আসবে।
— শুধু মেয়ে দেখতেই ১০ জন!
— মেয়ে দেখতে বলছিস কেন? ওরা তো তোর ছবি দেখে পছন্দই করেছে। এখন সামনাসামনি তোকে আংটি পরিয়ে দিবে।
এর আগে আর কোন পাত্রের কাছ থেকে এতোটা আশ্বাস পায়নি। তাই এবার আম্মার উচ্ছ্বাসটা একটু বেশী। আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিস ফিস করে বললেন,
— আমি অবশ্য রোকনকে বলেছি একজন কাজী ঠিক করে রাখতে। ওরা আংটি পরিয়ে দিলে আমরা প্রস্তাব দিবো কাবিনটা করে ফেলার জন্য।
— আচ্ছা মা আমার যদি ছেলেকে পছন্দ না হয়?
আমার কথায় আম্মা খুব বিরক্ত হন।
— তুই এসব কি বলছিস? এত সুন্দর ছেলে। ব্যাংকের অফিসার। পছন্দ হবে না কেন?
আমি কোন কথা বললাম না। আম্মার কথা শুনতে শুনতে হাই তুলতে লাগলাম।
আমি একটা লাল রঙের শাড়ী পরে বসে আছি। ছেলেদের আসার কথা সকাল ১১টায়। ওরা আসলো দুপুর ২টায়। মা-বাবা, ভাইবোন, আত্মীয় স্বজনসহ ১২ জন। আমাদের পক্ষ থেকে আশা করেছিলো মেয়ে দেখবে আগে তারপরে দুপুরের খাবার খাবে। ছেলের মামা এসেই রোকন মামাকে বললো,
— ছেলের নানা আজ সকালে অসুস্হ হয়ে পড়েছেন তাই আমাদের একটু দেরী হয়ে গেলো। আমাদের মধ্যে তিন চারজন ডায়বেটিক রোগী আছেন। দুপুরের খাবারের পরে মেয়ে দেখার ব্যবস্হা করলে ভালো হয়।
ছেলে পক্ষের সবাই খেতে বসলো। আম্মা মেজো মামীর কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে তার সাধ্যমত পোলাও, কোরমা, রোস্ট, ডিম ভুনা, পায়েস রান্না করেছেন।
ছেলেপক্ষ খেয়ে উঠেই কেমন একটা ব্যস্ততা দেখানো শুরু করলো। আমাকে সামনে এনে বসানো হলো। ছেলের খালা মামুলি টাইপের কয়েকটি প্রশ্ন করলো। আমার মেজো মামী ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন,
— বাবা, তোমার কিছু জানার থাকলে জিজ্ঞাসা করতে পারো।
ছেলে বললো,
— আপনার নাম কি?
আমি ছেলের দিকে সরাসরি তাকালাম। ছেলের সমস্ত মুখ জুড়ে কেমন একটা তাচ্ছিল্য ভাব। আমার উত্তর দিতে ইচ্ছা করছে না। আমাকে চুপ থাকতে দেখে মেজো মামী বললেন,
— শ্বেতা মা, তোমার নাম বলো।
আমি বললাম,
— শুভ্রা শ্বেতা রহমান।
মেজো মামী বললেন,
— ওর আব্বার রাখা নাম। ওর আব্বা নিজে পছন্দ করে মেয়েদের সুন্দর সুন্দর নাম রেখেছিলেন।
মামীর কথায় কেউ কোন মন্তব্য করলো না। মামী চুপ করে গেলেন। ছেলের খালা আমার হাতে ৫০০ টাকার একটা নোট দিয়ে ভিতরে যেতে বললেন।
ছেলের মামা বললেন,
— মেয়ে আমাদের পছন্দ হয়েছে। আমার আব্বা অসুস্হ থাকায় আজকে কোন শুভ কাজ শুরু করবো না। কয়েকদিনের মধ্যে এসে আমরা আংটি পরিয়ে যাবো।
ছেলেপক্ষ তড়িঘড়ি করে সবাই চলে গেলো। এরপরে দিন গেলো, সপ্তাহ গেলো, মাসও যাওয়ার উপক্রম। আম্মা অস্হির হয়ে উঠলেন। রোজই প্রায় রোকন মামাকে ফোন করে। মামা একদিন আমাদের বাড়িতে এসে আম্মার হাত ধরে মাফ চেয়ে বললেন,
— আপা, আমি জানতাম না এই ছেলে মেয়ে দেখার নাম করে সব বাড়িতে যেয়ে আত্মীয় স্বজন নিয়ে খাওয়া দাওয়া করে আসে। খবর পেলাম ইতিমধ্যে প্রায় শ খানেক মেয়ে নাকি তাদের দেখা হয়ে গেছে।
আম্মা আশা ভঙ্গের তীব্র কষ্টে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন। আমার অবশ্য এ দৃশ্য দেখতে হয়নি। সামনে পরীক্ষা থাকায় পরের দিনই আমি ঢাকায় চলে এসেছি।
আমি আম্মাকে শক্তভাবে বলেছি বিয়ে নিয়ে উনি যেন আমাকে আর অস্হির না করেন। আম্মাও কেমন নিরাশ হয়ে গেছেন। আমি মনোযোগ দিয়ে পড়ালেখা করি। ছোট বোনদেরও বলেছি,
— মনোযোগ দিয়ে পড়ালেখা করো। আমরা সবাই নিজের পায়ে দাঁড়াবো। এখন হয়তো একটু কষ্ট হচ্ছে কিন্তু একদিন এই কষ্ট কেটে যাবে।
তিন বছর পরে—
আমি বিসিএস পাশ করে সদ্য চাকরীতে যোগ দিয়েছি। আমার কোন ব্যাংক একাউন্ট নেই। অনলাইনে বেতন নিতে আমার ব্যাংক একাউন্ট খুলতে হবে। আমি ব্যাংকে যেয়ে একজন অফিসারকে আমার পরিচয় দিয়ে বললাম,
— ব্যাংক একাউন্ট খুলতে আমাকে কি করতে হবে?
অফিসার তার সামনের কাগজের উপর থেকে চোখ তুলে আমার দিকে তাকালো। একটু কি চমকে উঠলো? শত শত মেয়ের মধ্যে আমাকে কি মনে করতে পারার কথা! আমি কিন্তু ঠিকই চিনতে পেরেছি। জিজ্ঞাসা করলো,
— আপনার নাম কি?
— শুভ্রা শ্বেতা রহমান।
আগ্রহ ভরা গলায় বললো,
— সুন্দর নাম।
আমি চেহারার মধ্যে যথাসম্ভব তাচ্ছিল্য আনার চেষ্টা করলাম। তারপর গম্ভীর গলায় বললাম,
— ধন্যবাদ। একাউন্ট খোলার একটা ফর্ম দিবেন প্লিজ।
******
গল্পের নামঃ তাচ্ছিল্য
লেখিকাঃ কাজী তাসমীন আরা আজমিরী
বনানী, ঢাকা।
ভালো লাগলে অবশ্যই আমার বাকি গল্পগুলো পড়বেন।
আপনারাই আমার লেখার অনুপ্রেরণা