৩.
ভোর বেলা থেকে বৃষ্টি হচ্ছে, গত রাতে আবিদ গেস্ট রুমে এসে ঘুমালো তারপর আর নিজের রুমে ঘুমাতে ইচ্ছা হয়নি। ছেলে মেয়েদের রুমে এসে ঘুমিয়েছি। ভোর বেলা উঠেই নাস্তা রেডি করে মেয়ে কে নিয়ে বের হতে হতে ৭.৩০ মিনিট। আবিদের সাথে আর দেখা হয়নি। মেয়েকে স্কুলে দিয়ে ডাইভার কে বললাম অপেক্ষা করতে, আমি গাড়িতে বসে বসেই ঝিমুচ্ছি। এক সময় চোখ লেগে আসলে ডাইভার কে ফোন করে বললাম বাসায় দিয়ে আসতে। বাসায় এসে কোনো রকম নিজের রুমে এসে দিলাম ঘুম। কাজের মেয়ে আর ড্রাইভার কে তিতলিকে আনা খাওয়া দাওয়া আর রান্নার সব ডিরেকশন দিয়ে যে ঘুম দিলাম তারপর আর কিছুই জানিনা। সেই ঘুম ভাংলো বিকেল ৪ টায়।
ঘুম ভেংগে প্রথমেই মনে হলো আবিদের স্পর্শ দরকার আমার, আমি তো ওকে এখনো সেই প্রথম দিনের মতোই ভালোবাসি। এক মুহুর্ত ও থাকতে পারিনা তাহলে ও কেন আমাকে ছাড়তে চায়?
তাড়াহুড়ো করে গেস্ট রুমে যেতে নিলেই কাজের মেয়ে ময়না বলে উঠে ভাবীসাব স্যার তো নাই।
নাই মানে??? অফিসে?
যে না, বইলা গেছে তিন দিন পর আসবে। কিসের নাকি মিটিং নাকি ফিটিং করতে গেছে।
আমার কষ্টে বুক দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছিলো। আমাকে একবার ও ডাকলো না, আমি জানি আমাকে এখন আর প্রয়োজন হয়না তাই বলে আগের সব কি মিথ্যা?
শ্রীমংগলের এক নামকরা রিসোর্টে আবিদ উঠেছে। ওদের সাথে ডিল করতে দেশের বাহির থেকে গেস্ট আসবে। আবিদের সাথে এসেছে আবিদের পারসোনাল সেক্রেটারি কেয়া। যদিও আলাদা রুম বুকিং করা আছে তবুও রাতের খাওয়া দাওয়ার পর কেয়া আবিদের রুমেই চলে আসে। প্রায় ২ বছর হলো আবিদের অফিসে জয়েন করেছে। কেয়া দেখতে অনেক সুন্দরী স্মার্ট আর সবচেয়ে আকর্ষণীয় হলো ওর বাচনভংগী।
আবিদের মন কিভাবে যুগাতে হয় তা কেয়া খুব ভালো করেই জানে। আর তাই অফিস জয়েন করে বেশি দিন সময় লাগে নি তাদের কাছে আসতে। সব কিছু জেনে শুনেও আবিদের সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছে কেয়া, কারণ সে শুধু নিজের লাভ লোকশান হিসেব করে তার জীবনে।
আপাতত শ্রীমংগলের মিটিং ক্লোজ করে তারা ডিনার করে রুমে ফিরেছে। লিফটে উঠতেই কেয়া আবিদ এর গলা জড়িয়ে ধরলো। নেশা ভরা চোখে আবিদের দিকে তাকিয়ে ইশারা করতেই আবিদ কোলে তুলে নিলো কেয়াকে। পুরো কড়িডোড়ের পথ কোলে নিয়ে রুমে ঢুকলো কোনোরকমে। দরজা আটকে বিছানায় তাদের আদিম নৃত্য শুরু করতেই আবিদের ফোন বেজে উঠলো।
আবিদ ফোন চেক করতে চাইলেই কেয়া হাত টা খপ করে ধরে বলল,
উম হূ, এখন না প্লিজ।
আবিদ খেয়াল করলো মলি কল করেছে। মনোযোগ নষ্ট হয়ে গেছে তাই সে উঠে বসলো। কেয়া তখনো আবিদের পিঠে নাক মুখ ঘষে চলছে। মলিকে আগের মতোন ভালো না লাগলেও সারাদিন ছেলে মেয়ের সাথে কথা না বললে আবিদের শান্তি লাগে না। আজকে বাচ্চাদের সাথে কথাও হয়নি কাজের চাপে।
ফোন টা সাইড টেবিল থেকে আবিদের হাতে দিয়ে কেয়া অভিমানী সুরে বলে উঠলো,
নাও কথা বলো, আমি রুমে যাচ্ছি। আবিদ বুঝতে পারলো যে কেয়া রাগ হয়েছে। তাই হাত টেনে নিজের বুকে নিয়ে আসলো। তারপর আবার ডুবে গেলো কেয়ার মোহমায়ায়।
৪.
প্রায় ৪০ মিনিট যাবত ফোন দিচ্ছে মলি আবিদ কে। তিতলির প্রচন্ড জ্বর, হাসপাতালে নিতে হবে। ছেলে মেয়ের কিছু হলে মলির মাথা কাজ করে না। আর মেয়েটাও হয়েছে একদম বাবার নেওটা। জ্বরের ঘোরে শুধু বাবা বাবা করে যাচ্ছে। অথচ আবিদ ফোন ই ধরছে না।
মলির নিজেকে এত বেশি অসহায় লাগলো, মনে হলো কেন এমন জীবন। অথচ শুরু টা ত এমন ছিলো না। এখন কেন এত ছন্ন ছাড়া।
আবিদের ফোন আসতে আসতে পরের দিন সকাল পার হলো। রাতে মলি তিতলি কে হাসপাতালে ইমারজেন্সী বিভাগে নিয়ে গিয়েছিলো। সাথে ছিলো ড্রাইভার আর কাজের মেয়ে ময়না। ময়নার কোলেই তোতন বেঘোরে ঘুমাচ্ছিলো। বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত তিন টা। বিকেলে আবার কিছু টেস্ট করিয়ে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে তাদের। মেয়েটার এজমার সমস্যা আছে তার উপর বৃষ্টির পানি গায়ে লাগাতে এত্ত জ্বর।
মন কে শক্ত করে ফেলেছে মলি। বুঝতে পারছে টাকা পয়সার অভাব না থাকলেও জীবন সংগীর অভাব বড় অভাব। কিন্তু এখন থেকে হয়ত সংগ্রাম টা শুধু মলির একার। তিতলি হউয়া পর্যন্ত সময় গুলো অনেক সুন্দর ছিলো। বিয়ের পর শুশুর শাশুড়ীর সেবা সংসার নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পরেছিলো। তারপর ও আবিদের জন্য মলি রাতে সাজুগুজু করে থাকতো। মন যুগানোর চেষটা করতো।
বাধ সাধে যখন তোতন পেটে আসে, আর সেই সময় শাশুড়ী ও বিছানায় পরা। স্ট্রোক করে প্যারালাইজড হয়ে গিয়েছিলেন।
সারাদিন সংসার সামলে অসুস্থ শাশুড়ি কে সামলে তারপর আর মলির কিছু করতে ইচ্ছা হতো না। তিতলিকে ও দেখতে হতো, বিছানায় একবার শুয়ে পরলে মরার মতোন ঘুমাতো। শরীরে পানি চলে এসেছিলো, দেখতে মলি অনেক টা ফুটবলের মতোন হয়ে গেলো।
আবিদেরো ব্যস্ততা বেড়ে যায়। আস্তে আস্তে একদিন দুদিন করে স্বামী স্ত্রীর মাঝে এক পাহাড় সমান দূরত্ব তৈরি হয়ে যায় যা তিতলি ঘূনাক্ষরেও টের পায়নি।
৫.
প্রথম যেদিন টের পেলো মলি যে আবিদের বাইরে কারো সাথে এফ্যায়ার চলছে, বিশ্বাস ই হলো না। বাসায় এসে দ্বিধায় পরে গিয়েছিলো আবিদ কে কি জিজ্ঞেস করবে!!!
সে রাতে আর নিজের রুমে আসেনি, শাশুড়ীর পায়ের কাছেই ঘুমিয়ে পরে। আশ্চর্যের বিষয় হলো আবিদ ও তাকে ডাকে নি। তাদের কথা হয় একেবারে সকালের নাস্তার টেবিলে।
আবিদ সকালে নাস্তার টেবিলে পেপার পড়ছিলো আর মলি সব রেডি করে সামনে রাখছিলো।
নিজ থেকেই মলি কথা বলল,
আমি আসিনি রাতে রুমে, তুমি ও একটা বার ডাকলে না, অভিমানী সুরে মলি আবিদের দিকে না তাকিয়েই জিজ্ঞেস করলো।
আবিদ খপ করে হাত ধরে বলল, সারারাত অপেক্ষা করলাম তোমার জন্য, ভেবেছি মায়ের সাস্থ্য হয়ত বেশি খারাপ তাই আসোনি। তা নাহলে কি আমি তোমাকে ছাড়া ঘুমাতে পারি বলো? তিতলিও আমার সাথে সাথে অপেক্ষা করে ঘুমালো।
এমন সুন্দর অভিনয় মলির মতোন সহজ সরল মেয়ে ধরার বাইরে এটা আবিদ জানে তাই তো খুব দ্রুতই রাগ পরে গেলো। সেই রাতে মলি খুব দ্রুতই আবিদের কাছে চলে আসে। ভালোবাসায় তারা দুজন মাখা মাখি হয়ে ঘুমিয়ে পরে। মলি সেই আগের দুনিয়ায় ডুবে যায়, নিজের সংসার, বাচ্চা স্বামী। অথচ কঠিন বাস্তবতা খুব শীঘ্রই তাকে ঘ্রাস করবে।
তোতন যখন মলির পেটে ৮ মাস তখন মলির শাশুড়ী ইন্তেকাল করলো। সন্ধ্যার পর থেকেই মলি আবিদ কে ফোন করে যাচ্ছে, আবিদ খুব বিজি ছিলো অফিসে। তাই তাকে পাওয়া যাচ্ছিলো না। মলির শাশুড়ি আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে আসে। রাত বারোটার দিকে প্রস্রাব পায়খানা করে সমস্ত বিছানা নোংরা করলো, গোংগাতে থাকলো। দ্রুত হাসপাতালে নেবার জন্য সব গুছাতে থাকলেই দেখলো তার শাশুড়ী নিস্তেস হয়ে আসছে।
আস্তে আস্তে বাম দিকে তার মাথা ঢলে পরলো, সব টা দৃশ্য মলির চোখের সামনে। গা গুলাচ্ছিলো, বমি পাচ্ছিলো আর শাশুড়ী কে বাচাতে পারছে না জেনে বুঝে নিজেই দ্বিকবিদিক শূন্য হয়ে যাচ্ছিলো।
আবিদ যখন বাসায় ঢুকলো তখন তার মায়ের রুমের থেকে ভেসে আসছিলো কান্নার আওয়াজ। কাজের মেয়েটা চাপা গলায় কি কি যেন বিলাপ করে বলছিলো। এদিকে মলির ফ্লোরে হাত পা ছড়িয়ে বসে ছিলো। ওর বিধস্ত অবস্থা দেখে আবিদ কি মা এর জন্য কান্না করবে নাকি তার ওয়াইফ কে হাসপাতালে নিয়ে যাবে এই দ্বিধায় পরে গেল।
এই ঘটনায় বেশ কয়েকদিন হাসপাতালে থাকতে হয় মলি কে। সব মিলিয়ে এই ধকল কাটতে কাটতে অনেক দিন লেগে যায় তার।
চলবে……..