১৪.
রাতে ঝড়ের বেগ বাড়লো মলির কান্নার সাথে পাল্লা দিয়ে। আবিদের রুম থেকে নিজের রুমে এসে ঢুকরে কেঁদে উঠলো মলি। রাত বাড়ছে কিন্তু ঘুম নেই কারো চোখে। মলি এক দিকে কান্না করেই যাচ্ছে অন্যদিকে আবিদ তার প্রিয় প্রেমিকা কেয়া কে কনভিন্স করার চেষ্টায় ব্যস্ত। তার কাছে মলির এই রিএকশঅন যেন খুব ই সাভাবিক। নতুন কিছু না।
সারারাত কতটা দুর্বিষহ যন্ত্রনাতে কেটে গেলো মলি ছাড়া কেউ জানলো না। শেষ রাতে চোখ লেগে এসেছিলো কিন্তু তোতনের কান্নার জোরে আর ঘুমাতে পারলো না মলি। কাজের মেয়ে ময়না কে ডেকে তার কাছে তোতন কে দিয়ে নিজের জন্য এক মগ কফি বানালো। মেয়ে কে নিয়ে আবার স্কুলে যাবার সময় হয়ে এলো। নিজের এই জীবনের কোনো প্রভাব তার বাচ্চাদের উপর পরুক তা মলি কিছুতেই চাইছে না। তাই যথা সময়ে স্কুলের জন্য বের হলো সে।
আবিদ নিচে নেমে সেই আগেরকার রুটিন লাইফ দেখে ভেবেছে মলি তো একদম সাভাবিক হয়ে গিয়েছে। তাহলে ভালোই হলো নতুন করে কোনো ঝামেলা সামলাতে হলো না। আশ্চর্যজনক ঘটনা হলো ওর মাঝে কোনো অনুশোচনা ও নেই। ময়না কে একবার জিজ্ঞেসাও করেনি মলির আর বাচ্চাদের ব্যাপারে।
তিতলিকে স্কুলে দিয়েই বাসায় মলি ফোন দিলো। ময়না কল রিসিভ করেই বলল,
জ্যা ভাবীসাব।
তোমার স্যার কি চলে গেছেন? জ্যা ভাবীসাব। নাস্তা করে একটু আগেই গেছেন।
দীর্ঘ শ্বাস লুকিয়ে মলি ছোট্ট করে শুধু ওহ বলল। তারপর আবার জিজ্ঞেস করলো কিছুই বলেন নি?
ময়না অবাক কন্ঠে বলল, না তো ভাবীসাব। আফনে না হয় ফোন কইরা লন একবার। কোনো কাজ আছে নি?
মলি দীর্ঘ শ্বাস লুকায়, তারপর আচ্ছা বলে ফোন এর লাইন কেটে দেয়। স্কুলের কাছেই এক কফি শপে ঢুকে আবারো এক কাপ কফি অরডার করে। চোখের জল আড়াল করার চেষ্টা করতেই ফোনে রিং বেজে উঠলো। ফোনের স্ক্রীনে ভেসে উঠে ফাহাদের নাম, না চাইতেও কল টা রিসিভ করে মলি,
হ্যালো,
হ্যালো কি অবস্থা তোমার। খোঁজ খবর নাই কিছুই!
এই তো আছি, তোমার কি অবস্থা?
আমি ব্যচেলর মানুষ আমার আর কি অবস্থা!
মলি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে তারপর আর কিছু বলবা?
ফাহাদ হেসে বলে উঠে, তুমি কি বিরক্ত হউ আমি খোঁজ নিলে?
আরে না না, তেমন কিছু না, কথা খুঁজে পাচ্ছিলাম না তাই বলেছি আর কি! মলির খুব আনিজি লাগে তাও সহজ স্বীকারোক্তি।
ফাহাদ কথায় কথায় হেসে উঠে, এটা কি মলির সাথেই করে নাকি ওর মুদ্রা দোষ মলি ভেবে পায় না। অন্য কেউ হলে এই সহজ স্বীকারোক্তি তে লজ্জা পেতো কিংবা নিজেকে দূরে রাখার প্রয়াস চালাতো। অথচ ফাহাদ বলে উঠেছে, তিতলির স্কুলের সামনে আসি এক সাথে কথা বলতে বলতে কফি খাওয়া যাবে!
মলি কথা না বাড়িয়ে কফি শপের কথাতে রাজি হয়ে উঠে।
*******
প্রায় ২০ মিনিট হলো ফাহাদ আর মলি কফি শপে বসে আছে। মলি উশখুশ করে যাচ্ছে কফি ঠান্ডা হলো অথচ কোনো কথা নেই মুখে। ফাহাদ অধৈর্য হয়ে বলে উঠলো,
সমস্যা যদি না বলো সমাধান দিবো কিভাবে? দেখো মানছি আমি তুমি অত ক্লোজ ফ্রেন্ড ছিলাম না, তুমি তো বরাবরই চাপা। এখন তো আমরা ভালো ফ্রেন্ড হতে পারি। মানুষের জীবনে কত সমস্যা থাকতে পারে। শেয়ার করলে একটা না একটা সমাধান খুঁজে পাওয়াটা ইজি। প্লিজ বলো তো কি হল???
মলি ছল ছল চোখে তাকিয়ে বলল, আমি আমার এই জীবন থেকে মুক্তি চাই। চিরতরে মুক্তি চাই। কিন্তু মুক্তি পাচ্ছিনা। শুধু মাত্র বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে আমি সুইসাইড করতে পারছি না। এত টুকু বলে মলি ঢুকরে কেঁদে উঠলো। কাঁদার ফ্লোতে কথা বের হচ্ছে না আর।
ফাহাদ ভাবলো কাদুঁক, কাঁদলে ব্যথা হালকা হয়। মলিকে আর ফোর্স করবে না সে। তার যখন নিজ থেকে বলতে ইচ্ছা হয় ঠিক তখন ই সে শেয়ার করবে। ততদিন অপেক্ষা করুক সে।
১৫.
কেয়া অনেক ক্ষণ যাবত নিজের ডেস্কেই বসে আছে। আবিদ কয়েকবার ডাকলো কিন্তু কেয়া গেলো না। গত রাতে আবিদের বউ এর করা অপমান নিতে পারছে না সে। কেয়া একজন ডিভোর্সি, সিংগেল মাদার। তার ৮ বছরের এক ছেলে আছে। কিন্তু কেয়া কে দেখে বুঝার উপায় নাই যে এক সন্তানের জননী সে। দেখতেও মাশা আল্লাহ আর ভীষণ স্মার্ট নারী, চালচলন কথাবার্তায়। আবিদ এবার কেয়ার ফোনেই টেক্সট করলো,
“এখুনি যদি না আসো রুমে তবে সবার সামনেই কোলে করে নিয়ে আসবো। “
কেয়া আর দেরি করেনি, আবিদের রুমে দরজার লক মোচড় দিয়ে ঢুকতেই আবিদ তাকে হেচকা টানে নিজের দিকে টেনে নেয়। কেয়া একদম ই ভরকায় না অবাক ও হয়না যেন সে জানতোই কিংবা সে এই মুহুর্তের জন্য প্রস্তুত ই ছিলো। নিমিষেই আবিদের হাত চলে যায় কেয়ার উষ্ণ উন্মুক্ত ফর্সা মেদহীন পেটে। কেয়া সব সময় ই শাড়ি পরে আর শাড়ির প্রতিটি ভাজে ভাজে ফুটে উঠে তার দৈহিক সৌন্দর্য। আবিদ যখন কেয়ার ঘাড়ে মুখ ডুবাতে ব্যস্ত তখন কেয়া বলে উঠে,
কেন আমার কাছে আসো তুমি, তোমার বউ অনুমতি দিলো?
আবিদ তখনো কেয়াকে আদর করতেই ব্যস্ত,কিন্তু কেয়া আবিদের চুলের মুঠি ধরে টেনে ধরে ঘাড় থেকে মুখ সরায়।
কি বলছি কানে যাচ্ছে না?
আবিদ হিংস্র বাঘের মতোন থাবার ন্যায় কেয়ার পেট খামছে ধরে। কেয়া কিছু বলার আগেই এলোপাথারি চুমু খেতে থাকে আবিদ। আদর করতে করতে রুমের কোনে পরে থাকা ডিভানের দিকে নিয়ে যায় কেয়া কে। দীর্ঘক্ষণ শুয়ে থাকে কেয়ার বুকে। একটা সময় কেয়ার হাত আবিদের মাথার চুলে বিলি কাটতে থাকে। আবিদ বলে উঠে,
তোমাকে আদর বা তোমার কাছে আসতে কারো অনুমতি এই আবিদ হাসান চৌধুরীর প্রয়োজন হয় না কেয়া। তোমার ও না।
কেয়া মুচকি হেসে বলে, তাই নাকি।
আবিদ উঠে বসে, তারপর বলে, গতকালের জন্য সরি। তুমি তো জানো তোমার কাছে যা শান্তি পাই জগতের অন্য কোথাও পাইনা আমি। তোমার সাথে কারো তুলনা হয়না কেয়া।
কেয়া মোহনীয় ভংগিমা তে আবিদের ঠোঁটে চুমু খায়। তারপর বলে এখন যাই। অফিসেও কানাঘোষা শুরু হয়েছে।
কে কে কি বলে শুনি?
আহা, সেসব শুনে লাভ নেই। আমি যাই, রাতে কিন্তু দেখা হচ্ছে, আমার আদর পাওনা রইলো। আসবে তো?
আবিদ উঠে বলে, অবশ্যই আসবো ডার্লিং, সাথে তোমার জন্য সারপ্রাইজ ও নিয়ে আসবো।
***********
ইদানীং মলির রাতে ঘুম হয়না, সারারাত এপাশ ওপাশ করতে থাকে। শেষ রাতে যখন ঘুম আসে তখন ই তোতন উঠে যায়। রাত টা কাটে বুকের ভিতরের এক দলা কষ্ট পুড়াতে পুড়াতে। এই কষ্টের কোনো শেষ নাই। কারো কাছে বলার বা শেয়ার করার মতোন ভাষা নাই। আবিদ কখনো বাসায় ফেরে কখনো ফেরে না। আজকাল একদম ই আবিদের চেহারা দেখা যায় না।
রাত ১২ টা। টুং করে মলির হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ এলো। ফাহাদের মেসেজ, সোজাসাপ্টা প্রশ্ন,
তুমি কি জেগে আছো?
হুম বলে ছোট্ট করে উত্তর করলো মলি।
কাল দেখা করতে পারবে? স্কুলের আশে পাশেই।
মলি ভেবে চিনতে আবারো হুম বলে ছোট্ট উত্তর করলো।
ফাহাদ বিরক্ত হয়ে বলে উঠলো কি ব্যপার, হুম হুম কি?
না কিছু না, কোনো জরূরী কিছু কি? মলির উলটো জিজ্ঞেসা।
হ্যা অবশ্যই জরুরী, কাল দেখা হলেই বলি?
মলি শুধু আচ্ছা রিপ্লাই দিয়ে চুপ করে থাকে। ফাহাদ আরো টুকিটাকি অনেক কিছুই জিজ্ঞেস করেছিলো। কোনো টার উত্তর মলি দিয়েছে কোনো টা না। পরের দিন সকালে মলির কফি শপে ওয়েট করছিলো প্রায় পনেরো বিশ মিনিট পর ফাহাদের আগমন, এসেই মাফ টাফ চেয়ে নিলো সে লেট করার জন্য।
ইস খুব সরি, আমি প্রতিবারই লেট করি।
ম্লান হেসে মলি বলে উঠে, ইটস ওকে।
আহা তুমি ইটস ওকে বলো বলেই নিরদিধায় লেট করে ফেলি। ফাহাদ খুব চাইঁছিলো মলি একটু হাসুক। আর এই কথা শুনে মলি সত্যি হেসে দিলো। তারপর জিজ্ঞেস করলো,
তোমার জরুরী কথা খানি কি?
কফিতে চুমুক দিতে দিতে ফাহাদ বলল, রুমকি কে চিনো? মনে আছে তোমার?
মলি বিস্ফোরিত চোখে বলে উঠলো, অবশ্যই মমে আছে,ওই যে চঞ্চল আবার কিছুটা বোকা করে ছিলো যে একটা মেয়ে। কেন ওর কি হলো?
মুচকি হেসে ফাহাদ বলল, নেক্সট ফ্রাইডে ওর বিয়ে।
মলির চোখ যেন কোটর থেকে বের হয়ে আসছে, এত দিন পর বিয়ে?
ফাহাদ তখন বলল, আমাদের সাথের অনেকেই এখনো বিয়ে করেনি মলি, একমাত্র তুমি ই আর্লি বিয়ে করেছিলে। না হলে ৩০ বছর বয়স এই আর এমন কি???
মলি লজ্জা পেলো মনে মনে, সে নিজেকে অনেকটা বার্ধক্যের কাতারেই ফেলে দিয়েছিলো, বয়স ৩০, দুই বাচ্চার মা অনেক টা মুটিয়ে গেছে। শাড়ি সাথে বেনী অথবা চিরচারিত খোপায় তার জীবন আটকে গিয়েছে। নিজেকে আজকাল খুব তুচ্ছ লাগে। মনে হয়ে ইউজলেস। এসব ভাবনায় যখন ডুবতে শুরু করলো তখন ই ফাহাদ তার চোখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে ধ্যান ভেংগে বলল,
কি ব্যপার? কোথায় হারিয়ে গেলে শুনি?
আনমনে মলি ও উত্তর দিয়ে বসে, অতীতে,জীবনের প্রতিটি ভুলে, বিশ্বাস অবিশ্বাসের মাঝে হারিয়ে গেছি। হারিয়ে ফেলেছি নিজের অস্তিত্ব কে।
চলবে…………