১৯.
একদিন হয়ে গেলো আবিদ সিংগাপুর গিয়েছে। এর মাঝে যতবার কল করলো কখনোই মলিকে সে রিচ করতে পারেনি। ওর নং এ কল করলে তো ধরেই না আবার বাসার ল্যান্ডফোনে কল দিলেও কাজের মেয়ে টা ধরে আর বলে ভাবি তো বাসায় নাই। এই ধরনের ব্যবহার আবিদ মলির কাছ থেকে কখনো পায়নি ইভেন আশা ও করেনি কখনো।
বাচ্চাদের জন্য নানান কেনাকাটা করার পর একটা ল্যাডিস শো রুমে ঢুকলো কেয়ার জন্য কিছু কিনতে। একটা সেক্সি নাইট স্যুট, হ্যান্ড পার্স আর দুইটা পারফিউম নিয়ে বের হবার সময় তার চোখে পরলো একটা ব্রেসলেটের দিকে। হঠাতই তার মনে হলো সেদিনএর পর মলির সাথে আর দেখা কিংবা কথা কোনো টাই যেহেতু ভালো করে হয়নি, এইটা গিফট হিসেবে নেয়া উচিত। কারণ ঘর সংসার ঠিক রাখা সবার আগে জরুরী। তাছাড়া আবিদের হাজারটা এফ্যায়ার থাকুক না কেনো, তার বাচ্চারা যেন কোনো ব্রোকেন ফ্যামিলির ছায়াও না পায় সেদিক টা আবিদ বরাবরই সচেতনতার সাথে ডিল করে।
এখানে আসার পর সে কেয়াকে ও ফোন করেনি। আবিদ প্রচন্ড ইগোটিক পার্সন। কেয়া ত তার হাতের মুঠোয় ই আছে তাই কেয়ার কাছে ছোট সে কখনোই হবে না সে। দুই দিন পর আবিদ যখন ফিরলো তখন মলি রুমকির গায়ে হলুদ নিয়ে ব্যস্ত।
আবিদ সেজন্য বাসায় ফিরে বাচ্চাদের কিংবা মলি কাউকে পায় নি। জোরে হাক ছাড়ে ডাকলো আবিদ,
ময়না, ময়না, সবাই কোথায়?
ময়না তড়িঘড়ি করে সামনে হাজির হয়। তারপর হাত থেকে ক্যারিং ব্যাগ টা নিয়ে বলে,
কেমন আছেন ভাইসাব? লেবুর শরবত আনবো নাকি কমলার জুস আনবো আপনার জন্যে?
আবিদ বিরক্ত চোখে চেয়ে বলে, বাকিরা কোথায়। কোথাও গিয়েছে?
ময়না হরবর করে কথা বলতে থাকে, কই গেছে তা তো জানিনাহ, তয় ভাবিসাব আর বাচ্চাকাচ্চা সব সাইজ্জা গুইজ্জা গেছে বের হইয়া৷। কইলো রাইত হইবো আজকে আসতে।
আবিদের কপালে চিন্তার ছাপ। তারপর সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে যায়। রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে বের হতেই চোখে পরে কমলার জুস রাখা সাইড টেবিলে। ঢক ঢক করে খেয়ে আবিদ ড্রয়িং রুমে বসে অপেক্ষা করতে। এত রাতে বাচ্চাদের নিতে বাইরে তো মলি কখনো থাকে না। তার উপর সিংগাপুর যাবার পর থেকে এই পর্যন্ত ফোন ও ধরেনি, তাই কথা ও হয়নি। অপেক্ষা করতে করতে আবিদের চোখ লেগে আসে।
**************
রুমকির আর পলাশের গায়ে হলুদের স্টেজ টা এত সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। তোতন আর তিতলিকে তো নামানোই যাচ্ছে না। ওরা গান বাজার তালে তালে নেচেই যাচ্ছে আর নেচেই যাচ্ছে। ওদের সাথে তাল মিলাতে আরো কয়েকজন যোগ হয়েছে। সবাই ওদের কে এত পছন্দ করেছে। আর ফাহাদ ই ওদের কে দেখে শুনে রাখছে। ফাহাদের এই কেয়ারিং নেচারে মলি মাঝে মাঝে মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছে।
অনেক দিন পর মলি এমন পরিবেশকে এঞ্জয় করছে। ছেলে মেয়ে সংসারের দায়িত্ব ছাড়াও যে একটা জীবন আছে সেটা ত সে ভুলতেই বসেছিলো। আজ যেন নিজের স্বত্তাতে প্রাণ ফিরে পেলো।
এত কিছু ভাবনার পরেই হুট করে ফাহাদ এসে পাশে দাড়ালো। মলির দিকে না তাকিয়েই বলল,
ভালো লাগছে না বলো? ওদের দুজন কে এক হতে দেখে কি যে শান্তি লাগছে বুঝাতে পারব না।
মলি ও পলক হীন চোখে বলছে, হ্য আসলেই, কাছের মানুষ রা সুখে থাকলেই শান্তি।
এবার ফাহাদ বলে উঠে, তুমি সুখে থাকলে আমি এর চেয়ে শান্তি পেতাম মলি। মলি চকিতে দেখে ফাহাদকে। না বোঝার ভান করে বলে,
আমি ত সুখেই আছি, তুমি কি সব বলছো!!!
ফাহাদ মলির দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলে, সমস্যা আছে অনেক সেটা আমি ভালোই বুঝি। কিন্তু তুমি এরিয়ে যাচ্ছো, শেয়ার করতে চাইছো না। অথচ এমন ও হতে পারে শেয়ার করলে সমাধান ও পেতে পারো।
মলি অনেক ক্ষণ ফাহাদের চোখের দিকে চেয়ে থাকে। জল ভরে আসে চোখে। সেই জল আড়াল করতেই হুট করেই বলে উঠলো
“অনেক রাত হয়েছে, বাসায় যেতে হবে। আজ আসি। “
ফাহাদ ও বলে উঠে চলো পৌছে দেই। মলি মানা করে না। তোতন অলরেডি ঘুমিয়ে গেছে। তোতন কে কোলে নিয়ে মলি পলাশ আর রুমকির থেকে বিদায় নেয়। বাসায় আসতে আসতে রাত ১.৩০ মিনিট। মলি ভিতরে ঢুকেই ময়না কে বলল তিতলিকে আর তোতন কে তাদের রুমে নিয়ে যেতে। সে এসে থমকে দাড়ালো সোফার পাশে, সোফায় পরেই ঘুমাচ্ছে আবিদ, হাতে তখনো রিমোট টা আকড়ে ধরে রাখা। মলি কিছুক্ষণ নিষ্পলক তাকিয়ে ডেকে উঠলো,
আবিদ, আবিদ, আবিদ নড়ে উঠলো। পিট পিট চোখ করে তাকিয়ে দেখলো মলি তার সামনে দাঁড়িয়ে। তাকে খুব ক্লান্ত লাগছে, কমলা রংগের শাড়িতে কাজল টা কিছুটা ছড়িয়ে আছে। আবিদ উঠে বসলো ভালো করে খেয়াল করলো মলি কে। মলি হালকা মেইক আপ করেছে দেখতে শান্ত স্নিগ্ধ লাগছে। কিন্তু গত দুই দিন ফোন ধরেনি বাচ্চাদের খোজ ও পায়নি মনে পরে রাগ ধরে যায় তার।
ধরাম করে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
কোথায় ছিলে শুনি। ফোন ধরোনা ঠিক মতোন আর এত রাতে কোথা থেকে আসলে তুমি?
মলি বিরক্ত হয় এত প্রশ্নে, ঘুরে দাড়িয়ে বলে অনেক ক্লান্ত আমি, ঘুমাতে চাই। তুমি এখানে ঘুমাচ্ছো তাই ডাকলাম। নিজের রুমে গিয়ে ঘুমাও।
এতটা বেখেয়ালি উত্তরে আবিদ একদম ভড়কে যায়। মলি ত আবিদের ব্যপারে এত টা উদাসীন নয়। আর এত কাটা কাটা উত্তরে আবিদ আবার ক জিজ্ঞেস করবে তাই বুঝতে পারেনা।ওই দিকে মলি আবিদের অপেক্ষা না করেই নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায়। পিছনে একবার তাকিয়েও দেখলো না হতভম্ব আবিদ ঠিক একি জায়গায় দাঁড়িয়ে।
২০.
দুইদিন সিংগাপুরের সফর শেষ করে আবিদ আজ অফিস যাচ্ছে। সকালে ডাইনিং টেবিলে বসে নাস্তা খাবার আগেই পত্রিকাতে চোখ বুলাচ্ছে সে। আজ মংগলবার অথচ তিতলি কিংবা মলি কেউ উঠেনি। বাচ্চাদের এত দিনে কাছে পেয়েও যেন পাচ্ছে না সে। মনে মনে একটা ক্ষোভ নিয়ে নাস্তাতে শুধু চা খেয়ে অফিস চলে যায় আবিদ।
অফিসে এসেই মন একদম ফুরফুরা হয়ে যায় তার। দুইদিন পর তার প্রিয়তমার সাথে দেখা হবে। নিজের কেবিনে প্রবেশ করতেই কেয়াকে ল্যান্ডলাইনে ডাকলো আবিদ।
কেয়া ডেস্কের ড্রয়ার থেকে আগে একটা মিনি মিরর বের করলো। নিজের সাজুগুজু ঠিক আছে কিনা একপলক দেখেই আবিদের রুমের পানে ছুটলো। রুমে ঢুকতেই আবিদ চোখের ইশারাতে কাছে ডাকলো। কিন্তু কেয়া কোপট রাগ দেখিয়ে নিজ জায়গায় দাঁড়িয়ে রইলো।
গিফটের প্যাকেট গুলো সামনে এগিয়ে নিয়ে এসে কেয়ার সামনে ধরতেই কেয়া উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠে। কিন্তু পরমুহূর্তেই আবার অভিমানী হয়ে দূরে সরে যায়।
আবিদ বুঝতে পেরে বলে উঠে, পছন্দ হয়েনি বুঝি?
কেয়া একটু দূরত্ব বজায় রেখে বলে উঠে, আমরা বিয়ে করছি কবে? কেয়ার প্রশ্নে আবিদের মেজাজ তেতে উঠে। কিন্তু বুঝতে দিতে চায়না সে। কেয়াকে আরো কাছে টেনে বলে আগে দেখোই না কি এনেছি। তুমি কি আমার কাছে বউ এর থেকে কোনো অংশে কম? বার বার কেন একি প্রশ্ন করো?
কেয়া অবাক নয়নে তাকিয়ে বলে, বিয়ে করলে তোমাকে আমাকে নিয়ে কোনো কানাঘোষা হতো না। আমার বাবাহীন ছেলে টা অন্তত একটা আশ্রয় পেতো। তুমি ভেবো না৷ ওকে খরচ দেয়ার জন্য আমি এক কথা বলছি। কিন্তু মেয়েদের মাথার উপরে ছায়া প্রয়োজন। আমি বরাবর ই চেয়েছি তোমার প্রিয়জন হতে তোমার কাছে থাকতে সুখে দুখে পাশে থাকতে।
আবিদ হাতের শপিং ব্যাগ গুলো ডিভানে ছুড়ে মারে, তারপর টাই টাকে ঢিলা করতে করতে বলে
তুমি ও টিপিক্যাল মেয়েদের মতোন কথা বলা শুরু করেছো। আমি ভেবেছি তুমি ডিফারেন্ট, অথচ তুমি তো মলির মতোই কথা বলছো।
অধিকার,পাশে থাকা সাথে থাকা, এসব কি??? তুমি অবশ্যই তোমার জায়গায় আছো। তোমাকে কি দেইনি বলো, টাকা পয়সা দামী গিফট, নামী দামী রিসোর্টে ঘুরতে যাওয়া কি হয়না আমাদের মাঝে।
লিসেন কেয়া, এভাবে চলতে থাকলে আমার কাছে কিছুই এক্সপেক্ট করবে না। ইটস আ গিভ এন্ড টেইক রিলেশনশীপ। তুমি আমার সব কিছু মেনে নিয়ে মেইনটেইন করতে পারলে তবেই এসো। পারসোনাল লাইফ এর অংশ হবার প্রয়োজন তো দেখছিনা। আমার কাছে মলির প্রায়োরিটি না থাকলেও আমার বাচ্চার মা হিসবে সে যথেষ্ট প্রায়োরিটি পায় এবং পাবে। আমার বাচ্চাদের সাথে তোমার বাচ্চাকে স্থান দেউয়ার প্রশ্ন ই আসে না।
কেয়ার চোখ থেকে ফোটায় ফোটায় জল পরে, চোখ মুছে বলে উঠে, আমি তো আমার বাচ্চাকে তোমার বাচ্চার সাথে কম্পেয়ার করিনি। আমি শুধু…….. এত টুকু বলে কেয়া থামে। তারপর বেরিয়ে যায় কেবিন ছেড়ে।
আবিদএর মুখ থেকে তখন চ বর্গীয় শব্দ বেড়িয়ে আসে নিজের অজান্তেই।
২১.
সন্ধ্যায় যখন মলি তার বাচ্চাদের নিয়ে রেডি হয়ে বের হয়ে যাচ্ছিলো ঠিক তখন ই আবিদের গাড়ি ও গ্যারেজে ঢুকার অপেক্ষায়। আবিদ খেয়াল করলো মলি বেশ সাজুগুজু করেছে, সেই বিয়ের পর প্রথম প্রথম যখন মলি সাজতো ঠিক তেমনই। পার্থক্য এই যে আগে মলি কে দেখলেই প্রেমে পরে যেতো এখন আর তেমন ফিল আসে না। কিন্তু আজ মলি কে পরিপাটি দেখে বেশ ভালো লাগছে, আজকেও তাহলে বাচ্চাদের সাথে টাইম স্পেন্ড করা হবে না আবিদের।
এদিকে কেয়ার এসব কথা শোনার পর ওর কাছে যাবার ইচ্ছা টাও মরে গেছে। বিয়ে শাদির কোনো ভেজালে জড়াতে চায়না সে। এসব ঝামেলা থেকে যত এড়িয়ে থাকা সম্ভব ততই ভালো।
রাত ১০.৩০, বিয়ে বাড়িতে জম্পেশ আয়োজন চলছে। রুমকি কিছুক্ষণ আগেই পার্লার থেকে আসলো কেবল। মলি কে অনেক সাধাসাধি করেও পার্লারে নেয়া গেলো না। পাশাপাশি একটা টেবিল বুক করে বসে ছিলো মলি তার বাচ্চাদের নিয়ে। ফাহাদ এসে তার পাশে বসতেই বাচ্চাগুলো খুশি হয়ে উঠে, মলি ও হাফ ছেড়ে বাচে। এখানে তেমন কেউ পরিচিত নয় শুধু রুমকি পলাশ আর ফাহাদ ছাড়া। ফাহাদ ই কথা বলা শুরু করলো,
বাচ্চাদের স্কুল তো সামনে কিছুদিন বন্ধ পাবা, তাই না?
হাস্যোজ্জ্বল মলি বলে উঠলো হ্যা তা তো পাওয়া যাবে।
কোথাও ঘুরতে যাবা? প্ল্যান ট্যান আছে নাকি?
মলি মুখটা ছোট করে বলেই ফেললো, আমার ঘুরতে যাওয়া মানে বাবার বাড়ি। এখন সেটার রাস্তা ও বন্ধ।
বন্ধ মানে? অবাক হয়ে ফাহাদ জিজ্ঞেস করে।
মানে যাবো না তাই আর কি?
তাহলে আমাদের সাথে চলো। রুমকি আর পলাশ, তুমি আর আমি। বাচ্চাদের কিছুদিন নানুবাড়িতে বেড়াতে দাও। চলো রাংগামাটি ঘুরে আসি।
মলি আঁতকে উঠে, বাসা ছাড়া কোথাও যাওয়া হয়না তার উপর বাচ্চাদের রেখে। মন ছোট হয়ে আসে মলির। মন খারাপ করে বলে তোমরা প্ল্যান করো আমার তো যাওয়া সম্ভব না।
চাইলেই সম্ভব মলি। বাচ্চাদের জন্য আলাদা টাইম দিতেই হবে আবার নিজের জন্য ও আলাদা টাইম বের করা লাগে। জীবন এভাবেই এঞ্জয় করা লাগে। আমাদের বন্ধুত্ব যখন গ্রহণ করেছো তাহলে এই অত্যাচার গুলো ও গ্রহণ করতে হবে। রাংগামাটি না হোক। কোথাও না কোথাও সবাই মিলে একটা ট্যুর তো দেয়াই যায়।
চলবে…………….