বিষের বিষ ১
আগা আহমদের প্রাণ অতিষ্ট।এক ফোটা মেয়ে তার বউ মালিকা খানমটা–ফু দিলে উড়ে যাবার কথা,কিন্তু সেই যে সাত সকাল ভোরবেলা থেকে ক্যাট ক্যাট আরম্ভ করে তার থেকে আগা আহমেদের রেহায় নেই।মিনষে,’হারহাভাতে ‘”ড্যাকরা”–হেন গাল নেই যেটা আগা আহমেদকে দিনে কমপক্ষে ৫০বার শুনতে না হয়।
ব্যাপরটা চরমে পৌছাল বিয়ের ২০ বছর পর।একদিন যখন আগা আহমেদ কি যেন একটা খুজতে গিয়ে আবিষ্কার করলো,মালিকা খানম নিজের খাবার জন্য লুকিয়ে রেখেছে মুরমুরে রুটি,ভেজা কাবাব,টোনটনে সেদ্ধ ডিম এবং তেলতেলে আচার।
সে রাত্রে আগা আহমদে খেল না।বউ ঝঙ্কার দিয়ে বললো,ও আমার লবাব পুত্ররে !-রুটি পানীয় ওহার রোচে না ।কোথায় পাব আমি কাবাব, আণ্ডা আমার আগা জানের জন্য—
সেই কাবাব আণ্ডা!যা বউ নিজে খেয়েছে।
আগা আহমেদ স্থির করলো ওকে খুন করবে।
শুয়ে শুয়ে সমস্থ রাত ধরে আগা আহমেদ প্ল্যান করলো,খুন করা যায় কি প্রকারে?ওরা থাকে বনের কাছে।সকাল বেলা বনে গিয়ে খুড়লো গভীর এক গর্ত।তার উপর কঞ্চি,কাঠ ফেলে উপরটা সাজিয়ে দিল লতা পাতা দিয়ে।
বিকালের দিকে বউকে বললে,’গা টা ম্যাজ ম্যাজ করছে।একটূ বেড়াতে যাবে?
বউ তো খল খল করে হাসলে চোচা দশটী মিনিট।তারপর চেচিয়ে উঠলো,”কোজ্জাবো,মা-মিনসের পরাণে আবার সোহাগ জেগেছে!’
আগা আহমেদ নাছর বান্দা ।বহু মেহেনত করে গা গতর পানি করে গর্তটা তৈরি করেছে।
বিষের বিষ ২
বউ রাজি হল ।বেড়াতে নিয়ে গেলো বনে।কৌশলে বউ গর্তের কাছে নিয়ে গিয়ে দিল এক মোক্ষম ধাক্কা।তারপর ফের বাশ কঞ্চি লতাপাতা দিয়ে গর্তটি উত্তম রুপে ঢেকে দিয়ে আগা আহমেদতার পীর মুরশীদকে শুকরিয়া জানাতে জানাতে বাড়ি ফিরলো।রান্না করতে করতে গিয়ে বাড়ীতে অনেক কিছুই আবিষ্কৃত হলো।
হালুয়া, মোরব্বা,তিন রকমের আচার,ইস্তেক উওম হরিণের মাংসের শূটকি।পরমানন্দে অনেকক্ষন ধরে আগা রান্না বান্না সেরে আহারাদি সমাপন করিল।ক্যাট ক্যাটানি না শুনে আজ তার চোখে নিদ্রা আসিবে-এ কথাটি যতোবার ভাবে,ততোই ততই তার চিত্তাকাশে পুলকের হিল্লোল ওঠে।পরদিন কিন্তু আগা আহমেদের শান্ত মনে।
এক কোণে কালো মেঘ দেখা দিলো।হাজার হোক তার বউতো!এই অবস্থায় আর ৫জন যা করত আগা আহমদ ও তাই করলো।যাকগে ছাই দেখে আসি না বেটী গর্তের ভেতর আছে কেমন করে?তারপর মনস্থির করা যাবে?
গর্তের মুখের পাতা সরাতেই ভেতর থেকে পরিত্রাহি চিৎকার,’আল্লাহর ওয়াস্তে,রসুলের ওয়াস্তে,বাচাও আমাকে বাচাও।”এ তো মালিকা খানম এর গলা নয়।আরো পাতা সরিয়ে ভালো করে তাকিয়ে আগা আহমদ দেখে বাপরে বাপ,এব্বড়া এক কাল নাগ,চক্করকাটা এক গোখরো সাপ।সে তখনো সমানে চেচাচ্ছে,বাচাও আমাকে
বাচাও,বাচাও,আমি তোমাকে লাখ টাকা দিব,আমি গুপ্তধনের সন্ধান জানি,আমি তোমাকে রাজা করে দিব।
আগা আহমদের হাসি পেল।সাপকে বললে,’তা তুমি তো কত লোকের প্রাণ নির্ভয়ে হরণ করো-নিজের প্রাণ্টা দিতে এতো ভয় কিসের?
ঘেন্নার সঙ্গে সাপ বললে,ধ্যত্ত তোর প্রাণ!প্রাণ বাচাতে কে কাকে সাধছে!আমাকে বাচাও,এই শয়তান রমণীর হাত থেকে।তারপর ডুকরে কেদে উঠে বললে,’মা-গো মা,সমস্ত রাত কী ক্যাটক্যাট,কী বকাটাই না দিলো।আমি ড্যাকরা,আমি মদ্দা মিনসে হয়ে একটা অবলা নারীকে কেনো সাহায্য করছি না,গর্ত থেকে বেরুবার কো্ন
পথ খুজছিনে,আমি একটা অপদার্থ,ষাড়ার গোবর।আমি——
আগা আহমদ বললে,’তা ওকে একটা ছোবল দিয়ে খতম করে দলে না কেনো?
চিল চ্যাচ্যানি ছেড়ে সাপ বললে,আমি ছোবল মারবো ওকে!ওড় গায়ে যা বিষ,তা দিয়ে সাত লক্ষ কালনাগিনী তৈরি হতে পারে।ছোবল মারলে সঙ্গে সঙ্গে ঢলে পড়তুম না?সারাতো কোন ওঝা?ওসব পাগলামি রাখ।আমাকে তুমি গর্ত থেকে তোলো।তোমাকে অনেক ধন দৌলত দিব।পশুপাখি,সাপ বিচ্ছুর বাদশা সুলেমানের কসম।
বিষের বিষ ৩
রুপকথা নয় ,সত্য বলে মনে হলো,মালিকা খানমেরও অনেকক্ষানি পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে –কারণ সে এতোক্ষণ ধরে একবারও স্বামিকে কোন কড়া কথা বলেনি।
মালিকা খানম মাথা নিচু করে বললে,ওরা গুপ্তধনের সন্ধান জানে।
আমাদের আগা আহমদের টাকার লোভ ছিলো মারাত্মক।সাপলে সুলেমানের নামে তিন কসম খাইয়ে গর্ত থেকে তুলে নিলো।বউকে তুলতে হলো–সেও শুধরেগেছে জানিয়ে অনেক কিরে কসম কাটেছিলো।
সাপ বললে,গুপ্তধন আছে উত্তর মেরুতে-বিহু দূরেরে পথ।তার চেয়ে অনেক সহজের পথ তোমাকে বাতলে দিচ্ছি।শহর কোতয়ালের মেয়ের গলা জড়িয়ে ধরব আমি।কেউ আমাকে ছাড়াতে আসলেই মারতে যাব ছোবল।তুমি আসা মাত্রই আমি সুড়সুড় করে সড়ে পড়বো–তোমাকে দেবে বিস্তর এনাম,অনেক ধন দৌলত।
কিন্তু খবর ওই একবার।অতিলোভে যেওনা।
শহরে এমনই তুলকালাম কাণ্ড যে,তিন দিন যেতে না যেতে সেই বনের প্রান্তেয়াগা আহমদের কানে এসে পৌছাল কোতায়াল নন্দীনির জীবন-মরণ সমস্যার কথা।তিন দিন ধরে তিনি অচৈতন্য।গলা জড়ীয়ে কাল-নাগ ফোস ফোস করছে।কোতয়াল লক্ষ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছেন।তবু সাপুড়েরাও নাকি কাছে ঘেষছে না,
বলছে,উনি মা-মনসার বাপ।
প্রথমটাই তো আগা আহমদ কে কেউ পাত্তাই দিলনা।ওঝাবিদ্যা হদ্দ হল,এখন ফার্সি পড়ে আগা!কী বা বেশ,কি বা ছিরি!
কোতায়েলের কানে কিন্তু খবর গেল।
ছিবি-চেহারা দেখে তিনি বিশেষ ভরসা পেলেন না।কিন্তু তখন তিনি শ্মশান চিকিতসার জন্য অ তৈরি-সে চিকিতসা ডোমই করুক,চাড়াল ও সই।
বিষের বিষ ৪
তারপর যা হওয়ার কথা ছিল তাই হলো।‘ওঝা’ আগা আহমদ ঘরে ঢোকামাত্রই সেই কালনাগ কোথা দিয়ে বেরিয়ে গেল,
কেউ টেরটি পর্যন্ত পেলোনা।কোতয়াল নন্দিনী উঠে বসেছেন,তার মুখে হাসি ফুটেছে।ভীশন দর্শন কোতয়াল সাহেবের চেহারা প্রসন্ন,বদান্যতায় মোলায়েম হয়ে গিয়েছে।আগাকে লক্ষ টাকা তো দিলেনই,সঙ্গে সঙ্গে তাকে বানিয়ে দিলেন তার বাসার পাশের ফরেস্ট অফিসার।এইবার আগা দু’বেলা প্রাণ ভরে বাচ্চা হরিণের মাংস খেতে পারবে।
আগা সুখে আছে।সোনাদানা পরে মাল্কা খানমও অন্য ভুবনে চরছেন-ক্যাটক্যাট করে কে?
ওমা এক মাস যেতে না যেতে খবর রটলো, উজির সাহেবের মেয়ের গলা জড়িয়ে ধরেছে একটা সাপ।কোন সাপ?—সেই সাপটাই হবে, আর কোনটা?
একেবারে দশ লক্ষ টাকার এনাম,কিন্তু সেই সঙ্গে সঙ্গে পাইক-বরকন্দাজ,পেয়াদা-নফর ছুটেছেয়াগা আহমদের বাড়ির দিকে ।
কিন্তু আগা আহমদের বিলক্ষণ স্মরণ ছিল,অতি লোভ ভাল না-সাপ সারাতে একবারের বেশি সে যেন না যায়।সে যতই অমত জানায়,ইয়ার বক্সি ততই বলে,
হুজুর কি কপাল!বাপ-মার আশীর্বাদ না থাকলে না এমন হয়?
আগাকে জোর করে পাল্কিতে তুলে দেওয়া হলো।
এবার সাপ জুলজুল করে তার দিকে তাকিয়ে বললে,’তোমার খাঁই বড্ড বেড়েছে না?
তোমাকে না পইপই করে বারণ করেছিলুম,একবারের বেশি আসবেনা।তবু যে এসেছ?তা যাকগে-তুমি আমার উপকার করেছ বলে তোমাকে এবারের মতো ছেড়ে দিলুম।কিন্তু এই শেষ বার।আর যদি আসো,তবে তোমাকে মারবো ছোবল।“
দশ লক্ষ তকা এবং তার সঙ্গে পাচ’শ ঘোড়ার মনসব পেয়েও নওয়াব আগা আহমদের দিল সাহারা মরুভুমির মতো শুকিয়ে গিয়েছে?মুখ দিয়ে জল নামে না,পেটে রুটি সয় না।কাল নাগ আবার কখন কোথায় কি করে বসে,আর সে ছোবল খেয়ে মরে।স্থির করলো,ভিনদেশে পালাবে।
বিষের বিষ ৫
ঠিক সেদিনেই স্বয়ং কোতয়াল সাহেব এসে উপস্থিত।কোতয়াল সাহেব গদগদ কণ্ঠে বললেন,”ভাই,নওয়াব সাহেব,”তোমার কি রাজ কপাল!তামাম দেশের চোখের মণি,দিলের রোশনি রাজিকুমারির প্রান উদ্ধার করে তুমি হয়ে যাবে দেশের মাথার মুকুট।চলো শিগগিরি!সেই হারামজাদা কাল নাগ এবার জড়িয়ে ধরেছে শাহজাদীর গলা।“
নওয়াব আগা আহমদ জড়িয়ে ধরলেন কোতয়ালের পা।হাউ মাউ করে কেঁদে নিবেদেন করলে,সে কোন ফাটাবাশের মধ্যিখানে পড়েছে।
কোতয়ালের হৃদয় মাখন দিয়ে গড়া থাকেনা।ব্যাপারটা বুঝে নিতেই শহর দারোগাকে হুকুম দিলেন,চিড়িয়া বন্ধ করো পিঞ্জিরামে।পাল্কিতে নওয়াব আগা আহমদ।দু’পাশের লোক তার জয়ধ্বনি করছে।
আগা আহমদ মুদ্রিত নয়নে মুর্শিদ মৌলের নাম আর ইষ্টমন্ত্র জপছে।
স্বয়ং বাদশা তাকে হাত ধরে তাকে রাজকুমারির দোরের কাছে নিয়ে এলেন।
আগা আহমদ ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল।
কাল-নাগ হুঙ্কার দিয়ে উঠলো,’আবার এসেছিস,হতোভাগা?এবার আর আমার
কথার নড়চড় হবেনা।তোর দুই চোখে ঢেলে দিব কুল্লে বিষ।‘
আগা আহমদ অতি বিনীত কণ্ঠে বললে,’আমি টাকার লোভে আসিনি।তুমি আমার
অনেক উপকার করেছ,তাই তোমার একতা উপকার করতে এলুম।এদিক দিয়েই
যাচ্ছিলুম,শুনলুম তুমি এখানে।
ওদিকে সকাল বেলা বিবি মালিকা খানম আমাকে বলেছিলেন,তিনি রাজ কন্যাকে সেলাম করতে আসছেন।বোধ হয় এক্ষুণি এসে পড়বেন।তুমি ত ওকে চেনো—হে,
তাই ভাবলুম তোমাকে খবরটা দিয়ে তোমার উপকারটা করি।
‘বাপরে,মারে’,চিৎকার শুনা গেলো।কোন দিক দিয়ে যে কাল-নাগ অদৃশ হলো,
আগা আহমদ পর্যন্ত স্থির করতে পারলো না।
এরপর আগা আহমদ শান্তিতেই জীবন যাপন করেছিল।
সংক্ষিপ্ত
গল্প পাশের বাসার ভাবি ।