®রোজা রহমান
‘
ভোর পাঁচটা। অন্ধকারচ্ছন্ন ভোর। প্রকৃতি এখনো আলো-আঁধারির আয়ত্তে। পাখিরা উঠে তাদের নীড় ছাড়ছে। কিচিরমিচির শব্দ তুলে ছুটছে। আকাশে দু’একটা তারা এখনো দৃশ্যমান সেই তারার মাঝে শুকতারা নামক তারাটি জ্বলজ্বল করে জ্বলছে৷ প্রকৃতি শীতলতায় ছেয়ে আছে। মৃদুমন্দ সমীরণ বইছে। এক অন্যরকম প্রকৃতির সকাল হতে চলেছে আজ। রোমাঞ্চকর সেই প্রকৃতি। মিষ্টি প্রকৃতিও কি চাইছে শিশির, কুয়াশার জীবনের প্রথম সকালটা মিষ্টি হোক? প্রকৃতিও কি সাঁই দিতে চাইছে তাদের জীবনের প্রথমদিনের শুরুটাকে? রোমাঞ্চকর প্রকৃতিও বোধহয় চাইছে তারা জীবন সাজিয়ে নিক, গুছিয়ে নিক। একে অপরকে সঙ্গী হয়ে মানিয়ে নিয়ে এবং মেনে চলে। জীবনের রঙ পাল্টাতে সাঁই দিতে চাচ্ছে। তাইতো সে-ও আজ নতুন, মিষ্টি রূপে সেজে জানান দিচ্ছে তার আনন্দ এবং সঙ্গ। বলতে চাইছে জীবন সুন্দর, জীবনের রঙ সুন্দর।
‘
আজানের পরপর-ই ঘুম ভেঙে যায় কুয়াশার। শিশিরেরও তেমনি অভ্যাস। ফজরের আজানের পর নামাজ পড়তে ওঠে সকলে। নামাজ পড়ে শোয় আবার। তেমনি নিয়ম মাফিক কিছুক্ষণ আগে কুয়াশার ঘুম ভেঙে গেছে৷ কিন্তু সে উঠবে কি করে সেই চিন্তায় মগ্ন। কিভাবে? কি করে? কি বলে? শুরু করবে বুঝে আসছে না। কারণ সে এখন শিশিরের কোলবালিশ রূপে আছে। এই নতুন দিনের শুরুর সকালটা খারাপ করে শুরুও করতে চাইছে না আবার এই বুনো ওলের সাথে ভালো কথাও আসছে না। কী একটা জ্বালায় পড়েছে সে!
শিশির উপর হয়ে শুয়ে কুয়াশার একদম শরীর ঘেঁষে পেট আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে গলার কাছে মুখ গুঁজে ঘুমচ্ছে আরামে৷ যেন কুয়াশা কোলবালিশ আর সে কোলবালিশ জড়িয়ে ঘুমচ্ছে। আজ যেন আরামের ঘুম পাড়ছে ভাবটা এমন। কোনো চিন্তা নেই সেই ঘুমে৷ নিদারুণ, নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। রোজ আজানের পর পর ওঠে অথচ আজ তার ঘুম-ই ভাঙছে না! গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন সে৷
কুয়াশার দেরি হচ্ছে বলে বহু চিন্তা ভাবনা করে ডাকল,
” এ্যাই “
কানে গেল কিনা বুঝল না৷ কারন কথার সুরটাও অতি অল্প অর্থাৎ অতি আস্তে। বেচারা পড়েছে মাইনকার চিপায়। ভাইয়া বলে সম্মোধন করতে পারছে না নাম ধরে তো আরোই পারবে না। নিজের প্রতি এখন রাগ উঠছে৷ কখন যে ঘুমের মাঝে এতটা কাছাকাছি এসেছে বুঝে নি। এবার হাত দিয়ে ধাক্কাল৷ বলল,
” এ্যাই লোক উঠো। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে ”
শিশির এবার নড়েচড়ে উঠল৷ ঘুম হালকা হলো৷ তবে পুরোপুরি ভাঙল না। কুয়াশার বিরক্ত বোধ হলো অনেক৷ এবার কিছুটা বাহুতে জোরে ধাক্কিয়ে বলল,
” আরেহ্ ওঠো না! আজান দিয়েছে অনেকক্ষণ। ওঠো। ছাড়ো আমায় ”
বলে শিশির হাত সহ দেহও সরানোর চেষ্টা করল৷ কিন্তু ঐ শক্ত দেহ তারউপর আবার ঘুমে সেই দেহ কি সরানো সম্ভব চাইলেও? শিশির নিজে থেকে না সরলে? শিশিরের হাত তুলতে লাগল পেট থেকে৷ এবার শিশির তাকাল৷ দেখল নিজের পাশে কাউকে৷ মনে পড়ল গোবর ঠাঁসা নামক কুয়াশা তার বউ। মিষ্টি গন্ধ পেল একটা কুয়াশার কাঁধের কাছের গলার মাঝে থেকে৷ স্মেলটা তার ভালো লাগল বলে আরেকটু জোরে নিঃশ্বাস টানল৷ ঠোঁটে কেন জানি আপনায় হাসি ফুটে উঠল। এরপর বলল,
” আস্তে চেঁচা গোবর ঠাঁসা। সকাল সকাল এত জোরে চেঁচাচ্ছিস কেন? কান খুলে গেল আমার ”
সকাল সকাল শিশিরের মুখে নিজের নিক নামটা শুনে রাগ উঠল৷ সে নিজে এতক্ষণ তাকে বুনো ওল বলবে না বলে এ্যাই, এ্যাই করছিল আর দেখো এই বুনো ওল উঠে তাকে ধমকাতে লেগেছে৷ দিল সকালটা নষ্ট করে৷ একটু রাগ নিয়ে বলল,
” এ্যাই, সরো তো৷ আমাকে যে ভাবে ধরে আছো চেঁচাব না তো কি করব? আর আমি চেঁচালাম-ই বা কোথায়? কখন থেকে ডাকছি? সাড়ে পাঁচটা বেজে গেল সরো!!”
শেষ কথাটা একটু জোরেই বলল৷ শিশিরের হুস এলো বুঝল এবার সে কোথায় আছে৷ তখন শুধু মাথা তুলে কুয়াশার পানে তাকাল৷ সদ্য ঘুম ভাঙা, ফোলা চোখ, ফোলা মুখ, ফোলা ঠোঁট কপালে কিঞ্চিৎ রাগের ভাজ সব-ই নজরে এলো। তেল তেল হয়ে আছে মুখ। তবুও ফ্রেশ লাগছে মুখটা। মনের অজান্তেই বেড়িয়ে এলো,
” কী দারুণ লাগছে রে তোকে! ”
কুয়াশা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল৷ চোখ বড় বড় করে তাকাল৷ মনে হচ্ছে জীবনের প্রথম শুনল এই বাক্যটা। কিন্তু তা তো নয়! সে তো অনেকবার শুনেছে৷ কিন্তু জীবনের প্রথম শুনল এই মানুষটার থেকে। কোনোদিন তাকে ভালো করে দেখেছে কিনা সন্দেহ আর সে কিনা তার প্রশংসা করল? ভাবা যায়!
শিশিরও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে কথাটা বলে। কেন বলল জানা নেই। সে তো কখনো কুয়াশাকে এভাবে দেখেই নি! তার চেহার কোন জায়গায় কী আছে বা কোনটা কিরকম সে কখনো তাকিয়েও দেখেনি। তার বলার ক্ষেমতাই নেই বোধহয় কুয়াশার নাকটা কেমন, ঠোঁট টা কেমন বা চোখটা কেমন! কিন্তু আজ তার কি হলো? এমন মন্তব্য করল? এটাই কি তবে তিন কবুলের জোর? এটাকেই কি তবে বলে নিজের অধিকারবোধ?
শিশির সরে এলো৷ কুয়াশার হতভম্ব চেহারায় নজর দিয়ে বলল,
” কি? অভাবে কি দেখছিস? সুন্দরী বলেছি বলে উড়ছিস নাকি? পাম দিয়েছি, অত উড়তে হবে না। তুই পেত্নীর থেকে কম কিছু না৷ যাহ্ সর৷”
কুয়াশার রাগ উঠল। কোনো মেয়েকে এসব মন্তব্য করলে যে কোনো মেয়েরই রাগ হবে৷ আর সে তো শুনল তার শত্রু পক্ষ থেকে৷ তাই এক লাফে উঠে বসে নিজে মাথার নিচে যে বালিশটা ছিল সেটা তুলে নিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে থাকা শিশিরের বুকের উপর দুইটা বাড়ি দিল। বাড়ি দেয়ার সময় বলল,
” বুনো ওলের বাচ্চা!”
মে-রে বালিশ রেখে ওয়াশরুমে দিল ভোঁদৌড়। শিশিরকে না কিছু বলার সুযোগ দিল আর না কিছু করার সুযোগ দিল৷ ধরতে পারলে যে উল্টো মা-ইর সে-ও খেতো সে জানে। তাই সেই সুযোগ আর দিল না।
এদিকে শিশির মা-র খাবার সময় ‘আহ’ করে উঠেছিল। কিন্তু এখন কুয়াশা যেতেই দাঁত বের করে শব্দ করে হেসে দিল৷ সকালটা রোজ এই গোবর ঠাঁসাকে জ্বালিয়ে শুরু করা যাবে। ভেবেই আনন্দ পেয়ে হাসল আবার। খুঁনসুটিটা ভালোই লাগল৷ তাই আবার আপন মনে দুষ্ট চোখে মুচকি হাসল।
” ইশশ কী সুন্দর সকাল! “
‘
দু’জনের নামাজ পড়ে উঠতে উঠতে সকাল হয়ে গেছে। চারিদিকে পরিষ্কার হয়ে গেছে৷ রাস্তা ঘাটে মানুষজনের চলাচল শুরু হয়ে গেছে। গাড়ির শব্দও শরু হয়ে গেছে।
কুয়াশা নামাজ শেষে নিজেকে একটু পরিপাটি করল। শাড়ি খুলে ফেলেছে নামাজের আগেই। এখন কালো রঙের থ্রি-পিচ পড়া। হাতে চুড়ির শব্দ, পায়ে নূপুরের শব্দ সবই শিশির পেল। নিজের ঘরে মেয়েমানুষের আনাগোনা কেমন যেন মনটা সিক্ত হয়ে উঠছে৷ দিন কি তবে পাল্টাতে চলল? হয়তো চলল।
শিশির শুয়ে কুয়াশার চুল বাঁধা দেখল৷ এরপর কুয়াশা দরজা খুলে যেই বের হতে যাবে তখনই শিশির গিয়ে ধরল। কুয়াশা কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওর বাহু ধরে বিছানায় এনে ফেলল। আবারও কিছু বুঝে আসার আগে পাশে থেকে বালিশ তুলে কুয়াশার কাঁধের বরাবর দিল তি-ন চারটা বাড়ি। কুয়াশা ‘ইশশ’ ‘মা গো ‘ এই দুইটা শব্দ করে উঠল। রাগল এবার প্রচুর। কতত বড় বেয়াদব!! সে মে-রেছে দুইটা আর তাকে এতগুলো মা-রল? শিশির বলল,
” ফিরিয়ে দিলাম। যাহ্ সর এবার ”
বলে ঢাঁস করে শুয়ে পড়ল কুয়াশার পাশে। কুয়াশাও উঠে শিশিরের চুল টেনে দিয়ে দিল দৌড়। শিশির ফিরতি আক্রমন পেয়ে বালিশ নিয়ে তাড়া করল। ততক্ষণে কুয়াশা পগাড় ডান্ডি পাড়।
” আবার আসবিনা এই ঘরে? তখন তোর খবর করব ”
বলতে বলতে দরজার মুখে চলে এলো। তাও আবার বালিশ হাতে নিয়ে। কিন্তু সামনে বৃষ্টি, ইয়াসমিন, শশী, স্মৃতি, নীহার রিজভী, হিম আর জাকিয়াকে দেখতে পেল। তাদের সামনে কুয়াশা দাঁড়িয়ে৷ তারা শিশির, কুয়াশাকেই ডাকতে আসছিল আর দেখতে আসছিল। শিশির মা’কে দেখে ঘুরে বালিশটা ছুড়ে বিছানায় ফেলল৷ অপর পাশের সকলে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। একবার শিশিরকে দেখছে তো একবার কুয়াশাকে। বৃষ্টি কুয়াশার হাত পা চেক করতে করতে বলল,
” তোমরা অক্ষত আছো? কা-টা কা-টি করো নি? কই র’ক্ত টক্ত তো দেখছি না। তারমানে খু-না খু-নি হয়নি৷ যাক বাঁচালে। আমি তো সারারাত ঘুমোয়-ই নি তোমাদের চিন্তায়। ভাবছিলাম সকালে উঠে কান্না করা শুরু করব তোমাদের র-ক্তাক্ত দেখে। কিন্তু আমার তো ম-রা কান্নাটা মিস হয়ে গেল।”
বলে মন খারাপের মেকি ভাব করল।
ইয়াসমিনও একই সুরে বলল,
” আমি তো আরো ভেবেছিলাম এরা জী’বি’তই থাকবে না “
কুয়াশা, শিশির হতবাক হয়ে গেল। মানে তারা মা-রা মা-রি করে বলে এমন করে ইনসাল্ট করবে? এরা আজ খু-না খু-নি দেখতে চলে এসেছে? দু’জনে এক সাথে উচ্চশব্দে ডেকে উঠল,
” ভাবি….!”
অপর পাশের সকলে জোরে শব্দ করে হেসে দিল। জাকিয়া হেসে বললেন,
” আহ্ বৃষ্টি, ইয়াসমিন এভাবে বলো না। আমার ছেলে, ছেলের বউ এতটাও খারাপ না৷ তারা লক্ষ্মী এই দেখো তারা কী সুন্দর বালিশ দিয়ে মা-রা মা-রি করছিল৷ অন্য কিছু দিয়ে তো আর করেনি! ”
সকলে আবার হেসে উঠল৷ দু’জনে আবারও ভড়কে গেল। তবে শিশিরের কেন জানি লজ্জা লাগল মায়ের মুখে কথাটা শুনে। শেষ পর্যন্ত জাকিয়াও মজা উড়াচ্ছে! নীহার বলল,
” আমি তো তৈরি-ই হয়ে এসেছিলাম৷ সারারাত ঘুমের মাঝেও ভেবেছি আমার ভাই-বোন দু’টো বুঝি যু-দ্ধ করে মালিথা ভিলা স্বাধীন করে ফেলেছে “
আবারও হাসির রোল পরল৷ দু’জনে নির্বিকার হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। জাকিয়া এবার বললেন,
” থাক হয়েছে আর মজা নিস না৷ এরা ঠিক হয়ে যাবে৷ আমার ছেলে মেয়েরা বুঝদার৷ পরিবার তাদের খারাপ চাইনি একদিন ঠিকই বুঝবে ”
বলে কুয়াশার মাথায় হাত দিয়ে আদর দিলেন৷ নীহার, রিজভী শিশিরের পাশে গিয়ে দাঁড়াল৷ শশী কুয়াশাকে জড়িয়ে ধরল। হিম বলল,
” কিন্তু আমি তো সারারাত এটা ভেবেছি সকালে উঠে শিশির ভাইকে কি বলে ডাকব? এদিকে বুবুকেই বা কি বলে ডাকব? গুলিয়ে ফেলছি তো সব৷ ভাইকে ভাই ডাকব নাকি দুলাভাই? ববুকে কি ভাবি ডাকব? ”
সকলে হা হা করে হেসে ফেলল এবার৷ শিশির চোখ গরম করে হিমের দিকে তাকাল। আর কুয়াশা তেড়ে গেল বলল,
” বে-য়াদব, চামচা তুইও এসছিস মজা নিতে? ”
হিম সরে গিয়ে বলল,
” আরেহ্ বুবু রাগো কেন? আমাদের সম্পর্ক বদলে গেছে একটি পলকে। তুমি আমার বুবু আর ভাইয়ের সাথে তোমার কাল বিয়ে হয়েছে সেই হিসেবে শিশির ভাই তো আমার দুলাভাই হচ্ছে! ভুল কোথায় বললাম? লজিক বুঝো বুঝছো, লজিক বুঝো৷ দু’দিন পর কী খেয়ে লয়ার হবা যদি যুক্তিবিদ্যায় না বুঝো? “
এবার শিশির আর সহ্য করল না। তেড়েমেড়ে হিমকে ধরল৷ বলল,
” খুব যুক্তিবিদ্যা শিখেছিস না? চল তোকে আমি যুক্তিবিদ্যা শিখায়। যুক্তিবিদ্যা কত প্রকার ও কী কী এবং তার উপকারিতা ও অপকারিতাও শিখাব। ”
হিম এবার ভয় পেয়ে ঢোক গিলল। বাকিরা মিটিমিটি হাসছে। রিজভী বলল,
” কেন রে ভাই? তোর উচিত কথা সহ্য হচ্ছে না? হিম তো ঠিকই বলেছে৷ তুই তো ওর দুলাভাই-ই হচ্ছিস। হয় হয়, উচিত কথা বললে কুটুম বেজার হয়। “
কুয়াশা শুনে হতবাক, হতবুদ্ধি হয়ে গেল৷ এরা সকাল সকাল আটঘাট বেঁধে এসেছে নাকানিচুবানি খাওয়াতে? সব একপক্ষে! শিশির কটমট নজরে তাকালে সকলে দাঁত বের করে হাসল। শশী বলল,
” সব কথা ছাড়ো, কুয়াশা বুবুকে আমি তিন রকম সম্মোধন করতে পারব। “
নীহার বলল,
” তিন রকম কেমন? “
” আরেহ্, কুয়াশা বুবুকে তো আমি বুবু বলি! সেদিক দিয়ে আমার বোন, এদিকে শিশির ভাইয়ের বউ তাহলে ভাবি আর একটা হচ্ছে আমার জা হবে তো। “
শেষটা বলতে গিয়ে লজ্জায় লাল হয়ে গেল মেয়েটা। সকলে শুনে হাসল৷ নীহার ভড়কে গেল৷ বিড়বিড়াল,
” স্বাধে কি আর বলি ইঁচড়েপাকা মেয়ে! ”
বৃষ্টি বলল,
” হ্যাঁ রে শশী তোর আমাদের জা হবার জন্য এত তাড়া কেন? “
” বহুত তাড়া। জলদি নিয়ে আসো তো, চলে আসি। তোমাদের দেবর বোঝে না তা”
নীহার চোখ গরম করে তাকাল। শশী পাত্তা দিল না সেদিকে। কুয়াশা বলল,
” পাকনা মেয়ে, আগে আঠার বছর বয়স বানা ”
সকলে হেসে উঠল আবার। শশী মন খারাপ করে তাকাল নীহারের দিকে। নীহার নির্বিকার। জাকিয়া বললেন,
” হয়েছে এবার ছাড়ো এসব। চলো, নিচে চলো সকলে। ”
কেউ আর কথা বলল না। শিশির কুয়শাও চুপ করে রইল। বলতে দিল। এদের উপর রাগ করেও লাভ নেই৷ সময় এখন ওদেরই যত পারে নিয়ে নিক মজা৷
________
ভোর ছয়টা বেজে মিনিটের কাটা তিনের ঘরে। অর্থাৎ পনের। নিচে বাড়ির সকল সদস্যই উঠে গেছে। বসে গল্প করছেন বড়রা। আজমিরা, আম্বিয়া রান্নাঘরে। এখন হালকা নাস্তার বদলে ভারী খাবারের আয়োজন করা হচ্ছে একবারে। কারণ জাহিদ মালিথা সহ শশী, মিহির, রিজভী, স্মৃতিও চলে যাবে সকালের খাবার খেয়ে।
কুয়াশারা আসতেই জাকির মালিথা, জাহিদ মালিথা তাকিয়ে মুচকি হাসলেন। কুয়াশাকে জাকির মালিথা ডাকলেন পাশে। জিজ্ঞেস করলেন,
” রাগ করে আছিস মা আমাদের উপর? “
” না চাচু”
সরল স্বীকারক্তি তার৷ দুই ভাই হাসলেন৷ মনে মনে ভাবলেন সময়ের সাথে সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে। সুখী হবে দু’জন৷ মাথায় হাত রেখে দোয়া করলেন অনেক। শিশির সামনের সোফায় বসে দেখল নির্বিকার ভাবে। দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। মনেমনে আওরাল,
” ঠিক হয়ে যাক সব, জলদিই ঠিক হয়ে যাক। ”
________
সকাল সাড়ে আটটা। সকল ছেলেরা খাবার টেবিলে আর মেয়েদের মধ্যে শশী ও কুয়াশা বসেছে। রান্না ঘরে বৃষ্টি ইয়াসমিন ব্যস্ত শাশুড়ীদের সাথে৷ তিন শাশুড়ী তাদের দুই জা’কে একটা দায়িত্ব দিয়েছেন তা হলো, কুয়াশাকে সব বিষয়ে শিখিয়ে পড়িয়ে দেয়া। সংসার সম্পর্কে বেশি বেশি বলা যাতে করে দ্রুত সব মেনে নিয়ে সংসারের প্রতি মন দিতে পারে। আর তার সাথে দেবর আর জা’য়ের দু’জন দু’জনের মনের মিলটা যেন দ্রুতই হয়ে যায়৷ তাদের সাহায্য করতে বলেছেন। বৃষ্টি, ইয়াসমিনও তা সাদরে গ্রহণ করেছে। দায়িত্ব নিয়েছে দেবর জা’কে মেলানোর যথা সাধ্য চেষ্টা করবে তারা।
খাবার টেবিলে এক সাথে বসানো হয়েছে নতুন জীবনে পদার্পণ করা দু’ই জনম শত্রুকে। যা জীবনেও, আজ পর্যন্ত যা করেনি বাড়ির লোক। সবসময় দু’জনকে আলাদা রাখতে পারলে বাঁচত পরিবারে লোক আর আজ সময় ব্যবধানে, নিয়তির লীলাখেলায় সব থেকে অপত্যার দু’টি ছেলে মেয়েকে পাশাপাশি বসানোর মতো সাহস করেছেন সকলে।
আগে আলাদা রাখতে পারলে বাঁচত আর এখন একসাথে রাখতে পারলে বাঁচে। কী অদ্ভুত না! মানুষ এবং জীবন বড়ই অদ্ভুত! দু’টো-ই কখন বদলে যায় বোঝা বড় দায়।
‘
দু’জন একটু বিরক্তি হয়েছে বটে। কারণ এসব আদিক্ষেতা তাদের অসহ্য-ই লাগছে কিন্তু বাবাদের সামনে কিছু বলতে পারছে না। ভ্রু কুঁচকে বসে আছে। আজব বসিয়ে রাখার কী আছে খেতে ডেকে? খেতে ডেকেছে অথচ খাবার দেয়নি সামনে। বৃষ্টি, ইয়াসমনি কী যেন করছে বলে গেছে একটু পর খাবার পাবে৷ জাকির মালিথা ও জাহিদ মালিথার খাবার প্রায় শেষের দিকে। তুহিন, তুষারেও হয়ে এসেছে৷ চারজনেই চলে যাবেন।
কিছুক্ষণ পর জাকির ও জাহিদ মালিথা উঠে গেলেন। তুষার, তুহিনের এখনো হয়নি। তখন বৃষ্টি, ইয়াসমিন খাবার নিয়ে এলো। বাবা, চাচুকে উঠে যেতে দেখে শিশির উঠে পড়তে যাচ্ছিল কিন্তু বৃষ্টি এসে থামিয়ে দিয়ে বলল,
” আহ্ শিশির, কী হচ্ছে, উঠছ কেন? আজকে একসাথে বসে খাওয়ার নিয়ম। ”
” ভাবি, তোমাদের আর নিয়ম খাটাতে এসো না তো। অসহ্য লাগছে সময় লাগবে আমাদের ”
শিশিরের কথার উত্তর তুষার দিল বলল,
” শিশির এমন গাছাড়া ভাব ছাড়। আস্তে আস্তে গুছিয়ে নে। একবারে কিছু চাপানো হচ্ছে না তোদের উপর৷ কিন্তু একদমই যদি গাছাড়া ভাবে বসে থাকিস তাহলে কিকরে হবে? ”
বড় ভাইয়ের কথা শুনে কিছু বলতে পারল না। কুয়াশা মুখ শুকনো করে বসে রইল। সব মেনে নিতে হবে। কিন্তু মন? সে কেন এমন বেহায়াপনা করছে? কবে মানবে সে?
শিশির বসল বিরক্ত মুখে। বৃষ্টি হেসে দু’জনকে একটা প্লেট দিল। কি আশ্চর্য! একটা প্লেট দিল কেন? কুয়াশা বলল,
” আমার প্লেট কই ভাবি? ”
আজ এক প্লেটে খাবে তোমরা। কাল যে রিচুয়ালটা হয়নি আজ হবে। বিয়ের দিন বরের পাতের খাবার খেতে হয় তাহলে মহব্বত বাড়ে কিন্তু তোমাদের তো তেমন বিয়ে হলো না তাই আজ হবে৷ কুয়াশার কান গরম হয়ে উঠল কথাটা শুনে৷ এটা সে-ও জানে এবং মানে। কারণ সকলের বিয়েতে দেখেছে এমনটা৷ যদিও সকলে করে কিনা যানা নেই। সে যেই বিয়েগুলো দেখেছে সবটাতেই করেছে। তারও ইচ্ছে জাগত সেগুলো দেখে মনে মনে সে-ও ভেবে রেখেছিল বিয়ের পর সে-ও বরের পাতের খাবার খাবে। ইশশ কী অদ্ভুত সেই ভাবনাটা ছিল আর অদ্ভুত শিহরণও হতো। এছাড়া বিয়ে নিয়ে আরো কতশত ছোট ছোট অনুভূতি ছিল তার। কিন্তু সব তো এলোমেলো হয়ে গেছে৷ এই বুনো ওলের পাতের খাবার এখন তাকে খেতে হবে? ভাবতেই রাগে শরীর জ্বলছে।
শিশির কথাটা শুনে কুয়াশার দিকে তাকাল। রাগ নিয়ে বলল,
” এই গোবর ঠাঁসার সাথে এক প্লেটে খাবার খাব? ”
” এ্যাই বুনো ওল, তুই কি মনে করেছিস আমি নিজেও খাওয়ার জন্য নাচছি? “
” বে-য়াদব ভাষা ঠিক কর নয়তো মা-র একটাও মাটিতে পরবে না৷ বউ হয়েছিস বলে আহ্লাদ দেখব না৷ ”
” তোর কাছে আহ্লাদ দেখাতে গেছি আমি? দেখতে বলছি তোকে? ”
” তোকে তো ”
বলে কুয়াশাকে মা-রতে যাবে সেই সময়ে তুষার ধমকে উঠল
” এ্যাই..! “
শিশির থেমে গিয়ে বলল,
” দেখো কার সাথে বিয়ে দিলে আমায়৷ কতটা বেপরোয়া। এর সাথে সংসার করা কি আদৌ সম্ভব? ”
” শুরু তো তুই আগে করলি, ও তো চুপই ছিল ”
তুহিনের কথায় শিশিরের রাগ আরো বাড়ল। বৃষ্টি বলল,
” আরেহ্ থামো না। জাস্ট আজকের দিনটায়। আর কখনো এভাবে খেতে হবে না। আর জোর করব না। “
শিশির চুপ রইল৷ এদের সব আদেশ গিলতে হবে। কুয়াশা রাগ, ক্ষোভ নিয়ে চুপ রইল৷ জীবন তার নষ্ট করে দিল এই বাড়ির লোক৷
অতঃপর এক প্লেটে খাবার দিল। খাবার দিল ঠিক, কিন্তু মাছের মাথা একটা দিল কেন? এবার এটা নিয়েও কি আবার নিয়ম খাটাবে?
শিশির, কুয়াশা দুইজনই মাছের মাথা পছন্দ করে। আর বাড়ির কেউ মাথা খায় না৷ শুধু ওদের জন্য মাথা রান্না করা হয়। দু’জনের দু’টো করা হয়। কিন্তু আজ একটা দেখে উপরক্ত কথাটা মাথায় এলো দু’জনেরই। শিশির বলল,
” আরেকটা কই মাথা?”
” একটায় রান্না হয়েছে ”
জাকিয়া আসতে আসতে বললেন। আজ বোধহয় বিরক্ত দিবস তাদের৷ শুধু বিরক্ত হচ্ছে সবকিছুতে। বাড়ির সবার এমন ন্যাকামো করার কী আছে বুঝছে না দু’জন। সব কিছুতে এমন জোর খাটানোর কী আছে? শিশির বলল,
” আম্মু, তুমি জানো আমিও মাথা খাই তবে একটা কেন? ”
” কারণ একটাই ভাগ করে খাবি ”
” কিহ্..!”
শিশির কুয়াশার এক উত্তর। কুয়াশা বলল,
” এই বুনো ওলের সাথে আমার স্বাধের প্রিয় মাছের মাথা ভাগ করে খাব? ”
” আমার প্রিয় জিনিস এই গোবর ঠাঁসাকে সাথে ভাগ দেব? ”
ল্যাহ কেউ কাউকে ভাগ দিতে নারাজ। এবার না আবার মাথা নিয়ে যু-দ্ধ হয় যে,
” মাছের মাথা আমি খাব ”
জাকিয়া বললেন,
” হ্যাঁ ভাগ করে খাবি। তোদের সম্পর্কই হয়েছে তেমন ভাগাভাগির সম্পর্ক তাই কোনো কথা না বলে চুপচাপ খা। দু’জনের অধিকার এটা, একে অপরের জিনিসে ভাগ বসানো ”
সত্যি কী তাদের ভাগাভাগির সম্পর্ক হয়েছে? ভাগ বসানো অধিকার হয়েছে? এখন থেকে একে অপরের জিনিস ভাগাভাগি করতে হবে? একে অপরের জিনিস একে অপরকে ভাগ দিতে হবে? এগুলো অধিকার? জীবনে যা দু’জনের এক জনও করেনি আজ থেকে তা করতে হবে? ইহজীবনেও কেউ কারো জিনিসে একচুল পরিমাণ ভাগ নিতে দেয়নি। দেয়নি কি? দিতে নারাজই ছিল একদম। আর এখন ভাগ বসাতে দিতে হবে তাও আবার সম্পূর্ণ অধিকারের সাথে? একে অপরের জিনিসে ভাগ বসাতে আসলেই মা-রা মা-রি, চুলোচুলি, ঝগড়া বেঁধে যেত৷ কারো ভালোবাসার ভাগ পর্যন্ত একে অপরকে দিতে নারাজ ছিল আর আজ থেকে সেসবই তাদের একে অপরের জন্য অধিকারে পরিণত হলো? এ কি দিন এলো? এ কি সময় এলো? কেউ কি ঘুনাক্ষরেও টের পেয়েছিল এমন কিছু হবে? কেউ কি ভেবেছিল এমন ভাগাভাগির দিনও তাদের জীবনে আসবে? উহু কখনো ভাবেনি৷ ভাববে কেন? তাদের তো তেমন সম্পর্ক ছিলই না। একে অপরকে ছাড় না দিতে পারলেই বাঁচত সেখানে ভাগাভাগির প্রশ্নই আসে না!! এটাকেই কি তবে বলে একে অপরের প্রতি জোর খাটানো, অধিকারবোধ, বিয়ের বন্ধন? অর্ধাঙ্গ, অর্ধাঙ্গী?
| চলবে |
সবাই যদি ভেবে থাকো যে ওরা বিয়ের পরেরদিন থেকেই লুতুপুতু প্রেম শুরু করে দিবে তো ভুল ভাববে। ওরা এখন প্রেমে পড়বে শুরু করবে না৷ ওরা নিজেদের কাছে সময় নিয়েছে সেই অনুযায়ীই আগাবে৷
আর হ্যাঁ পরিবারের বিষয়টাকেও যদি বেশি বেশি ধরো তবে সেটাও ভুল পরিবারই ওদের মিলের কৃতিত্ব হবে।
শুধু বলব ধৈর্য ধরে পড়তে থাকো ভালোকিছুই পাবে। আমার ভাবনা অনুযায়ী লিখি আমি।
বুনো ওল বাঘা তেতুল গল্পের লিংক ( all part ) click