#মেহরুমা নূর
★ড্রয়িং রুমে মোটামুটি একটা বিশাল ভীড় জমাট বেঁধে গেছে। আদ্রিতা গলা ছেড়ে ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে এই ভীড়ের আয়োজন করেছে। প্রায় দশমিনিট যাবৎ সে সোফায় পা ভাজ করে অনবরত কেঁদে কেঁদে বন্যা বানিয়ে দিচ্ছে।চোখের পানি নাকের পানি মিলেমিশে একাকার। এরইমধ্যে একবক্স টিস্যু শেষ।সামনেই চোখ নাক মোছা টিস্যুর পাহাড় জমেছে। সবাই তাকে ঘিরে উদ্বিগ্ন। আবির আদ্রিতার মাথায় হাত বুলিশে হায় হুতাশ করতে করতে বলছে,
“অরি মা,কি হয়েছে আমার মা-টার? চাচ্চুকে বলো। কে কি বলেছে? একবার শুধু বলো, দেখো আমি তার কি হাল করি! মেরে মেরে।একেবারে মদনা পাগল না বানিয়ে দিয়েছি তো,আমার নামও আবির শাহরিয়ার না।”
আবিরের কথায় অরি টিস্যু দিয়ে নাক মুছতে মুছতে তার দিকে করুন চোখে তাকালো। কান্নার সুর বন্ধ হলো খানিক। আবির অধীর আগ্রহে তাকিয়ে রইলো আদ্রিতার পানে, সে কি বলতে চায় সেটা জানতে। কিন্তু সেকেন্ড দুই বিরতির পর আদ্রিতা আবারও সুর তুলে ভ্যাঁএএ…করে কেঁদে উঠলো। সবাই আবারও উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চাইলো কি হয়েছে। আরমান আর আহনাফ দুইজন নাতনীর পেছনে দাঁড়িয়ে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। তাসান, দুই হাতে ভীড় ঠেলে সামনে এসে দাপুটে ভঙ্গিতে বলল,
“দেখি,দেখি সরো সবাই। দেখি কি হয়েছে? অরি বইন, আমারে ক কি হইছে? কেউ তোরে ছ্যাঁকা দিছে? খালি নাম ক একবার। দেখ তোর এই ভাই কি করে! কার এত্তো বড় বুকের পাটা! আমার বোনরে ছ্যাঁকা দেওয়া! ওরে আমি চুলোয় রাখা গরম তাওয়ার উপর সারাদিন বসিয়ে রেখে বোঝাব আসল ছ্যাঁকা কারে কয়। সারাজীবন আর নিজের নিতম্ব নিয়ে কোথাও বসতে পারবেনা। সেটাই হবে আসল প্রতিশোধ। ছ্যাঁকার বদলে প্রো ম্যাক্স ছ্যাঁকা।”
সবাই হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো তাসানের দিকে। আবির মাঝে মধ্যে ভাবে, সে তাসানের মাঝে কেমন যেন নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে পায়। সানাও মাঝে মাঝে বলে,ছেলেটা একদম তোর উপর গেছে ভাইয়া। আবির তখন মজা করে বলে,ভাগ্নে তো মামার উপরেই যাবে। তাসানের বয়ান শুনে ওখানে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট্ট তিন্নি প্রশ্নবোধক চাহনি দিয়ে বলল,
“তাসান মামা, নিতম(নিতম্ব) কি? এটা দিয়ে কি করে? অলি পিপি(অরি ফুপি) কি নিতমের জন্য কান্না করছে? তাহলে তাকে নিতম কিনে এনে দাওনা।”
তিন্নির কথায় বেচারা তাসান ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। মেকি হাসি দিয়ে বলল,
“নিতম্ব? ওই একটা রাক্ষসের নাম।”
“ওওও…তাহলে কাতুনের(কার্টুনের) লাক্ষসকে এখন থেকে নিতম ডাকবো আমি।”
“হ্যাঁ ডেকো,আর ওর বউরে নিতমি বলে ডেকো। ভালো মানাবে।”
“আচ্ছা।”
এদের এসব আজগুবি আলোচনা শুনে আদ্রিতার কান্নার জোর আরও বেড়ে গেল। সানভি ফোনে আদ্রিতার কান্না রেকর্ড করে বাঁকা হেঁসে বলল,
“বাহ! কি ভিডিও হয়েছে! এখুনি আপলোড করছি। দেখিস ছাড়তেই ভাইরাল হয়ে যাবে। ফেমাস বনে যাবি তুই আদ্রিতা।রাতোরাত সেলিব্রিটি হয়ে যাবে। “
আদ্রিতা আরও কান্নার জোর বাড়িয়ে সানার উদ্দেশ্যে বলল,
“ফু্পিইইইই……”
সানা তার ছেলে-মেয়ে দুটোকে ধমকের সুরে বলল,
“এই থামবি তোরা! দেখছিস মেয়েটা কেঁদে যাচ্ছে। তারওপর আরও জ্বালাচ্ছিস তোরা।”
তানি এবার আদ্রিতার পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে মায়াময় সুরে বলল,
“কি হয়েছে অরি? আমাকে বলবি না,তোর সোনা মা-কে?”
আদ্রিতা তানিকে জড়িয়ে ধরে ফোপাঁতে ফোঁপাতে বলল,
“আমাদের আম গাছটা কে কাটলো, সোনা মা? আমার কতো পছন্দের গাছটা। ওই গাছে আমি ছোট্ট ঘর বানাতে চেয়েছিলাম। আমার ঘরের কি হবে?”
সবাই একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। যাক তেমন কোনো গুরুতর কিছু হয়নি। তাসান বিরক্তির মুখ করে উঠে যেতে যেতে বলল,
“ধুর, ভাবলাম সেই লেভেলের একটা কাহিনি শুনতে পাবো। কিন্তু এহেনেতো কিছুই না। হুদাই এতো পার্ট নিয়া গঙ্গা, যমুনা বাহায় দিলি।”
একে একে সবাই যার যার মতো প্রস্থান করলো। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল তানি। কোনোরকমে আদ্রিতাকে শান্ত করে রান্নাঘরে গেল সকালের খাবারের আয়োজন করতে। তানি যেতেই তানহা আদ্রিতার কাছে এসে ফিসফিসানো আওয়াজে চোরের মতো করে বলল,
“গাছ নাকি ভাইয়া কাটিয়েছে, অরি। শুনলাম ফোন করে লোক এনে রাতের মাঝেই কাটিয়ে ফেলেছে। বড়রা জিজ্ঞেস করলে বলল,” গাছ নাকি এই বাড়ির ক্ষতি করছে।তাই কাটানো অবশ্যক।” ব্যাস,আর কেউ কিছু বলেনি। কারো সাহস আছে ভাইয়ার কাজের প্রতিরোধ করার!”
রাগে নাক ফুলে উঠলো আদ্রিতার। গাছের সাথে আবার কি শত্রুতা হলো ওই দৈত্য দানবের? মানুষ এতো বদ কীভাবে হয়? ওদের কথার মাঝেই সিড়ি বেয়ে নেমে আসতে দেখা গেল নিবিড়কে। শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে খুব মুড নিয়ে নেমে আসছেন তিনি। তাকে দেখেই আদ্রিতার রাগ অভিমান আবার উপচে পড়লো। কিন্তু আদ্রিতার সেই অপরাধীর মাঝে কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না। সে আরামসে হেঁটে এসে খাবার টেবিলের সামনে চেয়ার টেনে বসলো। প্লেটে নিজের নাস্তা নিয়ে খেতে শুরু করলো সে। নাস্তা বলতে আদ্রিতার ভাষায় যাকে বলে ঘাসপাতা। মানুষ হয়েও ছাগলের মতো ঘাসপাতা খায়। সেইজন্যই তো কাজকামও ছাগলের মতোই করে। আমার আম গাছটাকে কেটে ফেলাটাই তার প্রমাণ। বদ লোক, একবার এসে আমার কথা জিজ্ঞেসও করলোনা। দেখলও না আমি কাঁদছি।অভিমানে আবারও কান্না পেল আদ্রিতার। কিন্তু এই লোকের সামনে সে কাঁদবে না। আমি বদদোয়া দিচ্ছি। এই খাবার তোর হজম হবে না। পেটের ভিতর গিয়ে বিস্ফোরণ শুরু করবে। বাথরুমে যেতে যেতে যেন বাথরুম বাসি হয়ে যায়।
তানি আদ্রিতাকে ডেকে বলল,
“অরি মা,এসো খেয়ে নাও।”
আদ্রিতা অভিমানে ফুলতে ফুলতে বলল,
“খাবোনা আমি।”
“এমন বলতে নেই মা। আসো আমি খাইয়ে দিচ্ছি তোমাকে।”
“না, খাবোনা আমি। তুমি তোমার ছেলেকেই বেশি করে খাওয়াও। রাতভর এতো মেহনত করে নিশ্চয় অনেক ক্ষুধা পেয়ে গেছে। তাকে সব খাওয়াও।”
বলেই ধুমধাম পা ফেলে উপরে চলে গেল আদ্রিতা। নিবিড় কাটা চামচের মাথায় স্যালাড গেঁথে মুখে নিয়ে খেতে খেতে একবার আরচোখে তাকিয়ে দেখলো তার মা রাগী মুখ করে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। নিবিড় খাওয়ার মাঝে সামান্য বিরতি নিয়ে বলল,
“হোয়াট?”
তানি কিছু না বলে হাতের বোলটা রাগী মুডে দুম করে টেবিলের উপর রেখে চলে গেল ওখান থেকে। মায়ের রাগ দেখে স্মিথ হাসলো নিবিড়।
রুমে এসে আরও কিছুক্ষণ কান্নার কার্যক্রম অব্যাহত করলো আদ্রিতা। তানিসহ অনেকেই ডাকতে আসলেও দরজা খুলল না। একসময় ঘুমিয়ে গেল। ঘুম যখন ভাঙলো তখন বেলা এগারোটা। মনমরা হয়ে উঠে বসলো আদ্রিতা। কান্নাকাটির ফলে মাথা ব্যাথা করছে এখন। বিষন্নচিত্তে নিচে নামতে নিলেই হঠাৎ খাটের পাশে ক্যাবিনেটের উপর একটা র্র্যাপারে মোড়ানো গিফট বক্স দেখতে পেল সে। ভ্রু কুঁচকে গিফট বক্সটা হাতে নিলো। র্র্যাপার খুলে বক্সের ঢাকনা খুলতেই চোখ জোরা চকচক করে উঠলো আদ্রিতার। একটা ম্যাংগো শেইপের সুন্দর একটা ম্যাংগো ফ্লেভারের পেস্ট্রি দেখতে পেল সে। ম্যাংগো পেস্ট্রি তার ভীষণ পছন্দের। কিন্তু এটা দিলো কে? ভাবলো নিশ্চয় চাচ্চু এনেছে। কিন্তু আদ্রিতার ধারণা ভুল প্রমাণ হলো যখন পেস্ট্রি বক্সের একপাশে একটা চিরকুট দেখতে পেল। কৌতূহলী হয়ে চিরকুট খুলে দেখলো সেখানে গুটিগুটি অক্ষরে লেখা আছে।
“পুতুল সোনা রাগ করে না
রাগলে তোমায় ভাল্লাগে না।
চাঁদ উঠে না, ফুল ফোটে না
তুমি রাগলে প্রকৃতি হাসে না
হাসলে তুমি, হাসে ময়না
তোমার হাসি যে চাঁদের কণা।”
চমকিত, ধমকিত হলো আদ্রিতা হৃদয় মন। দৃষ্টি নির্নিমেষ চিরকুটের পানে। তার ভালো মনে আছে, ছোট্ট বেলায় যখন আদ্রিতা রাগ করতো তখন নিবিড় ভাইয়া ওকে এই কবিতাটাই বলে শোনাতো। সাথে সাথেই রাগ ভুলে খিলখিল করে হেঁসে দিতো আদ্রিতা। আজও তার ব্যাতিক্রম হলোনা। ঠোঁটের কোণে মোহনীয় হাসি ফুটে উঠলো। তারমানে এই পেস্ট্রি নিবিড় ভাইয়া এনেছে! ভাবতেই হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল আদ্রিতার। মন খারাপ মুহুর্তেই ছু মন্তর হয়ে গেল। খুশিতে ভরে উঠল মন।যেন তার অবচেতন মন এমন কিছুরই অপেক্ষায় ছিলো। চিরকুট ধরে দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে আনমনে হাসলো আদ্রিতা। আদ্রিতা দেখলো বক্সে আরেকটা চিরকুট আছে। সে দিগুণ উচ্ছ্বসিত হয়ে প্রফুল্লচিত্তে সেটাও খুলে দেখলো তাতে লেখা আছে,
“বেশি দাঁত কেলানোর দরকার নেই। গাছের জায়গায় যে তোর গর্দান কাটি নাই সেটাই তো ভাগ্য। তাই গাছের শোক ছেড়ে নিজের গর্দান বেঁচে আছে সেটার খুশি মানা।চুপচাপ এটা খেয়ে নে। নাহলে এবার আর তোর গর্দন বাঁচবে না।”
আদ্রিতার প্রফুল্লিত মুখখানা চুপসে গেল। কত্তো খারাপ লোক! রাগ করতে নিয়েও কেন যেন রাগ হলোনা আদ্রিতার। তার নজর আপাতত পেস্ট্রিতেই আবদ্ধ।এসবের মাঝে বেচারি পেস্ট্রির কি দোষ। সে-তে আমার পেটে যাওয়ার জন্য কতো আশায় মুখ চেয়ে আছে। তাকে নিরাশ করা ঠিক হবে না। তাই কিছু সময়ের জন্য রাগটাকে বালিশের নিচে চাপা দিয়ে রাখি। পেস্ট্রি খাওয়া হলে নাহয় আবার রাগ বের করে নিবো। হিসাব নিকাশ শেষ করে পেস্ট্রিতে হামলে পড়লো আদ্রিতা। পেস্ট্রি মুখে দিয়ে স্বাদের তৃপ্তিতে আবেশে চোখ বুজে নিলো আদ্রিতা। মুখ দিয়ে আনমনে তৃপ্তিদায়ক আওয়াজ বের হলো,
“উমমম……ইয়াম্মী।
আদ্রিতার মুখের এই তৃপ্তিদায়ক আনন্দ দেখে দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যাক্তির ঠোঁটের কোণেও তৃপ্তিময় হাসির ফুটে উঠলো। ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ঝুলিয়ে সরে গেল সে।
___
নতুন একটা পেইন্টিং-এ মনোযোগ সহকারে রং তুলির ছোঁয়া লাগাচ্ছে নূরান। একটা পাখির শত চেষ্টার ফলে আকাশে উড়তে পারার গল্প তার এই পেইন্টিং-এর থিম৷ নূরান বাস্তবচিত্র খুব কমই আঁকে। মাঝে মধ্যে চোখে তেমন বিশেষ কিছু পড়লে তবেই আঁকে। তবে বেশির ভাগ সময় সে নিজের মনের কল্পনাকে রং তুলির সাহায্যে কাগজে তুলে ধরে। এটা সে কাল রাতে শুরু করেছিল কিন্তু শেষ করতে পারেনি। আসলে তখন কেমন মন বসেনি। আর মন না বসলে নূরানের দ্বারা সে কাজ কখনোই হয়না। বানোয়াট কোনো কিছু সে করতে পারে না। মাথার লম্বা চুলগুলো রাবার ব্যান্ড দিয়ে বেঁধে রেখেছে। তবুও কিছু চুল বের হয়ে কানের পিঠে পড়ে আছে। শরীরের জামাকাপড়ে জায়গায় জায়গায় রঙের ছিটা লেগে আছে।
তার কাজের মাঝেই হঠাৎ ফোনে নোটিফিকেশনের টোন বেজে উঠল। ম্যাসেঞ্জারে ম্যাসেজ আসলে যেমন টোন বাজে তেমন টোন বেজে উঠল। নূরান একবার বিছানার পাশে ক্যাবিনেটের উপর থাকা ফোনের দিকে তাকালো। তারপর আবারও নিজের কাজে লেগে পড়লো। এসব ব্যাপারে সে খুব একটা আগ্রহী না। কিন্তু পরপর আরও কয়েকবার একই টোন বেজে উঠল। এবার একটু বিরক্ত হলো নূরান। পেইন্টিং-এর সময় এমন ডিস্টার্বেন্স আসলে কাজে ব্যাঘাত ঘটে। তাই নূরান ব্রাশ রেখে রুমালে হাত মুছে সে ফোনটা হাতে নিলো। ফোনের স্ক্রিনে “নীলাম্বরী” নামের একটা আইডি থেকে ম্যাসেজ এসেছে সেটার নোটিফিকেশন দেখা যাচ্ছে। অদ্ভুত! এটা আবার কে? নূরানের জানামতে এই নামের কাউকে সে চেনেনা। নূরানতো সোশ্যাল মিডিয়ায় তেমন থাকেই না। প্রয়োজনীয় কাজ সে নিজের কম্পিউটারেই করে। অদরকারী কাজ ছাড়া কখনো সে ফোনও হাতে নেয় না। কিছুদিন আগে আদ্রিতা জোর করে ওর একটা ফেসবুক আইডি খুলে দেয়। কিন্তু সেটা সেই খোলা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। আজ পর্যন্ত তাতে উঁকি দিয়েও দেখেনি সেটা কালা না ধলা দেখতে। নূরানের এসব ভালো লাগে না। যেখানে তার বাস্তবেই কোনো ফ্রেন্ড নেই সেখানে সোশ্যাল মিডিয়ায় বানোয়াট ফ্রেন্ড দিয়ে সে কি করব? তাইতো সে কখনো এসবে সময় দেয়নি। আদ্রিতা খুলে দিয়েছিল সেটা তেমনই আছে। কিন্তু এই অচল আইডিতে আবার কে ম্যাসেজ দিলো? তবে আইডির নামটা বেশ ইন্টারেস্টিং লাগলো নূরানের কাছে। হালকা কৌতূহল নিয়ে সে ম্যাসেজ ওপেন করলো। প্রথম ম্যাসেজ টা দেখেই নূরান কেমন থতমত খেয়ে গেল। সেখানে লেখা আছে,
“আপনি কখনো খোলা আকাশের নিচে ঝুম বৃষ্টির মাঝে দাঁড়িয়ে হা করে বৃষ্টির পানি খেয়েছেন?”
নূরানের কেমন আগ্রহ জমলো। সে বাকি ম্যাসেজ গুলোও পড়লো। সেখানে লেখা আছে,
(২)
“আপনি কখনো আকাশে উড়তে থাকা পাখির সাথে পাল্লা দিয়ে দৌড়েছেন?”
(৩)
“কখনো পৌষের শীতে সোয়েটার জড়িয়ে কুয়াশার মাঝে দাঁড়িয়ে থেকে আইসক্রিম খেয়েছেন?”
(৪)
“কখনো সন্ধ্যার ডুবতে থাকা সূর্যের পানে চেয়ে থাকার প্রতিযোগিতা করেছেন?”
(৫)
“কখনো মাঝরাতের উদাসীনতা দেখেছেন?”
(৬)
“কখনো পবনের সুমধুর সুর অনুভব করেছেন?”
ম্যাসেজ গুলো পড়তে পড়তে কখন বিছানায় বসে পড়েছে নূরান তা খেয়ালই করেনি। হঠাৎ খেয়াল হতেই অবাক হলো সে। অজানা আগ্রহ যেন বেড়েই চলল। জানতে ইচ্ছে হলো কে এই ব্যাক্তি। আর জানার আগ্রহ থেকেই প্রথম ম্যাসেঞ্জারে টেক্সট পাঠাল নূরান।
“কে আপনি?”
ম্যাসেজ পাঠিয়েই কেমন উসখুস হতে লাগলো নূরানের মাঝে। পরক্ষণেই রিপ্লাই এলো,
“আমি ভুউউউ…….ত। শেওড়া গাছের পেত্নী।সাথে একটা কঙ্কালের মাথার ইমোজি। “
আনমনেই হালকা করে হেঁসে উঠলো নূরান। মেয়েটা নির্ঘাত পাগল। নিজের ভাবনায় নিজেই অবাক হলো নূরান৷ এই ব্যাক্তিকে যে মেয়েই হবে তা কীভাবে ধরে নিলাম! ছেলেও তো হতে পারে।নূরানের কেন যেন মনে হলো এটা একটা মেয়েই। যাচাই করতে নূরান দ্বিতীয় টেক্সট করলো,
“মনে হচ্ছে ব্যাকরণে শূন্য পান।একবার ভূত, একবার পেত্নী। লিঙ্গ নিয়ে কনফিউশানে আছেন। কারণ ফিমেল হলে ভূত না, ভূতনী হবে।”
সঙ্গে সঙ্গে রিপ্লাই এলো,
“নাইস ট্রাই। লিঙ্গ জানার ভালো প্রচেষ্টা ছিলো।”
আবারও স্মিথ হাসলো নূরান। রিপ্লাই করলো,
“তো চেষ্টায় কি সফল হলাম? জানতে পারি কি এই ভূত বা ভূতনীর পরিচয়?”
সময় নিয়ে রিপ্লাই এলো,
“আমার পরিচয়? উমম…
আমি জলহীন নদীর কূলহীন ঢেউ
মানো আর নাইবা মানো
আমি গোধূলি আলাপের সেই অপরাহ্নের
মন ভাঙা কেউ
আমি জানতাম প্রকৃতির প্রয়োজনেই
হয়তো আমি কলি থেকে হলাম ফুল
নিজেকে কবুই করিনি খেয়াল
মেনেছি কুয়াশা রেখে আলোতে হাঁটা বুঝি ভুল।
লাইনগুলো পড়ে যেন মুগ্ধতায় ছেয়ে গেল নূরান। কেমন একটা ঘোরের ভেতর চলে গেল সে। পড়তে পড়তে কখন বিছানায় শুয়ে পড়লো টেরই পায়নি। অদ্ভুত এক অনুভূতি হতে লাগলো। যা এই জীবনকালে প্রথম হলো নূরানের। কিছুক্ষণ নূরান আবার রিপ্লাই দিলো,
“পরিচয় চেয়েছিলাম। আপনিতো আরও ধূম্রজাল বুনলেন। তবে কি বুঝে নিবো আজ এই আমাকেই বিনোদনের মাধ্যম করলেন?”
রিপ্লাই এলো,
“আজকের জন্য এই পর্যন্তই থাক
দৈবে চাহিলে আবারও হবে বাক।”
এর পরপরই আইডির সবুজ বাতি নিভে গেল। নূরানের মন কেমন অস্থির হয়ে উঠলো। আজ ওর সাথে এসব কেমন অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে। নিস্তব্ধ, শান্ত নূরানকে হঠাৎ এভাবে অশান্ত করে দিয়ে এখন চলে গেল? কিন্তু নূরান তো স্থির হতে পারছেনা।আজ পর্যন্ত বড়ো থেকে বড়ো বিষয়েও কখনো নূরান এতটা বিচলিত হয়নি।তবে আজ কি হলো? সামান্য কারোর ম্যাসেজে এমন লাগছে কেন ওর? এমনতো আমি না। আগ্রহ দমাতে না পেরে নিজ স্বভাবের বিপরীতে গিয়ে নূরান একটা কাজ করে বসলো। সে ওই আইডির প্রোফাইলে ক্লিক করলো। প্রোফাইল পিকচারে হাতের তালুর উপর প্রজাপতি ধরে রাখা একটা হাতের ছবি৷ ছবিটা যে একটা মেয়ের তা তার হাতের চুড়ি দেখে বোঝা গেল। তারমানে নূরানের মন ঠিক ছিলো। এটা একটা মেয়ের আইডি। কারণ হাতের ছবিটা যে বাস্তব তা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। প্রোফাইলে বায়ো দেওয়া আছে, “এইযে, আইডিতে যে ঢুকলেন। জুতা খুলে ঢুকেছেন? ময়লা জুতা পড়ে আমার আইডিতে ঢোকা নিষেধ।”
বায়োটা পড়ে আবারও হাসি পেল নূরানের। সে টাইমলাইন দেখতে উপর দিকে স্লাইড করলো। প্রথমেই মেয়েটির একটা ছবি দেখতে পেল। ছবি না, আসলে শুধু একটা চোখ দেখা যাচ্ছে। জর্জেটের ওড়না জাতীয় কিছু দিয়ে মুখ ঢাকা। শুধু একপাশের একটা চোখ বের করা। নূরান তাকিয়ে রইলো কতক্ষণ সেই পানে। ছবিটার ক্যাপশনে লেখা আছে,
“চোখ নাকি মনের কথা বলে। তবে আমার চোখের ভাষা বোধহয় চাইনিজ বা আফ্রিকান হবে। তাইতো এই চোখের ভাষা কেউ বুঝলোনা এখনো।”
আবারও নীরব হাসলো নূরান। মেয়েটা সত্যিই পাগল। আজ নিজের কাজে নিজেই চরম অবাক হচ্ছে নূরান। আজ পর্যন্ত নিজের ফ্যামিলি ছাড়া বাইরের কোনো মেয়ের সাথে কথা বলাতো দূর। কোনো মেয়ের ছায়াও মারিয়েছে কিনা তা সন্দেহ নূরানের।তার জীবনতো কেবল এই ঘর আর ওর পরিবার এর মাঝেই সীমাবদ্ধ। এর বেশি না তার প্রয়োজন ছিলো না ইচ্ছে। আর আজ সে র্র্যানডম ছেলেদের মতো কিনা কোনো মেয়ের প্রোফাইল চেক করছে। ভাবতেই হাসি পাচ্ছে।
নিচে আর তেমন কিছু পেলনা। আইডি টা নতুন খোলা। তাই তেমন পোস্ট নেই। নূরান ওই একটা ছবিই বারবার দেখতে লাগলো। মনে মনে আওয়ালো,
“শান্ত সাগরে তুলেছ অশান্ত ঢেউ
তুমি পদ্ম নাকি জবা সেই খেয়ালে ডুবেছে কেউ।”
চলবে……