®মেহরুমা নূর
★কালকের গলা ফাটিয়ে কান্নাকাটি করা আদ্রিতা এখন বিপরীত মুখে। তাকে দেখে কেউই বলবেনা এটাই সেই সকালের মরাকান্না করা মেয়েটা। যদিও এই স্বভাব আদ্রিতার নতুন না। কথায় কথায় যেমন কাঁদতে সময় লাগেনা তেমন ফট করে হাসতেও সময় লাগেনা। তবে আজ কারোর কসরত করে মানানো ছাড়াই মেয়েটা হাসিখুশি মনে সারাবাড়ি ধেইধেই করে বেড়াচ্ছে এটা দেখে তানি একটু অবাকই হলো। সাধারণত কাউকে না কাউকে তার রাগ ভাঙাতে মেহনত করতে হয়। কিন্তু আজ একা একাই মন এতো প্রফুল্ল হলো! পরক্ষনেই তানি যা বোঝার বুঝে গেল। ফোৎ করে নিঃশ্বাস ছেড়ে নিজের কাজে মনোযোগ দিলো সে। কাজ করতে করতেই দেখতে পেল প্রফুল্ল, চঞ্চল আদ্রিতাকে। সোফায় তিন্নির সাথে দুষ্টুমি করছে। এতো বড়ো মেয়ে হয়ে কিনা ছোট্ট তিন্নির খেলনাটা নেওয়ার জন্য টানাটানি করছে। নিবিড় তিন্নির জন্য একটা বিদেশি ডল এনেছে। সেটাই নেওয়ার জন্য টানাটানি করছে আদ্রিতা। তার খুব পছন্দ হয়েছে ডলটা। আদ্রিতা তিন্নির পুতুল টা নেওয়ার চেষ্টা করে বলল,
“এই তিন্নি দেনা আমাকে একটু। শুধু কিছুক্ষণের জন্য। দেখ,তোকে আমি অনেক গুলো চকলেট দেবো।”
আদ্রিতার ঘুষ নিতে সাফ সাফ মানা করে দিয়ে তিন্নি বলল,
“না,চক্তেত লাগবে না। টম চাচ্চু আমাকে এত্তো গুলো চক্তেত দিয়েছে। তুমি আমার ডল ছালো। ওকে ধলবানা। ছালো,ছালো বলছি।”
“আরে এমন করছিস কেন,দেনা একটু। নাহলে কিন্তু আমি কান্না করবো। তোর ভালো লাগবে আমি কাঁদলে?”
“হ্যাঁ লাগবেতো। তুমি কাঁদলে একদম কাতুনের মতো লাগে। আমাল অনেক মজা লাগে দেখতে। কাঁদো, কাঁদো আবার।”
মুখ চোখা করে বিরক্তভরা চাহুনি দিলো আদ্রিতা। ওদের কান্ড দেখে রান্নাঘরে তিন্নির মা হাসতে লাগলো। তানিও হাসলো। তার মাঝে মাঝে মনে হয় তিন্নিটাও বুঝি আদ্রিতার চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান। তবে আদ্রিতার এই চঞ্চলতাই এই বাড়িটাকে প্রাণবন্ত করে। ওর হাসির সাথেই সারাবাড়ি হাসে।
ট্রে-তে কফির মগ রেখে ছেলের রুমের দিকে এগুলো তানি৷ নিবিড়ের রুমে প্রবেশ করে দেখলো নিবিড় ওর কাপড়চোপড় গুলো আলমারিতে গুছিয়ে রাখছে। তানি কফির ট্রে টেবিলের উপর রেখে এগিয়ে গিয়ে বলল,
“তোর এসব করতে হবে না। রাখ আমি করে দিচ্ছি।”
নিবিড় নিজের কাজ অব্যাহত রেখে শান্ত সুরে বলল,
“ইটস ওকে মা। নিজের কাজ নিজেই করতে ভালোবাসি আমি। এমনিতেও এতো বছরেতো সব নিজেকেই করতে হয়েছে। অভ্যাস হয়ে গেছে আমার।”
তানির বুকটা হু হু করে উঠলো। ছেলের কথায় যেন একরাশ অভিযোগ প্রকাশ পেল। সে-কি ছেলের সাথে বেশিই কঠোরতা করেছে? কিন্তু তার হাতেই বা এছাড়া কোনো পথ আছে? তানি স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কতক্ষণ ছেলের পানে।তার সেই কিশোর ছেলেটা আজ পরিপূর্ণ বলিষ্ঠ যুবক।তবে মায়ের কাছে সন্তান সেই ছোট্টই রয়ে যায়। ছেলেটার চেহারা বা-মা কারোর মতোই হয়নি।এমনকি স্বভাব চরিত্রের দিক দিয়েও নিবিড় তানি বা আবিরের কিছু পায়নি। আবির বলে ছেলে নাকি তার দাদার মতো হয়েছে দেখতে। নিবিড়ের দাদাও বলে, তার নাতি নাকি একেবারে উনার বাবার মতোন হয়েছেন। আবির বলে,তার দাদা শমশের শাহরিয়ার নাকি খুবই তেজী পুরুষ ছিলেন। সাত গ্রামের লোক নাকি তার ভয়ে থরথর কাঁপত। নিবিড়ও নাকি তার মতোই রাগী স্বভাবের। আবিরের কথায় তানিরও তখন বিশ্বাস হয়। কারণ তার ছেলেও প্রচন্ড রাগী। যাকে বলে ভয়ংকর বদরাগী। ওর রাগের সামনেতো মনে হয় আদিত্য ভাইয়ার রাগও তুচ্ছ। তবে বিদেশ যাওয়ার পর থেকে ছেলে যেন কেমন গুরু গম্ভীর হয়ে গেছে। তানি আনমনেই ফট করে বলে উঠলো,
“তুই কি এখনো আমার উপর রাগ করে আছিস?”
মায়ের প্রশ্নে তার কর্মরত হাতটা খানিক স্থগিত হয়ে গেল। সেকেন্ড পার হতেই আবারও সক্রিয় হয়ে কাজ করতে করতে বলল,
“নাতো। রাগ কেন করবো? তুমি আমাকে পৃথিবীর আলো দেখিয়ছ। তুমি আমাকে মেরে ফেললেও রাগ করার স্পর্ধা নেই আমার। ছেলে হয়ে মায়ের উপর রাগ করে থাকবো এমন অযোগ্য সন্তান নিশ্চয় জন্ম দাওনি। অন্তত এতটুকু ভরসাতো রাখতেই পারো।”
বুক চিঁড়ে কান্না এলো তানির। তবে ছেলের সামনে দূর্বল হওয়া যাবে না। তানি সন্তর্পণে নিজের চোখের পানি মুছে নিয়ে হালকা গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“রাগ থাকলেও কিছু করার নেই। আশা করি যে কারণে গিয়েছিলে তা ভুলে যাওনি। আম্মার অসুস্থার জন্য আসতে হয়েছে, ঠিক আছে। কিন্তু আমাদের মাঝে যে কথা হয়েছিল তা নিশ্চয় মন রাখবে। কফিটা খেয়ে নিও।”
বলেই বেড়িয়ে গেল তানি। নিবিড় কিছুক্ষণ সেই পানে তাকিয়ে থেকে আবার নিজের কাজে মনোযোগ দিলো।
আবির রুমে এসে দেখলো তানি চোখের পানি মুছছে। তার বুঝতে বাকি রইলোনা কি হয়েছে। আবির এগিয়ে তানিকে এক হাতে জড়িয়ে নিলো বুকের মাঝে। মাথায় চুমু খেয়ে বলল,
“এসবের কি দরকার তানি? শুধু শুধু নিজেও কষ্ট পাচ্ছ আর ছেলেটাকেও কষ্ট দিচ্ছ। তোমার মনে হয়না ছেলেটার সাথে একটু বেশিই কঠোর হচ্ছ? ছেলেটা আমার কেমন গম্ভীর হয়ে গেছে।”
তানি কান্না জড়িত কন্ঠে বলল,
“তুমি ভালো করেই জানো আমি কেন করেছি। মা হয়ে আমার জন্য সবচেয়ে বেশি কঠিন ছিলো নিজের কলিজার টুকরাকে দূরে পাঠানো। কিন্তু এছাড়া আর কি করার ছিলো আমার? নিবিড় যত বড়ো হচ্ছিল ততই যেন ভয়ংকর হয়ে উঠছিলো। অরির জন্য ওর পাগলামো দিনদিন সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছিল। তুমি ভুলে গেছ সেসব? অরি একবার রান্নাঘরে ওর মায়ের সাথে রান্না রান্না খেলতে গিয়ে হাত কেটে যাওয়ায় নিবিড় পুরো রান্নাঘরে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল। অল্পের জন্যে বাড়িতে আগুন লাগেনি। সেসব দেখে অরি কতোটা ভয় পেয়ে গিয়েছিল! ভয়ে এককোনায় থরথর করে কাঁপছিলো। একবার অরিকে স্কুলে এক ছেলে খেলতে খেলতে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিল বলে,নিবিড় সেই ছেলের হাতই ভেঙে দিয়েছিল। তারজন্য কতো ঝামেলায় পড়তে হয়েছিল। ছেলেটার বাবা আমাদের নামে কেস করে দিতে চেয়েছিল। আদিত্য ভাইয়া বিষয়টা না সামলালে তখনই ওকে জেলে যেতে হতো। শুধু কি স্টুডেন্ট! সেতো অরির স্কুলের টিচারকেও ছাড় দেয়নি। টিচার অরিকে শাস্তি হিসেবে হাতে একটা বেতের বাড়ি দিয়েছিল বলে,পাগল নিবিড় সেই টিচারের হাতে ছু,রি দিয়ে কেটে র,ক্ত বের করে দিয়েছিল। ওর জন্য অরিকে নাজানি কতবার করে স্কুল চেঞ্জ করতে হয়েছে। আর শেষবার! সেবার সে যা করেছিলো তা ভাবতেই আমার রুহ কেঁপে ওঠে। একটা মানুষকে প্রায় জানে মেরেছিল ও, আবির। প্রায় খু,নি হতে হতে বেঁচেছে তোমার ছেলে।
আবির বলল,
“হ্যাঁ জানি।কিন্তু তুমিও জানো সেটার পেছনে যথেষ্ট কারণ ছিলো। ওইসময় ওর জায়গায় ভাইয়া বা আমি যে কেউ থাকলেও অমনটাই করতাম। আমাদের ছোট্ট অরিকে ওই ন,র,পি,শা,চ টা অশুভ নজরে দেখেছিল। তার ক্ষতি করতে চেয়েছিল। সেখানে নিবিড়ের অমন রিয়্যাক্ট করাটা খুব একটা অস্বাভাবিক ছিলো না।”
“তাই বলে খু,ন করে ফেলবে! রড দিয়ে তার মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিল তোমার ছেলে। ঠিক সময়ে না ঠেকালে এখন তোমার ছেলে খু,নের দায়ে জেল খাটতো। আর ওর এসব ভয়ংকর রুপ দেখে সবচেয়ে বেশি ভয় হতো আমার অরির জন্য। সেদিনও মেয়েটাকে অন্ধকার ঘরে বন্ধ রেখেছিল ওর কথা না মেনে বান্ধবীদের সাথে বেড়াতে যাওয়ার জন্য। যেখানে ওই ন,র,পি,শা,চ অরির উপর কুনজর দিয়েছিল। মেয়েটা এতো ভয় পেয়েছিল জ্ঞান হারিয়ে ফেলে সে। ভয়ংকর জ্বর আসে অরির। পুরো সাতদিন তার জ্বর। ভয়ে তার মস্তিষ্ক এতটাই আঘাত পায় যে, অরি সেদিনের সব ঘটনা ভুলে যায়। সেদিনই আমি সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছিলাম। ওকে অরির কাছ থেকে দূরে পাঠানোর। কারণ ওর এসব পাগলামোর প্রভাব সবচেয়ে মেয়েটার জন্য ক্ষতিকর হতো। আর আমি এক সন্তানের জন্য আরেক সন্তানের ক্ষতি হতে দিতে পারিনা। তুমি ভালো করেই জানো,অরি আমার কাছে আমার নিজের সন্তানের চেয়েও বেশি। নূর ওকে জন্ম দিলেও ওকে আমিই মানুষ করেছি। নূরান একটু দূর্বল হওয়ায় নূর ওর বেশি খেয়াল রাখতো। আর অরিকে আমি আমার কাছে রাখতাম। ওকে আমিই বড় করেছি৷ আমার এটা বলতে একটুও দ্বিধা নেই যে,আমার দুই সন্তানের চেয়েও অরি আমার বেশি আদরের।”
“আর নিবিড়? সেও কি অরির জন্য কিছু করেনি? তুমি ভুল গেছ সেসব কথা! অরির খেয়াল শুধু তুমি একা রাখোনি। ছোট্ট নিবিড়ও সব করতো। রাতে তোমার আর ছোট্ট অরির পাশে সে শুয়ে থাকতো। রাতে তুমি ঘুমিয়ে পড়লে নিবিড় ওর খেয়াল রাখতো। কখনও কেঁদে উঠলে কোলে নিয়ে সারারাত হাটতো। অরির সামান্য কষ্ট হলেও সে অস্থির হয়ে যেত। অরির জ্বর আসলে, নিবিড় ইচ্ছে করে পানির মাঝে ভিজে থেকে নিজের শরীরে জ্বর লাগাতো। ভাবতো যাতে,অরির শরীরের জ্বর ওর শরীরে চলে আসে। আর অরি ঠিক হয়ে যায়। অরির যতোই জালাক তবুও কখনো বিরক্ত হতোনা। একবার অরির জেদ মানেনি বলে অরি রাগ হাতের কলম নিবিড়ের হাতে ঢুকিয়ে দেয়। গলগল করে র,ক্ত বের হয় নিবিড়ের। তাতেও নিবিড় রাগ করেনা। বরং উল্টো অরি যখন র,ক্ত দেখে ভয় পেয়ে যায়।তখন ওকে সামলানোর চেষ্টা করে। নূর ভাবি অরিকে এই নিয়ে মার দিয়েছিল বলে নিবিড় তার সাথে কথা বলাও বন্ধ করে দিয়েছিল।আরও কতো কি, সেসব কি ভুলে যাচ্ছো?”
“ভুলিনি আবির। সব মনে আছে। আর ওর এই অতিমাত্রায় পাগলামোই অরির জন্য দিনদিন ভয়ংকর হয়ে উঠছিল। ওর পাগলামো একসময় অরিরই ক্ষতি করে দিতো। তাইতো ওকে দূরে পাঠানো জরুরি ছিলো। হ্যাঁ, আমিই একসময় মজা করা নূরকে বিয়াইন বানাতে চেতাম। তবে নিবিড়ের ওই ভয়ংকর উন্মাদনা দেখে মনে হয় আদৌও কি সেটা ঠিক হবে?”
“আরে এতো দুশ্চিন্তা করছ কেন? নিবিড় এখন আর আগের মতো নেই। দেখোনা কেমন গম্ভীর আর শৃঙ্খল স্বভাবের হয়ে গেছে। সে এখন বিচক্ষণ বুদ্ধিসম্পন্ন সম্পূর্ণ পুরুষ হয়ে উঠেছে। তাই আর এসব ভেবে চাপ নিওনা। বুড়ি গালে আরও ভাজ পড়ে যাবে।”
শেষের কথাটা মজার ছলে বলল আবির। তানি বুঝতে পারলো আবির ওর মন ভালো করার জন্য বলছে। তবে ওর চিন্তা কি এতো সহজেই যাবে? আদৌও নিবিড় বদলেছে? কালকের করা কাজে তানির সন্দেহ আরও গাঢ় হয়। মা হয়েও যেন ছেলেকে বুঝতে পারছে না তানি।”
__
নূরান পেইন্টিং-এ কন্সেন্ট্রেশন করতে পারছেনা। বারবার মাইন্ড ডিসট্রাক্ট হয়ে যাচ্ছে। মুহূর্ত পরপর চোখ চলে যাচ্ছে ক্যাবিনেটের উপর পড়ে থাকা ফোনের দিকে। যেন কোনো কিছুর অপেক্ষা করছে সে। হয়তো সেই নোটিফিকেশনের যেটা কাল রাতে পেয়েছিল। ওই রহস্যময়ী মেয়েটা হঠাৎ উড়ে এসে নূরানের নিয়মে বাঁধা ভাবনা গুলোকে এলোমেলো করে দিয়ে গেছে। তারপর আবার গায়েব। আর কোনো বার্তা আসেনি। মনটা কেমন উসখুস করছে নূরানের। শেষমেশ আর থাকতে না পেরে নূরান ব্রাশ ছেড়ে, ফোন হাতে নিলো। ম্যাসেঞ্জারে ঢুকে দেখলো নীলাম্বরী আইডির পাশে সবুজ বাতি জ্বলছে। তারমানে মেয়েটা এখন অনলাইনে! নূরান কতক্ষণ অপেক্ষা করতে লাগলো মেয়েটার ম্যাসেজ আসে কিনা। কিন্তু মিনিট দশেক অপেক্ষার পরও এলোনা ম্যাসেজ। নূরান ভাবলো সে নিজেই নাহয় একটা ম্যাসেজ দিবে। পরক্ষণেই আবার সেই খেয়াল বাদ দিলো। এইভাবে কোনো মেয়ের সাথে সেধে কথা বলাটা তার কাছে কেমন ইতস্তত লাগে।ভাবনা আর দোটানার মাঝেই হঠাৎ কাঙ্খিত টোন বেজে উঠল। তড়িৎ গতিতে নূরান ম্যাসেজ ওপেন করলো। যাতে লেখা আছে,
“আমার অপেক্ষা করছিলেন বুঝি? এই সুন্দরী ভূতনীর দেওয়ানা হয়ে গেলেন নাতো? ওয়েল,এটাতো হওয়ারই ছিলো। এই ভূতনীর দেওয়ানাতো হাজার হাজার। কি করি,এতো সৌন্দর্য কই লুকিয়ে রাখি?”
নূরান মুখের উপর হাত মুঠ করে ধরে হালকা হাসলো। তারপর রিপ্লাই দিলো,
“অপেক্ষাতো করছিলাম। যতোই হোক স্মার্ট ভূতনী বলে কথা। নাহলে কোন ভূতনীর কাছে ফোন আছে বলুন! চ্যাট করা ভূতনীকে তো আর সচরাচর পাওয়া যায় না।”
“আপনি ভূতনী জাতিকে কী ভেবে রেখেছেন বলুন তো? উই আর ভেরী স্মার্ট ভূত বুঝেছেন? আপডেটেট ভারসন ২.০।”
নূরান কয়েকটা হাসির ইমুজি দিয়ে বলল,
“আপনি যে পাগল তা কি আপনার বাড়ির লোক জানে?”
“হুম জানেতো। মা-তো রোজই বলে, ‘তোর মতো পাগল পয়দা করে আমি নিজেই পাগল হয়ে গেলাম’।”
“এমন করে বলছেন যেন অনেক গর্বের বিষয়। “
“হ্যাঁ গর্বের বিষয় বৈ কি। আমি আমার সব কাজেই গর্ব করি। রাস্তা দিয়ে যাওয়া লোকজনকে ঢিল,থুতু মেরেও নিজের উপর গর্ব হয়। আবার পাশের বাসার পিচ্চিকে শুধু শুধু থাপ্পড় মেরেও আমার গর্ব হয়।”
“মনে হচ্ছে আপনি নিজেকে অনেক খুশি রাখেন।”
“হ্যাঁ অবশ্যই। মানুষ সর্বদা অন্যকে খুশি করার চেষ্টা করে । তবে আমি সবসময় নিজেকে খুশি রাখি। আমার মতে,নিজে খুশি থাকলেই সবার মাঝে খুশি ছাড়ানো যায়। মন খুশি তো জগৎ খুশি।
আমি হিমালয় পর্বত জয়ী চাইনা
চাইনা হতে উত্তাল তরঙ্গের জলরাশী।
ঘাস ফুলের কুড়ি থেকে চাই শ্যামলতা
চাই হতে রাখালিয়ার সুরে ভেজা বাঁশী “
মুগ্ধ হয়ে নূরানও কিছু লিখল,
“রংধনুর সাত রং ছাড়াও আরও হরেক রং আছে
গোলাপ ছাড়াও পুষ্প আছে ধরায় অগুনিত
থাকে যদি দৃষ্টির গভীরতা তবে কালো রঙেও সৌন্দর্য ভাসে
কস্তুরি ফুলেও পাওয়া যায় মুগ্ধতা অফুরন্ত ।”
___
মিমিকে কোলে নিয়ে বিকেল বেলা বাড়ির সামনের লনে হাঁটতে বেড়িয়েছে আদ্রিতা। সুইমিংপুল সাইডে হাঁটছে। মিমিকে আজ সুন্দর একটা কাপড়ের নেক বেল্ট লাগিয়ে দিয়েছে।ধবধবে সাদা ফুরফুরে মিমিকে কিংক কালারের ব্যান্ডটাতে ভালো মানিয়েছে। উদ্দেশ্য মিমির সাথে কিছু সেলফি নেওয়ার। আদ্রিতা মিমির উদ্দেশ্যে বলল,
“তোকেতো একদম ফুলটুসি লাগছেরে মিমি। আজতো তোর উপর রাস্তার উপর সব বখাটে বিড়ালগুলো ফিদা হয়ে পড়বে। আয় আমরা দুজন সেলফি নেই। দেখি কার ছবিতে বেশি লাইক কমন্ট আসে। সুন্দর হাসবি হ্যাঁ? আর ঠোঁট চোখা করে পাউট করবি। এইযে এমন করে।”
আদ্রিতা ঠোঁট জোড়া চোখা করে চুমুর মতো বানিয়ে মিমিকে শিখিয়ে দিলো পাউট কীভাবে করতে হয়। মিমি ঠিক ভাবে করলো কিনা জানা নেই। আদ্রিতা ফোনটা উঁচু করে ধরে মিমিকে ধরে ঠোঁট পাউট করে নানান ভঙ্গিতে সেলফি নিতে লেগে পড়লো। একসময় মিমি বোধহয় বিরক্ত হলো। সে নেমে গেল আদ্রিতার কোল থেকে। তবে আদ্রিতা তার সেলফি অভিযান অব্যাহত রাখলো। এক হাত কোমড়ে রেখে মুখ আর ঠোঁট উঁচু করে সেলফির বর্ষণ করছে। হঠাৎ সেলফি ক্যামেরার স্ক্রিনে নিজের পেছনে নিবিড়কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো। আদ্রিতা ভূত দেখার মতোই ফট করে ঘুরে তাকালো পেছনে। কিন্তু ঘুরে তাকানোর আগে তার পাউট করা ঠোঁট জোরা স্বাভাবিক করার কথা ভুলে গেল সে। ঠোঁট চোখা করা অবস্থাতেই সে ঘুরে তাকালো।আর সেভাবেই স্ট্যাচুর মতো তাকিয়ে রইলো। নিবিড় দুই প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আদ্রিতার পানে। চোখের নজরে তার তীব্রতা। চোখের সাদা অংশে লালিমা ছেয়ে আছে। কিছুটা ভয় লাগলো আদ্রিতার। এই দৈত্য দানবের চাহুনি ঠিক লাগছেনা। উনার পাকা ধানে আবার কে মই দিলো? এমন ক্ষুদার্থ বাঘের মতো তাকিয়ে আছে কেন? আদ্রিতা একই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থেকেই ভ্রু জোড়া নাচিয়ে ইশারায় জানতে চাইলো কি হয়েছে? নিবিড় আদ্রিতার নিকট আরও এক কদম এগিয়ে এলো। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি গেল এবার আদ্রিতার পাউট করে থাকা অধর যুগলে। সেদিকে একাগ্র দৃষ্টি স্থাপন করে চোয়াল চিবিয়ে বলে উঠলো,
“ওয়াও, কিউটিপাই, একেবারে সদ্য ফোটা লাল গোলাপ মনে হচ্ছে তোমাকে। আই উইশ আমি তোমার মোবাইল হতে পারতাম।সারাদিন তোমার সুন্দর মুখটার ছবি তুলতাম।”
আদ্রিতা ভীমড়ি খেল যেন৷ পাউট করা ঠোঁট জোড়া এবার খুলে গিয়ে আপনাআপনি হা হয়ে গেল। বেচারি আদ্রিতার ছোট্ট মস্তিষ্ক ঘুরে উঠার যোগাড়। উনার কি মাথায় কলেরিয়া হয়েছে নাকি? কি বলছেন এসব! হঠাৎ আদ্রিতার মনক হলো এই কথাগুলো সে আগেও কোথায় যেন দেখেছে। ছটাক সমান মস্তিষ্কে জোর দিতেই আদ্রিতার মনে পড়লো। এসব তো তার গতকালের পোস্টে এক ফ্রেন্ড কমেন্ট করে বলেছিল। এবার টনক নড়লো আদ্রিতার। শুকনো ঢোক গিলতে আরম্ভ করলো। কিছুদিন আগেই সে নতুন একটা আইডি খুলেছে। যেটাতে শুধু বাইরের ফ্রেন্ড সার্কেল আছে। কিন্তু এই লোক সেটা দেখল কি করে?
নিবিড় বাঁকা হেঁসে বলল,
“পিপিলিকার পাখা গজায় মরিবার তরে।”
আদ্রিতা ভয়ে জমে গেল। মনে মনে নিজেকে নির্দোষ সাবস্ত করার দলিল পত্র গোছাতে লাগলো। কিন্তু তা পেস করার আগেই নিবিড় রায় ঘোষণা করে দিলো। কোন কিছু বুঝে উঠার আগেই নিবিড় ফট করে আদ্রিতার হাত থেকে ফোনটা নিয়ে টুপ করে সুইমিং পুলের পানিতে ফেলে দিলো। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব, বাকরুদ্ধ হয়ে গেল আদ্রিতা।তীব্র শক পেয়ে স্তব্ধ চোখে তার সদ্য শহীদ হয়ে যাওয়া ফোনের দিকে তাকিয়ে রইলো। হৃদপিণ্ড টা ঠাস ঠাস করে বিস্ফোরিত হলো। প্রতিক্রিয়াহীন হয়ে গেল সে। এভাবে দিনদুপুরে চোখের সামনে তার কলিজার টুকরা, জানের জান, পরাণের পরাণ ফোনটাকে খুন করা হলো! কি দোষ করেছিল এই মাছুম? এতো নির্মম মৃত্যু কেন পেল সে?
আদ্রিতা ক্রোধ ভরা ক্ষিপ্র দৃষ্টিতে তাকালো নিবিড়ের পানে। চাহুনি এমন যেন এক্ষুনি চোখের ভেতর থেকে ধারালো ছুরি বের হয়ে নিবিড়ের হৃদপিণ্ড ভেদ করে দিবে। অতিরিক্ত ক্রোধে কথাও বলতে পারছেনা সে।তবুও মুখ লাল করে কিছু বলতে যাবে তার আগেই নিবিড় আদ্রিতার ঠোঁটের উপর তর্জনী আঙুল ঠেকিয়ে এক ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
“হুঁশশ…ফোনের জায়গায় তুই নেই এটাই তোর সৌভাগ্য। আকাশে উড়ার অনুমতি দিয়েছি বলে বেঈমান পাখি হওয়ার সাহস করিসনা।কেটে কুঁচি কুঁচি করে চিল শকুনে খাইয়ে দিবো।যা নিবিড়ের, তা একান্তই নিবিড়ের। নিবিড়ের জিনিসে কোনো বিরামচিহ্ন বরদাস্ত করবেনা।”
কথা শেষ করে চলে গেল নিবিড়। পেছন থেকে রাগে, দুঃখে ফুঁসতে লাগলো আদ্রিতা। নিবিড়ের কথার ঠ্যাং মাথা কিছুই বুঝতে পারেনি সে। সেতো এখন প্রতিশোধের আগুনে জ্বলছে। বদল! বদলা নিবে সে। তার ফোন হ,ত্যা,র প্রতিশোধ সে নিয়েই ছাড়বে।
চলবে…….