®মেহরুমা নূর
★সন্ধ্যা হতেই পার্টি জমজমাট হতে শুরু হলো।বাইরে ঝিকিমিকি ফেইরি লাইটের আলোয় ঘেরা পার্টি এরিয়ায় বাড়ছে মানুষের পদচারণা। মিউজিক সিস্টেমে বাজছে সফট মিউজিক। হাতে হাতে স্নাকসের প্লেট আর জুসের গ্লাস। কেউবা নিজেদের মতো হাসি আড্ডায় মেতে আছে। বাচ্চা গুলো এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছে। আর তাদের সাথে ছুটছে আদ্রিতাও। বাচ্চাদের মতো সারা পার্টি এরিয়ায় ছোটাছুটি করছে। দূর থেকে নিবিড়ের গরম চোখের হুমকি দেখে কিছুক্ষণ থেমে যায়। নিবিড়ের ধ্যান পরিবর্তন হতেই আবারও একই কাজ করে সে। কিছুক্ষণ পর সানা আর তাসির স্টেজে এসে ওদের আসন গ্রহণ করে বসলো। লোকজন একে একে এসে গিফট দিয়ে শুভেচ্ছা জানাতে লাগলো।
অনেকক্ষণ ছোটাছুটি করে এবার একটু বসলো একটা চেয়ারে আদ্রিতা। সানভি আর তানহাও সেখানে বসা। সানভি আদ্রিতার উদ্দেশ্যে বলল,
“এই অরি,তোকে না আমি মেকাপ করে দিলাম সেসব কি হলো? সেগুলো পরিষ্কার করে ফেলেছিস কেন?”
আদ্রিতা দূরে দাঁড়ানো নিবিড়ের পানে তাকালো।প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে লোকজনের কথা বলা বলছে সে।তাসানের কিছু কাজিন আর ফ্রেন্ডসদের সাথে। মাঝে মাঝে সৌজন্যমূলক খুব স্বল্প পরিসরে স্মিথ হাসছে।যেন হাসির উপর ট্যাক্স বসানো। হাসি একটু বেশি হলেই উনি ব্যাংকরাপ্ট হয়ে যাবে। সেদিকে তাকিয়ে থেকেই আদ্রিতা হাসিমুখে সানভির প্রশ্নের জবাবে বলল,
“কারণ আমি প্লাস্টিকের ফুল না।”
ভ্রু কুঁচকালো সানভি। আদ্রিতার কথার অর্থ ধরতে অক্ষম সে। প্রশ্নসূচক চাহুনি দিয়ে কিছু বলতে যাবে তখনই সানভির পাশে বসা ওর ফুফাতো বোন সাবিহা বলে উঠলো,
“এই সানভি,তোর এমন একটা হলিউড হিরো টাইপ মামাতো ভাই আছে তাতো কখনো বলিসনি। মা কসম, কি পোলা মাইরি! মমতাজ আন্টির ওই গানটা আজ সত্যি করে দিচ্ছে। পোলাতো নয় যেন আগুনের গোলা। একটু লাইন ঘাট করিয়ে দেনা। এমন হট হাংক-কে একবার নিজের করে পেলে জীবন ধন্য হয়ে যাবে।”
আদ্রিতা জুস মুখে দিয়েছিলো মাত্রই। সাবিহার নিবিড়কে নিয়ে এমন মহৎ ধারণা শুনে মুখের জুস টুকু আর গলার নিচে নামলো না। হঠাৎই যেন মিষ্টি স্বাদের জুসটা তেতো স্বাদে পরিবর্তিত হয়ে গেল। না পারছে গিলতে, না পারছে উগরে দিতে। গালভর্তি জুস ভরে দুই গাল ফুলিয়ে ওভাবেই বসে রইলো সে। সাবিহার কথা আর তার মুখের জুসের স্বাদ পাল্টে যাওয়ার বিষয় টা বুঝতে পারলোনা আদ্রিতা। মানুষের কথাও বুঝি কোনো কিছুর স্বাদ পাল্টে দিতে পারে! পারে হয়তো। সাবিহার কথাবার্তা মোটেও ভালো লাগেনি তার কাছে। রাগ নামক বস্তুটা খুব করে হলো তার। ক্রোধিত মনে একটা পরিকল্পনা এলো। হাতের জুস টুকু ওই মেয়েটার মাথায় ঢেলে দিলে ব্যাপার টা খারাপ হবে না। নির্লজ্জ মেয়ে একটা। কিন্তু আদ্রিতা বুঝতে পারছে না তার এতো রাগ কেন হচ্ছে হঠাৎ! আজব!
আদ্রিতার পাশে বসা তানহাও ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো সাবিহার কথাবার্তায়। বোন হয়ে ভাইয়ের সম্বন্ধে এসব কথা শোনা অস্বস্তিকর বিষয়। সাবিহার এই বেলাজ কথাবার্তা তার কাছেও ভালো লাগলো না। একটা মেয়ে হয়ে এভাবে কীভাবে বলে! তানহা নিজের অস্বস্তি কাটাতে ওখান থেকে উঠে গেল। সানভি সাবিহার প্রতিত্তোরে বলল,
“তুই এতো লুইচ্চা ক্যারে ছেড়ি! সুন্দর ব্যাটা দেখলেই তোর লালা পড়ে খালি। তবে এবার তুই ভুল ব্যাক্তির উপর নজর দিয়েছিস। নিবিড় ভাইয়া অন্য ধাতুর তৈরী। সে তোর মতো মেয়েদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। আরে আজ পর্যন্ত আমারেই ভাউ দিলোনা। বোন ছাড়া দ্বিতীয় কোনো নজরে দেখেনি। তাহলে তুই কেন ক্ষেতের মুলা! আমিতো ভাই বুঝে গেছি নিজের যায়গা। তুইও সামলে যা। নিবিড় ভাইয়া হলো মরিচীকার মতো। দেখা দেয়, ধরা দেয়না।”
সাবিহা আত্মগর্ব করে বলল,
“আরে ধরা না দিয়ে যাবে কোথায়। এই সাবিহার জালওয়াও কিছু কম না। আজ পর্যন্ত এমন কোনো ছেলে নেই যাকে সাবিহা ঘায়েল করতে পারেনি৷ একেও বশ করেই ছাড়বো দেখিস। এখুনি তোদের দেখাচ্ছি কীভাবে এই হটিটাকে আমার উপর ফিদা করি।”
বলেই খুব এটিটিউট নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে নিবিড়ের কাছে যাওয়ার জন্য অগ্রসর হলো সাবিহা। আদ্রিতার কি হলো কে জানে! সাবিহা ওর সামনে দিয়ে যেতে নিলেই, সে মুখের মাঝে জমিয়ে রাখা জুসটুকু ফুঁসস করে বের করে দিলো। আর সেটা সোজা গিয়ে পড়লো সাবিহার ডিজাইনার ঝকমকে পোশাকের উপর। সাবিহা এতে খুবই রাগ হলো। মুখ চোখা করে রাগান্বিত স্বরে বলল,
“হোয়াট দ্য হেল। তুমি কি পাগল অরি! এটা কি করলে তুমি! আমার এতো দামি ড্রেসটা নষ্ট করে দিলে। এতো বড় ধামড়ি মেয়ে হয়ে গেছ অথচ এখনো খাওয়ার ম্যানারস শেখোনি, তাহলে আসার দরকার কি মানুষের মাঝে। ঘরে বসে থাকলেই পারো। যত্তসব!
আদ্রিতা প্রতিত্তোরে বলল,
” সরি আপু, আমি ইচ্ছে করে করিনি। আসলে কেন যেন আপনার ড্রেসটা দেখেই আমার বমি আপনাআপনি বের হয়ে এলো। এতে আমার কি দোষ বলুন?”
সাবিহা রাগে কটমট করতে করতে বলল,
“কি বলতে চাইছ তুমি হ্যাঁ? “
“ওমা আপনি তো দেখি কথাও বোঝেন না। মানে উপরের ফ্ল্যাট খালি! আমিতো নাহয় ম্যানারস জানিনা।কিন্তু আপনিতো মেন্টাল রুগী তাহলে।আমার ঘরে বসে থাকা লাগলে, আপনাকেতো শেকলে বেঁধে রাখা উচিত। ইউ আর ভেরি হার্মফুল ফর হিউম্যান।”
সাবিহা রাগে কড়মড় করতে করতে জমিনে পা গুঁতিয়ে চলে গেল তার ড্রেস পরিষ্কার করতে। মনে হয় এখন তাকে পুরো চেঞ্জই করতে হবে। তারপরই নিবিড়ের কাছে যেতে পারবে। সাবিহা যেতেই সানভি আঁটকে রাখা হাসির ফোয়ারা ছুড়লো। আদ্রিতার কাজে খুব মজা পেয়েছে সে। ওই সাবিহাটা ভালো শিক্ষা পেয়েছে। বেয়াদব ছেড়ি।
পার্টির এতো শোরগোল নূরানের ভালো লাগছে না। সে পার্টি এরিয়া থেকে সরে এসে একটু নির্জন স্থান দেখে বসলো। পকেট থেকে ফোনটা বের করলো। আজকাল তার আর ফোনের সম্পর্কটা একটু বেশিই জোড়াল হয়েছে। আর এই সম্পর্কের সূত্র হয়েছে সেই অজানা মেয়েটির বদৌলতে। বিগত কিছুদিনে তাদের ফোনে টেক্সটের আদান প্রদান অনেকটাই রীতিগত হয়ে গেছে। রহস্যময় মেয়েটির কখনো রসিকতা, কখনো হেয়ালি, কখনো আবার খুব নিগূঢ় কিছু অভিপ্রায় নূরানকে বারবার বাধ্য করে মেয়েটির সাথে আলাপ করতে। যদিও তাদের মাঝে এখনো তেমন কোনো প্রণয় ঘটিত আলাপ হয়নি। বরং নূরানতো এখনো মেয়েটির নামই জানে না। প্রথম প্রথম কয়েকবার জানতে চাইলে মেয়েটি নানান হেয়ালি পূর্ণ কথা বলতো। এই যেমন, নামে কি আসে যায়,শেক্সপিয়ার বলে গেছেন, “হোয়াট ইজ ইন দ্য নেম?” পরবর্তীতে নূরানও তাই আর জিজ্ঞেস করেনি। থাক না কিছু পরিচয় অজানাই। সব জানলে আর মজা কই। এই অজানা সম্পর্কেরও একটা আলাদা মজা আছে। যা জানার মাঝে নেই।
মোবাইলের নেট কানেকশন অন করতেই টুং করে ম্যাসেজ টোন বেজে উঠল। ভূতনী নামের আইডি থেকে। নূরানই এই নিক নেম সেট করেছে। ঠোঁটের কোণে অস্পষ্ট হাসি ছুঁয়ে গেল নূরানের। এটা আজকাল প্রায়শই হয়। মেয়েটার সাথে চ্যাট করতে নিলেই তার ঠোঁটে এই হাসির রেখা বিদ্যমান থাকে৷ ম্যাসেজ ওপেন করলো নূরান৷ দশ মিনিট পূর্বে দিয়েছিল। লেখা আছে,
“আমার মন খারাপ”
নূরান রিপ্লাই দিলো,
“ভূতনীদেরও বুঝি মন খারাপ হয়? ভেরী ইমোশনাল ভুতনী তো আপনি! তা মন খারাপ হওয়ার কারণ কি? আজ কারোর ঘাড় মটকানোর সুযোগ পাননি বলে? নাকি কারোর র,ক্ত শুষে খেতে পারেননি বলে?”
রিপ্লাই এলো,
“ইয়াক! আমি ওসব খাইনা। আই অ্যাম এ পিওর ভেজিটেরিয়ান ভূতনী।”
“তাহলে মন খারাপ কেন?”
“সবসময় কি মন খারাপের কারণ থাকতে হবে? আমার মন এতো ডিমান্ডিং না যে,তার খারাপ হতে ভ্যালিড রিজন দরকার। তার যখন ইচ্ছ হয় এমনি এমনিই খারাপ হয়ে যায়।”
“এমনও আবার হয় নাকি?”
“হুম হয়তো? কেন আপনার কখনো এমনি এমনি মন খারাপ হয়না?”
“উহুম। এসব মন খারাপ, টোন খারাপ আমার হয়না। হয়তো আমার মনটা অনেক ডিমান্ডিং। তার খারাপ হওয়ার জন্য যথাযোগ্য কারণ চাই। আজ পর্যন্ত মন খারাপ হওয়ার তেমন কোনো কিছু পায়নি।”
“লাকি ইউ! এমন ডিমান্ডিং মন পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। নাহলে আমার মতো নন ডিমান্ডিং ‘মন’ পালা, বড়োই মুশকিল। সে-তো ওই নীড় হারা পাখির ভ্রান্ত ছুটে চলা দেখেই উদাস হয়ে যায়। বিষন্ন হয়, পৃথিবীকে বিদায় জানিয়ে গহ্বরে তলিয়ে যাওয়া রক্তিম সূর্যাস্ত দেখে। আকাশের নীলিমা যখন মেঘের পারদে ঢেকে যায় তখনও মনটা খারাপ হয়ে যায়।”
“বাহ! আপনার মন খারাপের বিশ্লেষণ শুনেতো কেমন লোভ লাগছে। মনে হচ্ছে জীবনে এক বার হলেও মন খারাপ হওয়াটা খুব জরুরি।”
“যান,আমি আজ দোয়া করে দিলাম। আপনার যেন একদিন খুব করে মন খারাপ হয়। মন খারাপের দেশের রাজা হন আপনি।”
“এটা আবার কেমন দোয়া! এটা দোয়া,নাকি বদদোয়া!”
“বদদোয়াই ভেবে নেন। দোয়াতো সবাই দেয়।আমি নাহয় বদদোয়াই দিলাম। এই ভূতনীর বদদোয়ার জবান, কভু না যায় খন্ডন। ছু মন্তর ছু…. “
হাসলো নূরান। আর কিছু লিখবে তার আগেই খাবার জন্য ডাক পড়লো। আপাতত চ্যাট এখানেই শেষ করে উঠে গেল নূরান।
খাওয়ার টেবিলে বসে গেল সবাই। আদ্রিতা,সানভি, তানহা এক টেবিলে বসলো। টেবিলে চেয়ার খালি আছে আরও। আদ্রিতার পাশের চেয়ারে নিবিড় এসে চেয়ার টেনে বসলো। চেনা সুবাস পেয়ে আরচোখে একবার তাকে পরখ করলো আদ্রিতার চঞ্চল নজর। লোকটা আশেপাশে থাকলেই কেমন অদৃশ্য ছন্দ বাজে আদ্রিতার তনু মনে। ফুরফুর করে উড়তে থাকে শুভ্র তুলোর ফোয়ারা। ভালো লাগারা যেন গোল্লাছুটের মতো চারিদিকে ভনভন করে ঘুরতে থাকে তখন। ওয়েটার খাবার দিয়ে গেলে সবাই যার যার মতো প্লেটে খাবার জমাতে ব্যাস্ত। কেবল আদ্রিতা ভিন্ন প্রাণী। ঠোঁট চোখা সব খাবারে চোখ বুলিয়ে দেখে আদৌও কোনো খাবার তাকে আকর্ষীত করে কিনা। নাহ,কাজ হলোনা। কোনো খাবারই আদ্রিতার আকর্ষণের তালিকায় পড়লোনা। এখন খাবার আদ্রিতাকে আকর্ষীত করতে পারলোনা এতে বেচারি আদ্রিতার কি দোষ! সেতো খেতেই চেয়েছিল। অথচ লোকে শুধু এই মাছুম আদ্রিতাকেই দোষ দেয়, হুহ্। মনে মনে নিজেকে সম্পূর্ণ নিরপরাধী সাব্যস্ত করে,অনেক খুঁজে এক পিচ জালি কাবাব প্লেটে তুলে নিলো। হাতে গোনা যাবে এমন কয়েক দানা পোলাও নিয়ে খাওয়া শুরু করলো সে। ভাবটা এমন যেন সে কোন বিশ্বজয়ের মাঠে নেমেছে। বোরহানির গ্লাস টা হাতে নিয়ে তাতে দুই চুমুক দিয়ে আবার গ্লাস টা টেবিলে রেখে নিজের প্লেটে নজর দিতেই কলিজায় বিস্ফোরণ হওয়ার উপক্রম আদ্রিতার। তার মরুভূমির মতো প্লেট খাবার ভর্তি আমাজন জঙ্গল কীভাবে হয়ে গেল? ফাটা ফাটা চোখে তাকিয়ে রইলো আদ্রিতা। কে করলো এই কাজ? চারপাশে তাকিয়ে দেখলো সবাই নিজের খাওয়া নিয়ে ব্যাস্ত। আজব! তাহলে এই খাবার কি ভূতে দিয়ে গেল! এখানেও কী আমার সেই “পরা” এসে হাজির হলো! এতো খাবার! এটা খেতে শুরু করলে, আদ্রিতার নাতনীর নাতনী হয়ে যাবে তাও শেষ হবে না। আদ্রিতা বড়সড় ঢোক গিলে ডানে বামে তাকিয়ে, আস্তে করে সুড়সুড় করে স্থান ত্যাগ করতে চাইলো। কিন্তু বিধিবাম, তার পরিকল্পনা মাঝ নদীতে ডুবিয়ে দিলো নিবিড়ের শান্ত সুরের হুমকি।
“খবরদার! খাবার শেষ না করে এক পা উঠবিতো, এই পা নিয়ে আর বাসায় ফিরতে পারবিনা।”
ব্যাস, হয়ে গেল। সব ভালো লাগা মুহূতেই বাঁশে পরিণত হয়ে গেল। তারমানে এই লোকই ওর সাথে এই অত্যাচার করার প্ল্যান করেছে! নিজের পায়ের সালামতি হেতু আদ্রিতা নিজের জায়গা থেকে আর নড়ার সাহস পেলনা। পা ছাড়া নিজেকে দেখতে মোটেও ভালো লাগবে না৷ আর সবার বিয়েতে উড়াধুড়া নাচার জন্যেও তো পায়ের দরকার হবে। তাই পা খোয়ানো যাবে না। অতঃপর উপর ওয়ালার নাম নিয়ে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে নেমে পড়লো আদ্রিতা৷ একবার করুন নজরে সবার দিকে তাকালো। যেন বলছে, আমার যদি কিছু হয়ে যায় তাহলে দুওয়াওমে ইয়াদ রাখনা। বুক ফাটা কষ্ট নিয়ে আদ্রিতা খাবার পেটে চালান করতে লাগলো। আর মনে মনে নিবিড়কে তার উদ্ভট অভিশাপের বর্ষণ করলো। যেমন,নিবিড় ভুল করে লেডিস টয়লেটে চলে যাক আর লেডিস গুলো তাকে উদোম ক্যালানি দিক। সে খাবার খেতে গেলে সব খাবারে মাছি হাগু করুক।
আদ্রিতার অবস্থা সর্বশান্ত সৈনিকের মতো। প্লেটে এখনো তিন ভাগের দুই ভাগ খাবারই পড়ে আছে। এতেই তার জ্ঞান হারানোর যো। আর একটা দানাও মুখে দিলেই যেন ভেতরের সব ইউ টার্ন নিয়ে বেড়িয়ে আসবে। ছেড়ে দে মা, কেদে বাঁচি চেহারা করে আছে। কিন্তু তার সম্মুখের নির্দয় ব্যক্তির এতে একবিন্দুও দয়া হলোনা। সে নির্বিকার পাশে বসে ফোন টিপছে। বাকিরা খাওয়া শেষ করে কখন চলে গেছে। খাবার এরিয়া পিনপতন। সবাই খাওয়া দাওয়ার পার্ট চুকিয়ে চলে গেছে। এই দৈত্য দানবের জন্য আদ্রিতা উঠতে পারছেনা। ওইযে,পা থাকবেনা সেই ভয়ে। খাবার শেষ না করে ওঠার হুমকি গলায় ঝুলিয়ে রেখেছে। আদ্রিতা অসহায় কাঁদো কাঁদো মুখ করে নিবিড়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আর পারছিনা নিবিড় ভাইয়া, সত্যিই বলছি। আর খেলেই বমি করে ফেলবো। তখন যেন আবার বকা দেন না।”
নিবিড় সরু চোখে তাকালো আদ্রিতার পানে। স্থির নজর কতক্ষণ স্থায়ী রাখলো। তারপর হঠাৎ হাতের ফোনটা পাশে রাখলো। ডান হাত ধুয়ে আদ্রিতার সামনের প্লেটটা নিজের কাছে টেনে নিলো। বাম হাতে প্লেট ধরলো আর ডান হাতে লেবু চিপে খাবার মাখিয়ে এক লোকমা তুলে আদ্রিতার মুখের সম্মুখে ধরলো। আদ্রিতা হতবিহ্বলের মতো তাকিয়ে রইলো। পিটপিট করে কয়েকবার নেত্রপল্লব ঝাপটালো। একবার নিবিড়ের হাতের দিকে, তো একবার তার মুখের দিকে তাকাচ্ছে। উনি কি আমাকে নিজের হাতে খাইয়ে দিতে চাচ্ছে! নাকি আমার মগজের বাত্তি ফিউজ হয়ে গেছে তাই ভূতুড়ে ভ্রম দেখছে। নির্ঘাত মগজে গ্যাস জমে গেছে। আদ্রিতার ভ্রম পরমুহূর্তেই ভুল প্রমাণিত হলো নিবিড়ের ধমকে ওঠায়।
“আবালের মতো তাকিয়ে না থেকে মুখ খুলে খাবার মুখে নে। দেখি কীভাবে খাবার শেষ না হয়। জলদি মুখ খোল।”
আদ্রিতা চোখের পাতা ঝাপটে কেঁপে উঠল। ঘোরের মাঝেই ফট করে মুখ খুলে নিবিড়ের হাতের অপেক্ষাকৃত খাবার মুখে নিলো। একটা ঘোরের মাঝেই খাবার শেষ করলো আদ্রিতা। শেষ করে সে নিজেও অবাক। সে কীভাবে এতো খাবার খেয়ে ফেলল! উনার হাতে কী যাদু আছে! আজ যেন খাবারের স্বাদ বেশি হয়ে গিয়েছিল মন হচ্ছে। রাগ চলে গেল আদ্রিতার। আবারও ভালো লাগারা চারিদিকে গোল গোল ঘুরতে লাগলো। দুজন বেসিনে হাত ধুয়ে বেরিয়ে এলো। নিবিড় টিস্যু দিয়ে আদ্রিতার থুতনিতে লেগে থাকা হালকা খাবারের দাগ মুছে দিলো। আদ্রিতার হৃদগুহে মৃদু কম্পন হলো। ঝিনঝিন সুরের অদৃশ্য আওয়াজ বাজলো কর্ণগুহে।
চলবে……..