®মেহরুমা নূর
★আজ সবাই আদিত্যদের গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবে। বাসার প্রাইভেট কার আর বড়ো একটা হাইস ভাড়া করা হয়েছে। প্রাইভেট কারে মুরব্বিরা যাবে। আর বাকিরা সবাই হাইসে। সবার মাঝেই এক উচ্ছাস আর খুশির আমেজ। পিকনিকের মতো মনে হচ্ছে সবার কাছে। সারাবাড়ি হৈচৈ পূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে গেছে। সবচেয়ে বেশি আমেজ আদ্রিতার মাঝে।শেষমেশ সে সবার সাথে যেতে পারছে এটাই তার সবচেয়ে বেশি খুশির বিষয়। এক্সাইটমেন্টে সে গতরাতে ঘুমই আসেনি৷ মধ্যরাত পর্যন্ত মা-বাবার সাথে ভিডিও কলে কথা বলেছে। তাদের ফাইজার বিয়ের বিষয়ে সব আপডেট দিয়েছে। কাল রাতেই নিজের ব্যাগ প্যাক করে ফেলেছে। একটু পরপর নতুন করে কিছু মনে পড়লে আবার সেটা ঢুকাচ্ছে।তারপর লাফালাফি করে সারাবাড়ি ছুটে বেড়াচ্ছে আর সবার প্রস্তুতি পর্যবেক্ষণ করছে। সানা আর তাসিরদের পুরো পরিবারই যাবে। সাথে দ্য গ্রেট রবি বাবাজিও যাচ্ছে। ট্রিপ জমে খির হয়ে যাবে এমনটাই ধারণা আদ্রিতার।
আদ্রিতা বেবি পিংক কালারের টপ আর মাল্টি কালারের একটা লং স্কাট পড়েছে। মাথার চুলগুলো দুই পাশে উঁচু করে দুটো ঝুঁটি করেছে। লম্বা ফিতার একটা ছোট আকারের সাইড ব্যাগ কাঁধের উপর দিয়ে আড়াআড়ি ভাবে ঝুলিয়ে নিলো।আয়নায় নিজেকে ঘুরেফিরে দেখলো। তাকে দেখতে এই মুহূর্তে নার্সারি ক্লাসের মেয়েদের মতো লাগছে। সে রেডি হয়ে খুশি মনে ধেইধেই করে নাচতে নাচতে বাইরে আসতেই প্রতিবারের মতো নিবিড়ের সাথে ধাক্কা খেল। নিবিড় আদ্রিতার দুই বাহু ধরে সোজা করে দাঁড় করিয়ে দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলল,
“তুই যে বলদি গরু তা আমি এমনিতেই জানি। সেটা প্রমান করার জন্য বারবার এভাবে গুতা দেওয়া তোর অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে নাকি! গুতার ওয়ার্ল্ড রেকর্ড করতে চাস! নাকি গুঁতা মেরে মেরে আমার বুকের মাঝখান দিয়ে সুরঙ্গ বানাবোর ধান্দায় ঘুরছিস!”
এই হয়ে গেল। আদ্রিতার মেঘের উপরে হাওয়ায় ভাসতে থাকা মেজাজ টাকে ধপাস করে নিচে ফেলে দিতে চলে এলেন দৈত্য দানব টা। কিন্তু আদ্রিতা এখন রাগবেনা বলে মনোবল শক্ত করলো।এই লোকের জন্য সে তার মুড খারাপ করবেনা। এমনিতেও এই লোককে এখন কিছু বলা মানে নিজের পায়ে কুড়াল মারা।দেখা গেল আমার যাওয়াই বন্ধ করে দিলো। তাই আপাতত অপমানটাকে চিনি দিয়ে মিশিয়ে লেবুর শরবত মনে করে গিলে ফেললো আদ্রিতা। মেকি হেঁসে নিবিড়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
“সরি নিবিড় ভা……
ভাইয়া বলার জন্য খোলা ঠোঁট দুটো আর চাপলোনা আদ্রিতার। সেভাবেই হা হয়ে তাকিয়ে রইলো নিবিড়ের দিকে। মেরুন রঙের টিশার্ট আর এ্যাশ কালারের জিন্স পরিহিত পুরুষটিকে দেখে আদ্রিতা যা বলতে গিয়েছিল তা পেটের ভিতরেই থেকে গেল। চোখের ব্লাক সানগ্লাসটা তার সুদর্শনের মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে যেন। নিবিড় আদ্রিতার সামনে তুড়ি বাজিয়ে বলল,
” কিরে আবালের মতো হা করে আসিছ কেন?”
আদ্রিতা আমতাআমতা করে বলল,
“কি….কিছুনা।”
বলেই চলে যেতে নিলো। পেছন থেকে কড়া গলায় ডাকলো নিবিড়,
“এই দাঁড়া।”
দাঁড়িয়ে গেল আদ্রিতা। নিবিড় আদ্রিতার সামনে এগিয়ে এসে বলল,
“এদিক ঘোর।”
আদ্রিতা ঘুরে দাঁড়িয়ে নিবিড়ের দিকে তাকালো। নিবিড় ঘাড় হালকা বাঁকিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আদ্রিতার উপর থেকে নিচ পর্যন্ত স্ক্যান করতে লাগলো। তারপর বলে উঠলো,
“বাহ! কি সং ধারণ করেছিস! এখন শুধু একটা জিনিসেরই কমতি আছে। তাহলে তোর সাজ একেবারে সোনায় সোহাগা হয়ে যাবে।”
আদ্রিতা উৎসাহী কন্ঠে বলল,
“কি? “
“ফিডার।”
আদ্রিতা থতমত খেয়ে বলল,
“কিহ!”
নিবিড় দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“হ্যাঁ ফিডার। তোর এই লুকের সাথে জাস্ট একটা ফিডারের কমতি আছে। সেটা লাগালেই একেবারে পারফেক্ট লাগবে তোকে। মানুষ চলে সামনে আর তুই বোধহয় রিভার্স মোডে চলছিস তাইনা! দিনেদিনে আরও ল্যাদা বাচ্চা হতে চাচ্ছিস!”
নিবিড় আদ্রিতার দুই ঝুঁটি টেনে ধরে আদ্রিতার গলা পেঁচিয়ে ধরে বলল,
“তোকে টেনে বড়ো করতে পারছিনা সেই জ্বালায়ই আমার জীবন ভাজাভাজা হয়ে গেল। একেবারে তেলে ভাজা পোড়া পাপর হয়ে গেছে। আর তুই কিনা আরও ছোট হওয়ার পায়তারা করে যাচ্ছিস! জান শেষ করেই ক্ষান্ত হবি বুঝি।”
খুব একটা জোরে পেঁচিয়ে ধরেনি নিবিড়। তবে ভয়টা ঠিকই লাগছে আদ্রিতার। আপাতত নিজের জানের জন্য দোয়া দরুদ পড়তে ব্যাস্ত আদ্রিতা। নিবিড়ের কথার নাড়ীভুঁড়ি বের করার খেয়াল নেই এখন ওর। তখনই তানি নিচ থেকে ডাক দিলো আদ্রিতার নাম ধরে। তা শুনতে পেয়ে আদ্রিতাকে ছেড়ে দিয়ে গটগট করে নিচে নেমে গেল নিবিড়। আদ্রিতা বেচারি জান হাতে পেয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচল। আজকের পর জীবনেও আর সে দুই ঝুঁটি বা বেনি কিছুই করবেনা।
ফিরোজ, ফাইজা আর ওর পরিবারকে নিয়ে আগেই চলে গেছে।সবাই রেডি হয়ে একে একে বাইরে এলো গাড়ির কাছে। তানহা সাদা রঙের লং একটা গোলা জামা পড়েছে। তাসানের পোশাকে রঙের ছড়াছড়ি।টিশার্টের উপর হাতা কাটা জ্যাকেট সাথে থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট। মাথায় ক্যাপ,চোখে চশমা।পুরো মাল্টিকালার তার সব পোশাক। সানভিকে দেখে মনে হচ্ছে সে কোনো ফ্যাশন শোতে পার্টিসিপ্যান্ট করার উদ্দেশ্যে বের হয়েছে। আজতো মেকাপের ওভারলোড হয়ে গেছে। তার মুখ থেকে মেকআপ তুলে শ’খানেক গরীব দুঃখিকে দান করা যাবে।রবিও চলে এসেছে।সবার আসার পর সবাই গাড়িতে উঠা শুরু করলো। দাদুরা সবাই একটা কারে আর তানি-আবির, সানা-তাসির আরেকটা কারে। বাদবাকি সবাই হাইসে উঠবে। নূরান বরাবরের মতো সবার শেষ সিটে গিয়ে এক কোণা ধরে বসে পড়লো।দ্বিতীয় লাইনে বসলো তানহা,সানভি আর আদ্রিতা। তৃতীয় লাইনে রবি আর তাসান বসলো। ড্রাইভিং সিটে বসলো নিবিড়। তখনই হন্তদন্ত হয়ে নিবিড়ের পাশের সিটে এসে বসলো অপরাহ্ন। বসতে বসতে নিবিড়ের উদ্দেশ্যে বলল,
“সরি সরি দেরি করে ফেললাম।”
সানভি আর আদ্রিতার মাঝের সিটে বসেছিল তানহা। অপরাহ্নের কন্ঠ কানে আসতেই চকিত নজরে সামনে তাকালো তানহা। অপরাহ্নও ওদের সাথে যাবে! বুকের মাঝে আবারও সেই এলোমেলো প্রবাহ দৌড়াতে লাগলো তানহার। নিবিড় গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে বলল,
“আরে না না সরি কেন বলছেন। আপনি বরং আরও তিনদিন পর আসতেন।”
“আরে ক্লিনিক ছেড়ে এতদিন দূরে থাকবো। তাই সবাইকে একটু কাজ বুঝিয়ে দিতে সময় লেগে গেল।”
“যাক এসেছিস তো। আমিতো ভাবলাম হয়তো যাওয়ার কথা ভুলেই গেছিস।”
অপরাহ্নের নজর পড়লো সামনের মিররে।তানহার অবাক হওয়া চোখ জোড়া দেখতে পেয়ে সেদিকে তাকিয়ে থেকেই বলে উঠলো,
“আজকালতো নিজেকেই ভুলে যেতে শুরু করেছি। হাল বেহাল। কেউ এসে উদ্ধার করলেই বাঁচা। নাহলে মৃ,ত্যু নির্ঘাত।”
চোখ সরিয়ে নিলো তানহা। চশমা ঠিক করে বাইরের দিকে তাকালো। লোকটার আবহ ওকে কেমন অন্যমনস্ক করে দেয় আজকাল। ওসব মোহমায়ায় জড়াতে চায়না তানহা। তার যে ভীষণ ভয় হয়৷ অপরাহ্নের কথার পরিপেক্ষিতে রবি বলে উঠলো,
“ডাক্তারের কথায় মনে হচ্ছে নিজেই পেশেন্ট হয়ে গেছ বৎস৷ ডাল মে, কুছ কালা হে।”
হাসলো অপরাহ্ন। তাসান বলে উঠলো,
“ডালে মনে হয় ওর মাথার উকুন পড়েছিলো তাই ডালে কুছ কালা দেখা যাচ্ছে ।মেবি কালো জিরার পরিবর্তন হিসেবে ব্যাবহার করেছে। ব্যাপার না। নিরামিষে একটু আমিষ যুক্ত হয়ে পুষ্টি আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। ডাক্তার মানুষ তো তাই সবসময় সুষম খাদ্য খায় সে।”
সশব্দে হেঁসে উঠলো সবাই। সানভি মুখ কুঁচকে বলে উঠলো,
“ইউউউ…উকুন! ইয়াক! অপু ভাইয়া আপনার মাথায় উকুন আছে! উঁকুন নাশক শ্যাম্পু দিয়ে মেরে ফেলতে পারেন না।”
তানহা বিরক্তিকর চোখে তাকালো সানভির দিকে। আবার একবার আরচোখে অপরাহ্নের দিকেও তাকালো। অপরাহ্ন স্মিথ হেঁসে বলল,
“কি দরকার মারার! তারাও তো একটা প্রাণ। আমার মাথায় যদি তারা নিজেদের আশ্রয় বানিয়ে নেয় তাহলে ক্ষতি কি! শুধু শুধু প্রাণী হ,ত্যা করে পা,প ঘাড়ে নিতে চাইনা। আমি আবার অবলা প্রাণীর প্রতি অনেক স্পর্শকাতর। আমার মনে সবার প্রতি মায়া, কি করবো বলো!”
তানহা মাথা অন্য দিকে ঘুরিয়ে নিঃশব্দে হাসলো। লোকটাকে যতটা ভদ্র দেখা যায় ততটাও না উনি। দুষ্টুও আছেন।
আদ্রিতা অপরাহ্নকে বলল,
“ওয়াও অপু ভাইয়া,আপনি সত্যিই অনেক সুইট। নিজের কষ্ট হচ্ছে তাও উঁকুন গুলোকে মাথা থেকে সরাচ্ছেন না।। রিয়েলি সুইট অফ ইউ।”
অপরাহ্ন গদগদ সুরে বলল,
“থ্যাংক ইউ অরি বোইনা।আমিতো পয়দায়িশই সুইট। কিন্তু কিছু লোক কেমন যেন বুঝেই না।কেউ একটু এই সুইটনেস টেস্ট করেই দেখলোনা”
সামনের আয়নায় আবারও তানহার দিকে তাকিয়ে হালকা আপসোসের সুরে অপরাহ্ন বলল কথাটি। চোখে চোখ পড়তেই আবারও নজর লুকালো তানহা। আদ্রিতা উৎসুক কন্ঠে বলল,
“উঁকুন গুলোর সাথে মনে হয় আপনার বন্ধুত্ব হয়ে গেছে তাইনা? বর্তমানে কতজন সদস্য আছে?”
“হ্যাঁ তাতো হয়েছেই। একসাথেই থাকি বলে কথা। দে আর ভেরি সুইট এন্ড ফ্রেন্ডলি উঁকুন। একসময় দাওয়াত দিবো তোমাদের আমার মাথায়। তাদের সাথে সাক্ষাৎ করে সব নিজেই জেনে নিও।”
সানভি বিরক্তির সুরে বলে উঠলো,
“ইয়াক! এই অরি, তুই কিসব উঁকুন বিশারদ শুরু করে দিলি। চুপ করতো। আমার বমি আসছে শুনে।”
পেছন থেকে তাসান বলে উঠলো,
“এমন ভাবে বলছিস যেন তোর কখনো উঁকুন ছিলোই না! ভুলে গেছিস সেদিনের কথা যখন তোর চুলে উকুনের চৌদ্দ গুষ্টি বাস করতো! দিনরাত উকুন বের করে পট পট করে মারতিস।”
আবারও হেঁসে দিলো সবাই। হাসি আড্ডার মাঝেই রাস্তা এগুতে লাগলো।
কিন্তু পেছনের কোণায় সিটে বসা নূরান এসব থেকে আলাদা। সে কানে ইয়ারফোন গুঁজে ফোনে একটা রবীন্দ্র সংগীত চালালো। জানালার কাচ নামিয়ে বাইরের প্রকৃতিতে নিজেকে হারালো। গাড়ি চলার সাথে প্রবল বাতাসের শ্রোতে নূরানের লম্বা চুলগুলো ঝাঁপটা খাচ্ছে। ব্যাস্ত শহরের কোলাহল থেকে বেড়িয়ে যাচ্ছে তারা। কেউ আজ তাদের ধরতে পারবেনা। দুপাশের গাছের সারি, দূরন্তের সবুজ অরণ্য, বাসভূমি সবকিছুকে পিছু ফেলে হাওয়ার বেগে ছুটে চলেছে তারা।কেউ ধরতে পারছেনা তাদের। ভালোই লাগছে নূরানের। মনে কিছু শব্দের মেলা জমছে। তা লিখতে ফোন হাতে নিলো সে। নীলাম্বরীর আইডিতে ঢুকে টাইপ করলো,
“হয়তো কোনো শ্যামল বিহঙ্গে
শুভ্র মেঘের ভেলায় ভেসে,
পড়বো আবার নীলাভ তরঙ্গে।
সিন্ধু গহীনে ডুববো আবার
সিক্ত হবো স্বচ্ছতার।
ফেরারি পাখির সঙ্গী হবো
ডানা মেলে অজানায় হারাবো।
হারানোর সফর হবে আরও মোহময়
যদি তাতে সঙ্গী হিসেবে পাই তোমায়।”
টাইপ করা শেষে সেন্ড বাটনে চাপলো নূরান। হঠাৎই যেন হকচকিয়ে উঠলো সে। এপর্যন্ত নীলাম্বরীকে এমন ধরনের ম্যাসেজ সে কখনোই করেনি।আবার তুমি করেও সম্বোধন করেছে। আজ কীভাবে করে ফেললো বুঝতেই পারেনি। হুঁশ আসতেই ম্যাসেজ রিমুভ করতে চাইলো সে। কিন্তু বিধিবাম,রিমুভ করার আগেই ম্যাসেজ সিন হয়ে গেল। নূরান ভেতরে ভেতরে ভীষণ ঘাবড়ে গেল। নাজানি নীলাম্বরী ম্যাসেজ দেখে কি ভাববে! যদি রেগে যায়! আর কথা না বলে! কেমন গলা শুঁকিয়ে আসতে শুরু করলো তার। নূরান খেয়াল করলো ম্যাসেজ সিন করার পরও কোনো রিপ্লাই আসছে না। টাইপ করতেও দেখা যাচ্ছে না। অস্থিরতা আরও বাড়ছে নূরানের। কপাল ঘেমে উঠেছে। হঠাৎ সব কেমন এলোমেলো লাগছে তার। মিনিট পাঁচেক পার হওয়ার পর ম্যাসেজ এলো। নূরান তড়িৎ গতিতে তা দেখলো। ম্যাসেজ এসেছে,
“শ্যামল মায়ায় হারাতে মন চায়
মন চায় ভাসতে তরঙ্গের দোলায়।
ফেরারি পাখির মুক্ত ডানার সঙ্গী হবো
রঙ্গিন পাল তুলে মেঘের উপর ভাসবো
হতে রাজি সঙ্গী তোমার
রাজি আমি বাঁধন হারা হবার।”
ম্যাসেজ টি পড়ে নূরানের অস্থির মনে শীতলতা ছেয়ে গেল। নিরব হাসি ফুটলো তার ঠোঁটের কোণে। এজন্যই বলে যা হয় ভালোর জন্যই হয়। ভুলে ম্যাসেজ দিয়ে ইতিবাচক ফলই পেয়েছে। এখন নূরানও সিওর। তার মনে যে মনোভাব কাজ করে, নীলাম্বরীর দিক থেকেও তেমনই আভাস পাওয়া গেল। নূরানের মনে প্রশান্তির আলোড়নে ভরে গেল। আজ আর কোনো রিপ্লাই দিলেনা সে। এই মনোভাবটাকে এখন শুধু অনুভব করতে চায় সে। জানালায় মাথা ঠেকিয়ে প্রকৃতির মাঝে নিজের অনুভূতিকে মিশ্রিত করলো নূরান।
গাড়ি চলছে আপন গতিতে। টাঙ্গাইল পার হচ্ছে প্রায়। তাসান বলে উঠলো,
“ব্রো, জার্নি অনেক বোরিং হচ্ছে। একটু গান বাজনা বাজাও না। একদম ঝাকানাকা একটা গান দাও। আমরাও একটু দেহ দুলিয়ে হেইলা দুইলা নাচি। “
আদ্রিতাও তাসানের সাথে সায় দিয়ে বলল,
“হ্যাঁ হ্যাঁ একটু গান বাজান না। অনেক মজা হবে।”
অপরাহ্ন বলল,
“আরে গান বাজানোর কি দরকার! এখানে দ্য গ্রেট নিবিড় দ্য রকস্টার থাকতে মিউজিক প্লেয়ারে গান শুনবো কেন! আরে কলেজে থাকতে তো নিবিড়ের গানের মহল জমে যেত।”
আদ্রিতা অবাক হয়ে গেল অপরাহ্নের কথা শুনে। এই দৈত্য দানব আবার গানও গাইতে পারে! গাব্বার সিং-এর মতো ভিলেন রুপী তেনার আবার এই গুনও আছে নাকি! তাসান বলে উঠলো,
“তো ভাই কিছু হয়ে যাক! “
নিবিড় গাড়ি চালাতে চালাতে বলল,
“আরে তোরাও কার কথা শুনছিস! ওসব অনেক আগের কথা। এখন আর আমার দ্বারা গান টান হয়না৷ আর তাছাড়া আমি এখন ড্রাইভ করছি। তোরাই গা।”
“ঠিক আছে আমরাই এক এক করে গাই। সবার প্রথমে আমি শুরু করছি। তো সাহেবান, মেহেরবান,কাদারদান, পানদান, থুকদান হিরো আলম আর অনন্ত জলিলের খানদান, শাকিব খানের হাজার খানেক সন্তান। তোমাদের সামনে পেশ করছি দ্য গ্রেট, দ্য ড্যাসিং, দ্য হ্যান্ডসাম, দ্য হট এন্ড হ্যাপেনিং, মধুর কন্ঠের অধিকারী, সুরের রাজা, এখন আপনাদের সামনে পেশ করছে এক নাগমা।”
রবি বলে উঠলো,
“আরে নাগের মা আসলো কোত্থেকে! তুৃমি না গান গাইবে! তো নাগ মাতাকে আনছ কেন! এখন কি আমরা বসে নাগিন ডান্স করবো নাকি!”
অপরাহ্ন বলে উঠলো,
“দেখ আমি আগে থেকেই বলে দিচ্ছি এসব নাগিন ডান্স হলে আমি খেলবোনা।”
তাসান বলে উঠলো,
“আরে ধুরর,তোদের মতো মূর্খ লোকদের নিয়ে হয়ে গেছে আরেক জ্বালা। আরে উর্দুতে গানকে নাগমা বলে। একটা শায়রানা ফিল আসে বুঝছস!”
“হালা তুইতো দেখতাছি রাজাকার।আমগো দেশের যুবকরা নিয়ে নিজের জীবন দিয়ে বাংলা ভাষা অর্জন করলো আর উর্দুর পাছায় লাথি মেরে বের করে দিলো। আর তুই কিনা সেই উর্দু আবার ঢুকাইতাছস! তোর মতো রাজাকারদের জন্যই আজ দেশ রসাতলে গেল”
রবি বলল,
“আচ্ছা আচ্ছা, যার জন্য এতো আয়োজন সেটাতো করো। গান গাও এখন। “
তাসান কয়েকবার গলা খাঁকারি দিয়ে গান ধরলো,
♬ ও টুনির মা তোমার টুনি কথা শোনে না
♬ দিনে রাইতে মিসকল মারে ফোন করে না
♬ ও টুনির মা তুমি টুনিরে বোঝাওনা
♬ যার তার লগে ডেটিং মারে আমায় চেনে না
♬ টুনি স্কুলে যাইবো, টুনি বারান্দায় আইবো
♬ টুনিরে দেইখা আমার পরাণ জুড়াইবো
♬ টুনি আমার জানের ই জান পরানের পরান
টুনির মা রে খাইতে দিমু সুপারি আর পান
টুনি বধু সাজব , টুনি লজ্জা পাইব
টুনিরে লইয়া আমি বাসর সাজব
টুনিরে লইয়া যাইমু আমি ফেন্টাসি কিংডম
লোকাল বাসে চইরা যামু খরচ হইব কম
টুনি আইসক্রিম খাইব , টুনি ঝালমুরি খাইব
টুনিরে লইয়া আমি নৌকা দৌড়াব
টুনিরে লইয়া যামু আমি ঢাকা মিরপুর
খাইতে দিমু দেশি চিরা লগে দিমু গুর
টুনি আমরিকা যাইব
টুনি মডেলিং করব
ফরেনার দেইখা তারে টাকা বিলাইবো
টুনির মুখে মিষ্টি হাসি দেখতে চমৎকার
টুনির মত একটি মেয়ে আমার দরকার
টুনি পাশে থাকব , টুনি ভাল বাসব
সুখে দুখে একি সাথে দিন কাটাব
ও টুনির মা তোমার টুনি কথা শুনেনা
যার তার লগে ডেটিং মারে আমায় চেনে নাহ…
তাসানের ঐতিহাসিক মেলোডি শেষে আদ্রিতা বলে উঠলো,
“এবার আমার পালা। এখন আমি গান গাইবো।”
আদ্রিতার কথা শুনে তাসান, সানভি আর তানহা একসাথে চিল্লিয়ে ভয়ার্ত কন্ঠে বলল,
“নেহিইইইইই………”
তাসান করুন সুরে বলল,
“বোইন মাফ কর আমগো। এই মাছুম মাছুম বাচ্চাগো উপরে একটু রহম কর। কি দোষ আমগো। এই ভরা যৌবনকালে ক্যান দিনদুপুরে মারবার চাস! আমিতো এহোনো বিয়াই করলান না! তোরে ফুপি বানানোর জন্য হলেও আমারে বাঁচতে দে! আমি না থাকলে বংশের হারিকেন নিভা যাইবো।”
সানভি বলল,
“হ্যাঁ অরি, রহম কর। মেকাপের কসম,খবরদার গান গাবিনা!”
তানহা বলল,
“দেখ অরি, তুই বরং গ্রামে গিয়ে গান গাস। এখানে না প্লিজ।”
অপরাহ্ন বলে উঠলো,
“আরে এভাবে বলছ কেন সবাই! বেচারি একটু গান গাইতে চাচ্ছে গাইতে চাচ্ছে তো গাইতে দাওনা।”
তাসান বলে উঠলো,
“ওই তুই চুপ থাক হাতুড়ি ডাক্তার। ওর গান শুইনা যখন পোলিও হইয়া যাইবো তখন বুঝবি হালা।”
“আরে ধুরর, মেয়েটা একটু গান গাইতে চাচ্ছে তাতে এতো কি এমন হবে। অরি বোনু তুমি গাও।”
আদ্রিতা আহ্লাদি কন্ঠে বলল,
“থ্যাংক ইউ অপু ভাইয়া। আসলে আমার সুরেলা কন্ঠ শুনে সবার হিংসা হয়। তাইতো গাইতে দিতে চায়না। কিন্তু আপনি আমার গান শুনলে শুধু শুনতেই চাইবেন।”
“আচ্ছা ঠিক আছে তুমি গাও আমি শুনবো।”
আদ্রিতা খুশি মনে গলা ঝেড়ে গানের জন্য প্রস্তুত হলো। সবাই এদিকে ভয়ে গাড়ি ভেঙে বেড়িয়ে যাবার রাস্তা খোঁজার যো। অতঃপর আদ্রিতা গান শুরু করলো। চোখ বন্ধ করে প্রথম সুর বের করলো,
♬ আআআআআ……
ব্যাস প্রথম সুরের ধ্বনিতেই অপরাহ্ন নিজের সিট থেকে পড়ে যাবার অবস্থা।পুরো গাড়ি যেন ভূমিকম্পের মতো কেঁপে উঠল। সবার হার্টে গ্রে,নে,ড হামলার মতো ফটাস করে ফেটে যাবার যোগাড়। আদ্রিতা গলা ছেড়ে ফাটা বাঁশের মতো কানে বোম ফাটানো মধুর সুরে গান ধরলো,
(গান স্কিপ করলে আসল মজা মিস করবেন কিন্তু।)
♬উত্তরে ভয়ংকর জঙ্গল
♬ দক্ষিণে না যাওয়াই মঙ্গল
♬ পূর্ব পশ্চিম দুই দিগন্তে নদী
♬ মাথায় নাই এক তোলা
♬ আমি দোলা আত্ত ভোলা
♬ ওরে আয় আয় আয় ডানা কাটা পরি
♬ আমি ডানা কাটা পরি তুমি বন্ধু কালা পাখি
♬ আমি যেন কি,
♬ বসন্ত কালে তোমায় চিনতে পারিনি
♬ সাদা সাদা কালা কালা মাইয়া
♬ ও মাইয়ারে তুই অপরাধী রে
♬ এই পরাণের ভালোবাসা দে ফিরাইয়া দে
♬ মাইয়া ও মাইয়ারে তুই লোকাল বাসরে বন্ধু
♬ তুই লোকাল বাস
♬ আদর কইরা ঘরে তোলোস
♬ ঘাড় ধইরা ভালোবাসবো ভাসবোরে বন্ধু
♬ তোমায় যতনে
♬ আমার মনের ঘরে আগুন লাগাইলো রে টিংকু
♬ আগুন লাগাইলো।
♬ প্রেমে পড়েছে মন,প্রেমে পড়েছে
♬ অচেনা এক রুব্বানে নাচে কোমড় দোলাইয়া
♬ হাজার মানুষ মন মানে না, মানে না
♬ মন মানে না
♬ প্রেমেরই নীল নীল নীলাঞ্জনা চোখ দুটো
♬ টানা টানা তিনদিন তোর বাড়িত গেলাম
♬ দেখা পাইলাম না বন্ধু তিনদিন
♬ গাঙ পার হইতে একখান চুম্মা দে
♬ কারেন্ট লাগাইলি
♬ দুইখান চুম্মা দে ভোল্টেজ বাড়াইলি
♬ ধিকিধিকি জ্বলে ধিকিধিকি
♬ বুকে আগুন লাগিল রে নেশা লাগিল রে
♬ বাঁকা দু নয়নে নেশা লাগিল রে
♬ হাসন রাজা কো রানী সে পেয়ার হো গায়া
♬ পেহলি নাজার মে পেহলা পেয়ার হো গায়া
♬ দিল মে হো তুম আখো মে তুম…
এভাবে একের পর এক গানের চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করে যাচ্ছে আদ্রিতা। গানের লিরিক্স গুলোকে মিক্স করে চাটনি বানিয়ে তার বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে। আর সুরের কথা বলাই বাহুল্য। তার গান নামক সিডোর আর আইলা তুফানে সবার হার্ট বেড়িয়ে দৌড়াদৌড়ি শুরু করেছে।অবশেষে নিজের প্রতিভার প্রদর্শন শেষে আদ্রিতা দেখলো তাসান, সানভি আর তানহা জিহ্বা বের করে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। রবি বাবা বুকে হাত দিয়ে নিজের হার্ট খুঁজছে। আর অপরাহ্ন তো বাজ পড়া মানুষের মতো টাস্কি খেয়ে বসে আছে। আজকের পর তার কান আর কাজ করবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে। আদ্রিতা গর্ব করে বলল
“বাহ! আমি কতো ভালো গান গাই। আমার মধুর কন্ঠ শুনে সবাই ঘুমিয়ে গেছে।
অপরাহ্ন নিবিড়ের দিকে তাকিয়ে দেখলো এতকিছুর মাঝে সে দিব্যি গাড়ি চালাচ্ছে। যেন তার উপর কোনো প্রতিক্রিয়াই হয়নি। অপরাহ্ন হাঁপাতে হাঁপাতে বিড়বিড় সুরে বলল,
” আই সেলুট ইউ বস। তোর ভালোবাসা আসলেই গ্রেট। নাহলে এখনো কীভাবে ঠিকঠাক থাকিস।”
নিবিড় কান থেকে তুলো বের করে বলল,
“কিছু বললি!”
এবারে অপরাহ্নও জ্ঞান হারালো। গাড়ি চালাতে চালাতে বাঁকা হাসলো নিবিড়। সামনের আয়নায় তাকিয়ে দেখলো নিজ মনে খুশি থাকা আদ্রিতাকে। যারজন্য নিবিড়ের কাছে সাত খু,ন হাসিমুখে মাফ।
চলবে…..