®মেহরুমা নূর
★”পুতুল,এই পুতুল ওঠ” ঘুমের মাঝেই গালে আলতো স্পর্শ আর নিজের নাম পরপর শোনার পর ঘুমে কাদা হয়ে লেপ্টানো নেত্রপল্লব কোনরকমে টেনে সামান্য খুলতে সক্ষম হলো আদ্রিতা। তবে ঘুমের ঘোর এখনো কাটেনি তার। এতো গভীর ঘুম থেকে সজাগ পাওয়া তারজন্য অতি দুষ্কর। ঘুম জড়ানো চোখ মেলে তাকিয়ে নিবিড়ের মুখখানা নিজের মুখের সামনে ঝুঁকে থাকা দেখতে পেল। ঘুমের ঘোরে থাকা আদ্রিতা ভাবলো সে স্বপ্ন দেখছে। সামান্য হেঁসে ঘুমো ঘুমো কন্ঠে বলে উঠলো,
“আপনি এসেছেন! হুম স্বপ্নেইতো আসবেন। তাছাড়া কি আর এমুখো হবেন!”
নিবিড় কিঞ্চিৎ হেঁসে বলল,
“আচ্ছা! তোর মুখো হওয়া না হওয়াই কি তোর কিছু যায় আসে! মহারানীর আশেপাশে তো ভক্তগণের ছড়াছড়ি। আমার মতো নগন্য ব্যক্তিকে দেখার সময় কই তোর তাইনা!”
আদ্রিতা নিবিড়ের ঠোঁটের উপর তর্জনী আঙুল চেপে বলল,
“হুঁশ, এত কথা বলেন কেন আপনি! এটা আমার স্বপ্ন। আমার স্বপ্নে শুধু আমার বলার অধিকার আছে। আপনি চুপচাপ ভদ্র ছেলেটি হয়ে বসে বসে শুধু শুনবেন। নাহলে পিট্টি দেবো আমি।”
নিবিড় এক ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
“আচ্ছা তাই নাকি! দাঁড়া দেখাচ্ছি এখুনি কে কাকে পিট্টি দেয়।”
নিবিড় হাতের মুঠোয় পানি নিয়ে আদ্রিতার মুখের উপর ছিটা মারলো। সাথে সাথে ঘুম পুরোপুরি উড়ে গেল আদ্রিতার। ধড়ফড়িয়ে উঠলো সে। সম্মুখে নিবিড়কে দেখে হকচকিয়ে যায়। আশেপাশে তাকিয়ে আরও বড় রকমের ঝটকা খায় সে।তারতো ভালভাবে মনে আছে সে ঘুমানোর সময় নিজের বিছানাতেই ছিলো। তাহলে এই নৌকায় কীভাবে এলো ও! নাকি স্বপ্ন দেখছে সে! আদ্রিতা দু চোখ আঙুল দিয়ে ভালোভাবে ডলে নিয়ে আবারও চোখ মেলে তাকালো। নাহ, এখনো নিজেকে নৌকাতেই দেখছে। আর আশেপাশে পানির থইথই জলরাশি। অবাক, বিস্মিত চোখে নিবিড়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আ….আমি এখানে কীভাবে এলাম! আর আপনিই বা কি করছেন এখানে!”
নিবিড় চোয়াল চিবিয়ে বলল,
“লুকোচুরি খেলতে এসেছি। এইযে আমি গিয়ে এই পানির ভেতর লুকাবো আর তুই আমাকে খুঁজে বের করবি।কি পারবিনা!”
আদ্রিতা বোকার মতো তাকিয়ে বলে উঠলো,
“কিন্তু আমিতো সাতার জানিনা। তাহলে কীভাবে খেলবো!”
আদ্রিতার উত্তরে নিবিড়ের চোয়াল যেন আরও শক্ত হয়ে এলো। সে দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
“তুই কি আসলেই এমন টপ লেভেলের বলদি, নাকি আমার জন্যই তোর সব বলদিগিরি বরাদ্দ রেখেছিস! আমার সামনেই তোর এই প্রতিভার প্রদর্শন করতে নেমে পড়িস! ভালো একটা মুডের কচুঘাটি করতে খুব এক্সপার্ট তুই। এখন চুপচাপ বসে থাক এখানে। একটা কথাও বলবিনা।নাহলে পানিতে ছুঁড়ে মারবো।”
আদ্রিতা মুখ নারাজ করে বসে রইল। রাগতো হচ্ছে প্রচুর। কিন্তু পানিতে ডুবে মরার শখ নেই আপাতত। এই দৈত্য দানবের মতিগতির ভরসা নেই। রাতের অন্ধকারে পানিতে চুবিয়ে মে,রে রেখে গেলে কে বাঁচাবে তাকে! সকালে তার ম,রা লা,শটা ভেসে বেড়াবে পানিতে। কি ভয়ানক ব্যাপার স্যাপার! না না তারচেয়ে চুপ থাকাই শ্রেয়। এমনিতেও উনার সাথে কথা বলার ইচ্ছে নেই আদ্রিতার। তখনতো একবার ফিরেও তাকাচ্ছিল না। যেন তার নজর থেকে আদ্রিতা নামক তুচ্ছ প্রাণীটিকে ইরেজার ঘষে মুছে দিয়েছে। তো এখন এখানে আসার মানে কি! আর আমাকেই বা কেন এনেছে! বদ লোকের মগজে কি চলছে! যা খুশি চলুক। আমার তাতে কি। আমিতো আর কথাই বলবোনা হুহ্।
আদ্রিতা অভিমান করে নৌকার মাঝখানে অন্য দিকে ঘুরে বসে রইল। একটু পরেই নৌকা ধীরে ধীরে অগ্রসর হতে লাগলো। আদ্রিতা আরচোখে তাকিয়ে দেখলো নিবিড় নিজেই বৈঠা হাতে নৌকা চালাচ্ছে। বিস্ময় আবারও চমকিয়ে দিলো তাকে। নিবিড় ভাইয়া নৌকা চালাচ্ছে! উনি এটাও পারে! কিন্তু যাচ্ছে কোথায় আমাকে নিয়ে! আদ্রিতার খুব জানতে ইচ্ছে তার মনে জাগ্রত প্রশ্নের উত্তর। তবে অভিমানের সামনে সেই ইচ্ছে দমে গেল আদ্রিতা। কথা না বলার পণ কায়েম রাখবে সে। নৌকা ধীরে ধীরে বিলের মাঝের দিকে যাচ্ছে। যত এগুচ্ছে তত চারিদিকে শাপলা ফুলের শুভ্র সৌন্দর্য দৃশ্যমান হচ্ছে। তা দেখে আদ্রিতার বিস্ময় বাড়ছে। হঠাৎ তার মনে পড়লো এটাতো জোভানের দেখানো সেই ছবিটার মতোই জায়গা৷ তাহলে কি এটাই সেই বিল! আজকে রাতেতো জোভানের সাথে সবাই মিলে আসার কথা ছিল এখানে। কিন্তু তখন মন খারাপ হওয়ায় সেই প্ল্যানের কথা ভুলেই গিয়েছিল আদ্রিতা। তারপরতো কাঁদতে কাঁদতে কখন ঘুমিয়ে গেছে মনেই নেই। তাহলে কি নিবিড় ভাইয়া আমাকে ঘুমের মাঝে আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে! কিন্তু কেন! মনের মাঝে প্রশ্নের পাহাড় জমছে। কাকে শুধাবে সে! আপাতত সেসব ভাবার আর সময় নেই। এখনতো এই মোহনীয় প্রকৃতির অসীম সৌন্দর্যে নিজেকে হারাচ্ছে আদ্রিতা। চারিদিকে যেন অপরুপ মনকাড়া চিত্র।পানির উপর দিয়ে শাপলা ফুলের সমারোহ যেন মনকে দারুণ পুলকে দুলিয়ে দিচ্ছে। আকাশে রুপালী চাদের আলো। যে আলোয় পরিবেশ আরও স্নিগ্ধতায় ভরিয়ে দিচ্ছে। মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে হৃদয়ের পারদে পারদে। সাথে ঠান্ডা শীতল পবন আরও স্ফুর্তিতে ভরিয়ে দিচ্ছে শরীর মন। মনের বিষন্নতা ছাপিয়ে সেথায় ছেয়ে যাচ্ছে একরাশ প্রশান্তি। ভালো লাগারা চারিদিক থেকে জাপ্টে ধরছে যেন। চোরা চোখে তাকিয়ে মাঝি হওয়া নিবিড়কে দেখলো আদ্রিতা।নিজের মতো বৈঠা দিয়ে পানিতে ছলাৎ ছলাৎ ধ্বনি তুলে নৌকা চালাচ্ছে। চাঁদের রুপালী আলোয় এই মানবটিকেও যেন আরও মোহময় দেখাচ্ছে। বিয়েতে পড়া পোশাকেই আছেন জনাব এখনো। এত হ্যান্ডসাম, স্টাইলিশ আর সোফিস্টেকেটেড মাঝি জাতি কখনো দেখেছে কিনা সন্দেহ। আজতো এই নৌকার জন্ম সার্থক। দ্য গ্রেট, শাহরিয়ার বংশের আন,বান শান মিঃ নিবিড় শাহরিয়ার স্বয়ং তাকে চালিয়েছে। নৌকার জীবন ধন্য। বেচারা নৌকা এতো খুশিতে কেঁদে না ফেলে৷ শেষে বিলের পানি বেড়ে বন্যা হয়ে যাবে তখন৷ নিজের ভাবনার উপর নিজেরই হাসি পেল আদ্রিতার। এবং তখনই খেয়াল হলো আদ্রিতার সব অভিমান, রাগ যেন লুঙ্গি তুলে পালাচ্ছে। আদ্রিতা চেয়েও ধরে রাখতে পারছেনা রাগটাকে। সে কত করে বলছে “এই রাগ আরেকটু থাকনা! এমন করছিস কেন! দেখ চকলেট দেবো তোকে, আমার লক্ষি,কিউট রাগসোনা আর কিছুক্ষণ থাকনা! এভাবে মাঝপথে আমাকে ফেলে যাসনা।” কিন্তু রাগ বেটা ঘাড়ত্যাড়া, সে যেন কোনমতেই থাকবেনা৷ আদ্রিতার আকুতি মিনতি পায়ের তলে পদদলিত করে রাগ বেটা ওকে ছেড়ে চলেই গেল। থেকে গেল শুধু ভালো লাগাময় স্নিগ্ধতা। তবে আদ্রিতা সেটা বাহিরে দেখালোনা। রাগ ওকে ছেড়ে চলে গেছে সেটা রাগ জানে আর আদ্রিতা জানে। উনিতো আর জানে না। আর তাকে জানাবও না। এই মনোভাব নিয়েই বসে রইল আদ্রিতা।আপাতত মুগ্ধতার অতলে গহ্বরে হারানোয় মনোযোগ দিলো সে।
নৌকা বিলের মাঝামাঝি আসতেই তার গতি থেমে গেল হঠাৎ। আদ্রিতা প্রকৃতির অপরুপ মহিমায় আবেশিত ছিলো। চারপাশের শাপলা ফুলের মাঝখানে ওদের নৌকা এখন অবস্থান করছে। এমন অভূতপূর্ব হৃদয় জুড়ানো সৌন্দর্যে ডুবে থাকা আদ্রিতার খেয়াল নেই নৌকা কখন থেমে গেছে। সেতো এখন অন্যই এক রাজ্যে হারিয়ে গিয়েছে। যেখানে কেবলই মোহনতা মোহনতা। যে মোহনীয়তার আবেশ থেকে ফিরতে চায়না আদ্রিতা। এখানে আজীবন বাস করলেও মন্দ হবে না। তবে ফিরতে হলো আদ্রিতাকে। যখন বৈঠা রেখে নিবিড় উঠে তার দিকে হেঁটে আসতে লাগলো সেই শব্দ পেয়ে ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকালো সে। আদ্রিতার চোখেমুখে তখনও আবেশের শীতলতা লেগে আছে। যে আবেশ ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই নিবিড় উঠে এসে আদ্রিতার সম্মুখে এসে বসলো। অপলক, মায়াময় দৃষ্টি স্থির করলো আদ্রিতার পানে। নজরের প্রতিটি স্তরে স্তরে সীমাহীন মায়ার উত্তাল তরঙ্গ উপচে পড়ছে। এই চাহুনি আদ্রিতার জন্য হৃদকম্পন সৃষ্টকারী ঝড়। খুব একটা দেখা যায় না এই চাহুনি। তবে যখনই দেখা দেয় আদ্রিতার অন্তর্দেশ ঝংকারিত করে দেয়। দ্রবীভূত হয়ে যায় তার দেহ মন। বোধশক্তি সব বিলীন হয়ে যায় যেন তখন। শুধু থমকিত আঁখি যুগল অবশিষ্ট থেকে যায়। সেই আঁখি যুগলে কেবলই অসীম মোহঘোর। প্রমত্ত নয়নে তাকিয়ে রইলো আদ্রিতা নিবিড়ের পানে। দুজনের নজর দুজনায় নিমজ্জিত। নয়ন থেকে নয়নে চলছে অব্যক্ত অনুভূতির আদান-প্রদান। নিবিড়ের চোখে মাদকতা। সেই চাহুনি স্থির রেখে আদ্রিতার গালে নিজের হাতটি রাখলো পরম আদরে। কানের নিচে চার আঙুল রেখে, বৃদ্ধাঙ্গুলে আদ্রিতার কোমল গালে বুলিয়ে দিয়ে মোহাচ্ছন্ন সুরে বলল,
“তুই ওই আকাশের চাঁদ নস ।যাকে দূর থেকে দেখেও হাজার জন মন জুড়াবে। তুই হলো তপ্ত সূর্য। যার দিকে কেউ তাকানোর সাহসও পাবেনা। শুধু একমাত্র আকাশ তাকে নিজের মাঝে সামিল করে রাখে।”
আদ্রিতা নিবিড়ের কথার মর্ম কতটুকু বুঝলো তা জানে না। তবে হঠাৎ যেন তার মাঝে আবেগের এক বাঁধ ভাঙা সমুদ্র উপচে পড়ছে। সেই আবেগের প্রতিচ্ছবি তার চোখের নজরে ভেসে উঠছে। হঠাৎ যেন তার কেমন কান্না পাচ্ছে। টলমল চোখে একধ্যানে তাকিয়ে আছে সে নিবিড়ের পানে। নিবিড় আরও বলল,
“তোর সব আবদার,সব চাহিদা, সব আকাঙ্খা পূরণের জন্য শুধু একজনই বরাদ্দ করা আছে। তাছাড়া আর কারোর সেই স্পর্ধা নেই। তোকে পাওয়াতো দূরের কথা, সেই আশাটাও কারোর মনকে পুলকিত করার অধিকার নেই। তোকে নিয়ে কারোর মনে কোনো বাসনা থাকাও অসামান্য অপরাধ। যে অপরাধের শাস্তি ভয়াবহ। যে ভয়াবহতার চিত্র ভাবনাতেও আনা দুষ্কর। আমার শীতল সমুদ্রকে উত্তাপ করিসনা৷ নাহলে এমন ঝড় আসবে তাতে শুধু ধ্বংসলীলা ছাড়া আর কিছুই পাবিনা।”
এই পর্যায়ে আদ্রিতার চোখের টলমল নোনাজল টুকু গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো। তুমুল অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ স্বরুপ তা অশ্রু হয়ে ঝড়ে পড়লো যেন৷ সেই অনুভূতির ঝড়কে আরও প্রলয়ঙ্কর রুপ দিলো নিবিড়। যখন মুখ নামিয়ে আদ্রিতার অশ্রুভেজা চোখের নেত্রপল্লবে নিজের অধর গভীর ভাবে ছোঁয়াল নিবিড়। আদ্রিতার অশ্রুভেজা চোখের উপর অধর ছুঁইয়ে কিছু সময় সেভাবেই চেপে রাখলো নিবিড়। তারপর একইভাবে আরেক চোখেও অধর ছুঁইয়ে রাখলো। আদ্রিতার অভ্যন্তরীণ ঝড় এবার প্রবল আকার ধারণ করলো। যে স্রোতে আদ্রিতার সর্বস্ব যেন ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। অনুভূতির প্রবল তোড়ে পারছেনা সে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে। অতল গহ্বরের তলদেশে তলিয়ে যাচ্ছে সে। নিঃশ্বাসও তার সমর্থন করছেনা। হৃৎস্পন্দনের তুমুল আলোড়ন আদ্রিতাকে অবশ করে দিচ্ছে। আবেগের এমন তীব্রতায় নুইয়ে গেল আদ্রিতা। যার প্রভাব স্বরুপ হঠাৎ ফুঁপিয়ে উঠলো আদ্রিতা।
নিবিড় কতক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলো আদ্রিতাকে। যেন অনেক বিনোদনীয় কিছু দেখছে সে। অতঃপর ধমকের সুরে বলে উঠলো,
“এমন ভাবে কাঁদছিস যেন তোকে এইমাত্র আমি প্রেগন্যান্ট করে দিয়েছি! তুইতো বহুত সাংঘাতিক মহিলা দেখছি। এই মাঝরাতে কেঁদে কেটে আমাকে বদনাম করার ধান্দায় আছিস। আমার মতো ভদ্র সদ্র ছেলেটার সাদা গায়ে কাঁদা লাগাতে চাচ্ছিস! এমন রিনা খান টাইপ চিন্তাধারা পোষণ করতে শিখে গেছিস। ছিঃ ছিঃ ছিঃ… বড়-মা, বড়-বাবা জানলে কি ভাববে! তাদের আদরেরে মেয়ের এমন অবনতি দেখে তারা নির্ঘাত নির্বাসনে চলে যাবে।”
আদ্রিতার কান্না আর সেকেন্ডও টিকলোনা। পালিয়ে যাওয়া রাগটা আবার অলিম্পিকের দৌড়ে গোল্ড মেডেলিস্টের মতো ছুটে আদ্রিতার কাছে ফিরে এলো। এবারে আরও তীব্র মাত্রা নিয়ে ফিরলো রাগটা। রাগী সত্তাটা খুব করে চাইলো এই দৈত্য দানবটাকে উঠিয়ে পানিতে ছুঁড়ে মারতে। একটা লোক কতটা অসভ্য হতে পারে তার ব্যাকরণ জানতে চাইলে এই লোকটাকে দেখা উচিত। মানে মুহুর্তেই এতো রঙ কেউ কীভাবে বদলায়! গিরগিটিও এতো জলদি রঙ বদলায় না যত জলদি এই অসহ্যকর লোকটা বদলায়। রাগে শরীর পুড়ে যাচ্ছে আদ্রিতার। রাগে আর কোনো কথাই বলতে ইচ্ছে হলোনা আদ্রিতার। কিছু বললেও এই লোক সেটা নিয়ে উল্টো আরও অসভ্য কথা শোনাবে। তাই আদ্রিতা নিবিড়ের কাছ থেকে সরে গিয়ে নৌকার আরেক মাথায় গিয়ে অভিমান করে উল্টো ঘুরে বসে রইল। কথা না বলার পণ আবারও জারি রাখলো সে। নিবিড় সে পানে তাকিয়ে নিজ মনে কিঞ্চিৎ হাসলো।
কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পরও নিবিড়ের কোন কথা পেলনা আদ্রিতা। এতে যেন তার অভিমানের পাল্লা আরও ভারি হলো। স্থগিত কান্নাটা পুনরায় চালু হতে চাইলো। তখনই হঠাৎ পেছন থেকে নিবিড় বলে উঠলো,
“শুনেছি রাতে নাকি এই বিলের পানি থেকে জলের পেত্নীরা উঠে আসে। উঠে এসে নৌকার মেয়েদের টেনে নিয়ে যায় নিজেদের পেত্নীরাজ্যে। যাক ভালোই হবে। এটলাস্ট তুই তোর আসল জনগোষ্ঠীর সাথে তো দেখা করতে পারবি।তুই নিশ্চয় অনেক খুশি হবি তাইনা!”
ভীতু আদ্রিতার কলিজায় আতঙ্ক সৃষ্টি করার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট ছিলো। লোকটা যে ইচ্ছে করে আদ্রিতাকে ভয় দেখানোর জন্য এমন ভুতুড়ে কাহিনি শোনাল তা ভালোই বুঝতে পারছে আদ্রিতা। তবুও ভয় নামক জলদস্যুটা ঠিকই আদ্রিতার সব সাহসের হ,ত্যা করে দিলো। পানির দিকে তাকাতেও এখন ভয় করছে তার। মনে হচ্ছে এই বুছি লম্বা একটা হাত এসে ওকে টেনে নিয়ে চলে যাবে। ভয়ে কলিজা কিডনিতে ঢুকে যাওয়ার অবস্থা। ভয়ের জোরে আদ্রিতা নিজের রাগ অভিমান বজায় রাখতে পারলোনা। ভয়ের হাতে পরাজিত হয়ে আদ্রিতা ধীরে ধীরে পেছাতে লাগলো। পেছাতে পেছাতে একসময় উপলব্ধি করলো সে নিবিড়ের কাছে এসে পড়েছে। কাঁধে নিবিড়ের নিঃশ্বাসের ছোঁয়া পাচ্ছে। আবারও জমে গেল সে।মৃদু কম্পন সৃষ্টি হলো স্নায়ুকোষে। দুই হাত মুঠ করে বসে ধীরে ধীরে ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে তাকাতেই নিবিড়ের নাকের সাথে নাক লেগে গেল আদ্রিতার। নজর ঠেকলো নিবিড়ের একাগ্র দৃষ্টিতে। ওই দৃষ্টির।সামনে আদ্রিতার দৃষ্টি পরাজিত হয়ে গেল। সাথে সাথে নজর নামিয়ে ফেললো সে।নাকে নাক ঠেকে নিবিড়ের নিঃশ্বাসে মিলল আদ্রিতার ভারী নিঃশ্বাস। মৃদু কম্পন বুঝি এবার তার মাত্রা বাড়িয়ে আদ্রিতার জান কেঁড়ে নেওয়ার পণ করলো। নিঃশ্বাস যেন তার যাত্রাপথ ভুলে গেল। আদ্রিতা অনুভব করলো নিবিড়ের নিঃশ্বাস কেমন অশান্ত মনে হচ্ছে। যেন কতশত কালের পিয়াসী সে। আদ্রিতার হৃদগুহে পীড়ন হলো খুব। এ পীড়া সইতে না পেরে চোখ বুঁজে ভারী নিঃশ্বাস ফেলতে লাগলো সে।
কিছুক্ষণ পর হঠাৎ কানের কাছে ঠান্ডা পানির ফোটার স্পর্শ পেয়ে চকিত নজরে চোখ মেলে তাকালো আদ্রিতা। নিবিড় পানিতে হাত দিয়ে একটা শাপলা ফুলের কলি তুলে এনে আদ্রিতার কানে পড়িয়ে দিলো। কানের পিঠে ফুলের কলি গুঁজে দিয়ে গালে হাত রেখে মায়াবী সুরে বলল,
“মেয়ে তুই প্রাণঘাতী বিষাক্ত বিষ,
তোর দাবদাহে লৌহ মানবও পুড়ে শেষ।”
আদ্রিতার কাছে এখন নিবিড় হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে ষড়যন্ত্রকারী ব্যক্তি। যে আদ্রিতাকে মুহুর্তে জ্বালায় আবার মুহুর্তেই হীম শীতল করে জমিয়ে দেয়। আদ্রিতাকে এ কেমন খেলা খেলে সে! আদ্রিতা যে এ খেলায় বরাবরই নিজেকে পরাজিত পায়। পীড়া দেয় তাকে এই যাতনা। অনুভূতি গুলোকে ছন্নছাড়া অগোছালো করে দেয়। তখন আদ্রিতা নিজেকে গভীর অরণ্যে হারাতে বসে।
নিবিড় আদ্রিতার কপালে পরম ভালোবাসার অধর ছুঁইয়ে চুমু খেয়ে কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলল,
“এই কলির মতোই পবিত্র তুই। উন্মাদ ভ্রমরার নিজস্ব যতনে গড়া অরণ্যের একমাত্র কলি তুই। শুধুমাত্র তার ছোঁয়াতেই হবি কলি থেকে ফুল তুই।”
আদ্রিতার কি হলো কে জানে! হঠাৎ যেন অন্য এক জগতে হারিয়ে গেল সে। দ্রবীভূত হয়ে ধীরে ধীরে মাথা নামিয়ে নিবিড়ের বুকে মাথা ঠেকালো আদ্রিতা। সেই পরিচিত সুবাসে নিঃশ্বাসে মুগ্ধতা ছড়ালো। কান পেতে শুনতে পেল নিবিড়ের হৃৎস্পন্দনের সুরধ্বনি। যেটা এমুহূর্তে যেন খুব বেশিই দ্রুত বেগে বাজছে। যেন চামড়ার আবরণ ভেদ করে বেড়িয়ে আসবে বুঝি এখুনি। আদ্রিতা মাথাটা আরেকটু মিশিয়ে নিলো নিবিড়ের হৃৎস্পন্দনের কাছাকাছি। হঠাৎ অনুভব করলো নিবিড়ও আলতো হাতে আদ্রিতাকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়েছে। ধীরে ধীরে আদ্রিতাকে বুকে নিয়েই নৌকার উপর আস্তে করে শুয়ে পড়লো নিবিড়। আদ্রিতাও নিবিড়ের উষ্ণতা পেয়ে চুপটি মেরে মিনি বিড়ালের মতো বুকে পড়ে রইল। এখন এমুহূর্তে শুধুই প্রশান্তি যেন মনজুড়ে৷ কোন বাক্যের এখন প্রয়োজন মনে হচ্ছে না। তবে মৌনতা ভেঙে হঠাৎ নিবিড় বলে উঠলো,
“শোন,ওই জোভান টোভান থেকে দূরে থাকবি। একবারই বললাম দ্বিতীয়বার বলার প্রয়োজন আসলে আমার মুখ নয় অন্য অঙ্গ কথা বলবে।যা কারোর জন্যই শুভ হবেনা। আশা করি বুঝতে পারছিস।”
নিবিড়ের কথায় আদ্রিতার ভ্রু কুঁচকে আসলো। হঠাৎ যেন সে সবকিছু ধীরে ধীরে ক্লিয়ার করতে পারলো। এপর্যায়ে যেন সব বুঝতে পারলো। নিবিড়ের উপেক্ষা থেকে শুরু করে হঠাৎ এখানে আসা, সবটাই যেন পানির মতো পরিষ্কার হতে লাগলো। জোভানের আচার-আচরণ কথা বার্তায় আদ্রিতা একটুখানি আচ করতে পারছিল জোভানের মনে তাকে নিয়ে আকাঙ্খা আছে হয়তো। তবে নিবিড় ভাইয়ার কথায় সে এবার পুরোপুরি শিওর হয়ে গেল যে জোভান ওকে নিয়ে অন্য রকম ফিলিংস রাখে। এমনটা জানলে সে আগে থেকেই দূরত্ব বজায় রাখতো। আর না জনাব এতো রুষ্ট হতো আমার উপর। কিন্তু আপাতত ওসব তিক্ত কথা ভাবতে চায়না আদ্রিতা। এই মুহুর্তটাকে নষ্ট হতে দিবেনা। আদ্রিতা কি মনে করে হঠাৎ বলে উঠলো,
“একটা গান গাবেন, প্লিজ…!
ফট করে কথাটা বলেই চোখ মুখ বুঁজে নিজেকে রাম ধমক খওয়ার জন্য আগে থেকেই প্রস্তুত করে নিলো। মনে মনে দোয়া চাইলো, আর যা করুক এখন আবার পানিতে ছুঁড়ে না মারে। কিন্তু আদ্রিতাকে আরও অবাক করে দিয়ে নিবিড় বলে উঠলো,
“বাহ! নিজেকে মনে হয় সত্যি সত্যিই মহারানী ভেবে নিয়েছিস আর আমাকে তোর দরবারের পার্সোনাল দাস। মহারানীর আকাঙ্খা বেড়েই চলেছে। চল ঠিক আছে, তুইও কি মনে রাখবি নিবিড় শাহরিয়ার কত মহৎ ব্যক্তি। তোর মতো পেত্নীরও বাসনা পূরণ করার মতো মহান আমি। এই মহানত্বের জন্য কোনো বাহবা দিবিনা কিন্তু। আমার শো অফ পছন্দ না। তবে হ্যাঁ গান শোনার মাঝে কিন্তু একদম নড়াচড়া করে আমাকে ডিস্টার্ব করবিনা। চুপচাপ থাকবি এভাবে।”
অতঃপর নিবিড় আদ্রিতাকে এক হাতে বুকে জড়িয়ে সুর ধরলো,
♬ উড়েছে মন, পুড়েছে মন
যা ছিল আমার সবই তোর হাতে
আকাশে দৃষ্টি তোর, বৃষ্টি তোর
মনে মেঘ জমে
জানালার হাওয়াতে, ছাওয়াতে
মনের রোদ কমে
দিন শুরু তোর কথায়
তুই ছাড়া নামে না রাত
চাঁদ থেকে
চল হারাই সব ছেড়ে
তোর সাথেই ফুরোবে দিন
আজ থেকে
উড়েছে মন, পুড়েছে মন
যা ছিল আমার সবই তোর হাতে
উড়েছে মন, পুড়েছে মন
যা ছিল আমার সবই তোর হাতে
আকাশে দৃষ্টি তোর, বৃষ্টি তোর
মনে মেঘ জমে
জানালার হাওয়াতে, ছাওয়াতে
মনের রোদ কমে
লিখে যাই, গল্প না থাকুক
ভুলে যাই যন্ত্রণাটুকু
মন আমার তোর ইশারায়
খুঁজে বেড়ায় স্বপ্ন স্বপ্ন দেশ
দূরে যায়, অল্প অল্প সে
সত্যি না, গল্প গল্প সে
মন আমার সবই হারায়
খুঁজে বেড়ায় তোরই যে আবেশ
দিন শুরু তোর কথায়
তুই ছাড়া নামে না রাত
চাঁদ থেকে
উড়েছে মন, পুড়েছে মন
যা ছিল আমার সবই তোর হাতে
আকাশে দৃষ্টি তোর, বৃষ্টি তোর
মনে মেঘ জমে
জানালার হাওয়াতে, ছাওয়াতে
মনের রোদ কমে
চলে যাই দু’চোখের পথে
বলে যাই কথা তোরই যে
মন আমার ভবঘুরে যাবে দূরে
তোকে না পেলে
কেন তুই দূরে দূরে বল
আকাশে উড়ে উড়ে চল
মিশে যাই এই আকাশে তোর বাতাসে
পাখনা মেলে
দিন শুরু তোর কথায়
তুই ছাড়া নামে না রাত
চাঁদ থেকে
উড়েছে মন, পুড়েছে মন
যা ছিল আমার সবই তোর হাতে
আকাশে দৃষ্টি তোর, বৃষ্টি তোর
মনে মেঘ জমে
জানালার হাওয়াতে, ছাওয়াতে
মনের রোদ কমে……
চলবে…..