®মেহরুমা নূর
★বিয়ের আনন্দ উল্লাস শেষে এবার ঢাকায় ফেরার পালা এলো সবার৷ সকাল সকাল উঠে সবাই নিজেদের ব্যাগপত্র গোছাতে লেগে গেছে।তবে ঘুমকুমারী আদ্রিতা রানী এখনো ঘুমের দেশে আচ্ছন্ন। তানি এসে কয়েকবার আদ্রিতাকে ডাকলো। তবুও উঠার খবর নেই। শেষে এসে ঠেলে ঠেলে অনেক কষ্টে জাগালো আদ্রিতাকে। আদ্রিতার ঘুম থেকে উঠতে ইচ্ছে করছেনা একদম। সে উঠে বসে তানির কোমড় পেঁচিয়ে ধরে পেটে মাথা রেখে ঘুম জড়ানো গলায় বলল,
“ঘুমুতে দাওনা সোণা মা। আর পাঁচ মিনিট প্লিজ..
” একদম না। উঠ এখন। অনেক বেলা হয়ে গিয়েছে। একটু পরেই আমাদের ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হতে হবে।”
“ঢাকায় কেন যেতে হবে! আমার যেতে ইচ্ছে করছেনা গ্রাম থেকে। আমরা এখানেই থাকি না। অনেক মজ হবে। চাচ্চু লুঙ্গি পড়ে খেতে চাষ করবে আর তুমি আঁচল দিয়ে ঢেকে চাচ্চুর জন্য খাবার নিয়ে যাবে। আঁচল দিয়ে চাচ্চুর ঘর্মাক্ত ক্লান্ত মুখটা মুছে দিবে। আহা,ভাবতেই কত মজা লাগছে। ভালো আইডিয়া না বলো!”
“হ্যাঁ তাতো হবেই। আর তুই গরুর গবর দিয়ে ঘষি (চুলোয় জ্বালানোর বস্তু) বানিয়ে রোদে শুকাবি। কি পারবিনা! “
এপর্যায়ে আদ্রিতা তানিকে ছেড়ে দিয়ে মুখ কুঁচকে বলল,
“ইয়াক! এত সুন্দর আইডিয়াটাকে একেবারে গোবরে মিশিয়ে দিলে তুমি।”
তানি হেঁসে দিয়ে বলল,
“স্বপ্নের দুনিয়া থেকে বের হয়ে এলে এবার দ্রুত রেডি হয়ে আয়। নাহলে কিন্তু তোকে রেখেই চলে যাবো আমরা।কদিন পর মিডটার্ম এক্সাম তা ভুলে গেছিস! বসে বসে কল্পনার জগতে ভাসছেন উনি।”
আদ্রিতা মুখ ফুলিয়ে উঠে গেল ফ্রেশ হতে।
__
নূরান সকাল সকালই তার সব গুছিয়ে নিয়েছে। গ্রামের আঁকা ছবিগুলো সে এখানেই দেয়ালের সাথে লাগিয়ে দিয়েছে। এগুলো আর নিয়ে যাবেনা সে। সব গোছানো শেষে নূরান তার ফোনটা হাতে নিলো। কাল থেকে আর মেয়েটার সাথে কথা হয়নি। গ্রামে নেটওয়ার্ক অনেক উইক। তাই ঠিকমতো কথাই হয়না। আজ বলে দিবে সে ঢাকায় যাচ্ছে। ফোন অন করে দেখলো নীলাম্বরীর আইডি এখন সবুজ দেখাচ্ছে। নূরান ফটাফট ম্যাসেজ দিলো,
“কি করছ?”
ম্যাসেজ সিন হলো কিন্তু রিপ্লাই এলোনা। নূরান আবার টেক্সট দিলো,
“রাগ করেছ নাকি!”
এবার কিছুক্ষণ পর রিপ্লাই এলো,
“নাতো,রাগ কেন করবো! তাছাড়া কোন অধিকারেই বা রাগ করবো! রাগ একটা স্ট্রং ফিলিং। এটার সাথে অনেকগুলো শর্ত নিয়ে আসে সে। যার মধ্যে একটা হলো অধিকার। রাগ করার মতো অধিকারবোধ আমার কি আছে!”
নূরান রিপ্লাই দিলো,
“অধিকার! হুম, অধিকারবোধ খুবই গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। আর অনেকটা অদ্ভুতও বটে। অধিকার কখনো ঘোষণা দিয়ে আসে না। বলেনা,”এই যে শুনছ আমি এসে গেছি। আমাকে গ্রহণ করো।” অধিকার আছে, না আছে সেটাতো তখনই উপলব্ধি করা যায় যখন অধিকার ফলাতে শুরু করো। আর যার উপর অধিকার ফলাতে শুরু করো, সে তোমার অধিকারবোধকে নিজের অধিকারে সামিল করে নেয়।তাই অধিকার না ফলালে বুঝবে কীভাবে! হতে পারে তোমার অধিকার ফলানোটাই সে খুব করে চাইছে।একবার অধিকার ফলিয়েই দেখোনা!”
“কিন্তু আমার যে ভয় করে। অধিকার ফলানো যদি অনধিকার চর্চা হয়ে উঠে তা যে ভীষণ পীড়াদায়ক হবে।”
“বালিকা ভয়কে করো জয়
পীড়ার ভয় ভুলে অগ্রসর হও
প্রাপ্তির খুশি হয়তো রয়েছে অপেক্ষায়।”
এ পর্যায়ে হাসির ইমোজি এলো শুধু। তা দেখে নূরানের ঠোঁটেও হাসি ফুটলো। যাক, মেয়েটার অভিমান হয়তো ভাঙাতে পেরেছে সে।
___
ফ্রেশ হয়ে নিজের ব্যাগপত্র গুছিয়ে শেষবার একটু ছাঁদে এলো আদ্রিতা। গ্রামটা আবারও দু চোখ ভরে দেখে নিতে। এই তিন-চার দিনেই গ্রামের শ্যামল মায়ায় জড়িয়ে গেছে আদ্রিতা। এখান থেকে যেতে মন উদাস হয়ে যাচ্ছে তার৷ তবে যেতেতো হবেই। কিছুক্ষণ আশপাশে চোখ বুলিয়ে ফিরে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়াতেই জোভানকে তার দিকে আসতে দেখলো আদ্রিতা। এমুহূর্তে জোভানকে মোটেও আশা করেনি আদ্রিতা। তাকে দেখে ভীষণ অপ্রস্তুত পরিস্থিতিতক পড়ে গেল সে। ছাঁদে এখন আদ্রিতা শুধু একা। এই অবস্থায় জোভানের সাথে এখানে থাকার কোনো ইচ্ছেই নেই তার। তাই জোরপূর্বক হেঁসে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই জোভান বলে উঠলো,
“কি হলো অরি! আমাকে দেখেই চলে যাচ্ছ যে!”
আদ্রিতা অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বলল,
“না না তেমন কিছু না। আসলে বের হওয়ার সময় হয়ে গেছে। সোনা মা,সবাইকে রেডি হয়ে জলদি নিচে যেতে জড়ো হতে বলেছে।”
“ঠিক আছে যেও, আটকাবো না তোমাকে। শুধু পাঁচ মিনিট একটু কথা বলবো। আজ চলে গেলে আবার কবে দেখা হবে, না হবে। তাই আজকে কিছু কথা বলতে চাই আমি তোমাকে। অনেক দিন ধরে বলবো বলেও বলা হয়নি৷ তবে আজ আমি আমার মনের কথা তোমাকে বলবই। প্লিজ আমার কথাগুলো শুনো একবার।”
আদ্রিতা হয়তো বুঝতে পারলো জোভান কি বলতে চাইছে। আর সেটা বুঝতে পেরেই চরম অস্বস্তিকর মনোভাব হলো তার। আদ্রিতা এবার স্থির মনোভাব রেখে শান্ত কন্ঠে বলল,
“দেখুন ভাইয়া,আমি হয়তো জানি আপনি কি বলতে চাইছেন। আমি বোকা হতে পারি।তবে এতটাও না যে এতটুকু বুঝতে পারবোনা। তাই আপনার বলার আগে আমি কিছু বলতে চাই। আপনার মনে আমাকে নিয়ে যদি কোনরকম ফিলিং হয়ে থাকে তাহলে আমি অত্যন্ত দুঃখীত।যদিও আমার মনে পড়ে না কখনো আমি আমার কথা বা কাজ দ্বারা আপনাকে এমন কোন সাইন দিয়েছি যাতে আপনার মনে এমন মনোভাব হয়েছে। তবুও আমি দুঃখীত। আপনি যা আশা করছেন তা কখনো সম্ভব না। কোনভাবেই না। না আজ, না কাল, না কোনদিন হবে। তাই এই আশা করে শুধু শুধু নিজেকে কষ্ট দিবেন না। প্লিজ এই ধারণা মন থেকে মুছে ফেলুন। আমি চাইনা এসব কারণে আমাদের পারিবারিক সম্পর্কে একটা ব্যাঘাত ঘটুক। আশা করি বুঝতে পারছেন কি বলতে চাইছি আমি। চলি এখন, ভালো থাকবেন।”
বলেই আদ্রিতা জোভানকে পাশ কেটে চলে যেতে নিলো। হঠাৎ পেছন থেকে জোভান বলে উঠলো,
“এই অসম্ভবনার কারণ টা কি নিবিড়? “
থেমে গেল আদ্রিতা। কপাল কুঁচকে ঘাড় বাঁকিয়ে তাকালো জোভানের দিকে।জোভান আবারও বলল,
“কি হলো বলো! আমাকে মানা করার কারণ কি নিবিড়? তুমি কি নিবিড়ের ভয়ে আমাকে মানা করছ!”
আদ্রিতার এবারে সত্যি করে ভীষণ রকম রাগ লাগলো।সে কন্ঠে কিছুটা রুক্ষতা এনে বলল,
“আপনার জন্য যেটা জানা জরুরি ছিল সেটা আমি বলে দিয়েছি আপনাকে। এর বেশি না আপনার জানার অধিকার আছে, আর না আমি বলাটা প্রয়োজন মনে করি। সেটা আমার একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার। আশা করি মনে রাখবেন।”
কথা শেষ করে আর এক মুহুর্তও কালবিলম্ব না করে আদ্রিতা দ্রুত পা ফেলে বেড়িয়ে গেল। পেছন থেকে জোভান তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো। বিড়বিড় করে বলল,”সেতো না চাইলেও থাকবে৷ তোমাকে মনে রাখাটা যে আমার অভ্যাসের রীতি।”
আদ্রিতা ছাঁদ থেকে আসার পথে করিডরে দেখলো ফুলদানি ভেঙে পড়ে আছে। ভ্রু কুঁচকে আসলো আদ্রিতার।তার খুব ভালো ভাবেই মনে আছে যাওয়ার সময় এই ফুলদানিটা ঠিকঠাকই ছিলো। তাহলে হঠাৎ করে এভাবে ভাঙলো কীভাবে! তানির ডাক শোনা গেল তখন। তাই আর কিছু না ভেবে আদ্রিতা তানির ডাক শুনে ওখান থেকে চলে গেল। নিচে এসে দেখলো প্রায় সবাই রেডি হয়ে খাবার খেতে বসেছে৷ আদ্রিতাকেও দ্রুত খেয়ে নিতে বলল তানি৷ তারপর বের হবে সবাই। আদ্রিতা মাথা দুলিয়ে চেয়ার টেনে বসলো। এদিক ওদিক নজর ঘুরিয়ে নিবিড়কে খুঁজল। সে নেই এখানে। হয়তো এখনো রেডিই হচ্ছেন উনি। খাবার টেবিলে খাওয়ার মাঝে তাসান বলে উঠলো,
“মা শোনো, আমি কিন্তু একা যাবোনা। আমার সাথে তোমার বউমাও যাবে।”
তাসানের কথায় সবাই ভাত ছেড়ে টাস্কি খাওয়া শুরু করলো। হঠাৎ বিস্ফোরনের মতো সবার মাঝে ছড়িয়ে পড়লো। সানা,তাসির ছেলের কথায় বিস্মিত হয়ে বলল,
“কি বলছিস এসব! কীসের বউমা! কোথাকার বউমা!”
তাসান বলে উঠলো,
“আরে কোথাকার আবার! তোমাদের সামনেইতো বসে আছে। আমার বিউটফুল কিউট বউটা।”
সবাই এদিক ওদিক চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলো। বউমা খুঁজে না পেয়ে আবার জিজ্ঞেস করলো,
“কোথায়?”
“আরে ধুর, চোখের সামনে এত সুন্দর একটা বউমা বসে আছে তাও চোখে দেখেনা। আরে এইযে পান চিবিয়ে ঠোঁট লাল করছে ওটাইতো তোমাদের বউমা।”
এতক্ষণে বুঝলো সবাই। তাসান আসলে ফিরোজের দাদীর কথা বলছে। সবাই এবার হেঁসে উঠলো। তাসান বলল,
“আরে হাসছ যে বড়! দেখ বাবা মা,আমার ভালোবাসা একেবারে সিমেন্ট বালি ওয়ালা পাক্কা ভালোবাসা। আর স্বামী হিসেবেও আমি খুব দায়িত্বশীল। আমি যেখানে আমার প্রাণপ্রিয় বউও সেখানে। তাইনা বউ!”
সবাই উচ্চশব্দে হেঁসে উঠলো। ফিরোজের দাদী হাসিমুখে বলল,
“হ জামাই ঠিহই কইছ্যাও। তোমাক ছাড়া আমি থাইকপ্যার পারি নাহি। পিরিতের ছেড়া খেতা তুমি। এক কাম হরো। তুমি এহেনেই থাইহা যাও। আমরা তিনজন মিল্যা সুহে শান্তিত থাকমু।”
তাসান বলে উঠলো,
“তিনজন! তিনজন কে?”
“ক্যা! তুমি, আমি আর আমার মরা জামাইয়ের ভুত। হে আবার আমাক মেলা ভালোবাসে তো, তাই আমাক ছাইড়া যায়না। আইতে(রাতে) আইতে আইস্যা আমার কাছে থাহে।”
“না না থাক। আমি তোমাদের গভীর ভালোবাসার মাঝে আমি বাঁধা হয়ে আসতে চাইনা৷ যাও তোমাদের জন্য আমি আমার ভালোবাসার কুরবানী দিলাম৷ যা দাদী যা,জিলে আপনি জিন্দেগী।”
এদের কথাবার্তায় হাসির রোল পড়ে গেল চারিদিকে। আদ্রিতা আবারও চারপাশে নজর বোলালো। নিবিড় এখনো আসেনি৷ কি এমন বানিজ্য করছে জনাব! তখনই তানি আবিরের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
“নিবিড় কোথায়! দেখছি না যে ওকে! কোথাও গেছে নাকি!”
আবির বলল,
“কি জানি আমিতো জানি না। গেছে হয়তো কোন কাজে। চলে আসবে সময়মতো।”
“হুম।”
খাওয়া দাওয়া শেষে সবাই ধীরে ধীরে নিজেদের ব্যাগপত্র নিয়ে বাড়ির উঠোনে এসে হাজির হলো। আবির আর তাসির সবার ব্যাগপত্র গাড়িতে তুলছে। আদ্রিতার নজর নিবিড়কে খুঁজে চলেছে। তখন থেকে কোথাও দেখেনি তাকে। মনের মাঝে কেমন যেন অদ্ভুত একটা ফিলিং হচ্ছে ওর। অস্থিরতা কাজ করছে বুকের মাঝে। লোকটাকে না দেখা পর্যন্ত হয়তো এই অস্থিরতা কমবে না। আদ্রিতার ভাবনার মাঝেই তানি আবারও চিন্তিত গলায় বলল,
“নিবিড়টা কোথায়! বের হওয়ার সময় হলো এখনো পর্যন্ত খবর নেই ছেলেটার। ফোনও বন্ধ আসছে। গেল কোথায় ছেলেটা!”
বাড়ির সবাই এমুহূর্তে এখানেই অবস্থান করছে। সবাই এক এক করে জানিয়ে দিলো তারা নিবিড়ের খবর জানে না। এবার যেন সবার মাঝেই একটা উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়লো। আর সাথে হঠাৎ দ্রুত বেগে বাড়লো আদ্রিতার অস্থিরতার প্রকোপ। হাত পা অস্থিরতায় শিনশিন করতে লাগলো। আদ্রিতার ভীরু মনের অস্থিরতা বিস্ফোরণ আকার ধারণ করলো যখন আম্বিয়া মুখ খুলল।আম্বিয়া বাড়ির ভেতর থেকে আসার পর তানি তাকেও জিজ্ঞেস করলো সে নিবিড়কে কোথাও দেখেছে কিনা। আম্বিয়া তখন বলে উঠলো,
“হ দেখছিল্যামতো। হগালে যহন আমি ছাঁদের সিঁড়ি মুইছা আইসপ্যার নসি তহন ভাইজান আমাক দেইহা হইস(জিজ্ঞেস) করলো আমি আদ্রিতা আফাক দেখছি নাহি। তহন আমি হ্যাক কইল্যাম, হ দেখছি। আফা তিন্নির মামা জোভান ভাইয়ের হাতে ছাঁদে কথা কইত্যাছে। হেতা হুইন্যা ভাই ছাঁদের দিকে গেল। আর আমিও ওহন থাইক্যা চইল্যা আছি। তারপর ভাইয়া কোনে গেছে তা আর জানিনা।”
আম্বিয়ার বলা কথার তাত্পর্য এখানে উপস্থিত কেউ বুঝতে পারলোনা। বুঝলো শুধু আদ্রিতা। যদিও তানিও হয়তো কিছুটা আচ করতে পারলো। তবে আদ্রিতার কাছে সবটাই আয়নার মতো পরিষ্কার হয়ে গেছে ততক্ষণে। আম্বিয়া তখন সিঁড়ি মোছার সময় হয়তো জোভান আর আদ্রিতাকে কথা বলতে দেখেছে। আর সেটাই নিবিড়কে বলেছে। আদ্রিতার অস্থির মন এবার অবশ হয়ে বসে পড়লো যেন। সেই রুক্ষ পুরুষটা যে তার উপর তীব্র পরিমাণে ক্রুদ্ধ হয়েছে তা বুঝতে আর বাকি নেই। করিডরে ভেঙে পড়ে থাকা ফুলদানিটাও তার ক্রুদ্ধতার শিকার হয়েছে তাও স্পষ্ট এখন।আদ্রিতার মাথায় বারবার নিবিড়ের বলা সেদিন রাতের কথাগুলো মস্তিষ্কে বারি খাচ্ছে। জোভানকে নিয়ে শান্ত হুমকি দিয়েছিল সে।আর আজ! ভয় হচ্ছে আদ্রিতার। ওই ক্রুদ্ধ উন্মাদ পুরুষটার জন্য। সে আদ্রিতার সাথেও কথা বলেনি,তার উপর রাগ দেখায়নি,তাকে চোখের গরম দেখিয়ে ধমকায়নি। তারমানে ক্রোধের পরিমাণ কত ভারী তা আন্দাজ করতেও ভয় হচ্ছে আদ্রিতার।মনে শুধু একটা প্রশ্নই হানা দিচ্ছে। ওই ক্রুদ্ধ পুরুষটা তাহলে এখন কোথায়!
ঠিক তখনই আদ্রিতার প্রশ্নের জবাব এলো অপরাহ্নের কাছ থেকে। সে হঠাৎ বলে উঠলো,
“আন্টি,নিবিড়ের ম্যাসেজ এসেছে। কোম্পানিতে নাকি কোন ইমার্জেন্সি এসেছে তাই ও আগেই রওয়ানা হয়ে গেছে। তাড়াহুড়ায় কাউকে বলতে পারেনি।”
তানি হতাশ সুরে বলল,
“এটা কোন কথা! তাই বলে একবার বলে যাবেনা! আরে আমরাওতো যাচ্ছিলাম। একসাথে গেলে কি হতো! তারওপর আবার ফোনটাও বন্ধ করে রেখেছে। ছেলেটা আমাকে জ্বালানোর জন্যই পয়দা হয়েছে। এখন আর কি! এখন তাহলে চলো আমরাও যাই। “
সবাই একে একে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠে বসতে লাগলো। আদ্রিতাও ভারী মন আর উদাস হৃদয়ে আস্তে করে গাড়ির দরজার কাছে আসলেই আম্বিয়া এগিয়ে এসে বলল,
“আবার আইসেন আফা। আপনের কথা মেলা মনে পইড়বো।”
আম্বিয়াকে দেখে হঠাৎ আদ্রিতার চরম রাগ হলো। এতটা রাগ হচ্ছে যে এই মুহুর্তে আম্বিয়াকে উগান্ডায় ছুঁড়ে মারতে পারলে তার শান্তি লাগে।আজ এর জন্যই সব হলো।কি দরকার ছিল নাচতে নাচতে ওই পাগলকে ওসব বলার! আদ্রিতা যেন মনে মনে ইচ্ছেমতো আম্বিয়াকে ঝাড়ু দিয়ে পেটাচ্ছে। সে আর আম্বিয়াকে কিছু না বলে গাড়িতে উঠে বসে দরজা আঁটকে দিলো। কিছুক্ষণ পরই গাড়ি রওয়ানা হলো ঢাকার উদ্দেশ্যে। আদ্রিতা উদাস মনে গাড়ির কাচে মাথা ঠেকিয়ে বসে রইল। সময় গড়ানোর সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে যেন তার বিষন্নতা। আসার সময় যতটা উৎফুল্ল ছিল, যাওয়ার পথে তার থেকে দিগুণ বিষন্নতা ভার করছে মনে। বাকিরা ঠিকই তাদের মতো আড্ডা দিচ্ছে। কিন্তু আদ্রিতার তাতে এক বিন্দুও মন নেই। তার মনতো পড়ে আছে ওই রুষ্ট মানবের রুক্ষতায়। এত কেন ক্রোধ তার! একবার কি আমার সাথে কথাও বলতে পারতো না! আমার পক্ষের দলিলপত্র না জেনেই সোজা শাস্তির রায় জারি করে দিলো! নাহয় বকাঝকাই করতো,ধমকাতো। তবুও তো অন্তত একটাবার আমার সাথে কথা বলতো! কিছু না বলেই উনি চলে গেলেন। এত কঠোর কেন উনি! এসব ভাবনা আদ্রিতাকে ধীরে ধীরে ব্যাথিত করে তুলছে। ব্যাথার যাতনা তার চোখ বেয়ে নামতে চাচ্ছে খুব করে। তবে সবার সামনে কাঁদা যাবেনা। অনেক কষ্টে নিজের কান্না আটকাচ্ছে সে।
যমুনা সেতুর কাছে আসলে। তানহা বলে উঠলো,
“কিরে অরি,তুই না যমুনা পাড়ে ঘুরতে চেয়েছিলি। চল আজ ঘুরে যাই৷ এখনতো ভাইয়াও নেই মানা করার জন্য। “
অন্য সময় হলে হয়তো আদ্রিতা এই কথায় সবচেয়ে খুশি হতো। তবে এখন এমুহূর্তে তাকে পৃথিবীর কোনো খুশিই উৎফুল্ল করতে পারছেনা। আদ্রিতা সাফ মানা করে দিলো। বলল, তার ইচ্ছে নেই। তাই আর বাকিরাও নামলোনা। আদ্রিতার এখন শুধু দ্রুত ঢাকায় পৌঁছাতে পারলে শান্তি পায়। ওই রুক্ষ মানবের ভুল যে ভাঙাতে হবে তাকে।
ঢাকায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে বিকেল হয়ে গেল। গাড়ি থামতেই আদ্রিতা সবার প্রথমে নেমে দ্রুত এলো বাসার ভেতর। কাজের মহিলা দরজা খুলে দিলে আদ্রিতা ভেতরে এসেই দ্রুত পায়ে উপরে উঠে সবার আগে নিবিড়ের রুম চেক করলো। কিন্তু রুমে কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিকে দেখতে পেলনা সে। সে আবার নিচে নেমে এলো। ততক্ষণে বাকিরাও চলে এসেছে। আদ্রিতা যা জানতে চায় সেটা তানিই জিজ্ঞেস করলো কাজের মহিলাকে। তানি জিজ্ঞেস করলো,
“জামিলা,নিবিড় কি বাসায় এসেছিল?”
জামিলা বলল,
“জি খালাম্মা, আইছিল তো। আইসাই আবার কতক্ষণ পর ব্যাগ নিয়া বাইর হইলো। আমারে কইলো, অফিসের কাজে নাকি সিলেট যাইতাছে। সপ্তাখানেক লাগবো ফিরতে। আপনি আসলে যেন কইয়া দেই।”
“কি বলো! সিলেট চলে গেছে! ছেলেটা যে কি করে না!”
আবির বলল,
“আরে অফিসের কোনো জরুরি কাজ পড়েছে দেখেইতো গেছে। তুমি টেনশন নিও নাতো। চলো গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আরাম করো। তোমরা সবাইও গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও।”
সবাই যার যার রুমে চলে গেল। থেকে গেল শুধু স্তম্ভিত আদ্রিতা। পা যেন চলন ভুলে গেছে তার। নিবিড়ের এই সিলেট গমন যে কোনো অফিসের কাজে না বরং আদ্রিতার উপর রাগের বহিঃপ্রকাশ তা জানে সে। আর জানার পর আদ্রিতার বাদবাকি শক্তিটুকুও যেন হ্রাস পাচ্ছে। কঠোর মানবের নির্দয়তা তাকে ক্ষুন্ন করে দিচ্ছে।
বহু কষ্টে পা চালিয়ে নিজের রুমে এলো আদ্রিতা। রুমে এসেই ধপ করে বিছানায় বসে পড়লো সে। এতক্ষণ ধরে আঁটকে রাখা কান্নাটা এবার বাঁধ ভেঙে বেড়িয়ে এলো। ওই নিষ্ঠুর পুরুষের উপেক্ষার আঘাতে খুব করে আহত হচ্ছে তার মন৷ কালইতো বলেছিল আদ্রিতা,তাকে রেখে যেন কোথাও না যায়। আর আজই তা ভুলে গেল! তার কাছে এতই সহজ আমাকে ছেড়ে যাওয়া! সহজই হয়তো। তাইতো বারবার চলে যায়। কিন্তু এই আমিটাকে এখন কি বুঝ দিবো!
চলবে……..