বাবা মারা যাওয়ার পর মায়ের দ্বিতীয় বিয়ে আমি মেনে নিতে পারিনি। অথচ মা দাবি করেন, আমার জন্যই তিনি বিয়ে করেছেন, আমি যেন বাবার স্নেহ থেকে বঞ্চিত না হই। মা রীতিমত আমাকে জোর করেন তাকে বাবা বলে মেনে নিতে, বাবা বলে ডাকতে। মায়ের দ্বিতীয় স্বামীকে দেখলেই আমার প্রচণ্ড রাগ হয়। মায়ের কথা আমি মেনে নিতে পারি না। আমার বাবার জায়গা কেন আমি অন্য কাউকে দেব? কেন তাকে বাবা বলে ডাকব? আমাদের মা-মেয়ের সম্পর্কের টানাপোড়েন শুধু এই কারণে।
আমার মায়ের দ্বিতীয় স্বামীর নাম শিহাব সুলতান। তিনি আর মা একই অফিসে চাকরি করেন। তার প্রথম স্ত্রী মারা গিয়েছেন অনেকদিন। সেই পরিবারের কোন সন্তানাদি নেই। এই লোকটিকে আমি খারাপ বলতে পারি না। তিনি যথেষ্ট মার্জিত স্বভাবের একজন মানুষ। তবুও তাকে আমার সহ্য হয় না।
প্রতিদিন তিনি সকাল বেলা কফি বানান। একটা মগ এগিয়ে দেন আমার দিকে। ‘এশামনি, তোর জন্য স্পেশাল কফি বানালাম। চট করে খেয়ে নে। খেলেই বুঝবি, বাবার হাতের কফি কেমন মজা!’ প্রচণ্ড রাগ হয়। চুপচাপ কফি নিয়ে বেসিনে ফেলে দিয়ে আমি বেরিয়ে যাই কলেজের উদ্দেশ্যে।
এটা একদিন দুদিন নয়, গত চার বছর ধরে চলছে। আগে কফিসহ মগ আছাড় দিয়ে ভাঙতাম। মা রেগে চড় বসিয়ে দিতেন। এখন শুধু কফি ফেলে মগটা টেবিলে রেখে দিই। আশ্চর্য লাগে, লোকটার কত ধৈর্য! এত কিছুর পরেও কীভাবে রোজ কফি বানায়!
২. আমার বাবার হাত ধরে আমি আমার ছোটবেলা কাটিয়েছি। স্কুলে গিয়েছি, আইসক্রিম খেয়েছি। ছোটবেলায় আমার অল্পতেই ঠাণ্ডা লেগে যেত বলে আইসক্রীম মা খেতে দিতে চাইতেন না। আইসক্রীম প্রিয় বলে বাবা প্রায় দিনই লুকিয়ে আমাকে আইসক্রীম কিনে দিতেন। মায়ের দ্বিতীয় স্বামীও আমাকে আইসক্রীম কিনে দেন, লুকিয়ে যেন মা জানতে না পারে। এমন সহজ গলায় বলেন যেন তার সাথে আমার খুব ভাল সম্পর্ক। ‘এশা মনি, এই নে তোর জন্য আইসক্রীম আনলাম। দেখিস তোর মা যেন না জানে।’ আমার খুব রাগ হয়। তিনি কেন বাবার মত করে আমাকে এশামনি বলে ডাকবেন? এই ডাকটার অধিকার শুধুই আমার বাবার। আমি চিৎকার করে উঠি। আইসক্রীম এর বক্সটা ছুঁড়ে ফেলি। ‘কী চান আপনি? আপনি কি ভেবেছেন বাবার মত করে বললেই আপনি বাবার জায়গা নিতে পারবেন? মায়ের স্বামী হয়েছেন বলে আমার বাবা হয়ে গিয়েছেন? আর আনবেন না আইসক্রীম!’ তিনি দাঁড়িয়ে রইলেন চোখমুখে অপমান মেখে। মা তেড়ে আসেন, আমাকে হয়ত কড়া করে কথা বলবেন। তিনি ঈশারা দিয়ে থামিয়ে দিলেন।
৩. আমি দরজা বন্ধ করে কাঁদি। বাবার মারা গিয়েছেন আমার বয়স তখন দশ। তারপর থেকে সাত বছর আমি আইসক্রীম খাইনি। আর উনি এসেছেন আমাকে আইসক্রীম দিতে! শুধু আইসক্রীম নয়, আমার পছন্দের খাবারগুলো তিনি রোজ রান্না করেন। আমি সেগুলো মুখেও দিই না। বাইরে থেকে খাবার কিনে খাই। তবুও তিনি রুটিন মেনে রান্না করেন। আমাকে নজরে নজরে রাখেন। কোথায় যাই, কী করি, কে কে বন্ধু, পড়াশোনা কেমন করছি প্রতিটা বিষয় তার নখদর্পণে। এতটা মা নিজেও খেয়াল রাখেন না আমার। সবসময় নিজেকে আমার বন্দী বন্দী মনে হয়।
কিছুদিন পর পর তিনি হাবিজাবি গিফট কিনে আনেন আমার জন্য। যার একটাও আমি খুলে দেখি না। ফেলে দিয়ে আসি তার রুমে। জোর করে আমার বাবা হতে চাওয়াটাই আমার অসহ্য লাগে। ‘আপনি আমার মায়ের স্বামী। প্লিজ, আপনি সেটাতেই থাকুন। আমার বিষয়ে এত মাথা না ঘামালেও চলবে।’ মুখে যা আসে তাই বলে বসি।
৪. একদিন রাতে পানি খেতে ডাইনিংয়ে এসে দেখি, মা আর তিনি বারান্দায় বসে কথা বলছেন। ‘সাবিহা, এশা ইদানিং নেহা নামের একমেয়ের সাথে ঘুরে। নেহার সম্পর্কে আমি খোঁজ নিয়েছি। মেয়েটা অনেক বাজে ছেলেদের সাথে মেশে, নেশা করে। এশাকে নিয়ে আমার ভয় হয়।’
মা বললেন,’আমি ওর সাথে কথা বলব। টিনএজ এর সময় ভুল সঙ্গে পড়লে, সেখান থেকে টেনে তোলা মুশকিল।’
তারপর তারা ভিন্ন প্রসঙ্গে গেলেন। নিজেদের সুখী জীবনের গল্প। চাঁদের আলোয় দুজন চল্লিশ ছুঁই ছুঁই মানুষ মৃদুমন্দ আলাপে ব্যস্ত। মাঝে মাঝে তারা আমার প্রসঙ্গ আনছেন, স্মৃতিচারণ করছেন, চাপাস্বরে হাসছেন। আমি কিছুক্ষণ অতীত হাতড়ে বেড়ালাম। আমি বাবার সঙ্গে মাকে এমন মুহূর্ত কখনো কাটাতে দেখেছি কিনা মনে পড়ছে না। মাসে এক আধ দিন মাকে বাইরে নিয়ে যেতেন, রেস্ট্রন্টে খাইয়ে আনতেন। বিবাহবার্ষিকী বাবা ভুলে যেতেন কিংবা মা মনে করিয়ে দিলেও তেমন পাত্তা দিতেন না। মা সেজেগুজে বসে থাকতেন আর বাবা ফিরতেন হাজারটা ক্লান্তির গল্প নিয়ে। আজ মাকে এতটা খুশি দেখে মনে হলো, তিনি কি বাবার সাথে সুখী ছিলেন? আজ যতটা সুখী তাকে দেখি, তাকে তো বাবার সাথে দেখিনি? সত্যিই উনি যতটা সময় পরিবারের জন্য বরাদ্দ রাখেন, বাবা তার সিকিভাগও রাখতেন না। আমাকে বাবা খুব ভালবাসতেন বলে হয়ত মায়ের না পাওয়াগুলো আমার চোখে পড়েনি কিংবা ছোট ছিলাম বলে বিষয়গুলো বুঝিনি। দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। আমি চুপচাপ ঘরে চলে এলাম।
৫. শীতের ছুটিতে কলেজ বন্ধ হয়ে গেল। ছুটির দিনগুলো অলসভাবে কেটে যাচ্ছিল বলে ভাবলাম নতুন কিছু উপন্যাস কিনে আনি। চট করে রেডি হয়ে নিলাম। মাকে জানিয়ে বের হব, তখন সুলতান সাহেব বললেন,’আমি তোর সাথে যাই? আমারও কিছু বই কেনা দরকার।’ মূহূর্তেই আমার মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে গেল। বললাম,’না, আমি আমার মত যাব।’ মা বললেন,’কী এমন হবে সাথে গেলে?’
‘আরে, আমি তোর সাথে যাব না, তোর সামনে কিংবা তোর পেছন পেছন হাঁটব, তাহলে চলবে?
আমি আর কিছু বললাম না। বলা বৃথা।
উনি আমার পেছন পেছন হাঁটছেন। আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। ‘পেছনে পেছনে হাঁটবেন না তো, মনে হচ্ছে আপনি ছেলেধরা, আমাকে ফলো করছেন। বিরক্তিকর!’
‘তাহলে সামনে সামনে হাঁটব?’ তার সরল উত্তর।
‘হ্যাঁ, সামনে যান।’
‘তাহলে কিন্তু আমাকে তোর বাবার মত লাগবে। মনে হবে, বাবার পিছু পিছু মেয়ে হাঁটছে।’ বলে তিনি গটগট করে সামনে হাঁটা ধরলেন। ঠিক তখনই একটা ভয়াবহ ঘটনা ঘটে গেল। আচমকা দ্রুত গতির একটা প্রাইভেট কার এসে সুলতান সাহেবকে ধাক্কা দিয়ে চোখের পলকে দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেল। তিনি ছিটকে পড়ে গেলেন কয়েক ফুট দূরে। ঘটনার আকস্মিকতায় আমার যেন শ্বাস আটকে গেল। আমি থমকে দাঁড়িয়ে রইলাম যেন আমার পা দুটো পাথরে পরিণত হয়েছে। চারিদিক থেকে লোকজন ছুটে আসতে লাগল। তাদের মধ্যে একজনের সাথে ধাক্কা লাগল, আমি সম্বিৎ ফিরে পেলাম। ছুটে গেলাম সেদিকে। রক্তাক্ত সুলতান সাহেব নিথর পড়ে রয়েছেন, তার রক্তে রাস্তা ভেসে যাচ্ছে।
গল্প: স্নেহছায়া (পর্ব-১)
(আগামী পর্বে শেষ)
লেখা: আফসারা নূর
গল্প ভালো লাগল লাইক কমেন্ট ও শেয়ার করবেন।
গল্প: স্নেহছায়া – পর্ব -২ (শেষ)
লেখা: আফসারা নূর
খেয়াল করলাম আমার চোখ দিয়ে জল পড়ছে। এই প্রথম আমি আবিষ্কার করলাম, তিনি আমার বাবা না হয়েও অনেক কিছু। আমার মায়ের সুখী জীবনের গল্প তিনি। আমি তাকে ধরে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজনদের বললাম, ‘প্লিজ আপনারা উনাকে ধরুন। হাসপাতালে নিতে একটু হেল্প করুন। প্লিজ!’ উপস্থিত লোকদের মধ্যে চার -পাঁচজন তাকে ধরে হাসপাতালে পৌঁছাতে সাহায্য করল। ডাক্তার, নার্সরা তাকে নিয়ে দ্রুত চলে গেল। কেউ একজন বলল,’এক্ষুণি ভর্তির কার্যক্রম সেরে ফেলুন। রোগীর অবস্থা বিশেষ ভাল না। র’ক্তের ব্যবস্থা করতে হবে তাড়াতাড়ি।’ রক্ত? হ্যাঁ তাই তো, র’ক্ত লাগবে তো। সুলতান সাহেবের র’ক্তে আমার হাত, জামাকাপড় ভিজে গিয়েছে। এত র’ক্ত ঝরে গেল? সুস্থ মানুষটার চোখের পলকে কী হয়ে গেল! সাথে আসা লোকগুলো মধ্যে একজন বলল,’উনার পরিবারে ইনফর্ম করতে হবে। আপনি কি উনাকে চিনেন?’
মাকে জানাতে হবে। আমি কাঁপা কাঁপা হাতে মায়ের নাম্বারে কল দিলাম। দুঃসংবাদ জানানো যে কত কঠিন তা তীব্রভাবে অনুভব করলাম। মা কল ধরলেন, আমি সহসা কিছু বলতে পারলাম না। তিনি কয়েকবার হ্যালো হ্যালো করলেন। আমি নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলাম। বললাম,’মা, তুমি ‘ হাসপাতালে আসতে পারবে, জেনারেল হাসপাতাল। এক্ষুণি এসো মা। আমার নিজেকে খুব একা লাগছে। প্লিজ এক্ষুণি এসো।’
মা অস্থির গলায় জিজ্ঞেস করল,’এশা এভাবে কেন কথা বলছিস? হাসপাতালে কেন যাব? কি হয়েছে, তুই ঠিক আছিস? তোর বাবা ঠিক আছে? চুপ করে কেন বল, ফোনটা তোর বাবাকে দে।’
‘ঠিক নেই মা, তিনি ঠিক নেই। তিনি কথা বলছেন না। ডাক্তার বলেছে, অনেক রক্ত লাগবে। রাস্তা রক্তে ভেসে গেছে। আমি কী করব বুঝতে পারছি না। প্লিজ মা তাড়াতাড়ি এসো।’ আমি সাথে আসা লোকদের বললাম, আপনারা চলে যাবেন না। দয়া করে, আমার মা না আসা পর্যন্ত থাকুন।’ তারা আশস্ত করল, তারা থাকবে। তাদের মধ্যে একজন নিজে থেকে ভর্তির ফর্মালিটি করতে কাউন্টারে গেল। কিছুক্ষণ পর লোকটা এসে বলল,’আপনাকে রোগীর তথ্য দিতে হবে কাউন্টারে আসুন।’ কাউন্টারের লোকটা আমাকে জিজ্ঞেস করল,’আপনি রোগীর কে হন?’
আমি ধীরকণ্ঠে বললাম,’মেয়ে।’
সেই মূহূর্তেই মা এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। কাঁদতে কাঁদতে জিজ্ঞেস করলেন,’তোর বাবা কোথায়?’ আমার সাথের লোকটা বলল,’অপারেশন থিয়েটারে।’
আমি আর মা বসে রইলাম। এটা আমাদের প্রথম বসে থাকা নয়। বাবা যেদিন মারা যান সেদিনও আমরা এভাবেই বসেছিলাম। ঘা’তক ট্রাক তাকে এমনভাবে জখম করে ছিল যে সেদিন বাবা আর জেগে ওঠেননি। সেদিন মাকে যতটা কাঁদতে দেখেছিলাম, আজ তার বিপরীত। তিনি কাঁদছেন না, চুপ করে বসে আছেন। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি তিনি ভেতরে ভেতরে কতটা বিদ্ধস্ত আর মুষড়ে পড়েছেন। আমি খুব করে প্রার্থনা করতে লাগলাম, বাবার সাথে যা হয়েছে তা যেন সুলতান সাহেবের সাথে না হয়। আমি মাকে নিঃসঙ্গ দেখতে পারব না। সুখী মানুষজোড়াকে আমি জোছনা পোহাতে পোহাতে গল্প করতে দেখতে চাই আবার। অনেকক্ষণ পর মা নীরবতা ভাঙলেন,’এশা, তোর জামা কাপড় র’ক্তে ভিজে একাকার। বাসায় যা গিয়ে ফ্রেশ হ। আমি এখানে আছি। তোকে আর আসতে হবে না। জ্ঞান ফিরলে আমি তোকে জানাব।’ মায়ের কথা শুনে আমি অবাক হয়ে গেলাম। চলে যাব মানে? একটা মানুষ জীবন-মরণের সন্ধিক্ষণে, ডাক্তার এখনো ভাল মন্দ কিছুই জানালো না, এই অবস্থায় মা কীভাবে এমন কথা বলে? আমি উনার কেউ নই বলে কি মা আমাকে চলে যেতে বলছেন? অভিমানে আমার গলা ধরে আসে। আমি ছোট্ট করে ‘হু’ বলে উঠে পড়ি।
সন্ধ্যায় মা কল করে জানালেন, সুলতান সাহেব এখন নিবিড় পর্যবেক্ষণে আছেন। আমি আসব কিনা জিজ্ঞেস করলে মা নিরুত্তর থেকেছেন। মায়ের নীরবতা আমাকে ভীষণ পীড়া দিল। সারারাত ঘুমাতে পারলাম না। ভোরবেলা চোখটা লেগে এসেছিল, কিন্ত ভয়ঙ্কর এক দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে গেল। আমার ভীষণ ইচ্ছে করল, হাসপাতালে ছুটে যাই। বিছানা থেকে নামতেই মাথা ঘুরতে শুরু করল। আমি প্রচন্ড ক্ষুধার্ত তা অনুভব করলাম। মনে পড়ল গতকাল দুপুরের পর আর কিছু খাওয়া হয়নি।
৬. হাজার চেষ্টা করেও নিজেকে বাসায় আটকে রাখতে পারলাম না। বিকেলে হাসপাতালে চলে গেলাম। শুনলাম সুলতান সাহেবের জ্ঞান ফিরেছে। মা দেখা করার জন্য মাস্ক পরে নিচ্ছেন। আমি বেশ উৎসুক হলাম। এখন কেমন আছেন তিনি দেখতে ইচ্ছে করল। কিন্তু মা জানালেন, ডাক্তার বলেছে কেবল একজনই দেখা করতে পারবে। আমি বাইরে দাঁড়িয়ে রইলাম। মা কিছুক্ষণ পর ফিরে এলেন। আমি আগ্রহভরা চোখে মার দিকে তাকিয়ে রইলাম। আশ্চর্য! তিনি চুপ করে রইলেন। মা কেন এত নির্লিপ্ত? মা কারো সাথে ফোনে কথা বলছেন,’শিহাবের জ্ঞান ফিরেছে। এখন ভাল আছে। হ্যাঁ হ্যাঁ, কথা বলছে এখন। আচ্ছা রাখি তাহলে।’ একরাশ অভিমান আর রাগ হল আমার। আমাকে এত এড়িয়ে যাওয়া? দুম করে উঠে হাঁটা ধরলাম। আমাকে দরকার নেই, বেকার এখানে বসে থেকে আমি কী করব? সারাদিন বাপ হতে চাও, আর যখন জ্ঞান ফিরল, তখন শুধু মেয়ের মায়ের সাথে দেখা করতে চাইলে! একবারও মেয়ের সাথে দেখা করতে ইচ্ছে হল না? এজন্যই লোকে বলে, পর পরই হয়।
দশ দিন পর তিনি মোটামুটি সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরলেন। গত দশদিন আমি রোজই হাসপাতালে যেতাম। কেবিনের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতাম। কিন্তু ভেতরে যেতে সাহস পেতাম না। কিছুটা লজ্জায়, কিছুটা অভিমানে আর অনেকটা অনাত্মীয়তার কারণে। আমি সারাক্ষণ তার সাথে দুর্ব্যবহার করেছি, কষ্ট দিয়েছি, অপমান করেছি। কীভাবে সামনে যাব ভেবে পাই না। বাসায় ফিরে তারা দুজনে প্রচুর কথা বলছেন, হাসছেন। আমি কেবলই নিজেকে ঘরে বন্দি করে রাখলাম। অপেক্ষায় থাকলাম, তিনি নিশ্চয়ই ডাকবেন। আমি কল্পনাও করিনি, আমি স্নেহের জন্য এতটা কাঙাল হতে পারি। আমি অনুভব করতে পারি, যতই তার সাথে খারাপ ব্যবহার করি, তার বাবা হওয়ার সেই চেষ্টাগুলোকে আমি আসলে ভালবেসে ফেলেছি। তার কাণ্ডকারখানাগুলোকে মিস করতে শুরু করেছি।
দুপুরের খাবার খাওয়ার সময় হতেই তিনি ডাকলেন,’এশামনি!’ আমার হৃদপিণ্ড লাফিয়ে উঠল। প্রথমে মনে হলো এক ছুটে চলে যাই। গিয়ে কপট রাগ দেখিয়ে বলি,’এতক্ষণে আপনার আমার কথা মনে পড়ল? এই আপনি আমার বাপ হতে চান? যে মেয়েকেই ভুলে গেছেন!’ কিন্তু আমরা মনে মনে যা ভাবি, তার সবকিছু বাস্তবে করতে পারি না। সংকোচ লাগে। স্বাভাবিক ভঙ্গিতে খাবার টেবিলে গিয়ে বসলাম। আমাকে দেখে তিনি বললেন,’বাহরে! আমি এতদিন হাসপাতালে ছিলাম, তুই একবারো দেখতে গেলি না?’
চাপা অভিমানটা আবার দলা পাকিয়ে উঠল। বললাম,’গিয়েছিলাম তো, আপনার ডাক্তার শুধু আপনার ওয়াইফকে দেখা করার অনুমতি দিয়েছে। আমার নাকি কেবিনে ঢোকা নিষেধ! বেকার হয়রানি। আমার কত সময় নষ্ট হয়েছে জানেন? আর আপনি, আপনিও তো একবার বলেননি আমার সাথে দেখা করতে চান। আমি অনাত্মীয় মানুষ, জোর করে বিনা অনুমতিতে তো আর কেবিনে ঢুকতে পারি না।’
‘ঠিক, জোর করে বাবাও হওয়া যায় না। যেমন, আমি আজও তোর বাবা হতে পারলাম না। বাই দ্য ওয়ে, তুই কেন বার বার কেবিনের সামনে ঘুরঘুর করছিলি, তুই কি আমাকে মিস করছিলি? সত্যি বলবি কিন্তু, বাবাকে খুব ভালবেসে ফেলেছিস তাই না রে মা?’
কথাটায় কী ছিল কে জানে, আমার চোখ জ্বালা করতে লাগল। কী বিশ্রী অবস্থা! আর খাব না বলে ঘরে চলে এলাম। আমার বয়েই গেছে আপনাকে মিস করতে।
৭. সন্ধ্যাবেলায় মা একটু কাজ থাকায় বাইরে গেলেন। যাওয়ার আগে বলে গেলেন সন্ধ্যা সাতটায় একটা ওষুধ যেন সুলতান সাহেবকে খাওয়ার কথা মনে করিয়ে দিই। সাতটার সময় ঘরে গিয়ে দেখি তিনি ঘরে নেই, বারান্দায় বসে আছেন। আমি তার পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। দেখি তিনি একটা ছোট বাচ্চা মেয়ের ছবি মন দিয়ে দেখছেন। বললাম,’আপনার ওষুধ খাওয়ার সময় হয়েছে। ওষুধ খেয়ে নিন।’ তিনি হুম বলে আবার ছবিতে মনযোগ দিলেন। কিছুক্ষণ উশখুশ করে জিজ্ঞেস করলাম,’ছবিটা কার?’
‘আমার মেয়ে প্রতিভা।’ আমি তো জানতাম আগের পরিবারে তার কোনো সন্তান নেই। তবুও জানতে চাইলাম, ‘আচ্ছা, ও এখন কোথায়?’
‘নেই, অন্য জগতের বাসিন্দা। জানিস, কি মিষ্টি একটা বাচ্চা ছিল ও, একদম তোর মত। কিন্তু আমাকে বাবা ডাকার আগেই মায়ের সাথে একই দিনে আমাকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেছে।’ কথাটা শুনে আমার প্রচণ্ড মন খারাপ হয়ে গেল।
শীতের ছুটি শেষ হয়েছে দুদিন আগে। সকালে কলেজে যাওয়ার জন্য বের হচ্ছি। প্রতিদিনের মত সুলতান সাহেব কফি বানাচ্ছেন। বের হতে যাব তখন ডাকলেন,’ আয় এশামনি, বারান্দায় বসে কফি খাই। শীতের সকালে রোদ পোহাতে পোহাতে কফি খাওয়ার মজাই আলাদা।’ আমি কফির মগটা নিয়ে বেসিনে ফেলতে গিয়েও ফিরে আসি। তারপর সুলতান সাহেবের পাশের চেয়ারে বসি। কফিটা চুপচাপ শেষ করে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলি,’বাবা, তোমার কফিটা দারুণ হয়েছে। আজ আমার জন্য আইসক্রীম এনো তো। শীতের দিনে রোদ পোহাতে পোহাতে আইসক্রীম খেতেও অন্যরকম মজা।’ সারারাত ধরে নিজের মনের সাথে অনেক যুদ্ধ করেছি, গড়গড় করে সব উগরে দিয়ে আমি বুকের পাথর নামাই। তারপর উঠে পা বাড়াই, আমার কলেজের দেরি হয়ে গেল বুঝি। আমি জানি, মা বড় বড় চোখ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আর সুলতান সাহেব? তিনি চোখের জল মুছছেন। তবুও জল শেষ হচ্ছে না। আচ্ছা, তিনি কাঁদছেন কেন? এক মগ কফি খেলাম তাতে এমন কাঁদার কী আছে? আশ্চর্য! আমার চোখ আবার ভিজে উঠছে কেন? আমার সবকিছু কেমন অদ্ভুত লাগে!
(সমাপ্ত)