#রোগীকথনঃ ১৮৬
পৃথিবীতে প্রেম বলে কিছু আছে অবশ্যই আছে
“আসসালামু আলাইকুম। আমি লাবনী (ছদ্মনাম)। ম্যাডাম আপনি কি ব্রেস্টের প্রবলেম দেখেন? আমার মামা অনেক আশা করে মামীকে নিয়ে এসেছেন ঠাকুরগাঁও থেকে, আপনাকে দেখাবে বলে। প্লিজ ম্যাডাম না করবেন না।”
ম্যাসেঞ্জারে বার্তা প্রেরকের আকুতি দেখে মানা করতে পারলাম না।
নিয়ে আসতে বললাম। এপোয়েন্টমেন্ট পেয়ে বার্তা প্রেরক খুশি হয়ে গেলো।
আগে তো দেখি কি কেইস। লাগলে সার্জারী ডাক্তার দেখিয়ে দিবো। এতো করে যখন বলছেন!
ব্রেস্ট সার্জারির কেইস হলেও গাইনি বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে বেশ ভালোই আসে। রোগীদের কমফোর্ট জোন বলে হয়তো। তবে গাইনোকলোজিস্ট প্রয়োজন মতো সার্জন রেফার করে থাকেন।
আর আমার তো মাল্টি ডিসিপ্লিনারী টীম আছেই। অর্থাৎ গাইনি, শিশু, মেডিসিন, সার্জারী, এনেস্থিসিয়া, কার্ডিওলজি এবং এন্ডোক্রাইনোলজি মিলে আমরা একটা টীম করেছি। আমি আমার কাছে আগত পেশেন্টদের সমস্যা অনুযায়ী রেসপেক্টেড ডাক্তারের কনসালটেন্সি নিয়ে থাকি। তারাও নেয়। এতে পেশেন্ট ম্যানেজমেন্ট ভালো হয়।
পরের দিন পেশেন্ট এলেন। বয়স ত্রিশ বত্রিশ। বিয়ে হয়েছে আট বছর। কোনো বাচ্চা কাচ্চা নাই। কিন্তু এ নিয়ে তাদের কোনো আক্ষেপ চোখে পড়ল না। হিস্ট্রি নিতে নিতে এবং পরীক্ষা করতে করতে আরো কিছু ব্যপার চোখে পড়ল সে ব্যপারে পরে বলছি। ভুলে গেলে মনে করিয়ে দিয়েন। আপাতত ব্রেস্টে ফিরছি।
রোগীর ফাইব্রোএডেনোমা নামক এক ধরনের টিউমার হয়েছে ব্রেস্টে। ইতোমধ্যে এই টিউমারের জন্য একবার অপারেশন করিয়েছেন। আবার হয়েছে। এতে তারা ভয় পেয়ে গেছেন। তাই আর এলাকায় চিকিৎসা না করে ঢাকায় এসেছেন। আমি তাদের আস্বস্ত করলাম, এই টিউমারে ক্যান্সারের আশংকা তেমন নাই।
একবার হলে আরেকবার হতে পারে। ভয়ের কিছু নেই। পাশাপাশি সার্জারী ডাক্তার দেখিয়ে দিলাম। টিউমার রিমুভ করার সিদ্ধান্ত হলো। কিন্তু পেশেন্ট আমার উপস্থিতি ছাড়া অপারেশন করবেন না। অবশেষে আমার হাসপাতালে আমার উপস্থিতিতে অপারেশন সম্পন্ন হলো। মেইন সার্জনের সহযোগী হিসাবে আমি ছিলাম।
পুরো প্রক্রিয়ায় পেশেন্টের এবং পেশেন্টের হাসবেন্ড দারুণ কোঅপারেটিভ এবং হাসিখুশি ছিলেন। আরেকজনের কথা না বললেই নয়। তিনি পেশেন্টের ননাশের মেয়ে। যিনি আমার সাথে যোগাযোগ করেছিলেন পেশেন্টের ব্যপারে। তার বাসায় থেকেই চিকিৎসা নিয়েছেন। এ যুগে মামা মামীর জন্য কেউ এতোটা করে কিনা সন্দেহ। ভালোবাসা নিও মেয়ে।
ঢাকায় এসে অপারেশন চাট্টিখানি কথা তো নয়। টাকা পয়সার ব্যপার আছে। তার উপর আগেও একবার অপারেশন হয়েছে। এদিকে বিয়ের আট বছর, বাচ্চা কাচ্চা নেই। খুব যে টাকা পয়সা ওয়ালা তা কিন্তু নয়। তাহলে এতো আন্তরিক এবং লাভলি আচরণের কারণ কি? খটকা লাগলো। পাপী চোখ তো। অনাচার দেখতে দেখতে সুন্দর জিনিস দেখলে জানতে ইচ্ছে করে, ঘটনা কি?
বাচ্চা না হওয়ার কারণ হিসেবে জানলাম, পেশেন্টের জন্মগত ভাবে জরায়ু নেই। যোনীপথ ও অগঠিত। সামান্য দুই তিন সেন্টিমিটারের মতো হবে। স্বভাবিক যোনীপথ আট থেকে দশ সেন্টিমিটার হয়ে থাকে।
কন্যা সন্তান হয়েছে দেখে স্বামী হাসপাতালে ফেলে রেখে চলে গেছে! বিয়ের তিনবছর অতিবাহিত হয়েছে মাত্র। বাচ্চা হয় না দেখে ঘরে নতুন বউ নিয়ে এসেছে অথচ সমস্যা হাজবেন্ডের! নরমাল ডেলিভারিতে যোনীপথ নাকি বড় হয়ে গেছে, তাই আগের মতো টেস পায়না।
এই অযুহাতে আবার বিয়ে করেছে, এমন উদাহরণ ভুরি ভুরি আছে। প্রতিদিন দেখি। প্রতিনিয়ত ফেইস করি। অথচ এই লোক কিনা স্ত্রীর জরায়ু নেই, মাসিক হয় না। বিয়ে হলে বাচ্চা তো হবেই না, থাকতে পারবে কিনা সন্দেহ তবুও ভালোবেসে এই নারীকে বিয়ে করেছেন!
শুধু বিয়ে করেছেন বললে ভুল হবে।
পরম মমতায় আগলে রেখেছেন। ইন্ডিয়ায় নিয়ে চিকিৎসার চেষ্টা করেছেন। ক্রমাগত পরিবারের চাপ সহ্য করেছেন। বউয়ের গায়ে সেই আঁচ লাগতে দেননি! আবার বউয়ের ব্রেস্টের সমস্যায় রিপিটেড অপারেশন ও করাচ্ছেন। হাসিখুশি ও থাকছেন।
তাকে স্যালুট না নিয়ে উপায় আছে বলেন?
না সে আম্বানি নয়, তার স্ত্রী ও ক্যাটরিনা নয় তবে তারা মানুষ। সত্যিকার ভালোবাসার গল্পের সত্যি মানুষ। আমার দেখা শ্রেষ্ঠ ভালোবাসা উপন্যাসের নায়ক নায়িকা। হে সত্যিকারের হিরো হেরোইন, আমার
অভিবাদন গ্রহন করুন। আপনাদের দেখে আমার ভুল ভেঙেছে। আমি বিশ্বাস করতে শিখেছি, পৃথিবীতে রিয়েল ভালোবাসার অস্তিত্ব আছে।
আজকের রোগীকথন শেষ করবো ফাইব্রএডেনোমা সম্বন্ধে একটু আলোকপাত করে। ফাইব্রএডেনোমা ব্রেস্টের বিনাইন একটি কন্ডিশন। ব্রেস্টের চারটি ডিজিজের মধ্যে এটা সবচেয়ে কমন। শতকরা পাঁচ থেকে দশজন নারীর হয়ে থাকে। বেশি হয় পঁচিশ থেকে ত্রিশ বছর বয়সের মধ্য। এতে পেশেন্টের কোনো ব্যথা বেদনা থাকে না। ফলে সহজে ধরা পড়ে না। যেহেতু বিনাইন কন্ডিশন কাজেই অনেকদিন থাকলেও রোগীদের তেমন ক্ষতিও করে না। এরা সাইজে মার্বেলের মতো হয়ে থাকে। এবং একের অধিক থাকতে পারে।
কখনো কখনো দুই ব্রেস্টেও একসাথে থাকতে পারে। সবচেয়ে ইউনিক ব্যপার হচ্ছে, এরা মোবাইল অর্থাৎ হাত দিয়ে পরীক্ষা করলে দেখা যাবে এদের নড়ানো যায়।
এজন্য এদেরকে ব্রেস্ট মাউস বলে। মাউস মানে ইঁদুর! ইঁদুরের মতো নড়াচড়া করে বলে এই নাম। মজার না! কিভাবে ডায়াগনোসিস করা যায়, চিকিৎসাই বা কি ইত্যাদি এবং অন্যান্য ব্রেস্ট প্রবলেম নিয়ে আলাদা করে একটি পূর্নাঙ্গ রোগীকথন লিখবো। সে পর্যন্ত ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন, সুন্দর থাকুন। ঈদ মোবারক। জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক।
বিঃদ্রঃ- এটা কিন্তু নিছক গল্প নয়। বাস্তব ঘটনা। আমার সম্মানিত পেশেন্ট লিখতে বলেছিলো। লিখেছি। আপনাদের জন্য ঈদ উপহার। কেমন লাগলো জানাবেন।
©
ডা. ছাবিকুন নাহার
এমবিবিএস (ঢাকা), বিসিএস(স্বাস্থ্য
এফসিপিএস (অবস.& গাইনী)
স্পেশাল ট্রেইন্ড ইন ইনফার্টিলিটি
গর্ভবতী, প্রসূতি, স্ত্রী ও গাইনীরোগ বিশেষজ্ঞ এবং সার্জন,
ঢাকা মেডিকেল কলেজ, ঢাকা।
#Lady_in_Red