#এনোনিমাস_পোস্ট
(ছোটগল্প)
রাতে শুয়ে শুয়ে মোবাইলে স্ক্রল করতে গিয়ে হঠাৎ এক্টা এনোনিমাস পোস্টে চোখ আটকে যায় শাহেদের। একজন হাড়ি ভরে গরুর মাংস রেঁধেছে। ক্যাপশনের চেয়েও তরকারীর রং দেখে পোস্টে চোখ আটকায় বলে ক্যাপশনটুকু পড়ে শাহেদ।
‘ খুব লজ্জা লাগছিল অচেনা কারো রেখে যাওয়া গরুর মাংসের প্যাকেটটুকু নিতে। ভেবেছিলাম হয়তো যেন তেন ভাবে সামান্য একটু মাংস দেয়া থাকবে। তার ওপর চেনা পরিচিত কেউ দেখে ফেললে কি লজ্জাতেই না পড়তে হবে। কিন্তু না। প্যাকেটে অন্তত দুই কেজির ওপরে চমৎকারভাবে কাটা হাড় আর মাংস মেশানো ছিল। জানিনা কার কুরবানীর মাংস আমি ভাগে পেয়েছি। শুধু দোয়া করি আমার ঘরে আজ অনেকদিন পর যে মৌ মৌ সুবাসে ভরে উঠেছে, আমার মনে যে আনন্দ হয়েছে, সৃষ্টিকর্তা যেন তার মনের সব সৎ ইচ্ছা পূরণ করেন আর তার জীবন আরো বেশী আনন্দে ভরে দেন।’
পোস্টটা যেন এক লহমায় শাহেদকে ছিঁটকে ফেলে তার দূর অতীতে। দুই ভাই দুই বোন আর বাবা মায়ের পরিবারে শাহেদরা খুব বেশী স্বচ্ছল না থাকলেও অন্তত খেয়ে পরে দিন চলে যেতো ভালোই। পড়ালেখায় মাঝারী মানের হলেও স্কুল কলেজ আর ভার্সিটির পরীক্ষাগুলো উতরে যেতে খুব এক্টা কষ্ট হয়না শাহেদের। কিন্তু চাকুরীর বাজারে এসে ধরা খেয়ে যায় শাহেদ। বাবার রিটায়ারমেন্ট, সংসারের ক্রমবর্ধমান খরচ সামলাতে মায়ের হিমশিম খাওয়া আর নিজের বেকার জীবন সব মিলে শাহেদের তখন মনে হতো এ জীবনে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াও যে ভালো।
নানা জায়গায় ঘুষ দিয়ে লোক ধরেও কোন চাকুরী জোটেনা শাহেদের ভাগ্যে। সেসময় পাশের বাসার পরিচিত একজন স্টুডেন্ট ভিসায় অস্ট্রেলিয়া যাবে শুনে শাহেদের মনে হয় সে একটু চেষ্টা করলে হয়তো চলে যেতেও পারবে। কাগজপত্রের যোগাড়ও হয়ে যায়। কিন্তু বাদ সাধে টাকা। ছেলেকে নিজের সর্বস্ব দিয়ে বিদেশে পাঠাতে শাহেদের বাবার আপত্তি ছিলনা। কিন্তু কেন যেন সাহস করে উঠতে পারছিলনা। ছেলের যদি কোন কারণে যাওয়া না হয় কিংবা গেলেও যদি ঐদেশে সুবিধা করতে না পারে তাই বারবার নিজেদের ভাগের শেষ জমিটুকু বিক্রি করার আগে ভীষণরকম দ্বিধায় ছিলেন তিনি। ‘দেশেও তো কিছু হচ্ছেনা, ছেলে যদি বিদেশে যেয়ে ভালো রোজগার করতে পারে তবে তাদের এই দূর্দিন নিশ্চয়ই আর থাকবেনা’; শাহেদের মায়ের এই কথার ভরসায় শাহেদের বাবা জমি বিক্রির সব টাকা তুলে দেন শাহেদের হাতে।
শাহেদের যেদিন ফ্লাইট ছিল তার আগের দিন ছিল কুরবানীর ঈদ। টাকাপয়সার ভীষণ টানাটানিতে থাকা অবস্থায় সেবার শাহেদরা কুরবানী দিতে পারেনা। আশেপাশের সব বাসায় যখন কুরবানীর গরুর মাংস রান্না হয় আর তার মৌ মৌ গন্ধ শাহেদদের বাসার দরজা গলে নির্লজ্জের মতো ঢুকে পড়ে ঠিক সেসময় শাহেদের মা ছেলের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে, ‘আমাদের এমন দিন একদিন থাকবেনা বাবা। আমরাও একদিন এতো বড় এক্টা গরু একলা কুরবানী দেবো। আমরা কিন্তু ঠিক ঠিক সেদিন খেয়াল রাখবো আমাদের কোন প্রতিবেশী কি কুরবানী দিতে পারেনি এবার। আমার ঘরে মাংস আসার সাথে সাথে তার ঘরেও যেন মাংস যায় সেটা আমরা সবাই খেয়াল রাখবো। মন খারাপ করিস না। সৃষ্টিকর্তা মানুষের রিজিক সবসময় একরকম রাখেননা। তাও তো তুই পেট ভরে খেয়ে প্লেনে উঠতে পারবি সব ঠিক থাকলে। কারো ঘরে হয়তো সেই খাবারটুকুও রান্না হয়নি আজ।’
সিডনী জীবনের প্রথম সপ্তাহের ছুটির দিনে শাহেদ দাওয়াত পায় যাদের সাথে শেয়ারে থাকে তাদের পরিচিত একজনের বাসায়। এতো এতো খাবারের আয়োজন দেখে শাহেদের ভিরমী খাবার দশা হয়। কত টাকা এদের যে খাবারের পেছনে এতো টাকা ঢালতে পারে? সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার যেটা ছিল তা হলো যার বাড়িতে দাওয়াত ছিল তিনি খাওয়া শেষে বের হবার আগে আবার প্যাকেট ধরে কাঁচা মাংস দিয়ে দেয় শাহেদদের ফ্লাটে থাকা প্রত্যেককে। মুখে বলছিলেন, ‘এখানে এতো আত্মীয় প্রতিবেশী কোথায় পাবো যে তার হক আদায় করবো? তোমরাই তো আমার আত্মীয় এখানে।’ কথাটা এতো ভালো লেগেছিল শাহেদের। মনে মনে ঠিক করেছিল সুযোগ হলে একদিন সে ও এমন কিছু করবে।
অস্ট্রেলিয়াতে এসেই শাহেদ ধুমধাম কাজ পেয়ে এতো এতো ডলার কামাই করে দেশে পাঠিয়েছে ব্যাপারটা কিন্তু সেরকম ঘটেনি। পিঠ সোজা করে দাঁড়িয়ে এ দেশে সেটল হতে শাহেদের সময় লেগে যায় কয়েক বছর। এ বছরই প্রথম বাংলাদেশে কুরবানী দেয়ার পাশাপাশি এখানেও কুরবানী দেয় শাহেদ। আত্মীয় আর প্রতিবেশীর অংশটুকু দিয়ে এসেছিল এক্টা গ্রুপের কাছে যারা এই কুরবানী ঈদে যারা কুরবানী দেয়ার সামর্থ্য রাখেনি তাদের হাতে পরিচয় গোপন রেখে পৌঁছে দেবে মাংসের প্যাকেট।
এনোনিমাস পোস্টের মানুষটি কি শাহেদের দেয়া কুরবানীর মাংস পেয়েছে কিনা সেটা জানতে কেন যেন খুব ইচ্ছে হয় শাহেদের। একবার ভাবে সেই গ্রুপের এডমিনকে এক্টা টেক্সট করে। পরমূহুর্তে নিজেকে সামলে নেয়, সে নিজেও তো অজানা কেউই থাকতে চেয়েছে ঐ মানুষগুলোর কাছে। এনোনিমাস পোস্টদাতাও না হয় তার অচেনা হয়েই থাক। তার দেয়া কুরবানীর মাংসে আজ রাতে কেউ কব্জি ঢুকিয়ে ভাত খেয়ে তৃপ্তি পেয়েছে এটাই যে তার সবচেয়ে বড় পাওয়া।
#ডা_জান্নাতুল_ফেরদৌস