গল্প- আনন্দ !
ডাক্তার আমাদের দুজনকে পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে কেন আমরা কোনদিন মা বাবা হতে পারবনা, কেন আমরা শারীরিকভাবে সন্তান নিতে অক্ষম। ডাক্তারের চেম্বার থেকে আসার পর বিছানায় শুয়ে শুয়ে আমি একটা লিস্ট করে ফেল্লাম।
সেদিনের পর থেকে রোহানের মধ্যে কি কি পরিবর্তন আসতে পারে, আমার মা নাহতে পারা নিয়ে কে কি বলতে পারে … মনেমনে তার একটা লিস্ট করে ফেল্লাম। তারপর ডায়রির একটা পৃষ্ঠায় ক্রমিক নাম্বার সহ সেসব সম্ভাব্য পরিবর্তনের লিস্ট লিখে ফেল্লাম।
এইটা আমার একটা গোপন টেকনিক। কি কি ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হলে কিভাবে সেসব মোকাবেলা করতে হবে সেসবের আমি একটা লিস্ট করে রাখি আমার গোপন একটা মোটা ডায়রিতে। এক একটা পরিস্থিতির জন্য তিনটা বা চারটা পর্যন্ত টেকনিক লিখে রাখি।এই পদ্ধতিটা আমি নিজে নিজে এপ্লাই করছি গত আটবছর ধরে। এবং আমি বেশ সফল!
ঘটনার শুরু চৌদ্দবছর আগে। বিয়ের পর পর রোহানের এক আত্মীয়ের বিয়ের রিসেপশনে গিয়েছিলাম সেজেগুজে রোহানের সাথে। তখনো বেশ ঘুরেফিরে,বেড়িয়ে আমাদের হানিমুন পিরিয়ড কাটাচ্ছি দুজন মিলে। আমি আর রোহান দুজনেই এক অফিসে কাজ করি। দুজনে একসাথে মিলেমিশে সংসার, কাজ আর নানান পারিবারিক, সামাজিক আনুষ্ঠানিকতা মেইন্টেইন করছি। গ্রামে যাই প্রতি দু তিন সপ্তাহে একবার করে। শ্বশুরপক্ষের আত্মীয়স্বজনদের কাছে অল্পদিনেই বেশ সুপরিচিত হয়ে উঠলাম আমি। যেকোন পারিবারিক ছোটখাট অনুষ্ঠানে আমাকে আদর করে ডেকে নিত সবাই। তারপর অবাক হয়ে একদিন খেয়াল করলাম একদল মানুষের মিথ্যে মিথ্যে ভালবাসা আমি স্পষ্ট দেখতে পাই। প্রথম প্রথম কষ্ট পেতাম। ক্ষনিক পরে আবার ভাবতাম, শুধু আমিই কষ্ট পাচ্ছি তারাতো না!
তারপর থেকে সবার সবকিছুই আমি উপভোগ করতে শুরু করি।
অনেকটা গন্ধ নেবার মতন। রাস্তায় দাঁড়িয়ে ডিজেলের গন্ধ নেয়া আর ফুলের বাগানে দাঁড়ালে ফুলের গন্ধ নেবার মতন করে আমার জীবন শুরু হয়।
আমি বেশ হাসিখুশি আর উৎফুল্ল থাকতে পছন্দ করতাম সবসময়। পারি নাপারি ছুটোছুটি করে সব কাজে হাত দিতাম। সবার সাথে হৈচৈ করে গলা মিলিয়ে আনন্দ করতাম। তাৎক্ষনিক পরিচিত নতুন কোন মানুষকে গভীর আন্তরিকতার সাথে বন্ধু বানিয়ে ফেলতাম। কেউ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি শুনলে সময় করে ছুঁটে যেতাম দেখার জন্য। রোগীর পাশে বসে, মাথায় হাত বুলিয়ে কয়েক মিনিট শুধু নিচু গলায় কথা বল্লেই মানুষটা সারাজীবনের জন্য আমার ভক্ত হয়ে যেত! শুধু রোগী নয় রোগীর আত্মীয়স্বজনরাও আমার ভক্ত হয়ে যেত আমার এই কয়েকমিনিটের বিনা পরিশ্রমে। একদল নতুন ভক্ত পিছনে রেখে হাসপাতাল থেকে বের হবার সময় নিজেকে বেশ ফুরফুরে লাগত আমার।
এসব কাজ আমি করতাম সম্পূর্ণ নিজের মনের আনন্দের জন্য। আমার হাসতে ভাল লাগত, হৈচৈ করতে ভাল লাগত, তর্ক বা ঝগড়া করে জোরপূর্বক নিজেকে সঠিক প্রমাণ করার চেয়েও কথার পিঠে কথা বলে সত্যমিথ্যা নিয়ে আলোচনা করতে বেশি ভাল লাগত। কেউ রাগ বা তাচ্ছিল্যের সাথে কথা বল্লেও আমার ভীষণ হাসি পেত!
যে আমার উপর অকারণে রাগ করল, বা হিংসা করে তাচ্ছিল্য করল, সে যে আমাকে নিয়ে কি পরিমাণ ভাবছে! আমি ভাবতাম আর মজা নিতাম।
নিজেকে নিজে আনন্দ দেবার ব্যাপারে আমি একটুও ছাড় দিতাম না, একদম না। কারণ আমি জানি একজন মানুষের মনে আনন্দ দেবার মত তাঁর নিজের চেয়ে আপন কেউ নেই। থাকতে পারেনা।
মানুষের মনের কষ্টের কথা, ব্যাথার কথা, বিরহের কথা শুনতে আমার ভাল লাগত। এই কারণটার পিছনেও ছিল আমার নিজের একটা স্বার্থ।
একসময় আমার জীবনে অনেক নাপাওয়ার কষ্ট ছিল। ব্যর্থতার, পেয়ে হারানোর যন্ত্রণা ছিল যা আমাকে দীর্ঘদিন খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে যন্ত্রনাকাতর করে রেখেছিল। আমি সঙ্গত কারণেই আমার নিজের কষ্টগুলো কারো সাথে শেয়ার করতে পারিনি। আমার জীবনে এমন এমন সময়ও এসেছে যখন এই পৃথিবীর মায়া আমাকে আর টানতনা, আমার ইচ্ছে করত নিজেকে শেষ করে দিতে। অসংখ্যবার আত্মহত্যার কথাও ভেবেছি আমি সেই সব কালো দিনগুলোতে।
তারপর একদিন সব কালো দিন আলোতে এল।
এক মধ্যরাতে, সবাই যখন গভীর ঘুমে আমি তখন আত্মহত্যার জন্য একগাদা ঘুমের ট্যাবলেট হাতে নিয়ে স্নানঘরে বসেছিলাম। হঠাৎ আমার কাছে মনেহল স্নানঘরের শীতল মেঝটা আমাকে শীতল শান্তি দিচ্ছে, স্নানঘরের এই নিকষ কালো রাতের আঁধারটাও আমার কাছে অদ্ভুত সুন্দর লাগতে শুরু করছিল হঠাৎ করে! আমি যেন শুনতে পাচ্ছিলাম, গভীর রাতের কালো আঁধার ভেদ করে আসা ঝি ঝি পোকার ডাকগুলো আমাকে বেঁচে থাকার জন্য কাতর স্বরে আহবান করছে! আমার মাথায় একটা বিদ্যুতের ঝংকার খেলে গেল যেন।
হাতের মুঠোয় মৃত্যু নিয়ে আমি জীবনের আলো দেখতে পেলাম। আমি ভাবলাম, আমি যদি আমার জীবনটাকে শেষ করে দিতে পারি তাহলে বাঁচাতেওতো পারি! আমি মুঠো ভর্তি কষ্টগুলোকে শব্দ করেই বলি, “চল তোদের মাঝখান থেকে নিংড়ে নিংড়ে সুখ বের করি “। সেদিন থেকে আমার শুরু হল কষ্ট নিয়ে সুখ সুখ খেলা!
সেদিন থেকে আমি স্বার্থপরের মত শুধু নিজের জন্য ভাবতে শুরু করে দিলাম। আমি আমার উপরে আঘাত করতে আসা কষ্টের পাথরগুলো দিয়ে নিজের জন্য রাস্তা বানাতে শুরু করে দিলাম। সেদিন থেকে আমি ভীষণ সুখি, কারণ আমার জীবনের রাস্তা যে কঠিন পাথর দিয়ে সাজানো আর মসৃণ।
রোহান আমাকে নিয়ে চিন্তিত ছিল। রোহান আমাকে বারবার সাবধান করত, “পৃথিবীটা এত সহজ সরল না, যতটা তুমি মনেকর! এই পৃথিবীতে মানুষের ভিড়ে অমানুষের সংখ্যা লুকিয়ে থাকে। নিজেকে নিরাপদ দূরত্বে রেখে মানুষের কাছে যাবে”। রোহান জানেনা, আমি কতটা স্বার্থপর মানুষ! আমি শুধুমাত্র নিজের আনন্দের জন্যই মানুষকে আনন্দ দিই।
ঘরেবাইরে, আত্মীয় অনাত্মীয়দের মাঝে আমার নাম ছড়িয়ে পরল অল্পদিনেই। আমার আর রোহানের বিয়ে প্রথমদিকে যারা আমার চুলের স্টাইল, জামার ডিজাইন বা লিপিস্টিকের কালার নিয়ে জ্ঞ্যান দিতে আসতো, উনারাও ধীরে ধীরে সেসব ক্ষেত্রে আমাকে ফলো করতে শুরু করে দিলো। এসব নিয়ে রোহান আমাকে মাঝে মাঝে ক্ষেপাত আর বলত, “দেইখো, ফেমাস হলে মানুষের অনেক হেটারসও তৈরি হয় কিন্তু।”
এত সব সুখি গল্পের আড়ালে ভয়াবহ একটা কষ্টের ক্ষত ছিল। ১৩ বছর ধরে মা না হতে পারার কষ্ট। অপমানের কষ্ট। ভয়াবহ মানসিক অপমান।
“So , we should close this window now. Okay! “
দেশের বাইরের নামকরা একটা ফারটিলিটি ক্লিনিকের চেম্বারে বসে আমাদের ফাইলটা বন্ধ করতে করতে ডক্টর যখন বলছিল এই কঠিন কথাগুলো, তখন আমার জায়গায় অন্য কেউ হলে পুরো পৃথিবী জুড়ে শূন্যতা অনুভব করত!
কিন্তু সেই সময়টাতে আমি অনেক ক্লান্ত অনুভব করছিলাম। আমার পুরো শরীর আর মন জুড়ে সত্যিই তখন ভীষণ এক ক্লান্তি গ্রাস করছিল। আর পারছিলাম না নিতে আমি।
“এবার একটু বিশ্রাম দরকার। নিজের জন্য একটু ভাবা দরকার।” আমার মনে হচ্ছিল। নিজেকে নিজে বলছিলাম বিড়বিড় করে।
ডক্টরের কথা শেষ হবার পর পর আমি আর রোহান একে অন্যেরদিকে শূন্য চোখে তাকাচ্ছিলাম। একটা তুলোর মত তুলতুলে বাচ্চা কোলে নেবার আশায় দেশে , বিদেশে দীর্ঘ তেরবছর ধরে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে ফেলেছি দুজন মিলে।দীর্ঘ তেরবছর ধরে, গর্ভধারণের জন্য চিকিৎসাবিজ্ঞানে যত ধরনের উপায় আছে সব কয়টাতেই দুজন মিলে প্রচণ্ড উৎসাহে চেষ্টা করে গিয়েছি। IUI, IVF, ICSI সবকিছুতেই সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছেয় খালি হাতে ফিরতে হয়েছে আমাকে!
হোটেলে ফিরে সেদিন অনেকক্ষণ করে শাওয়ার নিয়েছিলাম। ক্ষত বিক্ষত এই শরীরে মনে সেদিন সতেজটা ছড়িয়ে পড়েছিল আমার। অনেক অনেক দিন পর মনে হয়েছিল আজ আমি মুক্ত। আজ আমি মুক্ত।
সেবারই দেশে ফেরার পর প্রথমবারের মতন রোহান আমার পক্ষ হয়ে সবার সাথে তর্ক করতে শুরু করে। আমার মমতাময়ী শাশুড়ি আমাকে বুকে টেনে নিয়ে বলে, “এমন একজন বুঝদার স্বামী সাতজন্মের ভাগ্য।”
সেদিন উনার কথা শুনে আমার চোখ হাসে, মুখ হাসে তবে আমার মনটা নয়।
রোহান ঠিক করেছে আমরা ওয়ার্ল্ড ট্যুরে যাব। অল্প অল্প করে ঘুরব দুজন মিলে। পৃথিবীতে দেখার অনেক কিছু আছে। ওর মতে মানুষ শুধু শুধু সংসারের মায়ায় পড়ে অনেক কিছুই দেখার সময় পায় না। শাশুড়ি মা স্নেহ ভরা চোখে ছেলের কথায় সম্মত হয়।
আর আমি নীরব চোখে দুজন মিথ্যাবাদীকে দেখে মজা নিই। মানুষ নিজের দুর্বলতা ঢাকার জন্য যতই ভাল হবার ভান করুক না কেন কোথাও না কোথাও হেরে থাকে। ওরা দুজনও এখন আমার কাছে হেরে বসে আছে।
রোহানের দুর্বলতা জানার পরও উনারা দুজনে এখনো সবাইকে আমার নামে মিথ্যে কথা বলে বেড়াচ্ছে।
কারণ কারো কারো মতে আমাদের এই সমাজে একজন পুরুষের সন্মান থাকে তাঁর ক্ষমতাতে। সেটা হোক না শক্তি দেখাবার ক্ষমতা অথবা বাবা হবার।