#অবন্তিকা_তৃপ্তি
শাহরিয়ার সিদ্দিক কাব্য কুহুর চাচাতো ভাই হয়। মহাখালীতে সড়কটা ঢাকার বাইরের দিকে যায়. . সেই সড়কের পাশটায় একটা চারতলা বিল্ডিং আছে। সেই পুরনো, লাল-সাদা বিল্ডিংটায় বসবাস সিদ্দিক পরিবারের তিন ভাইয়ের। বড় ভাই আনোয়ার সিদ্দিকের দুই ছেলে. . . কাব্য এবং স্নিগ্ধ। মেঝো ভাই, সাদাতের এক মেয়ে. . কুহু। ছোট ভাই শাদাফের আছে এক মেয়ে ও এক ছেলে. . মেয়ে মহুয়া, ছেলে মুবিন।
ছেলে-মেয়ে নিয়েই বাড়িটা যেন সিদ্দিক পরিবারের এক টুকরো সুখের রাজ্য। পরিবারের মূল রুজির উৎস বলতে আছে; গাড়ি আমদানির ব্যবসা, পাশাপাশি নিজেদের একটি ছোট রেস্টুরেন্টও আছে. . নাম ‘কুঁড়েঘর রেস্টুরেন্ট।
সেই ছোট পরিবারের এক নাদান;চঞ্চল কিশোরী মেয়ে কুহু আজ থেকে চার বছর আগে হুট করে একদিন তার-ই চাচাতো ভাইয়ের প্রেমে কি করে পরে গেল- তাহা কেউই জানতে পারলো না। এই প্রেম য্যান-ত্যান প্রেম নয়; প্রেমে নাস্তানাবুদ অবস্থা। কুহুর প্রতিটা রাত কাব্য ভাইয়ের চুরি করে আনা ডেনিম জ্যাকেট গায়ে দিয়ে ঘুমায়। নাক-মুখটা শুষে সুবাস নেয় কাব্য ভাইয়ের শরীরের নিজস্ব ঘ্রাণটুকু! ইদানিং কাব্য ভাই এক পারফিউম ব্যবহার করেন সম্ভবত। কুহু ছাদ থেকে যতটা শার্ট চুরি করেছে সবগুলোতে এক ধরনের পারফিউম স্মেল; কিন্তু স্মেলটা দারুণ সৌখিন। একটা ম্যানলি ভাইবস দেয় স্মেলটা। কুহুর তো ভীষণ ভালো লাগে। এতসব কথার মধ্যে আরো একটা গোপন কথা কুহু বলতে চায়. . . তা হলো— কুহু আজকেও ছাদ থেকে কাব্য ভাইয়ের নতুন কিনে আনা শার্ট চুরি করে টুক করে বাসায় এনে ফেলেছে। কাব্য ভাই গতকালই কিনেছে ওইটা; একদিন হয়তো পড়েছেন। কুহু ওটা চুরি করে আলমারির কোনায় লুকিয়েও রেখে দিয়েছে. . কাব্য ভাই সেটা জানেন না।
আজ কুহু বকা-টকা খেয়ে মনটা আজ ভীষণ ক্লান্ত! আজ কলেজ থেকে ফিরেই আলস্য নিয়ে ক্লান্ত-ঘামে ভেজা গা এলিয়ে দিল বিছানায়।শুয়ে হা করে ফ্যানের বসতাস গিলতে শুরু করেছে ততক্ষণে। পাশেই ব্যাগটা ছুড়ে ফেলা হয়েছে; পায়ের জুতো একটা বিছানার পালঙ্গের নিচে. . . আরেকটা সম্ভবত দরজার বাইরে।
কুহুর মামাতো বোন কায়া হোসাইন ঝুমুর। এখানে কুহুদের বাড়িতে এসেছে পড়াশোনার খাতিরে। বড্ড কাজের মেয়ে বলা চলে তাকে। এককথায় দারুণ ট্যালেন্টেড একটা মেয়ে। একদম পরিষ্কার-পরিছন্ন. . কুহু মেয়েটার একদম বিপরীত!
কায়া রান্নাঘরে নিজের জন্যে কফি বানাচ্ছিল। কুহু এসেছে শোনে কফিটা বানিয়ে নিজেদের ঘরে এলো। দরজার পাশে আসলে পায়ে লাগে কুহুর ছুড়ে ফেলা জুতোটা। কায়া বিরক্ত হয়ে তাকালো কুহুর দিকে. . .
— জুতোটা অব্দি জায়গায় রাখতে পারো না তুমি; কুহুপু।’
কুহু চোখ বন্ধ করে হা করে ফ্যানের বাতাস খেতে খেতে জবাব দিল আলস্য নিয়ে. . .
—- খুব টায়ার্ড আমি আজ। সাইডে রেখে দে ওটা।
কায়া কি করবে আর। চুপচাপ জুতো দুটো খুঁজে জায়গায় রাখল। কফি নিয়ে পড়ার টেবিলে বসে চেয়ার ঘুরিয়ে কুহুকে দেখছে। কুহু এখনও শুয়ে রয়েছে দুহাত মেলে। হঠাৎ কায়া বললো;
— আজ কাব্য ভাই নাকি তোমায় বকেছে?
কুহু ঠাস করে চোখ-দুটো টেনে খুলে মাথাটা সামান্য হেলিয়ে কায়ার দিকে তাকালো। কায়ার চোখ-মুখ ভীষণ স্বাভাবিক. . যেন এসব রোজ হয়েই আসছে। কুহুর দু কড়ির মান-সম্মান খুব একটা কদর পায় না কারোর কাছেই। কায়ার ওমন প্রশ্নে কুহু মনটা খারাপ না রেখে হাসার চেষ্টা করে বললো. .
— ওসবকে বকা বলে না। ওসব তার-আমার প্যায়ার! তুই বুঝবি না ওসব। প্রেম কর বুঝে যাবি।
বলেই কুহু আবার দুহাত ছড়িয়ে বিছানায় মাথা ফেলে দিল। কায়া দীর্ঘশ্বাস ফেললো। কি করার আর এই ছাগলকে নিয়ে? দুঃখিত; ছাগল না. . কুহুকে বড়জোর পাগল বলা চলে। কায়া কফিতে চুমুক দিতে দিয়ে বইটা খুলে দেখলো. . সামনে ওর এসএসসি এক্সাম আছে। বিকেলে স্যার আসবেন পড়াতে; তাই আগের পড়া একটু ঝালাই করে নিচ্ছে।
মার্চ মাসের গরম; ফ্যানের বাতাসেও কুলাচ্ছে না আজকাল। বিছানায় শুয়ে প্রায় ঘুমিয়েই গেছিলো কুহু. . . রান্নাঘর থেকে আওয়াজ আসলো;
— কুহু; গোসল করে এদিকে একটু আসো।
রান্নাঘর থেকে ওটা কুহুর আদুরে-নরম হৃদয়ের মা কবিতার আওয়াজ। কবিতা তার একমাত্র মেয়ের প্রতি একপ্রকার অবসেসড একজন মা। কুহুর জন্ম হয়েছিল কবিতা-সাদাতের বিয়ের প্রায় পাঁচ-পাঁচটে বছর পরে। একটা বাচ্চার জন্যে যখন কবিতা দিশেহারা; ঠিক তখন সাদাত ঠিক করেন উনি কবিতাকে নিয়ে হজ্বে যাবেন। আল্লাহর কাছে ভিক্ষা চাইবেন একটা বাচ্চার। কথামত ডাক্তারদের প্রতিদিনের কাড়ি-কাড়ি ঔষুধ থেকে রেহাই দিলেন নিজেদের; চলে গেলেন স্ত্রী সমেত মক্কাতে। আল্লাহর রহমতে সেই বছরেই কুহুর জন্ম হয়েছিল। তারপর আজ বিয়ের হলো. . . আরো ১৭ বছর। আর কোনো সন্তান হয়নি সাদাত-কবিতা দম্পত্তির। একমাত্র মেয়ে; তাও এতটা প্রাথনার পর পেয়েছেন. . . তাই দেখা গেছে কবিতা-সাদাত দুজনেই কুহুকে মাথায় তুলে রেখেছেন। মেয়ে একবার মুখ থেকে যাই বলে. . তাই ওকে দিয়ে দেওয়াই ওদের বৈশিষ্ট। কবিতা মেয়েকে কালেভদ্রে ধমক যেদিন দিয়ে বসেন. . ওইদিন সারারাত কেদে-কেটে পাড় করেন।
কুহুও মা-বাবার প্রতি অদ্ভুত এক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা সবসময় পোষণ করে। সে অবুঝ হলেও মায়ের একেকটা আদেশে সাড়া দেয়ার অভ্যাস তার রক্তে মিশে আছে। জীবনে এতটা আশকারা-লাই পাওয়া সত্বেও কুহু আজ অব্দি এমন কোনো কাজ করেনি যেন ওর বাবা-মায়ের মুখ ছোট হয়নি। শুধু একটা পাপ করেছে জীবনে. . কাব্য ভাইকে ভালোবাসা। জানে না; বাবা জানলে কি রিয়েকশন দিবেন। মা হয়তবা মেনে নিলেও; বাবাকে মানাতে কষ্ট হতেও পারে।
মায়ের আদেশ শিরোধার্য! কুহু উঠে বসে ঘর্মাক্ত গা থেকে ওড়না ছুঁড়ে ফেলে গোসলে গেল। আধা ঘণ্টা পর দরজা হালকা খুলে; ভেজা শরীর লুকিয়ে ডাকলো কায়াকে;
— কায়া; টোনামোনা আমার! আমার ড্রেসটা দে না কষ্ট করে।
কায়া পড়াশোনা করছিলো। কুহুর ডাকে চেয়ার টেনে পেছন ফিরে বিরক্ত হয়েই বললো;
—- তুমি এতবড় হয়েছো; এখনো কাপড় ছাড়াই গোসলে কেন যাও? সবসময় এটাই করো তুমি; কুহুপু।
কুহু ভ্যাবলার ন্যায় হাসল; বললো;
— দে না প্লিজ। রাগ করোস ক্যান?
কায়া বিরক্ত হলেও; কুহুর একমাত্র শুভাকাঙ্ক্ষী হওয়ায় চুপচাপ ড্রয়ার থেকে ড্রেস বের করে দিল। কুহু ড্রেস হাতে নিয়ে উড়ন্ত চুমু ছুড়ে বললো;
— থ্যাংক ইউ!’
কায়া এবার কিছুটা ব্যঙ্গ করেই বললো;
— এই যে এই অভ্যাস তোমার। কাব্য ভাইয়ের সাথে বিয়ে হলে এগুলা করলে তোমাকে কিন্তু দিনে কয়েকবার গোসল করা লাগতে পারে। তখন বের হবে নে মজা।
বলেই হাসতে থাকে কায়া। কুহুর ভ্রু কুচকে আসে; মুখটাতে শাসন এবং রাগ দুটোই একসঙ্গে দেখিয়ে হুতুম প্যাঁচার ন্যায় বললো;
— অসভ্য একটা। ভদ্র কাব্য ভাইয়ের নামে এসব চিন্তা করিস তুই? যা পড়তে বস।
বলে ঠাস করে ড্রেস নিয়ে কায়ার মুখের উপরে দরজাটা বন্ধ করে দিল কুহু। কায়া তখন কুহুর চুপসে যাওয়া; লাল-লাল লাজুক মুখটা ভেবে রাক্ষসের মতো হাসছে। বাথরুমের ভেতর থেকে কুহু হাসি শুনছে; আর রাগে ফুলছে। কতবড় খচ্চর হয়েছে এই কায়া। কতদূর অব্দি চলে গেছে; ছি! লজ্জা-টজ্জা খেয়ে বসে এসব ভাবে ওকে নিয়ে?
ধীরে-সুস্থে সময় লাগিয়ে গোসল শেষে চুলে টাওয়াল প্যাচিয়ে বের হলো কুহু। কায়া তখন বিছানায় বসে ফোন স্ক্রল করছে। কুহু চুল থেকে টাওয়াল খুলতে খুলতে জিজ্ঞেস করলো;
— পড়া শেষ তোর?
কায়া ফোন দেখতে দেখতে অন্যমনস্ক গলায় জবাব দিল;
— হ্যাঁ।
অথচ কুহুর থেকে একধাপ এগিয়ে কায়া তখন মেসেজে প্রেম করছিল। কুহু বেচারি যা করতে পারেনি এতবড় হয়েও; কায়া সেসব করে বসে আছে। কায়ার বয়ফ্রেন্ড আছে একটা. . ভীষণ দুষ্টু আর ভীষন প্রেমিক-প্রেমিক।
কুহু আয়নার দাড়িয়ে জামার পেটের দিকের অংশ দেখতে দেখতে কিছুটা ভাব নিয়ে বললো;
— কায়া আমি কি মোটা হয়েছি আগের থেকে?
কায়া জবাব দিল না; ও তখনো ব্যস্ত। কুহু এভাবেই নিজেকে উল্টেপাল্টে দেখতে দেখতে বললো;
— শুনেছি ছেলেদের একটু সুস্বাস্থ মেয়েদের পছন্দ। আমার কি তাহলে আরো একটু মোটা হওয়া উচিত? অ্যাই কায়া; কথা বলিস না ক্যান?
কায়া নিশ্চুপ; ফোনের দিকে চেয়ে মুচকি মুচকি হাসছে ও। কুহু আয়নার দিকে চেয়ে দেখছে নিজেকে। কবিতা তখন আঁচলে কপাল-গলার ঘাম মুছতে মুছতে বাটি হাতে কুহুর পেছনে এসে দাঁড়ালেন। কুহু আয়নায় নিজের আদুরে মায়ের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলো;
— বাটিতে কি আম্মু?
কবিতা বাটির ঢাকনা খুলে দেখিয়ে বললেন;
— কাব্যের জন্য করলা ভাজি করেছিলাম। দিয়ে আসো না এইটা।
‘কাব্য নামটা শোনামাত্রই কুহুর হৃদয়ে ঢেউ খেলে বরাবরের ন্যায়। কুহু টাওয়াল বিছানায় ছুড়ে ফেলে মায়ের দিকে ফিরে হাসিখুশি মুখে বললো;
— যাবো তো আমি। দাও আমাকে, বাটিটা দাও।
কুহুর আগ্রহ দেখে কবিতার মনটাই ভরে উঠে। কি আগ্রহ কাজ করার মেয়েটার। মায়ের কথা ফেলতেই শিখেনি কখনো। কায়া এইবার ফোনটা রেখে কুহুর পাশে দাঁড়িয়ে টিপ্পনি কেটে শুনিয়ে শুনিয়ে বললো;
— কুহুপুকে অনুরোধ করার দরকার নেই ফুপু, ও এমনিতেও নাচতে নাচতে যাবে।
কুহু চোখ রাঙ্গিয়ে তাকাতেউ কায়া জিহ্বা কেটে বললো;
— অ্যাই মিন; বড়মার আদরের মেয়ে বলে কথা না!
কুহু আড়চোখে তাকায় কায়ার দিকে। কুহু ইচ্ছে করছে. . এই অসভ্য মেয়েটাকে ধরে দিতে একটা। সারাক্ষণ কুহু ও তার কাব্য ভাইয়ের পেছনে হাত ধুয়ে পরে থাকে; অসভ্য একটা।
কবিতা তেমন ভাবেন না ওসব ঘুরিয়ে-প্যাচিয়ে বলা কথা নিয়ে। স্বস্তি নিয়ে কুহুর হাতে কাঁচের বাটিটা তুলে দিয়ে হেসে বললেন;
— মা ভাত বাড়ছি। দ্রুত আসিও।
কুহু বাটি হাতে সুন্দর করে হাসে। কবিতার হৃদয় গলে ওতে; তামাম দুনিয়ার সবচেয়ে সুন্দর হাসিটা বোধহয় তার মেয়েরই।
কুহু ভুলে; অতি উত্তেজনায় ওড়না ফেলেই চলে যাচ্ছিল। অবশ্য কামিজ এটা বেশ ঢিলা; তেমন একটা সমস্যা হবেও না। তবুও চলে পেছন থেকে কবিতা একটা বড় ওড়না এনে কুহুর গায়ে জড়িয়ে দেন।কুহু ফিরে তাকায়; কবিতা বলেন;
— বড় হচ্ছো মা। বড় মেয়েরা ওড়না ছাড়া এভাবে চলাফেরা করে না।
মায়ের কোমল কথায় কুহু মৃদু হাসলো! দু’হাতে বাটি ধরা, তারপরেও মায়ের গালে কয়েকটা টুপটাপ চুমু খেয়ে বলে;
— বেস্ট মম ইন দ্য ওয়ার্ল্ড। যাই এখন?
_______________
নীচতলার ফ্ল্যাটটা আনোয়ার সিদ্দিক ওরফে কুহুর কাব্য ভাইয়ের। কুহু দরজার সামনে দাড়িয়ে কলিং বেল বাজালো। শামিমা এসে দরজা খুলে দিলেন। হয়তবা কাপড় ভাঁজ করছিলেন তাই হাতে অর্ধেক ভাঁজ করা কাপড় ঝুলানো। কুহুকে দেখে উনার চেহারা আনন্দে জ্বলে ওঠে। প্রাণখোলা হাসিতে বলেন;
— আজ কলেজ থেকে এসেই কুহুরানি আমাদের ঘরে? সূর্য কোন দিক থেকে উঠলো রে? ঘুমাসনি আজ?’
কুহু হাতের বাটিটা শামিমার হাতে ঠাস করে ধরিয়ে দিয়ে হনহনিয়ে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে জবাব দিলো;
— করলা ভাজি. . মা দিয়েছে.; কাব্য ভাইয়ের জন্য।
কুহু সোজা ড্রয়িং রুমের সোফায় গিয়ে পা তুলে আরাম করে বসে গেলো। দরজা লাগিয়ে শামিমা ওর কাছে এলে কুহু কিছুটা ভোতা মুখ করেই জিজ্ঞেস করলো;
— আচ্ছা বড়মা, তোমার ছেলে এত তিতা একটা খাবার খায় কিভাবে? এইজন্যেই কি সে হাসে না? মুখটা গোমড়া করে বসে থাকে? লাইক অ্যাংরি বার্ড!
কুহু অভিনয় করে দেখাল কাব্য কেমন করে তাকায়। শামিমা সেই অভিনয় দেখে হেসেই কুটিকুটি। করলার ভাজিটা ডাইনিং টেবিলের ওপর সাজিয়ে রেখে বলতে থাকেন;
— কি জানি, আমাদের ঘরে তো কেউ করলা খায় না। ও ক্যান্টনমেন্টের হোস্টেলে থেকেই মনেহয় শিখেছে এইসব।
কুহু আরাম করে বসলো দু পা ছড়িয়ে। টেবিলের উপর থেকে টিভির রিমোট হাতে নিয়ে টিভি অন করলো। টিভিতে চলছে তার পছন্দের সিরিয়াল— ইরাবতীর চুপকথা! চোখে-মুখে প্রবল মনোযোগ কুহুর, আশপাশ ভুলে টিভি দেখছে। সিরিয়ালে ইরাবতীকে কিডন্যাপ করেছে কিছু গুণ্ডা, আর নায়ক রাস্তায় পাগলের মতো দৌড়ে বেড়াচ্ছে তাকে খুঁজে। থ্রিল আর সাসপেন্সে মোড়া দৃশ্য—কুহু যেন ঠিক ওই মুহূর্তে সিরিয়ালের ভেতর ঢুকে গেছে। একটু পর শামিমাও তার পাশে এসে বসলেন। কুহুর দিকে তাকিয়ে বললেন;
— গতকালের রিপিট টেলিকাস্ট এখন দেখছিস কেন?
কুহু চোখ না সরালো টিভির থেকে। টিভির সাউন্ড-দৃশ্য সব হা করে গিলে খেতে খেতে বললো;
— গতকাল দেখতে পারিনি… প্রেসারে ছিলাম।’
— তোর আবার কিসের প্রেসার? এটুকু মেয়ে একটা।
শামিমা কৌতূহলভরে জিজ্ঞেস করলেন।
এইবার কুহু ধীরে টিভি থেকে চোখ সরালো। আশপাশ সতর্ক চোখে দেখে নিয়ে আবার শামিমার দিকে তাকালো। শামিমার চোখে রয়েছে আগ্রহ। কুহু মুখটা একটু ভার করে বললো;
—- তোমার পোলায় আজ আমারে বকেছে।
—- আজকেও আবার কেন বকলো?
শামিমা চুড়ান্ত অবাক না হলেও; কুহুর কষ্টে কষ্ট না পেলে মেয়েটা আবার কষ্ট পাবে ভেবে দুঃখ দেখানোর চেষ্টা চালালেন।
কুহু সাবধানতার সাথে ফিসফিস করে বললো;
— আম্মুকে বলো না কিন্তু… আমি নকল করতে গিয়ে ধরা পড়ে গিয়েছিলাম। কাব্য ভাইকে তাই আমাদের যে বজ্জাত প্রিন্সিপাল আছে না? ওই ব্যাডা আজ ডাকিয়ে নিয়েছিল।
— কি?
শামিমা চমকে উঠলেন, তাই বোধহয় একেবারে কণ্ঠটা চড়া হয়ে গেলো। কুহু সাথে সাথে একটা আঙুল নিজের ঠোঁটে চেপে বলল;
—- আস্তে বলো! দেয়ালেরও কান আছে।
শামিমা নিজেকে সামলে নিয়ে কপালে ভাঁজ ফেলে বললেন;
— এমন করলে চলবে কুহু? পড়াশোনা না করলে তোকে কে বিয়ে করবে, বল তো?’
কুহু এইবার একটু হাসলো।কাব্যের রুমের দিকে চেয়ে কিছুটা রহস্য করেই বললো;
— কে বলেছে আমি চলে যাব? এই বাড়িতেই তো থাকবো সারাজীবন। এখন যেমন আছি, তেমনি পরেও থাকবো।
কুহু-শামিমার কথার মধ্যে হঠাৎ কাব্যের রুম থেকে কাব্যের গলা শোনা গেল। আলমারি এলোমেলো করতে করতে চিৎকার করে বলছে;
— আম্মু; আম্মু। আমার ব্লু শার্ট কোথায়? পাচ্ছি না; খুঁজে দিয়ে যাও প্লিজ।
শামিমা ভীষণ অবাক হলেন; বললেন
— আজকেও আরেকটা শার্ট হারাল নাকি? রোজ রোজ কাব্যটার শার্ট ছাদ থেকে কই যে উড়ে পরে।
শামিমা উঠে গেলেন কাব্যের রুমে। কুহু হাসে পেছনে পেছনে। কাব্য শামিমা রুমে যাওয়ার আগেই বেরিয়ে এসেছে শুধুমাত্র কোমরের টাওয়াল প্যাচানো অবস্থাতেই। ঘটনা ঠিক তখুনি ঘটলো! কাব্য কুহুজে দেখেওনি। কুহু কিন্তু দেখেছে কাব্যকে; হা করে গিলে গিলে দেখছে। কাব্য শামিমার সঙ্গে আলোচনায় বসেছে; কি করে রোজ রোজ তার শার্ট-জ্যাকেট এস হারিয়ে যাচ্ছে। বাসায় ভাড়াটিয়া থাকে না; তাহলে চুরি করেটা কে? অথচ চোর যে ওদের সামনেই বসে কাব্যকেই দেখছে. . ওসব ওদের জানা নেই।
কুহুর বুক তখন ঢিপঢিপ করছে। হার্ট মনে হচ্ছে খুলে বেরিয়ে আসবে। কুহু বুকের বাম পাশটা চেপে ধরে পেছনে ঘুরে গেল। চোখ বুজে বড়বড় শ্বাস ফেলছে; শান্ত করছে যেমন নিজেকে। কাব্যর চোখ তখন গেল টিভির সামনে পেছন ফিরে বসা কুহুর দিকে। কাব্য শামিমার দিকে চেয়ে বললো;
— ও কখন এলো?
শামিমা জবাবে বললেন;
— মাত্র এলো: তোর মেঝোমা করলা ভাজি পাঠিয়েছে ইয়োর জন্যে. ওটাই নিয়ে এলো।
কাব্য আর দাঁড়াল না; খালি গায়ে কুহুর সামনে ঘুরাফেরা করা উচিত নয়। তাই শার্টের আলোচনা ছেড়ে চুপচাপ আবার ঘরে চলে গেলো। কুহু তখনও সেভাবেই পেছন ফিরে বসে; অস্থির ওর মনটুকু। কাব্য ভাই ওভাবে এলেন; কেড়ে নিলেন কুহুর সমস্ত সত্তার লজ্জা। কুহু ওভাবে কেন তাকিয়ে ছিলো? উচিত ওইটা? না; একদম না। কাব্য ভাই কুহুর ভেতরের অস্থিরতা বাড়াচ্ছেন এভাবেই; ক্রমশ একটু একটু করে. . . যন্ত্রণায় দগ্ধ করে করে।
কাব্য এলো একেবারে বেরিয়েছে রেডি হয়ে। শামিমা ওকে দেখেই অবাক হয়ে বললেন;
— ওমা? রেডি হলি যে? কোথায় যাবি?
কাব্য ডাইনিং টেবিলে বসলো। বললো;
— টিউশন আছে।
— এখন? আজ না বন্ধ?
— তাসনিমের এক্সাম চলছে, যাওয়া লাগবে।
কুহু তখনও ওভাবেই বসে আছে। কাব্য ডাইনিং চেয়ারে বসে গম্ভীর গলায় ডাকল;
— এই যে মহিলা; খেতে আসো।
কুহু এইবার নিজেকে স্বাভাবিক করে পেছনে ফিরে তাকালো। আড়চোখে কাব্যের দিকে একহার তাকিয়েই; লজ্জায় চোখ এলোমেলো ঘুরাতে ঘুরাতে অস্ফুটে বলার চেষ্টা করলো;
— আমি. . বাসায় আম্মু. . ওয়েট . .!
কাব্য অবাক হয়ে বললো;
— তুই তোতলাচ্ছিস কেন? আশ্চর্য!
কুহু এরপর আর কথাই বলতে পারলো না। কাব্য ওসবে গেলোই না আর। কুহুর অনুভূতির ওর মনে কোনো এফেক্ট ফেললো না। নিজের পাশের চেয়ার টেনে দিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে স্রেফ বললো;
— বস, দুপুর বেলা লোকের ঘরে এসে কেউ না খেয়ে যায়না।
কুহু দেখলো; কাব্যের বাম পাশের চেয়ারটা ওকে ডাকছে। কাব্য ভাইও ওকে ডাকছে! গম্ভীর গলায়; কাঠকাঠ কণ্ঠে হোক. . . তবুও তো কুহুকে নিয়ে ভেবেছেন! এটুকুতেই নরম হৃদয়ে প্রেমে তোলপাড় কুহু মনেমনে নাচতে লাগলো।
#চলবে
রেগুলার দিচ্ছি+বড় পর্ব! তাই আশা রাখছি; সবাই রিয়েক্ট-কমেন্টস করবেন। আজকের পর্ব এ আপনাদের রিয়েক্ট-কমেন্টের বন্যা দেখতে চাই।