বিকাল ৩ টা। রুমে বসে চিপস খাচ্ছি । তখনই শুভ্র ভাইয়ার কথা কানে এলো। দৌড়ে দরজার কাছে গিয়ে দরজাটা ভালো করে লাগিয়ে কানে পেতে রইলাম, কি বলে শুনবো বলে। কয়েক সেকেন্ড পর আবারও কানে এলো রাফিয়ার কন্ঠ,
— আরে শুভ্র ভাইয়া। কেমন আছেন? অসুস্থ নাকি? চোখ- মুখ কেমন একটা লাগছে।
— না। ঠিক আছি। রোদ কোথায় রাফিয়া?
— রোদ তো রান্না ঘরে ছিলো। কেনো ভাইয়া?
— কিছু না।
তারপর আবারও নিশ্চুপ। আমি এবার বিছানায় গিয়ে বসলাম। গত তিনদিন ধরে উনার সামনে যাওয়া বন্ধ করেছি আমি। উনি বাসায় এলেই দরজা বন্ধ করে বসে থাকি। মামানি যেতে বললেও কোনোভাবে কাটিয়ে দিই উনাকে। ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জার এমনকি ফোন নাম্বারও ব্লক লিস্টে রেখে দিয়েছি যেনো উনার সম্মুখীন না হতে হয়। কিন্তু এবার তো উনি সরাসরিই খোঁজ করছেন আমার। উনার কথার আওয়াজে ঘোর ভাঙলো আমার। বাইরে থেকে হালকা কথার আওয়াজ ভেসে আসছে। আমি কান পাততেই,
— রোদ তো রান্না ঘরে নেই রাফিয়া। কোথায় ও? প্লিজ বলবা?
— আই থিংক রুমে আছে ভাইয়া। দরজা তো ভেতর থেকে বন্ধ।
রাফিয়ার কথায় উনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন,
— ওহ! ফুপ্পি কোথায়?
— জেঠীমনি তো ছাদে গিয়েছিলো। ওই তো, ওই যে জেঠীমনি।
— আরে শুভ্র! কখন এলি? ভাবির শরীর কেমন রে এখন? চোখ- মুখ এমন লাগছে কেন? জ্বর টর উঠেছে নাকি?
— নাহ ফু্প্পি। জ্বর উঠে নি। আম্মুর শরীরটা তেমন ভালো না। তাই রোদকে নিতে পাঠিয়েছে আম্মু। বাবা বাসায় নেই রাতে মার কাছে কেউ তো থাকা উচিত। আমি তো আর থাকতে পারি না…. তাই..
— তা তো ঠিকই। আমি তোকে বললাম ভাবিকে নিয়ে ক’দিনের জন্য আমাদের বাসায় চলে আয়। তা তো শুনলি না। দাঁড়া রোদকে ডেকে দিচ্ছি আমি।
তারপর শুনা গেল পায়ের শব্দ। কিছুক্ষণ পরই মায়ের গলা ফাঁটা চিৎকার।
— রোদ? রোদ? দরজাটা খোল। শুভ্র তোকে নিতে এসেছে।
— আমি যাবো না মা।
— যাবি না মানে কি? তোর মামানি অসুস্থ আর তুই যাবি না? এটা কোন ধরনের ব্যবহার রোদ?
— মা? এটা খুব ভালো ধরনের ব্যবহার। আমি যাবো না মানে যাবো না। রাফিয়াকে বলো ও চলে যাবে।
আমার কথায় রাফিয়া যেন আস্ত চাঁদ হাতে পেয়ে গেলো। লাফিয়ে উঠে বলে উঠলো,
— হ্যা জেঠীমনি, আমি যেতে পারি। আমার কোনো সমস্যা নেই।
— তুই সমস্যা নেই বললেই হলো? তুই আমার বাসায় মেহমান আর আমি তোকে আমি আমার ভাবির সেবার জন্য পাঠাবো? নিজের দু’ দুটো মেয়ে থাকতে অন্যের মেয়ে পাঠাতে হবে আমায়?রোদ? বের হ বলছি।
— মা? মামুর বাসায় যাওয়ার জন্য অলওয়েজ আমাকেই কেন চোখে পড়ে তোমার? তোমার বড় মেয়েকে পাঠাও৷ সে সর্বদা গোছালো মেয়ে। আরো ভালো সেবা করতে পারবে। আমাকে বিরক্ত করো না।
আমার কথার উত্তরে মাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই শুভ্র ভাইয়া বলে উঠলেন,
— সরি ফুপ্পি। তোমাদের প্রবলেমের মধ্যে ফেলে দিলাম আমি। বাদ দাও…আই উইল টেইক কেয়ার অফ হার। ছেলে থাকতে আর মায়ের কি চিন্তা। আসছি!
উনার কথাটা যেন বুকে গিয়ে লাগলো। সত্যিই কি মামানি অনেক বেশি অসুস্থ? নিজের জেদ ধরে রাখতে গিয়ে কি বেশি বলে ফেললাম আমি? কথাটা ভেবেই বিছানা থেকে ওড়না আর ফোনটা নিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে গেলাম আমি। রাফিয়া আর মা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। আমি তাদের দেখেও না দেখার ভান করে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলাম। শুভ্র ভাইয়া তখন গেইটের কাছেই ছিলেন। আমি উনাকে পাশ কাটিয়ে হাঁটা দিলাম। উনি আমাকে দেখেও কিছু বললেন না। রাস্তা ধরে হাঁটছি। আমি সামনে আর উনি আমার পেছনে। হঠাৎ করে কোথা থেকে সাইম এসে হাজির। আমাকে দেখেই দাঁত কেলিয়ে বলে উঠলো,
— কেমন আছো রোদাপু?
— ভালো, তুমি?
— একদম ফার্স্টক্লাস। মুরগী কিনতে গিয়েছিলাম। বার্বিকিউ বানানো শিখেছি, আজ বানাবো। খাবে রোদাপু?
— আজ নয়। অন্য কোনোদিন।
সাইম হাসলো। আমার পেছনে শুভ্র ভাইয়াকে থেকে একরকম লাফিয়ে উঠলো সে। এলাকার প্রিয় “শুভ্র ভাই” বলে কথা! উনাকে দেখে খুশিতে গদগদ হয়ে বলে উঠলো,
— ভাইয়া কেমন আছো?
— আমি সেকেন্ডক্লাস আছি শালাবাবু।
উনার মুখে “শালাবাবু” শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকালাম । উনি সামিয়া আপুর সাথেও কোনো রিলেশনে আছেন নাকি? কথাটা মনে পড়তেই রাস্তার ইট তুলে এক বাড়িতে মাথা ফাটিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে উনার। আমার পেশীতে পেশীতে যখন রাগ রি রি করছে ঠিক তখন সাইম সবকিছুকে উড়িয়ে দিয়ে বলে উঠলো,
— কোথায় গিয়েছিলে ভাইয়া? আজকে বারবিকিউ করবো….চলো না আমার বাসায়।
— তোর বোনের বাপের বাড়ি গিয়েছিলাম। এখন সোজা বাসায় যেতে হবে। অন্য কোনোদিন তোর বানানো বারবিকিউ খাবো। তোকে নতুন রেসিপিও শিখিয়ে দিবো। এবার বাড়ি যা।
— আচ্ছা ভাইয়া।
কথাটা বলেই মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে চলে গেলো সাইম। আমি একবার উনার দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে আবারও হাঁটা দিলাম। উনি আমার পিছু পিছু হাঁটতে লাগলেন। কয়েক পা এগুতেই বলে উঠলেন,
— ইশ! চারপাশে কি গরম।
আমি দাঁতে দাঁত চেপে উনার দিকে তাকাতেই কেঁশে উঠলেন উনি। জোড়পূর্বক হাসি টেনে নিয়ে বললেন,
— গরম লাগছে তো। তাই বললাম আরকি। অন্যকিছু নয়।
উনার কথায় রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে পনেরো মিনিটের রাস্তা দশ মিনিটে পাড় করলাম। দরজায় কলিংবেল বাজাতেই দরজা খুলে দিলেন মামানি। আমাকে দেখে মিষ্টি হেসে বলে উঠলেন,
— রোদরাণী এসেছে দেখছি। মামানিকে ভুলে গেছিস একদম?
— তোমাকে ভুলা তো ইম্পসিবল মামানি। এখন ঝটপট বলো কি কি খাবে ইফতারে। টাইম অনেক কম।
— ওরে বাবা। পিচ্চিটার কি বড় বড় কথা। বিয়ে দিয়ে দেওয়া যাবে এখনই। (গাল টিপে) কিন্তু আর পাকামো করতে হবে না তোমায়। চুপচাপ বসে থাক। আমি রান্না করছি।
— একদম না। আমি এসেছি যখন আমিই রাঁধবো। নয়তো এখনই চলে যাবো। এই গেলাম কিন্তু…যাবো?
আমার কথায় হেসে উঠলেন মামানি। একহাতে জড়িয়ে ধরে বললেন,
— হয়েছে আর নাটক করতে হবে না। তুই-ই রান্না কর আমি পাশে বসে দেখি। আ…
মামানির কথার মাঝপথেই শুভ্র ভাইয়া ঘরে এলেন। মামানিকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠলেন,
— তোমাকে এখানে বসতে হবে না আম্মু। তুমি এমনি অসুস্থ এই গরমে চুলোর কাছে যাওয়ার মানেই হয় না। যাও রুমে গিয়ে রেস্ট নাও।
— আমি অতো টাও অসুস্থ নই শুভ্র। তুই যা… মা-মেয়েকে কাজ করতে দে।
— আম্মু!( করুণ কন্ঠে) বুঝো না কেন?
কথাটা বলেই মামানিকে টেনে নিয়ে কানে কানে কি সব ফুসুরফুসুর করলেন আল্লাহ মালুম। মামানিও মুচকি হেসে শুভ্রর হাতে একটা চড় বসালেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
— শুভ্র এতো করে যখন বলছে আমি বরং রেস্টই নিই। তুই দেখ কি রান্না করবি।
কথাটা বলে একমুহূর্ত দাঁড়ালেন না মামানি। ধীর পায়ে নিজের রুমে চলে গেলেন। আমি কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থেকেই গেলাম রান্না ঘরে। বিরিয়ানির জন্য পিঁয়াজ – মরিচ কাঁটছি এমন সময় শুভ্র ভাই পাশে এসে দাঁড়ালেন। আমি দেখেও না দেখার ভান করে কাজ চালাতে লাগলাম। উনি কিছুক্ষণ ভদ্র ছেলের মতো দাঁড়িয়ে থেকেই শুরু করলেন উনার ফাজলামো।হালকা কেশে বলে উঠলেন,
— এখনো রেগে আছিস রোদপাখি?
আমি কিছু বললাম না। রাগে শরীর জ্বলে যাচ্ছে আমার। রাগ করার মতো কাজ করে রেগে আছি কি না জিগ্যেস করা হচ্ছে। বাহ্ অসাধারণ! আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে কাছে এসে ঘাড়ে ফু দিতে লাগলেন উনি। উদ্দেশ্য আমাকে বিরক্ত করা। কিন্তু তাতেও কাজ না হওয়ায় আমার পেটে কোমরে চিমটি দিতে লাগলেন উনি। সাথে সাথেই রাগটা চরমে পৌঁছে গেল। উনাকে ধাক্কা দিয়ে ফ্রিজের সাথে দাঁড় করিয়ে হাতের চাকুটা উনার গলার কাছে ধরে বলে উঠলাম,
— কি শুরু করেছিস তুই? হুম? কিছু বলি না বলে যা ইচ্ছে তাই করবেন? চাঁকু দিয়ে গলা কেটে ময়মনসিংহের মার্কেটে ঝুলিয়ে রাখবো। আনিকা তোর জানের জান তো ওর কাছে যা না…আমার কাছে কি হ্যা? আমার কাছে কি? ইচ্ছে তো করছে একদম খুন করে ফেলি। আমা..
এটুকু বলতেই বামহাতে শক্ত করে কোমর জড়িয়ে ধরে ডানহাতে হাতের চাকুটা ছিনিয়ে নিয়ে চেপে ধরলেন আমার গলায়। ফিসফিসিয়ে বলে উঠলেন,
— জানু! তোমার সাহস তো দেখি খুব বেড়ে গেছে। এতো সাহস কোথায় পাও তুমি? (ভ্রু নাচিয়ে) এবার কি হবে সোনা? চাঁকু তো আমার হাতে, মেরে ফেলি? জন্মানোর পর থেকে জ্বালাচ্ছিস আমায়। আগে আমার পিছু পিছু ঘুরে আমায় জ্বালাতি এখন আমাকে পিছু ঘুরিয়ে জ্বালাচ্ছিস।(চাকুটা আরেকটু চেপে ধরে) তুই যে ইচ্ছে করে জ্বালাস আমায় সেটা কিন্তু আমি জানি। তোর কি ধারনা আমি বুঝি না?
ইচ্ছে তো করে চাকু দিয়ে কেটে কুঁচিকুঁচি করে বোয়ামে ভরে রুমে সাজিয়ে রেখে দিই। এটলিস্ট সামনে তো থাকবি। আল্লাহ্ যদি একটা খুন মাফ করতো বিশ্বাস কর আমার হাতে খুন হতি তুই। একদম শেষ করে ফেলতাম তোকে। জীবনে বোঝার চেষ্টা করছিস আমায়? কে না কে একটা ম্যাসেজ দিলো তাতেই পৃথিবী উল্টে ফেলছিস। তোর কি ধারনা আমি জানি না তোর ফোনে কি চলছে? প্রতিদিন একটা না একটা আবেগমাখা ম্যাসেজ আসে তোর কাছে। একমাস ধরে একটা ছেলে একটানা তোর ফোনে দিন- রাত সময় করে ” আই লাভ ইউ ” ম্যাসেজ পাঠায়।
মাঝে মাঝে ফোন দেয়। তুই “হ্যালো” বলিস আর সে কন্ঠ শুনে কেটে দেয়। অন্যকেউ তোর কন্ঠ শোনার জন্য কল দিচ্ছে তা জানার পর আমার জাস্ট তোর এই গলাটায় কেটে ফেলতে ইচ্ছে করে। তবু আমি কিছু বলেছি? বলি নি কারণ তাতে তোর কোনো রেসপন্স ছিলো না। আর যদি তোর রেসপন্স থাকতো তাহলে তোকে সেই কবেই খুন করে ফেলতাম। আমি এতোটা রাগচটা মানুষ হয়ে চুপ থাকতে পারলে তুই কেন পারবি না? একটা ম্যাসেজ দেখেই সামনে আসা বন্ধ করবি কেন?
— ছাড়ুন। লাগছে আমার..
— লাগার জন্যই দিচ্ছি। তোকে আদর করছি না যে তোর ভালো লাগবে। চুপচাপ দাঁড়া নয়তো গলা কেটে আলাদা করে ফেলবো। (কোমরে চাপ দিয়ে) সেদিন কোন সাহসে বেরিয়ে গেলি বাসা থেকে? ওহ ওয়েট…আগে আপনার ভুল ধারনা ভেঙে নিই তারপর সারারাত শাস্তি চলবে আপনার। আপাতত শাস্তি স্টপ।
কথাটা বলে আমাকে ছেড়ে দিয়ে কাউকে ফোন লাগালেন উনি। ফোনটা লাউডে দিয়ে আমার সামনে ধরলেন। আমি একহাতে কোমর আরেক হাতে গলা চেপে ধরে দাঁড়িয়ে আছি। দুই জায়গাতেই ব্যাথা করছে খুব। কিছুক্ষণ পর ওপাশ থেকে সুমিষ্ট কন্ঠে কথা বলে উঠলো একটা মেয়ে,
— হ্যালো?
— তোর হ্যালো মাই ফুট। এতো দেরী হলো কেন ফোন ধরতে অসভ্য মহিলা।
— আরে ইফতার বানাচ্ছিলাম। পুড়ে যাবে তো তাই….
— আমাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে তুই ইফতার পুড়া বাঁচাচ্ছিস? বেয়াদব।
— আরে ব্যস! আমি আবার কি করলাম।
— হারামি! জানিস না কি করছিস? ওই থার্ডক্লাস মার্কা ম্যাসেজ কেন পাঠিয়েছিস আমায়? এখন আমার জীবন নিয়ে টানাটানি। বিয়ের পর জামাইয়ের মাইর খাবি তুই, দেখে নিস।
— ওহ্ শিট৷ রোদ এখনও রেগে আছে নাকি?
— নাহ! তোমার অতো সুন্দর ম্যাসেজ দেখে রোদ রেগে থাকবে না আমাকে এসে আদর করবে। ডাফার!
— আমি কি জানতাম নাকি এতোকিছু হয়ে যাবে। জিসানকে বা আসিফকে এই ম্যাসেজ পাঠাইলে ওরা এটা নিয়া ট্রল করতো। তুই তো ওমন না তাই তোরে পাঠাইছি। আর তাছাড়া তোরে নিয়ে প্রেমময় বাক্য বলা যায়, ফিল আসে।
— চুপ কর বইন। সব ফিল তোর জামাইয়ের জন্য তুলে রাখ। আমি তোর নিজের ভাইয়ের মতো। আমার দিকে ফিল ফিল নজরে তাকিয়ে আমার সুখের সংসার ধ্বংস করে দিস না। রোদ আমার সামনে চাকু হাতে দাঁড়িয়ে আছে। যেকোনো সময় ঢুকিয়ে দিবে পেটে।
— রোদ তোর সামনে বুঝি? আচ্ছা ওকে দে..ব্যাপারটা আমি বিশ্লেষণ করছি।
— বিশ্লেষণ করে ফেল ও শুনছে।
— হ্যালো রোদ?
— জি আপু!
— কেমন আছো আপু?
— জি ভালো, আপনি?
— আমিও ভালো। এই দেখো না, আমার জন্য তোমাদের মধ্যে কি একটা ঝামেলা হয়ে গেল। আমি আসলে এতোকিছু ভেবে দিই নি ম্যাসেজটা। আমাদের ক্যাম্পাসের গ্রুপে ট্রুথ ডেয়ার হচ্ছিল। দুর্ভাগ্যবশত আমি ডেয়ার নিই। আর আমাকে কোনো ছেলেকে রোমান্টিক একটা ম্যাসেজ সেন্ড করতে বলা হয় এবং প্রমাণ হিসেবে তার স্ক্রিনশটও দিতে বলা হয়। আমি পড়ে যায় ফ্যাসাদে, জিসান, আসিফ,আনিকেত ওদের দিলে ওরা এটা নিয়ে ট্রল করতো। আমাকে ইচ্ছে মতো পঁচাইতো কিন্তু সেদিক থেকে শুভ্র সেইভ। শুভ্র কখনোই এমন টাইপ কাজগুলো করে না। তাই আর কিছু না ভেবে ওকেই সেন্ড করে দিলাম। আর তুমি সেই ম্যাসেজটা দেখেই রেগে বোম হয়ে গেলে। শুভ্র সেদিন আমায় কি পরিমান ঝাড়ছে জানো তুমি? প্লিজ আর রাগ করে থেকো না নয়তো শুভ্র আমায় সত্যি সত্যি তোমাদের ব্রক্ষ্মপুত্রে চুবাবে। রোদ শুনছো?
— জি আপু শুনছি।
— গ্রেট! তো ফটাফট তোমার রাগে পানি ঢালো। আর আমার দোস্তটাকে একটু শান্ত করো। ওর মাথাটা গেছে।
— একটা থাপ্পড় মারবো। আমার মাথা গেছে না? ফারদার এমন গদগদ টাইপ ম্যাসেজ পাঠালে তোকে আমি গুণে গুণে ১০০ বার ব্রক্ষ্মপুত্রে চুবাবো বলে দিলাম।
— শিক্ষা হয়ে গেছে রে। জীবনে আর ট্রুথ অর ডেয়ারই খেলতাম না আমি।
— ভালো ডিসিশন এবার যা গিয়ে ইফতার পুড়া।
— ওহ শিট! আমার ইফতার। বাই রে। আর এইযে শুভ্রর পুচকি? তোমার উনি কোনো মেয়ের দিকে তাকায় না বুঝলা? সো তোমার এই ছোট্ট মাথা এতো ঘামিও না তো। কুল বেবি।
— এই তুই যাবি?
— ধমকাস কেন হারামি। যাচ্ছি তো, বাই রোদ।
উনি ফোনটা কেটে আমার দিকে তাকালেন। আমি মাথা নিচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি। চড় টর খাওয়ার জন্য আমি মানুষিকভাবে প্রস্তুত। কিন্তু আমার এতোসব প্রস্তুতিতে জল ঢেলে উনি চুলোর পাশে পা ঝুলিয়ে বসে পড়লেন। আমার গায়ে একটা পেঁয়াজ ছুঁড়ে মেরে বলে উঠলেন,
— কি রে? দাঁড়িয়ে আছিস কেন? রান্না কর। এখন কিছুই করবো না। রোজাদার ব্যক্তি হয়ে ওসব কিছু করা যাবে না। আগে ইফতার শেষ হোক তারপর বুঝবি।
আমি সন্দেহী চোখে উনার দিকে তাকিয়ে আছি। উনার মাথায় কি চলছে তা বুঝার সাময়িক চেষ্টা মাত্র। কিন্তু প্রতিবারের মতো এবারও ব্যর্থ হতে হলো আমায়। আর এই কথাটা বিশ্বাস করে নিতে হলো যে, ” উনাকে বুঝা আমার সাধ্যে নেই ” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পিঁয়াজ কাঁটতে কাঁটতে জিগ্যেস করলাম,
— ফ্রিজে টক দই আছে?
উনি গেইম খেলছিলেন। ফোনের দিকে তাকিয়ে থেকেই বলে উঠলেন,
— কেন খাবি?
— নাহ্ বিরিয়ানিতে লাগবে।
আমার কথায় ছোট্ট করে বললেন “ওহ!” নেমে গিয়ে ফ্রিজ থেকে দুধ বের করে বাটিতে ঢাললেন। আমার হাত থেকে চাকুটা কেড়ে নিয়ে লেবু কেটে লেবুর রস ঢাললেন দুধে। চাকুটা আবারও আমার হাতে ধরিয়ে দিতে দিতে বলে উঠলেন,
— তুই পেঁয়াজ কাটতে কাটতে টক দই হয়ে যাবে।
কথাটা বলে দুধের বোতলটা ফ্রিজে রেখে আমার সামনে মিষ্টির বাটি রাখতে রাখতে বললেন,
— খেতে খেতে কাজ কর। কালো মিষ্টি তো তোর প্রিয়।
আমি অবাক চোখে উনার দিকে তাকালাম। এটা কি সত্যি শুভ্র ভাই তাই বোঝার চেষ্টা। রোজার দিন খেতে বলার মানুষ তো উনি নন। তাহলে?
আমাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলে উঠলেন উনি,
— এভাবে তাকানোর কিছু নেই। আমি জানি তুই রোজা না। তোর সাথে দেখা না হলেও তোর সম্পর্কে সবই জানা আমার। সো ভাব না মেরে খা। রোজা যেহেতু রাখিস নি শুধু শুধু না খেয়ে থাকার তো কোনো মানে হয় না।
— আপনি কি করে জানলেন?(অবাক চোখে)
আমার কথায় বাঁকা হেসে চোখ টিপলেন উনি। উনার হাসি দেখেই গা জ্বলে গেল আমার। বিরবির করে বললাম, ” অসভ্য। ” আমার কথায় পাত্তা না দিয়ে আবারও গেমস্ খেলায় মেতে উঠলেন উনি। বিরিয়ানি রান্নার প্রায় শেষের দিকে হঠাৎই বলে উঠলেন,
— আচ্ছা? ঈদের শপিং করবি না?
— না।
— না মানে? না কেন?
— বাসা থেকেই বের হবো না তো ঈদের জামা দিয়ে কি করবো? ঈদের জামা পড়ে কি কম্বলের নিচে শুয়ে থাকবো?
— তাই বলে কিছুই কিনবি না? এটা কিছু হলো? শুন এবার জামা না কিনে শাড়ি কিনবি। একদম কালো জামদানী। তারসাথে পড়বি ছোট্ট কালো টিপ। চোখে গাঢ় করে কাজল। ঠোঁটে হালকা গোলাপী লিপস্টিক। আর চুলগুলো খোলে দিয়ে হয়ে যাবি মায়াবতী। আমি সেদিন তোর খোঁপায় দশটা কালো গোলাপ গুঁজে দিবো।
আমি ঘাড় ঘুরিয়ে উনার দিকে তাকালাম। তারপর বললাম,
— দরকার নেই। আমার মায়াবতী রূপবতী কোনোকিছু হওয়ারই শখ নেই। আপনার এতো মায়াবতী দেখতে ইচ্ছে করলে আপনার বউকে গিয়ে বলুন যান।
আমার কথায় হেসে উঠলেন উনি। মাথায় চাটি মেরে বলে উঠলেন,
— এজন্যই তো তোকে বললাম গাধী।
আমি কিছুক্ষণ চুপচাপ উনাকে দেখে গেলাম । তারপর বিরিয়ানি নামাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। আসলে ব্যস্ততার মাঝে একরাশ লজ্জা লুকানোর ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা চালাচ্ছিলাম। ব্যস্ততার আড়ালে লজ্জা লুকানোর কি অপরিসীম ব্যস্ততা আমার!
রোদ শুভ্রর প্রেমকথন সম্পূর্ণ গল্পের লিংক
https://kobitor.com/rodsuvro/
#রোদবালিকা